![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তৃতীয় ধরণের পাগল হল সেয়ানা পাগল। এটা সবচেয়ে কঠিন ধরণের পাগলামি। এই পাগল কি সুস্থ না অসুস্থ সেটা বোঝা খুব কঠিন। যখন সে পাগলামি করছে তখন তার কাজকারবার হবে সুস্থ মানুষের মতো। জটিল সব যুক্তি দিয়ে সে তার পাগলামি প্রতিষ্ঠিত করবে। আবার যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তার চিন্তা ভাবনা হবে পাগলের মতো। অফিসে এবং বাসায় নিয়মিত ভাবে আমি এই পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ভালোই লাগে। শুধু মাঝে মধ্যে আমার মাথার মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়ে। তখন খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে জানি না। আপনারা কেউ কি জানেন?
খক...খক...খক...
“আহ! অসহ্য কাশি!”
সায়েম এতক্ষণ মাথা গুঁজে প্রচণ্ড একাগ্রতা নিয়ে একটা রিপোর্ট লিখছিল, কাশিটা কিছুক্ষণ পরপর তাকে বিরক্ত করে মারছে। আজ সে একটু সকাল সকাল অফিসে এসেছে। সকালেই ইনভেন্টরি আপডেট সামারি রিপোর্টটা হাসিব স্যারের কাছে দেয়ার কথা। গতকাল কাজ শেষ হয়নি। আজকে আবার মহা ঝামেলা, শোয়েব ভাই আসবেন না। তার ছেলের মুসলমানি। শোয়েব ভাই থাকলে এতো টেনশন নেয়া লাগতো না।
অনেক ক্ষণ ধরে একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। টেনশনের সময় সিগারেটে খাবার মজাই আলাদা। কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে আড় চোখে একবার রিষ্ট ওয়াচটার দিকে একবার তাকাল সায়েম। নাহ! উপায় নেই। হাতে সময় খুব কম।
অফিসের শেষ প্রান্তের এই কিউবিকলটায় সায়েম, মৃধা, শোয়েব ভাই আর জেসি আপা বসেন। মৃধা আর জেসি আপা এখনো আসেন নি। কারন নয়টা বাজতে এখনো অনেক দেরী। মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। যদিও হাসিব স্যার অফিসে চলে এসেছেন। সকালে লিফটে করে উপরে ওঠার সময় দেখা হয়ে গেল।
ওকে দেখে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ কি ব্যাপার সায়েম? এতো সকালে? বউ পিটিয়েছে নাকি?”
সায়েম হাসিব স্যারের কথা শুনে হ্যা হ্যা করে হেসে ফেলেছিল প্রায়। কর্পোরেট অফিসে এভাবে হাসলে দাম থাকে না। আবার হাসির কথায় না হাসলেও চলে না, সবাই ছাগল ভাবতে পারে। সায়েম কোন রকমে হাসি সামলে মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “আর বলবেন না স্যার! আজকাল ভালোবাসা মনে করে বউয়ের দু’একটা কিল-ঘুষি খেয়ে ফেলি। এসব ব্যাপারে মাইন্ড করলে সাইন করা যায় না স্যার।”
সায়েমের কথা শুনে হাসিব স্যার হা হা করে হাসলেন। একদম মাপা হাসি। মার্কস দেয়ার সিস্টেম থাকলে এই হাসি পাবে দশে দশ। পারফেক্ট!
অবশ্য হাসিব স্যার সব কিছুতেই পারফেক্ট। এই লোক পারেও! বয়স কত হবে? থার্টি সেভেন, থার্টি এইট? অথচ এই বয়সেই এজিএম, চিন্তা করা যায়? যমের মতো খাটতে পারেন। আর কিচ্ছু ভোলে না। পাঁচ বছর আগের কোন একটা তথ্য এমন ভাবে বলবে যে শুনে হাঁ হয়ে যেতে হয়। ভোরে অফিসে আসে, বের হয় সবার শেষে। তবে কখনোই ফালতু কাজে অফিসে বসে থাকেন না আর কেউকে খামাখা বসিয়েও রাখেন না। অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হাসিব স্যারকে সবাই পছন্দ করে, ভালোবাসে; ভয় পায় আবার শ্রদ্ধাও করে।
ক্রিং...ক্রিং...
ক্রিং...ক্রিং...
খানিকটা আতঙ্ক আর হতাশা নিয়ে ফোনের দিকে একদৃষ্টিতে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল। ধুর! নিশ্চিত হাসিব স্যার। রিপোর্টটা এখনো শেষ হয়নি। কি করা যায়? ইতস্তত ভাবেই ফোনটা ধরল সায়েম,
“হ্যালো? ... জি স্যার! ... এই তো আর দশ মিনিট স্যার ... ওকে স্যার ... ও কে স্যা র ...”
কথা শেষ করে ফোনটা রেখে সায়েম তৃপ্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। মিটিং শুরু হতে দেরী হবে। হাসিব স্যার ইনভেন্টরির রিপোর্টের সাথে সাথে আরেকটা রিপোর্ট রেডি করে দিতে বললেন দুপুরের মধ্যে। কাজ একটু বাড়ল। কিন্তু তাতে কি? এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কেউ যেন ওর মাথায় একটা দোনলা বন্দুক ধরে রেখেছে। আপাতত বন্দুকের নলের হাত থেকে তো বাঁচা গেল!
মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেয়ে সায়েম আয়েশ করে চেয়ারে একটু হেলান দিল। আরেকটু ঘুমাতে পারলে ভাল হতো। টেনশনে পড়ে অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। তাড়াহুড়ায় নাস্তাই করতে পারেনি। সময় যখন পাওয়া গেছে তখন নাস্তা করে আসা যাক। নাস্তা করে একটা সিগারেট আর চা খেতে খেতে অফিসের সবাই চলে আসবে। ইদানিং এই একটা সমস্যা হয়েছে তার কিছুই খেতে ইচ্ছা করে না। মুখের এই অরুচির কারণে আজকাল কিছুই সে স্বাদ নিয়ে খেতে পারে না। আজ হঠাৎ করেই তার নাস্তা করতে ইচ্ছা করছে।
আড়মোড়া ভেঙ্গে বিরাট এক হাই তুলতে গিয়ে বিরক্তিকর কাশিটা আবার ফেরত এলো।
এবারে কাশতে কাশতে তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। বুকের ভেতর থেকে কেমন যেন মেঘের গর্জনের মতো গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে। কফ ফেলার জন্য কোন রকমে ওয়াস রুমের দিকে দৌড়াল সে। ধবধবে সাদা বেসিনে থু দিয়ে কফ টুকু ফেলেই জমে গেল সায়েম।
একি! কফের সাথে এটা কি রক্ত নাকি? সর্বনাশ!
ভাগ্য ভাল অফিসে কেউ নেই। একদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাপারটা ভালো করে দেখার জন্য বেসিনে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালো সে।
হ্যাঁ! রক্তই তো! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
মাথা তুলে আয়নায় নিজের হতভম্ব চেহারাটা একবার দেখল সায়েম। বিদ্যুৎ গতিতে ওর মাথায় অনেকগুলো চিন্তা খেলে গেল। ক’দিন আগে সর্দি থেকে এই কাশির উপদ্রব শুরু হয়েছে। একটা ব্যাপার সে খেয়াল করেছে, ঠাণ্ডা লেগে তার সর্দি হলে, সর্দি ঠিকই একসময় সেরে যায়, কিন্তু কাশিটা রয়ে যায়। কাশিটা যাচ্ছেই না। কদিনের জন্য কমে, আবার কিছুদিন পর ফেরত আসে। ইদানিং রাতে জ্বর জ্বর লাগে।– কথাটা ভাবেই সায়েম আনমনে একটু চমকে উঠলো।
যক্ষ্মা-টক্ষা কিছু হয়ে যায়নি তো আবার? নাকি শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারই হয়ে গেল?
মাথায় প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে সে সিটে ফিরে এলো। ভয়ে বুকটা ধবক ধবক করছে। ইদানিং শ্বাস নিতেও যেন সমস্যা হচ্ছে। বাসায় ফিরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে যে তার দম ফুরিয়ে যায় বিষয়টা সে আগেও খেয়াল করেছে। কিন্তু পাত্তা দেয়নি।
শারীরিক কারণ ছাড়াও বউয়ের প্রেশারে সে গত পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করছে সিগারেট ছেড়ে দেয়ার। কিন্তু এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি ব্যর্থ। শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সায়েম নিজস্ব কিছু যুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
প্রথমত সারাদিনে সে হাতে গুনে মাত্র পাঁচ ছয়টা সিগারেট খায়। ঢাকায় যে বায়ুদূষণ সেটা পাঁচ ছয়টা নিরীহ সিগারেটের কাছে কিছুই না।
দ্বিতীয়ত সে অনেক বৃদ্ধকে দেখেছে মনের সুখে বিড়ি খেতে। বিড়ি খেয়ে সেই লোক যদি বৃদ্ধ বয়সে পৌছাতে পারে তাহলে মাত্র পাঁচ ছয়টা সিগারেটে তার সমস্যা হবার কথা না। তাছাড়া হায়াত মউতের মালিক আল্লাহ।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে দুর্বল যুক্তি হল, এখন সিগারেট খেতে ভালো লাগছে, তাই খাচ্ছি। যখন ভাল লাগবে না - খাব না।
নাহ! কাজটা ঠিক হয় নাই। ইমিডিয়েটলি একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। আচ্ছা, রেজাকে একটা ফোন দিলে কেমন হয়? একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সে। নয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট। এই সময় ওকে পাওয়া যাবে না। রাতে হসপিটালে ডিউটি থাকলে এতো সকালে ওকে পাওয়া সম্ভব না। তাহলে?
কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সে গুগলে “যক্ষ্মা” লিখে একটা সার্চ দিল। না দিলেই ভাল ছিল। কারন ফুসফুসের যক্ষার প্রধান উপসর্গগুলো পড়ে তার দমবন্ধ হয়ে গেল। সব একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে!
ফুসফুসে যক্ষ্মার প্রধান উপসর্গগুলো হলো-
১) “তিন সপ্তাহের বেশি কাশি”- সায়েমের মনে হল তার কাশির বয়স বোধহয় তিন মাসের বেশী হয়ে গেছে। ভয়াবহ ব্যাপার।
২) “জ্বর” - গত রাতেও তো তার কেমন যেন জ্বর জ্বর লাগছিল।
৩) “কাশির সাথে কফ এবং মাঝে মাঝে রক্ত বের হওয়া”- লেখাটা পড়ে ওর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। তবে সায়েম নিজেকে সান্ত্বনা দিলো এই ভেবে যে আজকে তো মাত্র প্রথম বার। এমন তো হতে পারে সবারই কফের সাথে এরকম এক আধটু রক্ত যায়।
৪) “ওজন কমে যাওয়া” ও “বুকে ব্যথা, দুর্বলতা ও ক্ষুধামন্দা” – সায়েমের ওজন কমেনি। কিন্তু বুকে কি ব্যাথা আছে কি? ব্যাপারটা চেক করার জন্য সে জোরে একটা শ্বাস নিল।
আবারো...
খক...খক...খক...
“আহ! কি যন্ত্রণা!”
“কি হয়েছে সায়েম ভাই?” পেছন থেকে জেসি আপা জিজ্ঞেস করল।
“আরে না। তেমন কিছু না। এই একটু সর্দি কাশি।” সায়েম উত্তর দেয়। “মৃধা কোথায়? অফিসের গাড়িতে আসেননি?”
“হ্যাঁ। আসলাম তো একসাথেই। পাঞ্চ করেই নিচে গেল সিগারেট খেতে। আমাকে দিয়ে খবর পাঠালো যেন আপনাকে নিচে পাঠিয়ে দেই। যান ছাই পাঁশ খেয়ে আসেন। কেন যে আপনারা এই জিনিষ খান আল্লাহ্ই জানেন।”
জেসি আপার কথাগুলো সায়েমের বুকে শেলের মতো বিঁধল। তারপরও মুখে একটু হাসি টেনে সায়েম নিচে নেমে এলো। মৃধা অফিসের নিচেই চায়ের দোকানে একাউন্টসের মিহির ভাইয়ের সাথে হাত পা নেড়ে কথা বলছিল। মৃধা বয়েসে ওর চাইতে দু’এক বছর ছোট হবে। খুব চটপটে, হাসিখুশি আর বুদ্ধিমান ছেলে। সায়েমকে দেখে ওর চেহারায় একটা উৎকণ্ঠা ফুটে উঠলো,
“সায়েম ভাই, আপনার কি শরীর খারাপ নাকি? কেমন যেন দেখাচ্ছে।”
“আরে নাহ।” কথাটা বলে সায়েম আড় চোখে একবার মিহিরের দিকে তাকাল। মৃধা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, “আচ্চা মিহির ভাই। আপনি উপরে যান। আমি আসছি।”
মিহির চলে যাওয়ার পর মৃধা হাঁক দিল, “ অ্যাই জসিম, এক কাপ চা আর একটা বেনসন দে।”
সায়েম প্রবল বেগে হাত নেড়ে জানালো যে সে চা সিগারেট কিছুই খাবে না। সায়েমের হাত নাড়া দেখে মৃধার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। সন্দিহান গলায় সে জিজ্ঞেস করলো, “সায়েম ভাই, ভাবির সাথে কি আবারো ঝগড়া হয়েছে নাকি?”
“আরে নারে ভাই। এমনিতেই মন মেজাজ ভাল না। তারমধ্যে তুমি শুরু করলে ফাজলামি।”
“কি হয়েছে সেটা বলবেন তো আগে! নাকি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই সাত সকালে আপনার আবার কি হল?”
সায়েম একটু ইতস্তত করতে লাগলো দেখে মৃধা বলল, “আচ্ছা বাদ দেন। বলতে না চাইলে থাক।“
মৃধার পিড়াপিড়িতে আর না থাকতে পেরে সায়েম আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে... তোমার কি কখনো কফের সাথে রক্ত-টক্ত এসেছে নাকি?”
“রক্ত? না তো। কেন? আপনার কি কফের সাথে রক্ত আসছে নাকি?”
সায়েম একটু আহত গলায় বলল, “হ্যাঁ”।
মৃধা দিনে কম করে হলেও এক প্যাকেট সিগারেট খায়। সায়েম আশা করেছিল মৃধারও একই সমস্যা থাকবে। সমস্যা তাহলে আসলেই ভয়াবহ।
মৃধা কি যেন একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলো, “রক্ত আসছে কবে থেকে?”
“এইতো আজকে সকালে।”
“আগে কখনো হয় নি? নাকি আজই প্রথম?”
“নাহ! আজই প্রথম।”
“রক্ত কি কম না বেশী?”
“বেশী না। ভাল করে না দেখলে বোঝাই যায় না।“
মৃধা এতক্ষণে চেহারা থেকে উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে বলল,
“তাহলে তো আপনার কিছুই হয়নি। কফের সাথে রক্ত যাওয়াটা খুবই চিন্তার বিষয়। কিন্তু এটা হতে পারে। আমার এক কাজিনের কথাই বলি।” ও একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করে, “ আপনি কি চা-সিগারেট খাবেনই না? লাইটস খান। গলায় কি ব্যাথা আছে?”
“না। গলায় ব্যাথা নাই।”
“ও! তাহলে লাইটসই খান।” ও পেছন ঘুরে আবার হাঁক দিল, “মামা, একটা চা আর দুইটা বেনসন দাও। একটা লাইটস।”
মৃধা ঘুরে আবার গল্প শুরু করলো, “আপনি তো বোধহয় আমার ওই কাজিন কে চেনেন। আকরাম নাম। লম্বা চওড়া, স্বাস্থ্য ভাল। গায়ের রঙ ফর্সা। অফিসে মাঝে মাঝেই আসে।”
“আরে, তোমার তো কত লোকই অফিসে আসে। সবার কথা কি অতো মনে রাখা যায় নাকি? কি হয়েছে সেটা সংক্ষেপে বল। কাজ আছে।”
“আচ্ছা আচ্ছা সংক্ষেপেই বলছি। নেন, চা-টা নেন।”
সায়েমকে চা আর সিগারেট দিয়ে, নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃধা শুরু করল, “ ওই আকরামের একদিন এই অবস্থা। কফের সাথে রক্ত। বেচারা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বাসার কাছে একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাবার পর ওখানকার ডাক্তার নাকি ওকে বলেছে কাশি হলে নাকি এরকম হতে পারে। খুব জোরে কাশি আসলে নাকি ভেইন টেইন ছিঁড়ে হালকা রক্ত বের হতে পারে। এতে নাকি ভয় পাবার কিছু নেই। তারপরও অনেক টেস্ট ফেস্ট করা হল। কিন্তু কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। সব নেগেটিভ।”
“আমারও তাহলে একই কেস হয়েছে বলতে চাইছো?”
“আমি ১০০% শিওর। তারপরও সাবধানের মার নেই। ভালো একটা ডাক্তার দেখান। নিশ্চিত হয়ে নেন।”
কথাগুলো শুনে সায়েমের বুক থেকে একটা বিশাল পাথর যেন নেমে গেল। সিগারেটটা খেয়ে নিচে আর দেরী করলো না। অনেক কাজ। দুপুরের মধ্যে দু’টা রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সাড়ে নয়টা বেজে গেছে এরই মধ্যে।
ফ্লোরে ফিরে এসে সায়েম সকালের ঘটনা বেমালুম ভুলে গেল। কাজ নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। এগারোটার দিকে, ফারজানার ফোনে তার ধ্যান ভাঙল। ফারজানা ফোন করেই কলকল করে কথা বলা শুরু করলো,
“আজকে এতো সকালে অফিসে গেলে। এতো করে বললাম, নাস্তা রেডি আছে, নাস্তা করে যাও। শুনলে না। নাস্তা করেছ?”
সায়েম অন্যমনস্ক স্বরে বলল, “না।”
“কি? এগারোটা বাজে এখনো নাস্তা করনি? সারারাত যে তোমার গায়ে জ্বর ছিল সেটা কি তুমি জানো?”
“নাহ।”
“আজ যে বর্ষাদের বাসায় যাওয়ার কথা সেটা মনে আছে?”
“কার বাসায়?”
“বর্ষা। আমার বান্ধবী। আগস্টে যার মেয়ে হল। আজকে ওর মেয়েকে দেখতে যাবার কথা।“
“ও...তাই নাকি?”
“অ্যাই! কি হয়েছে তোমার?”
“অ্যাঁ?...নাহ কিছু হয়নি তো! আচ্ছা এখন একটু রাখি, পরে আবার ফোন করছি।”
সায়েম এতক্ষণ কাজের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে ছিল। ফারজানার কথা প্রথমে সে কিছুই কানে ঢোকায়নি। ওর বান্ধবীর বাসায় দাওয়াতের কথা তার আসলেই মনে ছিল না। কিন্তু সেটা ওর কাছে স্বীকার করা আর খাল কেটে কুমির আনা একই কথা। অন্যমনস্ক ভাবে ভুল উত্তর দিয়ে খাল অলরেডি কাটা হয়ে গেছে। এখন কুমিরের জন্য অপেক্ষা। সেই কুমির আসবে রাতের বেলা। ধুর!
নিজের বোকামিতে বিরক্ত হয়ে সায়েম মোবাইলটা হাতে নিয়ে, কি মনে করে রেজাকে একটা ফোন করলো। দ্বিতীয়বার ফোন বাজার পর ওপাশ থেকে রেজার ঘুম জড়ানো কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যাঁ, সায়েম বল।”
“বন্ধু, আমি তো একটা সমস্যায় পড়ে গেছি।”
“কি হয়েছে? ... দাঁড়ায় না? হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ।”
“আরে ধুর! আচ্ছা একটু ধর।” বলে সায়েম কিউবিকল থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে লবিতে চলে এলো।
“শোন। আজকে শালা কাশতে কাশতে কফের সাথে রক্ত চলে এসেছিল। কি ব্যাপার বল তো?”
“রক্ত কি বেশী না কম।” রেজা প্রফেশনাল গলায় জেরা করা শুরু করল।
“এই...তো... কমই তো লাগলো।”
“আগেও হয়েছে এমন?”
“আরে নাহ। আজকেই প্রথম।”
“প্রস্রাব পায়খানায় কখনো রক্ত এসেছিল?”
“না।”
“তোর কি প্রেশার আছে?”
“জানি না। প্রেশার তো মাপাইনি কোনদিন।”
“আচ্ছা। তাহলে প্রেশারটা মেপে নিস। ২ টা ঔষধ দিচ্ছি। ওটা খা আর একটা টেস্ট করে রিপোর্টটা আমাকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যা।”
“দোস্ত, যক্ষ্মা টক্ষা হয়ে গেল নাকি?”
রেজা বিকট শব্দে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, “মনে হয় না। আবার হতেও পারে। টেস্ট করলে জানা যাবে। এখন ফোন রাখ। ঘুমাবো।”
ফোনটা কেটে দিয়ে সে আবার তার সিটে ফিরে এলো। মনে মনে ভাবল - নাহ! সিগারেটটা আসলেই ছেড়ে দিতে হবে।
অফিসের বাকিটা সময় সায়েমের খুব ব্যস্ততায় কেটে যায়। রিপোর্ট, মিটিং ইত্যাদি নানান ঝামেলায় দুপুর গড়িয়ে যায়। লাঞ্চের পর জসিমের দোকানে চা আর সিগারেট খেতে খেতে মৃধা, টুটুল, ফারুক, আহমেদের সাথে অফিসের নানান বিষয় নিয়ে আলাপ হয়। হাসিব স্যার যে আজ তার রিপোর্টের খুব প্রশংসা করেছেন সেটা ওদের মুখ থেকে শুনতে তার বড় ভালো লাগে। ক্যারিয়ারের উন্নতি হচ্ছে, এর চাইতে খুশীর খবর আর কি হতে পারে? খুশীর তোড়ে ঘাড়ে-বুকে ব্যাথা, নির্ঘুম রাতের কষ্ট, হঠাৎ হঠাৎ জ্বর, এমনকি আজ সকালের “সিগারেট না খাবার” প্রতিজ্ঞাটাও রোজকার মতো কোথায় যেন ভেসে উড়ে যায়।
বাসায় ফিরে সায়েম ফারজানাকে অবাক করে দিয়ে ছেলে মাহিনকে সহ বর্ষাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসে। রাতে বর্ষাদের বাসাতেই বিশাল খাওয়া দাওয়া হল। বর্ষার মেয়ের আকিকা ছিল আজ। ফারজানা সম্ভবত বলেছিল, ওর খেয়াল নেই। খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না, তাই কি মনে করে ও একটা গিফট কিনে এনেছিল। কাজে লেগে গেল।
বর্ষাদের বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বাসায় ফিরে ঝপাঝপ ঠাণ্ডা পানি ঢেলে সে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ফারজানা ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। সায়েম এই ফাঁকে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে। এমন খাওয়া দাওয়ার পর একটা সিগারেট না খেলে খাওয়া ঠিক মতো হজম হয়না বলে মনে হয় তার। যদিও ঘুমে তার দু’চোখ ভেঙ্গে আসছে। বুকে কফ জমে থাকায় সিগারেটটা টানতে তার কিঞ্চিৎ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সিগারেটটার মধ্যেও কি যেন একটা অদ্ভুত নেশা আছে, ফেলে দেয়া যায় না।
ঘুম ঘুম চোখে বিছানায় এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে সায়েম। অনেক যন্ত্রণা গেছে আজ।
==========================
গভীর রাতে সায়েমের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গার পর সে শোয়া থেকে বিছানায় সটান হয়ে উঠে বসলো। কোথায় যেন কি একটা সমস্যা হচ্ছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ডীম লাইটের আবছা আলোতে মশারির ভেতর সব কিছু অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। ওর পাশেই ফারজানা তার ছেলে মাহিনকে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আহারে! ওদের কি শীত লাগছে?
মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথায় সায়েম আবার শুয়ে পড়লো। আহ! কি ব্যাথা! মাথাটায় কেমন যেন করছে। সায়েম মনে মনে একবার ভাবল - ফারজানাকে একটু ডাকি। ও হয়তো বুকে হাত বুলিয়ে দিলে একটু ভালো লাগতো। এখন শ্বাস নিতেও অনেক কষ্ট লাগেছে। বুকটা সীসার মতো ভারী হয়ে আছে। সব কিছু এমন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে কেন?
অবাক হয়ে সায়েম ভাবল, আমি কি তাহলে মারা যাচ্ছি?
নাহ! সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয়া দরকার ছিল..
০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৩৮
নাভিদ কায়সার রায়ান বলেছেন: ধন্যবাদ!
২| ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৭:২৫
মামুন রশিদ বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন । গল্প ভাল লেগেছে ।
০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৭:৫০
নাভিদ কায়সার রায়ান বলেছেন: ধন্যবাদ মামুন ভাই! গল্পটা লেখার পর আমার স্মোকার বন্ধুরা আমার উপর খুব খেপে আছে। ইন্ডিভিজুয়ালি সবার ধারণা আমি ওদের ভয় দেখানোর জন্যই এটা লিখেছি। কারণ, সায়েমের অবস্থা আর জীবন যাত্রার সাথে নাকি অনেকের মিলে গেছে।
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:৪৭
ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
চমৎকার লিখসেন !