নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\"দুইশো চার\"

নাভিদ ফারাবী

বাংলা ভাষার অক্ষরগুলোকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ফিরেয়ে ভাষাটার সাথে বেয়াদবী করি। বেয়াদবীগুলোর মধ্যে নকশা খুঁজতে গেলে গোলকধাঁধায় পড়বেন বলে দিচ্ছি।

নাভিদ ফারাবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

জার্নি বাই ট্রেন

২৯ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৪১


রাত পৌনে ১১ টা।
কমলাপুর রেলস্টেশন।
সাথে পার্বতী আর রমাকান্ত কামার।
মাঝরাত্তিরে মায়ের জন্য নেয়া রক্তের বোতল ভেঙে দেয়ার পর নায়ক জসিম যেভাবে হাহাকার করত আমাদের মানিব্যাগগুলোর ওরকম হাহাকারের কারনে ১১৬ টাকায় চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের টিকেট কাটা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক বগিসমেত ঝরঝরে ট্রেনটির আশায় দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে চাতক পাখির মত দাঁড়িয়ে আছি।
সন্ধ্যার পর ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে যত এগোয় ঢাকার স্টেশনগুলোতে জাতের মানুষের পরিমান ততই কমে। দেখতে দেখতে ট্রেন হাজির। চলন্ত অবস্থায় ধাক্কাধাক্কি করে ওঠার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু বাদবাকি সবাইকে মাছির মত ট্রেনটাকে জাপটে ধরতে দেখে সিট পাওয়ার আশায় জানের মায়া ছাড়তে হল।
বাংলাদেশ রেলওয়েকে ক্লাস টু পাশ করতে হয় না। ফার্স্ট ক্লাস এবং তার পরেই থার্ড ক্লাস। টিকেটে যদিও ছোট্ট করে সেকেন্ড ক্লাস শব্দটা উল্লেখ থাকে।
ট্রেনের চাকার নিচে পড়া সংক্রান্ত ভয়ডর যাদের একেবারেই কম তাদের দ্বারা প্রায় সবগুলো সিটই দখল। চোখে পড়ল ১৫/১৬ বছরের, গায়ে চার স্তর ময়লা বিশিষ্ট একটা খালি গায়ের ছেলে পা ছড়িয়ে আস্ত একটা সিট দখল করে বসে আছে। নরম শরম মানুষ পেলে টাকা নিয়ে সিট ছাড়ার ধান্ধা। প্রথমে ভদ্র ভাষায় বললেও শেষমেশ বজ্রনিনাদ ছাড়া তাকে ওঠানো গেল না। উদ্ধারকৃত সিটে পার্বতী আর রমাকান্তকে বসিয়ে আমি বসলাম দরজার কাছাকাছি বাথরুমের পাশের একটা বেঞ্চমার্কা সিটে। এটাও পাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল যদি রমাকান্ত কামার খানসাতেক মানুষকে ধাক্কা দিয়ে বসে না পড়ত।
প্ল্যাটফর্ম থেকে সিট অবধি পৌছানোটা মনে হল একটা সাইক্লোনের ভিতর দিয়ে রিকশায় করে আসার মত। দুই পকেট হাতড়ে, ব্যাগ ট্যাগ সামলে নিয়ে উম দেয়া মুরগীর মত জাকিয়ে বসলাম। পুরোটা রাত সামনে। এই ৯০ ডিগি এ্যাঙ্গেলের ব্যাকসাপোর্টহীন সিটে আরাম তো কিছু খুঁজে বের করতে হবে তা যতটুকুই থাক।


মিনিট পনের স্টেশনে দাঁড়ানোর পর হুঙ্কার দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। বগি টইটম্বুর। এর ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে, সিটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। ভাবলেশহীনভাবে ফ্লোরেও বসে আছে বেশ কয়েকজন। মেইল ট্রেনগুলো ট্র‍্যাকের প্রতিটা স্টেশনে থামে। তাই যারা লোকাল কমিউটার তারাও উঠে বসে আছে। অবশ্যই বিনে টিকেটে।
ঘাড় ঘুরিয়ে কার গা থেকে মুরগীর বিষ্ঠা পঁচা উৎকট গন্ধ আসছে খুঁজছিলাম, তখনই ডান পাশ থেকে আওয়াজ এল, "যাবেন কুনে?"
-"চট্টগ্রাম।"
-" চট্টগ্রামে কি লেখিপড়ি করেন?"
-" নাহ, সীতাকুন্ড যাচ্ছি ঘুরতে। আপনি যাচ্ছেন কোথায়?"
৭০ ছুঁই ছুঁই মেহেদীরঙা দাঁড়িওয়ালা মানুষটার সাথে কথা হল বেশ কিছুক্ষন। ১৯৭১ সালের ২১ বছর বয়সী পূর্ব পাকিস্তান আর্মির একজন মুক্তিযোদ্ধা সেপাই আমার ডানপাশের সহযাত্রী। বাড়ি মাদারীপুর। যাচ্ছেন চট্টগ্রামের হালিশহর। যুদ্ধের সময় কাউকে হারাতে না হলেও মাস তিনেক আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে হারিয়েছেন নিজের সেপাই ছেলেকে। ছেলের কাগজপত্র সংক্রান্ত কি যেন কাজে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম। ছয় রোজা রাখছেন। ঘন্টা দুই পরে যেন তুলে দেই এই অনুরোধ করে চোখ বুজলেন তিনি।
ট্রেন মাঝারী গতিতে ছুটে চলেছে তিতকুটে গন্ধ ভরা ঢাকা শহরের বুক চিরে। কখনো কোন বাজারের ভিতরের সবজী পঁচা গন্ধ, কখনো কোন বস্তি থেকে তেল চটচটে বালিশের গন্ধ, কখনো আবার খোলা নর্দমার কষ কষ গন্ধ। তাছাড়া সেই যে কার গা থেকে মুরগীর বিষ্ঠা পঁচা গন্ধ আসছিল, সেটা তো আছেই। নরাধমটাকে তখনও খুঁজে পাই নি। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বগির বাথরুমের এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও সেটার যন্ত্রণা এখনো পেতে হয়নি।


টঙ্গী স্টেশনে থামতেই যে পরিমান মানুষ নামল মোটামুটি সে পরিমান মানুষ উঠলও। এই নতুন ঢেউয়ের মধ্যে দরজা দিয়ে উঁকি দিল এক নানী। শুধু যে নানী তা নয়, তার সাথের ২০/২২ টা পাঁচ লিটারের মামের খালি পুরনো বোতল, ইঞ্জিন অয়েলের গ্যালন আর দুই বস্তা ভর্তি কাঁচের বিবিধ জার। নানীর সাথে উঠল সম্ভবত তার মেয়ে কাম এ্যাসিস্ট্যান্ট। বছর ৩৫ হবে বয়স। সম্ভবত মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে কিছু। কোন খাটো শুকনো শরীরে অত ছোট মাথা জীবনে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ল না। মুখে তার দাঁতও অনেকগুলো কম মনে হচ্ছিল। যাহোক, বগিভর্তি লোকের আহাজারি, বিরক্তি, চিল্লাপাল্লা সত্ত্বেও মা মেয়ে টেনে হিঁচড়ে তাদের "লাগেজ" বগিতে তুলে ফেলল। সব ঝামেলা শেষে নানী ফটাফট দাঁড়িয়ে গেল তার সম্পদের পাহাড়ের মাঝে আর মেয়েটা পা ছড়িয়ে বসে গেল মায়ের পায়ের নিচে। সিলিং বাতির আলো পড়তেই দেখলাম নানীর গায়ের শতচ্ছিন্ন এককালে কালো রঙের বোরখাটা উলটো করে গায়ে দেয়া আর মুখ-ডাকা কাপড়টা অনেকটা র‍্যাবের সদস্যদের মত শক্ত করে মাথায় বাঁধা। তিল পরিমান খালি না থাকা বগিতে চারজনের জায়গা দখল করা নানীর দিকে ছুড়ে দেয়া " নানায় কইগো নানী?", "নানারে কন গাড়ি লাগাইতে আরেকটা" কথাগুলো যেন তার গায়েই লাগল না।


ট্রেন ছুটে চলেছে নরসিংদী স্টেশন ছাড়িয়ে। ট্রেনের ঝাকুনীর তালে তালে নানীর সাম্রাজ্যের কোন এক বোতল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সন্দেহজনক হলুদ তরল পড়ছে আমার বাম পাশের সহযাত্রীর পায়ে। উপরের তিনটি বোতাম খোলা একটা চেকশার্ট গায়ে আর লুঙ্গী পরনে লোকটা হা করে ঘুমোচ্ছে। মুখের হলুদ দাঁতগুলো যেন দুহাত বাড়িয়ে আকাশটাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। লোকটার হাতে একটা আনকোরা পেপার গোল করে ভাজ করা। আঙুল দেখে রাজমিস্ত্রী গোছের মনে হওয়া মানুষটাকে কোনভাবেই পেপার-পড়ুয়া টাইপ হিসেবে ধারনা করা যায় না। "রাত বিরাতে আনকোরা পেপার কোথায় পেল" 'র থেকে "পেপার দিয়ে সে করবেটা কি?" ই বেশি ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।
ট্রেনের মৃদু মৃদু ঝাকুনি, ঢাকা ক্রস করায় গন্ধ থেকে মুক্তি আর নানীর হলুদ ঝর্ণার ফোটা গুনতে গুনতে কখন যে ঘাড় কাত করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটা আর খেয়াল নেই।


ঘুমটা ভাঙল গরমে। কোথায় আছি বুঝতে কিছু মুহূর্ত গেল। ট্রেন দাঁড়িয়ে। টুক করে মাথা বের করে দেখে নিলাম।
নরসিংদী স্টেশন।
প্লাস্টিকের সংসার নিয়ে নানী উধাও। এই স্টেশনেই নেমে গেছে মনে হয়। স্মৃতি হিসেবে রেখে গেছে আমার বাম পাশের ঘুমন্ত সহযাত্রীর পায়ের কাছে হলুদ তরলের ছোটখাটো একটা ডোবা। সাদা চোখে দেখে যা মনে হবার কথা তাই মনে হচ্ছিল। বিষয়টা শুধু আমারই মনে হচ্ছিল তা যে না এটা বুঝলাম আশেপাশের মানুষের ডোবাটার প্রতি অস্বস্তিকর দৃষ্টি দেখে।
ট্রেন কিছুটা ফাঁকা। ফাঁকা বলতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পরিমান কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে দেখলাম দুটোর কাছাকাছি বাজে। আড়াইটার পর পর নেক্সট স্টেশনে থামলেই ডান পাশের নানাকে তুলে দিলে চলছে। বড় শান্তিতে ঘুমাচ্ছে মনে হল দেখে। ঘুমাক।
মিনিট দশেক পর ভোঁ দিয়ে ট্রেনটা নড়ে উঠল। ট্রেনের সাথে নড়ে উঠল আমার বাম পাশের জন। উঠে ফাঁকা দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। ঘুমের সময় নাকি আত্মা শরীরের বাইরে ভাসাভাসা অবস্থায় থাকে শান্ত নদীতীরে বেঁধে রাখা ছোট্ট নৌকার মত। ঘুম ভাঙলে আত্মা আর শরীর এক হওয়ার জন্য কিছুটা সময় দিতে হয়। আমার সহযাত্রী মনে হয় সেটা জানে। সে সময় দিচ্ছে।
আত্মা পুরোপুরি ঢুকলে সে পায়ের ভিজে ভাবটা টের পেল। তৎক্ষনাৎ রেগে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বগির ভিতরে কোন আন্ডাবাচ্চার অস্তিত্ব খুঁজল মনে হয়।
- "দেখছেননি বাই কারবারডা? কোন ছোডোমোডো যানি মুইত্তা রাইখা গেছে। কানসা পাচাইয়া চোপার দেতাম পাইলে।"
বেচারার মনে শান্তি দেয়ার জন্য বোতল ডিলার নানীর কথাটা বললাম। খুব একটা শান্তি পেল বলে মনে হল না।
হাতের পেপারটার প্রথম পাতা ছিড়ে পাটা মুছল সে। বাংলাদেশ প্রতিদিন। হলুদ তরল মাখা পেপারের অংশটা নাকের কাছে নিয়ে আমার দেয়া থিওরিটার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করল। চেহারা দেখে মনে হল সন্দেহ তার আরো বেড়েছে।
কিছুক্ষন ভুরু কুঁচকে বসে থেকে পেপারের বাকি অংশ হাতে বাথরুমে গেল সে, ফিরল খালি হাতে। পেপারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হল আমার কাছে।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরের স্টেশন যতটুকু খেয়াল হয়। ট্রেন ছুটে চলেছে। হঠাৎই আলো নিভিয়ে দিল। থার্ড ক্লাসের মানুষজনের কতইবা আর আলো লাগে? আমার ডান বাম দুজনেই ঘুমে কাতর আবারো। আমি পুরোপুরি পারছি না কারন এই মুহূর্তে আমার পিছনে হেলান দেয়ার কিছু নেই। সরাসরি জানালা। ঘুমিয়ে পড়লেই ঘাড়সহ মাথাটা একেবারে বাইরে ঝুলে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। মাথাটা সাথে নিয়েই ঢাকায় ফিরতে চাই বলে ঘুমাতে পারছি না।
বাঁকা হয়ে বসতে গিয়ে হঠাৎই চোখ পড়ল বাইরে।
রাতটা পূর্ণিমার না। কিন্তু পুরো আকাশটা যেন চাঁদের সাথে মিলেমিশে একাকার। বিশাল এক মাঠের মাঝখান থেকে আমাদের ট্রেনটা ছুটে চলেছে। চারদিক ফাঁকা। চক কাটা মাঠের বুকে যেন রুপালী পরীর দল পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে।
চাঁদের একটা মজার বিষয় আছে। চাঁদ এক এক জায়গায় এক একরকম। সমুদ্র পাড়ের চাঁদের সাথে নদীর পাড়ের চাঁদের মিল নেই। শহরের ছাদের চাঁদের সাথে পাহাড় চূড়োর চাঁদের মিল নেই। প্রত্যেকেই নতুন, প্রত্যেকেই আলাদা এবং প্রত্যেকেই অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর।
সম্মোহিত ভাবটা জোর করে কিছুটা কাটিয়ে কল দিলাম রমাকান্ত আর পার্বতীকে। ধরল না। ঘুমাচ্ছে হয়ত। ঘুমাক।
আমি আবার ডুবে গেলাম আমার পবিত্র অশরীরীর মায়ায়।


আমার ধারনা ঠিক ছিল। স্টেশনে সাদা কংক্রিটের বোর্ডে লাল রঙের ব্রাহ্মণবাড়িয়া চকচক করছে। তিনটার কাছাকাছি বাজে। ট্রেনের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। নানাকে তুলে দিলাম। ট্রেন এবার আসলেই কিছুটা ফাঁকা মনে হচ্ছে। দাঁড়ানো মানুষের পরিমান একদম কম। হঠাৎই আমার বেঞ্চিমার্কা সিটের মুখোমুখি ঠিক ফ্যানের নিচে একটা সিট খালি মনে হল। নানা ফটাফট সেটাতে বসে পড়ে তার পাউরুটি, ফেরীওয়ালাদের থেকে কেনা সিদ্ধ ডিম আর কি যেন তরকারী দিয়ে সেহরী শুরু করলেন। একজন পান সিগারেটওয়ালার সাথে আমার বাম পাশের সহযাত্রী গোল্ডলিফ সুইচ কেন নেই এই নিয়ে কিছুক্ষন তর্কবিতর্ক করে গোল্ডলিফ লালটা নিয়ে সুখটান দিতে লাগল। নতুন যাত্রী হিসেবে হাজার বছরের না ধোয়া জামা গায়ে দুটো কমবয়সী খালি পায়ের মেয়ে একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা কোলে নিয়ে উঠল। উঠেই আমার মুখোমুখি বাথরুমের দরজা ঘেষে ফ্লোরে বসে পড়ল। মিনিট পাঁচেক পরে ভোঁ।
ট্রেন নড়তে শুরু করল। মোটামুটি পরিষ্কার জামা কাপড় পড়া একজন তড়িঘড়ি করে উঠে নানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার মুখভঙ্গিতে বুঝলাম যে সিটে নানা বসে আছেন সেটা তার সিট ছিল। স্টেশনে হয়ত নেমেছিল কোন কাজে। সিট যে এভাবে দখল হয়ে যাবে এটা হয়ত বেচারা বুঝতে পারেনি। বুড়ো মানুষ একজন বসে পড়েছে তাই ঝগড়া করে যে উঠাবেন তাও পারছেন না। নানা চলে যাওয়ায় আমি একটু পা ছড়িয়ে বসেছিলাম। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটাকে ইশারা করলাম আমার ডান পাশে বসার জন্য।
জীবনে অনেক ভুল করেছি। ছোট বড় মিলিয়ে কম না। সব মনে নেই। কিন্তু এই লোকটাকে ডেকে পাশে বসানোর ভুলটা আমার আজীবন মনে থাকবে কারন আমি অবশেষে বুঝতে পারলাম মুরগীর বিষ্ঠা পঁচা গন্ধ কার গা থেকে আসছিল।


ট্রেন ছুটে চলেছে। ফ্লোরে বসে থাকা ১৬ কি ১৭ বছর বয়সী মা বাচ্চাটাকে পাউরুটি ছিড়ে ছিড়ে দিচ্ছে আর বাচ্চাটা পানের পিক থেকে শুরু করে দুনিয়ার যত নোংরা তরল আছে সব মিশে মোটা হয়ে যাওয়া ফ্লোরে পাউরুটির টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাচ্ছে। আমি বসে বসে বাচ্চার পাউরুটি খাওয়া দেখছি আর ডান পাশে মুরগীর বিষ্ঠার ড্রাম শুকে শুকে লাইফের যাবতীয় ভুল সিদ্ধান্তের কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। ভাগ্যিস এই পিচ্চি নরসিংদী স্টেশনে এই ট্রেনে ওঠেনি। হলুদ ডোবা নিয়ে তাহলে তুলকালাম হয়ে যেত। এইসব ছাইপাশ যখন ভাবছি তখন ডান পাশ থেকে প্রশ্ন আসল,
-" ভাই যাবেন কোথায়?"
-" সীতাকুন্ড। আপনি?"
ভদ্রতার খাতিরে পালটা প্রশ্ন করতে হলেও ইচ্ছে করছিল ব্যাটাকে ফুটন্ত পানিতে ঘন্টাখানেক জ্বাল দিয়ে দুটো জোয়ান কামলা লাগিয়ে নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে আজদাহা একটা ডলা দেওয়াই।
-"আমি যাইতেছি ভাই চট্টগ্রাম। আগ্রাবাদ আনসার ক্যাম্পে যাব। ডিফেন্সে আছি।"
লোকটা বেশি কথা বলে মনে হল। তাও ভাল। গতরের গন্ধে ঘুমাতে যদিও পারব না, কিন্তু তাও কোনভাবে ঘুমিয়ে গেলে মাথাটা আমার আর ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে না। গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না।
-" ডিফেন্স বলতে কোথায়? আনসারেই?"
-" জ্বি ভাই, আনসারেই চাকরী করি। আপনাকে কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করছিল ভাই। শুনবেন?"
-" বলেন। সমস্যা নাই।"
কথা শুরু হল। নাম তার আমজাদ হোসেন। বাড়ি রংপুর। সেখান থেকে লালমনিরহাট এক্সপ্রেসে ঢাকা নেমে এই মেইল ট্রেন ধরেছেন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। এই রমজানের ঈদে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার পথে কমলাপুর রেলস্টেশনে ইফতারের পরপর দশ মিনিটের বন্ধুর দেয়া জুস খেয়ে বিশ হাজার টাকা, বাড়ির জন্য ঢাকা থেকে কেনা ঈদের জামাকাপড় এবং নিজের জন্য কেনা ১২০০ টাকার শখের বাটা জুতোজোড়া খুইয়েছেন।
-" বুঝছেন ভাই, আমি তো আসলে বুঝি নাই। ঈদে বাড়ি যাইতেছি। পকেটে টাকা আছে। কলিজায় জোর আছে। অন্য রকমের একটা শান্তি। লোকটা আইসা বলছিল সময় তো অনেক আছে ট্রেন আসার, আসেন গল্প গুজব করি। ইফতারির পর পর শরীরটা ছাইড়া দিছিল। দোকান থেইকা আমার চোখের সামনেই জুসটা কিনছিল। মনে হয় আগে থেইকাই কথাবাত্তি বলা ছিল। ঠান্ডা জুস দেইখা আমি আর সরতে পারি নাই। তার উপর দেখলাম যে দোকান থিকাই কিনতেছে। তখন আর অবিশ্বাস করি নাই।"
-"ঈদের সময় তো স্টেশনে লোকের শেষ থাকে না। অত মানুষের ভিতরে জুস খেয়ে পড়ে থাকলেন। কেউ দেখেনি?"
-" দেখব কিভাবে ভাই বলেন? স্টেশনের এক্কেরে শেষ মাথাডা আছে না, ঐখানে নিয়া গেছিল হাঁটতে হাঁটতে। বলছিল ওদিকে বাতাস আছে, এদিকে লোক বেশি, ওদিক গিয়া জিরাই চলেন। আমিও বিশ্বাস কইরা সাথে সাথে গেছিলাম।"
-"মানুষজন টের পেল কিভাবে?"
-"পইড়া ছিলাম অইখানে আধা ঘন্টা। এরপরে মানুষ দেইখা রেলওয়ে পুলিশরে খবর দিছে। সস্তার ফোন ছিল বইলা সেইটা আর নেয় নাই। মানিব্যাগ নিয়া গেছিল। অন্য পকেটে আইডি কার্ড ছিল বইলা সেইটা খোয়া যায় নাই। বাড়িতে ফোন দিয়া কথা বলছিলাম জুস খাওয়ার কিছুক্ষন আগে। সেইখানে কল দিয়া খবর জানছিল পুলিশে।"
-" পুলিশ পাওয়ার পর কি হল?"
-" থানায় হুশ নাই হয়া পইড়া ছিলাম চাইর ঘন্টা। বারান্দায় ফালায়া রাখছিল। পরে আমার এক ভাইস্তা আছে ঢাকায়। সে আইসা আমারে নিয়া হাসপাতালে ভর্তি করাইছিল। জ্ঞান ফিরার পর প্রথম তিনদিন নাকি খালি আমার টাকা কই, আমার ব্যাগ কই, বলছি। কিচ্ছু আমার মনে নাই। গলাটাও মোটা হয়া গেছে ভাই। এই যে আপনার সাথে কথা বলতেছি এইটাও বলতেছি শরীরের জোর দিয়া। শরীরেও জোর নাই।"
-"তা সেই ঈদের বন্ধ শেষ তো সেই কবে। এতদিন ছিলেন কই? ঢাকায় না বাড়িতে?"
-" জ্ঞান হারানির নয় দিন পর বাড়িতে গেছিলাম। সেই বাড়ি গিয়া সারাদিন ঘুমাইছি। ঘুম আর কাটে না। মায়ে দেইখা কি কান্দন। বাচ্চাগুলায় তো বুঝে না। আমারে ঘুমায়া থাকতে দেইখা মায়ে কান্দে, বউয়ে কান্দে।"
-"এতদিন পর ক্যাম্পে ফেরত যাচ্ছেন, ভেজাল করবে না? আগে খবর দিয়ে রেখেছিলেন?"
-" সেইটাই তো ভাই ভাবতেছি। চাকরী আছে কি নাই বুঝতেছি না। গেলে বুঝা যাইব।"
স্বভাবতই গল্পটা পুরোপুরি বিশ্বাস করলাম না। এক শোনাতেই কোন কিছু পুরোপুরি বিশ্বাস করা কোন কাজের কথা না। তার কাহিনীতে খুঁত ধরার আশায় অনেকক্ষন ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলাম। কোথায় ভর্তি ছিলেন, যাচ্ছেন ক্যাম্পে সাথে মেডিকেল কাগজপত্র কিছু নেই ; বিশ্বাস করাবেন কিভাবে, ইউনিফর্ম পড়ে রওনা দেননি কেন; সেটা তো আর নিশ্চয়ই চুরি করে নিয়ে যায়নি। উত্তর যেগুলো দিচ্ছিলেন কোনটা মিলছিল, কোনটা তেমন একটা মিলছিল না। কিন্তু তাও তার গল্পটা কেন যেন বিশ্বাস অবিশ্বাস দুই নৌকোতেই পা রেখে দাঁড়িয়েছিল।
আমার অতি পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রশ্নবানের কারন লোকটা একসময় আন্দাজ করতে পারল। কিছুটা দুঃখ পেলেন মনে হল।
-" জানি ভাই আমার অবস্থাটা বিশ্বাস যাইতেছেন না। আপনেরে দোষ দিব না। আমারে কয়দিন আগে কেউ বললে আমিও হয়ত বিশ্বাস যাইতাম না। আসলে ভাই, যার সাথে এরকম না হইছে সে আসলে বিশ্বাস করতে পারব না হইলে কি অবস্থা হয়। এই দেখেন আমার আইডি কার্ড।"
আমার হাতে একটা কার্ড দিলেন। আনসার সেপাই এর আইডি কার্ড। আনসারদের আইডি কার্ড আগে কখনো দেখিনি। সুতরাং সত্যতা যাচাই করার মত জ্ঞান আমার নেই। তবে নিজেকে আর্মি জেনারেল পদবী দিয়ে নীলক্ষেত থেকে হুবহু এরকম একটা আইডি কার্ড বানাতে ৩০০ টাকার বেশি লাগার কথা না।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল দরকার কি শুধু শুধু লোকটাকে আর খুঁচিয়ে। সত্যি হলে ভাল কথা, মিথ্যা হলে তো সাবধান আছিই। আর সাবধান হয়েই বা কি যায় আসে, সাথে জানটা ছাড়া আর তো দামী কিছু নেই। পুঁথিগত সান্ত্বনাবানী কিছু আউড়ে নিজের কলিজার কোমলতা দেখিয়ে বের হয়ে আসলেই চলে।
-" যাক ভাই। যা হয়েছে হয়েছে। কষ্ট ধরে রেখে আর লাভ কি? আল্লাহ চেয়েছেন বলেই তো হয়েছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আপনার তো সরকারী চাকরী। সরকারী চাকরী হল দশটা লাশের নিচে রাখা চটের মত। সহজে কেউ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। কাল সকালে চট্টগ্রামে নেমেই বাড়ির কাউকে দিয়ে হাসপাতালের কাগজগুলো ইন্টারনেটে আনিয়ে নিয়েন। আপনার চাকরীর কিচ্ছু হবে না। টেনশন করবেন না বেশি।"
স্বান্ত্বনা শুনে তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। মেরুদন্ডহীন,তেলতেলে, হতাশায় ভরা দূর্বল একটা হাসি।
দেখে কেন যেন সূক্ষ্ম ঘৃণা জাগল। এরকম হাসি দেখলে মারতে ইচ্ছা করে। কেন যেন মায়া হয় না। এই লোকের চেহারা হাসি বসানোর জন্য সৃষ্টি হয়নি। হলে হাসিটা এত গা শিরশিরে অদ্ভুত হত না। তার চেহারায় কি ভাল যাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে তার চেহারা না থাকলে ভাল হত৷ সব ঠিক থাকবে, খালি যেখানে নাক মুখ চোখ থাকার কথা সেখানে কিছু থাকবে না।বেশ হত ৷ চেহারাটাই এই লোকের কাল হয়েছে। চেহারা না থাকলে নিশ্চয়ই কেউ তাকে সেধে জুস খাওয়ানোর সাহস করত না।
এত কিছু বলছি কেন? গল্পটা বিশ্বাস করিনি পুরোপুরি সেজন্য? হবে হয়ত। গল্প সবার থাকে। সবগুলো গল্প বিশ্বাস করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই।


কুমিল্লা স্টেশন।
বেশ ঝকঝকে তকতকে মনে হচ্ছে। রাতের অন্ধকার সব ময়লা ঢেকে দিয়েছে বলেও হয়ত ঝকঝকে তকতকে মনে হতে পারে। সারারাত ট্রেন জার্নি করব বলে ভারী কিছু খেয়ে উঠিনি। পেটে দশ চিতা সমান আগুন জ্বলছে। পার্বতী উঁকি দিয়ে বলল চল কিছু ঢেলে আসি পেটে। বাইরে তাকালাম জানালা দিয়ে। আশেপাশের মানুষজনের চলাফেরা আর বগির ভিতরে মানুষের স্বল্পতা দেখে বোঝা গেল সময় হাতে আছে কিছুটা। বাম পাশের সহযাত্রী লালা ঝুলিয়ে ঘুম। আমজাদ হোসেন হাতের তালু খুঁটছেন বসে বসে৷ তার উপরে সিট রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নেমে পড়লাম। এসব জেলা শহরের মাঝরাতের স্টেশনগুলো খুব অদ্ভুত রকমের জীবনে ভরপুর। কতগুলো হোটেলে এই রাত পৌনে চারটায় পটাপট করে গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজি চলছে। কোত্থেকে যেন মালাই দেয়া চায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে ভেসে আসছে। কোথাও উজ্জ্বল কোন আলো নেই। কোন দোকানের সামনে অথবা স্টেশনের স্ট্যান্ডে অল্প অল্প দূরত্বে কম পাওয়ারের লাল আলোর বাতিগুলো জ্বলছে। যেটুকু বা ছোপছোপ অন্ধকার দেখা যায় সেটুকুও গলা টিপে ধরতে পারছে না রাতের রূপালী দেবীর জন্য। অন্ধকার এই স্টেশনটা যেন আত্মীয়তার উষ্ণ একটা আলিঙ্গন।
ট্রেনের অধিকাংশ মানুষই নেমে গেছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা চা সিগারেট কেক খাচ্ছে, যাদের নেই তারা মনে মনে জিভের জল ফেলছে। কিন্তু কারো কোন অভিযোগ নেই, রাগ নেই, তাড়াহুড়ো নেই। এখানের সবাই যেন সাহেব বাবুদের গালিগালাজে ভরপুর দিনের আলোর ঘামঝরানো কষ্ট থেকে একটু ছাড় পাওয়া সময়টা বেশ আয়েশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করছে।
দুটো কেক আর একটা ডিম সিদ্ধ খেয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। ভোঁ দেয়ার কিছুটা দেরী থাকলেও সিট বেদখল হয়ে যাওয়ার ভয়টা কাজ করছে। আমজাদ হোসেনের উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছি না।
উঠে দেখি আমজাদ হোসেন বেশ ভক্তিভরে একটা কলা খাচ্ছে।
-" ভাই, খাইছেন কিছু?"
-" হ্যাঁ, কেক আর ডিম খেলাম বাইরে।"
-"বুঝছেন ভাই দুনিয়ায় এখনও ভাল মানুষ কম নাই। আপনার সাথে গল্প করতেছিলাম না? অইসময় সামনের সিটে বসা একজনে শুনছে আমার কথা। উনি বাড়িতে নেওয়ার জন্য এক ডজন কলা কিনলেন৷ আমারে বললেন, ভাই একটা নেন। এরকম ভাল মানুষেরে তো না বলা যায় না। নিয়া নিলাম।"
-" ভাল করেছেন। আর খাবেন কিছু? আমি খাওয়াব।"
-" না ভাই। আর লাগবে না। রাতের বেলা বেশি খাই না আমি। পেটে সয় না।"
সিটে বসে বসে তার কলা খাওয়া দেখলাম। খেয়ে দেয়ে বেশ দক্ষ হাতে কায়দা করে ছোলাটা জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেললেন।
আমজাদ হোসেনের জুস খাওয়ার কাহিনী আমার বিশ্বাস হল।


ফেনীর দিকে এগোতে থাকার সময় অবশেষে বগির শেষ মাথায় টিকেট চেকারের টিকির দেখা মিলল। আমি বসে বসে এতক্ষন গজরাচ্ছিলাম মনে মনে যে ১১৬ টাকাই জলে গেল। এই টাকায় কত্তগুলো সিঙারা হয়। আলগোছে পকেট হাতড়ে দেখে নিলাম ছোট্ট আয়তাকার টিকেটগুলো আছে কি না। আমজাদ হোসেন ও তার গায়ের মুরগীর বিষ্ঠা পঁচা গন্ধ আমার ঘাড়ে মাথা রেখে বেশ আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। ফ্লোরে মায়ের কোলে বাচ্চাটা হা করে ঘুমাচ্ছে। তার মাথায় সুতার মত চিকন ছোট্ট হলুদ বেগুনী মিশের একটা পোকা বসে আছে। হালকা শ্যামলায় হলুদ বেগুনী ভালই লাগছে দেখতে। সিলিং এর প্রত্যেকটা লাইটের বাটির মত কাঁচের কাভারের ভিতরে পাঁচ বছরের বাচ্চার কোষ ভরে যায় এমন পরিমান শুকনো পোকা। সেই শুকনো পোকাগুলো ট্রেনের তালে তালে এদিক ওদিক যাচ্ছে। দেয়াল ভর্তি কৃষ্ণা মগ এর ৪" বাই ৬" নীলরঙা স্টিকারগুলো যেন সেই পোকাগুলোর আলো ছায়ায় নাচছে। দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি, পার্বত্যজেলা। 01887947949। সবাই যা যা দেয় তার পাশাপাশি সে জমকও নামায়। সেটা কি জিনিস খোদাতায়ালাই ভাল জানেন।
চারপাশটা একবার দেখে নিলাম। মানুষগুলো কি শান্তিতেই না ঘুমাচ্ছে। ফার্স্ট ক্লাস কম দেখা হয়নি জীবনে। সেখানটায় সব এক। বেশভূষা, আচরণ, সরি, থ্যাঙ্ক ইউ, এক্সকিউজ মি।
এখানে এই ছোট্ট বগিটার মধ্যে কতই না রঙ ছড়ানো। হোক না মলিন, ছেড়াফাটা, উলটো করে বোরখা পড়া। খালি চোখে সরাসরি তো দেখা যায়। দশ বারোটা পর্দা ওঠানো লাগে না। ম্যানার্সের দেয়ালের ওপারে কেউ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে না। খালি চোখে এত রঙ একসাথে কম দেখেছি।
চেকার বগির মাঝামাঝি আসতেই লাইট অফ হয়ে গেল। আবছায়ায় ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে দেখলাম চেকার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই হেলতে দুলতে ফেরত চলে গেল।
হায় আমার ১১৬ টাকা। কত্তগুলো সিঙাড়া হত!


৬:২০।
ঘুম ভাঙল রমাকান্তের ডাকে।
-"ওঠ, চলে এসেছি। পরের স্টেশনেই নামব।"
ঝিকঝিক শব্দটা কমে আসার সাথে সাথে সীতাকুন্ড রেলস্টেশনটা ফুটে উঠল চোখের সামনে। খুব ছোট্ট নিরীহ চেহারার একটা স্টেশন। ফাইভ স্টার হোটেলের লবির বাথরুমগুলোও এর থেকে বড় হয়। ট্রেনটা একটা ঝাকি দিয়ে থেমে গেল। বামদিকের সহযাত্রী আমার ঘুমিয়ে। রোজাদার নানাও মাথা এলিয়ে পড়ে আছেন। আমজাদ হোসেনকে ডেকে তুললাম।
-" ভাই, নেমে যাচ্ছি।"
-" সীতাকুন্ড আইসা পড়ছে?"
-"হ্যাঁ। সাবধানে যাবেন। আর টেনশন করবেন না। সাহস রাখার চেষ্টা করেন কিছুটা। আসি তাহলে।"
-" আচ্ছা, তাইলে।"
নেমে গেলাম ট্র‍্যাকের পাথরগুলোর উপর। ট্রেন ট্র‍্যাকের পাথর কখনো এত সুন্দর হয় তা ভাবিনি। চকচকে মসৃণ সাদা আর ধূসর পাথরের মিশ্রণ। আমার ক্ষমতা থাকলে এদেরকে কোন এক সমুদ্র সৈকতে পাঠিয়ে দিতাম। ট্র‍্যাকে পড়ে থাকার জীবন এদের না।
স্টেশন ধরে এগোচ্ছি আমরা।
ভোঁ দিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দিল। দেখতে দেখতে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল গল্পভরা আমার লোহার গাড়ি।
একটা সিনেমা, বা বইয়ের মাঝখানের কিছু অংশ দেখে বা পড়ে আমরা বসে থাকতে পারি না। কি যেন একটা খোঁচাতে থাকে। শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। কিন্তু কোন মানুষের গল্পের কিছুটা অংশ শুনেই কিভাবে যেন আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি। সত্যিকারের শেষটা কোনদিনই হয়ত শুনতে পারব না এটা আমাদের মন সম্ভবত জানে। তাই সে মানিয়ে নিতে পারে সহজেই।
তবে একটা কাজ আমি করব।
আসছে কোরবানীর ঈদে আনসারদের ছুটির তারিখটা খুঁজে বের করে ঐ দিনটাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাব। কারন আমি মোটামুটি বিশ্বাস করি আমজাদ হোসেনের সাথে আমার আবারও দেখা হবে। তার চেহারায় হাসি কেমন যায় দেখেছি, ঘুম কেমন যায় দেখেছি, "না-হুশ" কেমন যায় সেটা একটু দেখতে চাই। হয়ত সেটাই তার চেহারায় সবচেয়ে ভাল মানিয়ে যাবে।
কে জানে?


আমরা আস্তে আস্তে স্টেশনটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি।
সীতাকুন্ডকে সাত ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছি।
আরো বেশি অপেক্ষা করালে সে মন খারাপ করবে না?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:০৪

আল-ইকরাম বলেছেন: ধন্যবাদ। লেখার উপস্থাপনা সাবলীল। ভাল হয়েছে।

০৯ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:৫৫

নাভিদ ফারাবী বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ। ভালবাসা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.