নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীল নক্ষত্র

আমি একজন অতি সাধারন মানুষ। সুন্দরেরসন্ধানে ঘুরে বেড়াই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে।

মোঃ খালিদ উমর

আমি এক জন অতি সাধারন মানুষ। সুন্দরের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে।

মোঃ খালিদ উমর › বিস্তারিত পোস্টঃ

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৮

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:১০





নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল

মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!





দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।



রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে

কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!

কি বলব, যাচ্ছি তো।

আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।

নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!



সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল

ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?

ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল

ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

না।

তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।

কবে যেতে হবে?

দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?

হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।

এখানে কোথায় থাকছ?

হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।

দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।

না কোন অসুবিধা নেই।

গুড।

তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?

হ্যাঁ এনেছি।

বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।

না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।

আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।

সিডিসি কি?

পাসপোর্ট চেন?

হ্যাঁ চিনি।

এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরির জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।



ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।

ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল

চল, মামার বাড়ি যাই।

নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।

চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।



নিশাত জিগ্যেস করল একটা কথা জিগ্যেস করবো?

কি কথা?

আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?

নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।

ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?

ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?

না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?

হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।

তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।

হ্যাঁ মনে থাকবে।

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।

ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।

হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?

তাইতো শুনলি।

আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।

আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিগ্যেস করলাম।

চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।

হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?

ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?

আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!

দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।

ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।



কোন দুই জন?

বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?

কাল দিবে বলেছে।

গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।

এই জেমস, শুনছ?

কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল

বলেন স্যার শুনছি।

এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?

হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন

যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।

আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?

মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।

অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।

আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।



তা হলে?

ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।

বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।

তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?

লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।

কত দিবি?

কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিগ্যেস কর দেখি কি বলে।

আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?

৫০০ টাকার বেশি না।

তা হলে আমার দুই শ হলেই হবে।

আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।

ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।

এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।



নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৮



নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল

মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!





দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।



রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে

কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!

কি বলব, যাচ্ছি তো।

আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।

নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!



সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল

ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?

ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল

ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

না।

তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।

কবে যেতে হবে?

দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?

হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।

এখানে কোথায় থাকছ?

হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।

দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।

না কোন অসুবিধা নেই।

গুড।

তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?

হ্যাঁ এনেছি।

বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।

না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।

আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।

সিডিসি কি?

পাসপোর্ট চেন?

হ্যাঁ চিনি।

এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরির জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।



ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।

ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল

চল, মামার বাড়ি যাই।

নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।

চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।



নিশাত জিগ্যেস করল একটা কথা জিগ্যেস করবো?

কি কথা?

আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?

নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।

ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?

ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?

না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?

হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।

তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।

হ্যাঁ মনে থাকবে।

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।

ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।

হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?

তাইতো শুনলি।

আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।

আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিগ্যেস করলাম।

চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।

হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?

ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?

আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!

দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।

ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।



কোন দুই জন?

বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?

কাল দিবে বলেছে।

গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।

এই জেমস, শুনছ?

কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল

বলেন স্যার শুনছি।

এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?

হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন

যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।

আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?

মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।

অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।

আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।



তা হলে?

ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।

বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।

তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?

লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।

কত দিবি?

কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিগ্যেস কর দেখি কি বলে।

আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?

৫০০ টাকার বেশি না।

তা হলে আমার দুই শ হলেই হবে।

আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।

ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।

এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।



নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৮



নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল

মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!





দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।



রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে

কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!

কি বলব, যাচ্ছি তো।

আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।

নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!



সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল

ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?

ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল

ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

না।

তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।

কবে যেতে হবে?

দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?

হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।

এখানে কোথায় থাকছ?

হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।

দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।

না কোন অসুবিধা নেই।

গুড।

তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?

হ্যাঁ এনেছি।

বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।

না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।

আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।

সিডিসি কি?

পাসপোর্ট চেন?

হ্যাঁ চিনি।

এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরির জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।



ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।

ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল

চল, মামার বাড়ি যাই।

নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।

চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।



নিশাত জিগ্যেস করল একটা কথা জিগ্যেস করবো?

কি কথা?

আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?

নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।

ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?

ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?

না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?

হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।

তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।

হ্যাঁ মনে থাকবে।

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।

ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।

হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?

তাইতো শুনলি।

আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।

আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিগ্যেস করলাম।

চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।

হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?

ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?

আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!

দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।

ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।



কোন দুই জন?

বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?

কাল দিবে বলেছে।

গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।

এই জেমস, শুনছ?

কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল

বলেন স্যার শুনছি।

এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?

হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন

যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।

আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?

মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।

অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।

আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।



তা হলে?

ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।

বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।

তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?

লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।

কত দিবি?

কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিগ্যেস কর দেখি কি বলে।

আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?

৫০০ টাকার বেশি না।

তা হলে আমার দুই শ হলেই হবে।

আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।

ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।

এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।



নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৮



নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল

মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!





দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।



রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে

কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!

কি বলব, যাচ্ছি তো।

আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।

নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!



সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল

ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?

ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল

ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

না।

তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।

কবে যেতে হবে?

দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?

হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।

এখানে কোথায় থাকছ?

হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।

দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।

না কোন অসুবিধা নেই।

গুড।

তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?

হ্যাঁ এনেছি।

বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।

না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।

আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।

সিডিসি কি?

পাসপোর্ট চেন?

হ্যাঁ চিনি।

এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরির জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।



ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।

ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল

চল, মামার বাড়ি যাই।

নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।

চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।



নিশাত জিগ্যেস করল একটা কথা জিগ্যেস করবো?

কি কথা?

আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?

নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।

ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?

ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?

না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?

হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।

তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।

হ্যাঁ মনে থাকবে।

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।

ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।

হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?

তাইতো শুনলি।

আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।

আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিগ্যেস করলাম।

চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।

হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?

ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?

আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!

দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।

ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।



কোন দুই জন?

বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?

কাল দিবে বলেছে।

গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।

এই জেমস, শুনছ?

কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল

বলেন স্যার শুনছি।

এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?

হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন

যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।

আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?

মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।

অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।

আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।



তা হলে?

ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।

বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।

তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?

লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।

কত দিবি?

কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিগ্যেস কর দেখি কি বলে।

আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?

৫০০ টাকার বেশি না।

তা হলে আমার দুই শ হলেই হবে।

আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।

ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।

এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।



নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৮



নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল

মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!





দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।



রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে

কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!

কি বলব, যাচ্ছি তো।

আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।

নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!



সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল

ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?

ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল

ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

না।

তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।

কবে যেতে হবে?

দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?

হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।

এখানে কোথায় থাকছ?

হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।

দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।

না কোন অসুবিধা নেই।

গুড।

তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?

হ্যাঁ এনেছি।

বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।

না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।

আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।

সিডিসি কি?

পাসপোর্ট চেন?

হ্যাঁ চিনি।

এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরির জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।



ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।

ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল

চল, মামার বাড়ি যাই।

নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।

চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।



নিশাত জিগ্যেস করল একটা কথা জিগ্যেস করবো?

কি কথা?

আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?

নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।

ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?

ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?

না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?

হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।

তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।

হ্যাঁ মনে থাকবে।

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।

ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।

হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?

তাইতো শুনলি।

আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।

আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিগ্যেস করলাম।

চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।

হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?

ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?

আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!

দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।

ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।



কোন দুই জন?

বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?

কাল দিবে বলেছে।

গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।

এই জেমস, শুনছ?

কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল

বলেন স্যার শুনছি।

এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?

হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন

যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।

আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?

মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।

অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।

আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।



তা হলে?

ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।

বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।

তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?

লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।

কত দিবি?

কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিগ্যেস কর দেখি কি বলে।

আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?

৫০০ টাকার বেশি না।

তা হলে আমার দুই শ হলেই হবে।

আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।

ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।

এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।



নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.