![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
এই বিপুল পৃথিবীতে আমরা প্রত্যেকেই যে যার মতো করে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিনিয়ত গল্প বুনে যাচ্ছি। আমাদের কারও গল্পই কারও সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। তবু কিছু মানুষের গল্প আমাদের জীবনে গভীর ছাপ ফেলে যায়। আমার বন্ধু হাবীবের গল্পও তেমনি। হাবীবের জীবনের গল্প আমার জীবনে গভীর ছাপ ফেলে গেছে। আজ আমি আপনাদের আমার বন্ধু হাবীবের গল্প শোনাব।
হাবীব ছিল আমার ছোটবেলার স্কুল বন্ধু। বাবার চাকরির সূত্র ধরে আমরা ভাঙ্গা উপজেলার একটি ছোট গ্রাম থেকে ১৯৮৬ সালের দিকে ফরিদপুর শহরে চলে আসি। গ্রাম ছেড়ে ফরিদপুর শহরের নতুন পরিবেশে আমাদের খুব ভাল সময় কাটছিল। ফরিদপুর আসার পরই আমার বাবা আমাকে তৃতীয় শ্রেণিতে ফরিদপুর হিতৈষী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিল। সেখানে এক বছর যেতে না যেতেই ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তির পর ফরিদপুর জিলা স্কুলে প্রথম পরিচয় হলো হাবীবের সঙ্গে। ওর পুরো নাম মো: হাসিবুল হাসান। ডাকনাম হাবীব।
আমি আর হাবীব ছিলাম আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ছোট-খাটো দুই শিশু বালক। সেই মিল থেকেই হয়তো আমাদের বন্ধুত্বের শুর হয়েছিল। তবে হাবীব ছিল অসম্ভব মেধাবী। ঐ অতটুকুন বয়সেই গোটা-গোটা হাতে লেখা নোট তৈরি করে পড়ত হাবীব। ওর হাতে লেখা বিভিন্ন বিষয়ের নোট খাতার প্রতি আমাদের ক্লাসের সবার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। কিন্তু হাবীব তার নোট খাতা কাউকে দিতে চাইত না। তার মধ্যে একধরনের গর্ব ও অহংকার ছিল তাঁর নোট খাতা ও পড়ার স্টাইল নিয়ে।
মেধাবী হওয়ার অহংকারের চেয়ে হাবীবের কৌতূহলী স্বভাব, পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহ আর সহজ-সরল দুষ্টুমি আমাকে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে অনুপ্রানিত করেছিল। একদিন ওর বাসায় গেলাম, আর ওর পরিবারের আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করল। এরপর থেকে আমাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো। প্রতিদিন একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, গল্প করা, লাইব্রেরিতে বই পড়া এভাবেই কেটেছে আমাদের স্কুলের দিনগুলো। আমরা প্রায়শই বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় একসঙ্গে অংশ নিতাম। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্ব যেন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। তবে সেই সময়ই আমাদের বন্ধুত্বে প্রথম ফাটল দেখা দিল।
২.
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় কী একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। ঠিক কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, তা আজ আর মনে নেই। তবে হাবীবের মেধার কারণে তার মধ্যে যে অহংকার জন্ম নিয়েছিল, তা আমার আর পছন্দ হচ্ছিল না, সেটুকু মনে আছে। সেই ঝগড়ার পরে ওর সঙ্গে আমি কথা বলা বন্ধ করে দেই। দুই বছর ধরে আমরা একই ক্লাসে থেকেও একে অপরের সঙ্গে কোন কথা বলিনি।
তবু, ওর প্রতি একধরনের টান ছিল। ক্লাসে ওর উপস্থিতি আমি লক্ষ্য করতাম, কিন্তু ওর আচরণের কথা মনে করে নিজেকে দমিয়ে রাখতাম। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর বিভিন্ন শাখায় আমাদের ক্লাস ভাগ হয়ে গেল। হাবীব এক শাখায় চলে গেল, আর আমি অন্য শাখায়। এর ফলে আমাদের দেখা হওয়া আরও কমে গেল।
দশম শ্রেণিতে ওঠার পর আবার আমাদের বন্ধুত্বে নতুন গতির সঞ্চার হয়। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্ততি গ্রহণের সময়, ফজলুল হক স্যারের টিউশনি ক্লাসে অনেক দিন পর আবার হাবীবের সাথে দেখা হয়। হাবীবই প্রথমে বলল, “কিরে, কেমন আছিস?” ওর এই সহজ প্রশ্নে আমার সব অভিমান গলে গেল। আমিও বললাম, “ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?” আমাদের বন্ধুত্ব আবার ফিরে এল।
এই সময় আমরা ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক আলোচনা করতাম। হাবীবের স্বপ্ন ছিল অনেক বড় হওয়ার। সে বিদেশী কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু হাবীবের পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা ওকে ভীষণভাবে কষ্ট দিত। সৎ বোনের সঙ্গে ঝগড়া এবং বাবার অতিরিক্ত শাসন সবসময় ওকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করত।
৩.
ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আমাদের পথ আলাদা হতে শুরু করে। আমি ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হই, আর হাবীব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাবীব ঢাকায় ওর মামার বাসায় থাকত। মাঝে মাঝে ঢাকায় গেলে ওর সঙ্গে দেখা হতো আমার। আবার বিভিন্ন ছুটিতে হাবীব যখন ফরিদপুরে আসতো, তখন আমাদের চলতো ননস্টপ আড্ডা। মনে আছে ঐ নব্বই দশকে আমরা যখন কম্পিউটারের ব্যবহারই ঠিক মতো জানতাম না, তখন হাবীবের ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। হাবীব কোয়ান্টাম মেকানিক্স খুব ভাল বুঝতো। আমি ওর কাছে কোয়ান্টম মেকানিক্স শিখতাম।
হাবীব জাপানে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত ওর আর জাপানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবু ওর স্বপ্ন দেখা থেমে থাকেনি। এর মধ্যে সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড়লোক সহপাঠীর প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু ওদের সেই অসম প্রেম শেষপর্যন্ত পূর্ণতা পায়নি। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেলে হাবীব মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
অনার্স শেষ করার পর পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে হাবীব একটি বেসরকারি ঔষধ কোম্পানির মার্কেটিং চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়। তার পোস্টিং হয় বগুড়ার মহাস্থানগড়ে। সেখানে একবার আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। এক সপ্তাহ ওর ওখানে ছিলাম। ঐ এক সপ্তাহ আমাদের দারুন সময় কেটেছে। পৃথিবীর হেন বিষয় নাই, যা আমাদের আড্ডার আলোচনার বিষয় ছিল ছিল না। ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সে থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম ফিজিস্কের ভবিষ্যত। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি, হেন বিষয় নাই যা নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা দুই বন্ধু ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করেছি। সেই আলোচনা পরবর্তী জীবনে আমার খুব কাজে এসেছে। বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করার পরিস্কার ধারণা জন্মেছে। তখনই জানতে পারি, হাবীব ফেসবুকে পরিচিত এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে এবং তারা বিয়ের পরিকল্পনা করছে।
হাবীবের বড় বড় স্বপ্ন পূরণের অস্থিরতা ওকে কখনও স্থির হতে দেয়নি। হঠাৎ করে একদিন বেসরকারি কম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাবীব আবার ঢাকায় ফিরে আসে। হাবীবের এই বড় স্বপ্ন দেখা কখনোই থামেনি, কিন্তু বাস্তবতাা তাকে ক্রমশ জটিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
৪.
ঢাকায় ফিরে হাবীবের জীবন আরও জটিল হয়ে ওঠে। মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সে স্বল্প সময়ের জন্য কয়েকটি চাকরিতে যোগ দেয়, কিন্তু কোথাও বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। ওর লক্ষ্য ছিল বড় কিছু করার, সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার এবং সমাজে প্রভাব ফেলার। এসময় সে কিছু অসৎ রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে, যা তাকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে।
তবে বাস্তবতার মাটি ছিল কঠিন। হাবীবের জীবনযাত্রায় আর্থিক সমস্যা লেগেই ছিল। তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় পারিবারিক সম্পর্ক সবসময়ই জটিল ছিল। সৎ বোনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত স্বার্থের দ্বন্ধ, বাবার কঠোর শাসন, এবং নিজের বড় স্বপ্নের ভারে সে একা হয়ে পড়েছিল। তার জীবনের এই টানাপোড়েন তাকে ক্রমশ আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছিল।
এর মধ্যেই হাবীবের বিয়ে হয় ফেসবুকে পরিচিত সেই মেয়ের সঙ্গে। তাদের একটি সন্তানও হয়। তবে সংসারের চাপে হাবীব নিজের বড় স্বপ্নগুলো থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ করেই তার নাম জড়িয়ে যায় একটি আর্থিক জালিয়াতির ঘটনায়। হাবীব জেলেও যায়। এই খবর শুনে আমি স্তব্দ হয়ে যাই।
জেল থেকে বের হওয়ার পর হাবীবের আর্থিক পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। সে আমাকে মাঝে-মধ্যে ফোন করে সাহায্য চাইত। আমি যতটুকু পারতাম, সাহায্য করতাম। কিন্তু আমার সাহায্য যথেষ্ট ছিল না। হাবীব ছোট ছোট চাকরি করত, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশিদিন কাজ চালিয়ে যেতে পারত না। তার ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
৫.
হাবীবের ফোন আসা মানেই ছিল তার নতুন কোনো আর্থিক সমস্যার খবর। কখনো সে একশ টাকার জন্যও ফোন করত আমাকে। আমি যতটুকু পারতাম সাহায্য করতাম, কিন্তু তার অসুস্থতা আর আর্থিক সংকট মিলে জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল। একদিন, ইচ্ছে করে ওকে কিছুটা কড়াভাবে কথা বললাম। ভেবেছিলাম এতে হয়তো সে নিজের জীবনে পরিবর্তন আনবে। কিন্তু সে অপমান সহ্য করে শুধু বলেছিল, “তুই ঠিক বলেছিস। আমার জীবনটা হয়তো এমনই।”
এরপর কয়েক মাস হাবীবের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ও আর কোন ফোন কিংবা মেসেজ দেয়নি। একদিন হঠাৎ করে হোয়াটসঅ্যাপে হাবীবের একটি মেসেজ পাই। সেখানে একটি বিভৎস ছবি শেয়ার করেছে, তাঁর পায়ে পচন ধরার ছবি। হাবীব হাসপাতালে ভর্তি ছিল এবং কিছু টাকার জন্য আমাকে এই মেসেজ পাঠিয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে কিছু টাকা পাঠালাম। টাকা পাঠানোর পর বেশকিছু দিন ওর আর কোনো খবর পাইনি। আমারও খবর নেয়া হয়ে উঠেনি।
কয়েক মাস পর, এক রাতে হাবীবের স্ত্রীর কাছ থেকে একটি মেসেজ পেলাম, সংক্ষিপ্ত মেসেজ, হাবীবের বউ লিখেছে “ঐধনরন রং হড় সড়ৎব”। সংবাদটি পাওয়ার পর কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, হাবীব আর এই পৃথিবীতে নেই। অসুস্থ থাকার সময় কোন একদিন ও বলেছিল, ’চল দুই বন্ধু মিলে বান্দরবন অথবা কক্সবাজার থেকে ঘুড়ে আসি ”। আমাদের আর একসাথে নদী কিংবা পাহাড়, কিছুই দেখা হলো না। মাত্র ৪১ বছর বয়সে, সকল স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে আমার বন্ধু হাবীব পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেল।
হাবীবের মৃত্যু আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার মতো মেধাবী একটি ছেলে, যার ছিল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন, তাঁর এমন করুণ পরিণতি, আমার মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। আমার মনে হয়, হয়তো আমি তার জন্য আরও বেশি কিছু করতে পারতাম। কিংবা করা উচিত ছিল। এই আফসোস আর অপরাধবোধ আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়। হাবীবের জীবনের করুন গল্প আমার হৃদয়ে এক গভীর শূন্যতার ছাপ রেখে গেছে। কেন যেন মনে হয়, দিন শেষে সকল মানুষের গল্পই শেষ হয় চূড়ান্ত অপূর্ণতা ও একবুক আফসোস নিয়ে!
(সমাপ্ত)
(ছোটগল্পটি ফরিদপুর জেলা শহরের সাহিত্যের আড্ডা বইঘাঁটা থেকে প্রকাশিত ছোটকাগজ ‘সাঁতার’ পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।)
Click This Link
©somewhere in net ltd.