নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নিভৃতা। ভালোবাসি পড়তে। একটু আধটু লেখালেখির অপচেষ্টা চলে মাঝেমাঝে।

নিভৃতা

সামুতে আট বছর আগে কোনভাবে যুক্ত হলেও আমার ব্লগিং জীবন আসলে শুরু জানুয়ারি, ২০২০ থেকে।

নিভৃতা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: আক্রোশ - ০৯

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:০১





তপু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
----জানেন?
----জানিই তো। আমিই মেরে ফেলেছি ছেলেটাকে। আমি খুনি। আমি পাপী।
বলে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন নিয়াজ উদ্দিন। তপু হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো।
নিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী আবার শান্ত হয়ে গেলেন। চোখের জল মুছে বসা থেকে উঠে পড়লেন। লাঠিতে ভর দিয়ে গিয়ে হলঘরের জানালার কাছে দাঁড়ালেন। উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তার উদাস দুটি চোখ অস্থিরভাবে কাকে যেনো খোঁজে চলেছে। শরীরে ধীরতা বাসা বেঁধেছে কিন্তু মনটা আজও বড় চঞ্চল তার। সেই চঞ্চল মনের সবটুকু জুড়ে আজও রয়েছে একটি মুখ। পবিত্র স্নিগ্ধতায় ভরা মায়াবী সেই মুখটাকে পরম যতনে আজও মনের সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছেন তিনি।
নিয়াজ উদ্দিনের মাথার ঠিক নেই। উনাকে আর বেশি না ঘাটিয়ে চুপচাপ হলঘর থেকে বেরিয়ে আসে তপু। মনে মনে ভাবে, সাপের লেজে পা দিয়ে এলো। ছোবল কোন দিক দিয়ে আসে কে জানে। কিন্তু সে চায় ছোবলটা আসুক।
-----
মোহনপুর, ১৯৮৯ সাল।
ওসমান, ফারুক ও তাহের তিন বন্ধু একই কলেজে ক্যামিস্ট্রিতে মাস্টার্স পড়তো। ওসমানের বাড়ি ছিল অনেক দূরের একটি গ্রামে। সে মোহনপুরে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতো। ওসমান ছিল দারুণ মেধাবী। ওসমান আবার ছাত্র রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিল। বোরহান উদ্দিন চৌধুরী তখন তুখোড় ছাত্রনেতা। তারই ডান হাত ছিল ওসমান। সেই সূত্রে চৌধুরী বাড়িতে ছিল ওর অবাধ যাতায়াত। এরই মধ্যে একদিন ওসমান একটা আমের জুস আবিষ্কার করে ফেলল। সবাই সেই জুসের খুব প্রশংসা করতে লাগলো। ফারুক বুদ্ধি দিলো সেই জুসটা দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করার। ওসমান ও তাহের তাতে সায় দিলো। শুরু হলো টাকা সংগ্রহ করা। তিন বন্ধু মিলে অনেক কষ্টে টাকাটা জোগাড় করে ফেলল। শুরু হলো একটি নতুন কোম্পানি "তাওফা ফুড"। কোম্পানিটা ছোটখাটো হলেও অল্প কদিনের মধ্যেই বেশ নাম করে ফেলল। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো তাওফা ফুড। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বন্ধুদের সাথে ওসমানের দ্বন্দ্ব শুরু হলো। ওরা জুসে ক্যামিকেল মিশিয়ে প্রফিট বাড়াতে চায়। কিন্তু তাতে কিছুতেই সায় দেয় না ওসমান।

ওদিকে বোরহান উদ্দিনের দূরসম্পর্কের এক খালাতো বোন চৌধুরী বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করতো। নাম ছিল রজনী। বোরহান উদ্দিনের মা সুরাইয়া বেগম ভেবে রেখেছিলেন রজনীকে ছেলের বউ বানাবেন। বোরহান উদ্দিনও রজনীকে পছন্দ করতেন। রজনী কলেজ পাস করলেই সুরাইয়া বেগম রজনীর বাবা মার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতেন। কিন্তু রজনী বোরহানকে পছন্দ করতো না। চৌধুরী বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে ওসমানের সাথে পরিচয় হয় রজনীর। দুজনেরই দুজনকে ভাল লেগে যায়। ভাল লাগা রূপ নেয় প্রণয়ে। গোপনে চলে চিঠি চালাচালি। প্রণয় ধাবিত হয় পরিণয়ের দিকে। একদিন দুজনে লুকিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে। রজনী চৌধুরী বাড়ি থেকে তো বিতাড়িত হয়ই, নিজের বাপের বাড়ি থেকেও বিতাড়িত হয়। ওসমান রজনীকে নিজের গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। রজনী সেখান থেকে আর মোহনপুরে আসতে রাজী হয় না। সে ওসমানকেও ছাড়তে নারাজ। রজনী চৌধুরী বাড়ির লোকদের ভাল করে চেনে। ওরা কিছুতেই ওসমানকে ছাড়বে না। কিন্তু ওসমান যদি মোহনপুরে না যায় ওর ব্যবসার কী হবে? আর পড়াশোনারই বা কী হবে। তাই ওসমান ঠিক করে পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হলে মা আর স্ত্রী দুজনকে নিয়েই সে মোহনপুরে যাবে। চৌধুরীদের ভয়ে দমে থাকলে চলবে না। তাছাড়া মোহনপুরে তারও অনেক দাপট আছে। সবাই তাকে খুব ভালবাসে। চৌধুরীরা তার কিছুই করতে পারবে না। মাস দেড়েক পর সে মোহনপুরে গিয়ে একটা ঘর ভাড়া করে মা আর রজনীকে নিয়ে আসে।

এদিকে তাহের আর ফারুক ওসমানের সাময়িক অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্যামিকেল মেশানো জুস তৈরি শুরু করে দিয়েছে। সব জানতে পেরে ওসমান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে ব্যাবসা আলাদা করতে চায়। এক পর্যায়ে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়। আর তখনই, মোহনপুরে ফিরে আসার সাত দিনের মধ্যেই নৃশংসভাবে খুন হয় ওসমান। ওর স্ত্রী আর মা সেদিনই মোহনপুর ছেড়ে পালিয়ে যান। ফলে খুনটাও ধামাচাপা পড়ে যায়। ফারুক ও তাহের কোম্পানির কাগজপত্র সব নিজের নামে করে নেয়।
-----
সময় বর্তমান
কুলসুমের বয়স এখন চল্লিশের উপরে হবে। জীর্ণ শীর্ণ একটা ঘরে স্বামী ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে সে। তপুকে দেখে অবাক হলো কুলসুম। এই রকম সাহেব মানুষ তার ঘরে কেন আসছে বুঝতে পারছিল না সে। কোথায় বসাবে কী খাওয়াবে এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ও। তপু একটা চৌকি টেনে নিয়ে বসে বলল,
----আপনি ব্যস্ত হবেন না। কিছু কথা ছিল আপনার সাথে। এখানে এসে বসুন।
কুলসুম তপুর সামনে মাটি দিয়ে লেপা মেঝেতে বসে পড়ে বলল,
----কী বলবেন সাব?
----আপনি তো অনেক বছর আগে চৌধুরী বাড়িতে কাজ করতেন।
----হ। ম্যালা দিন আগে।
----ওসমান আহমেদকে চিনতেন?
কুলসুমের মুখটা কালো হয়ে গেলো।
----আপনি আমাকে সব খুলে বলেন। ভয়ের কিছু নেই। আমি কাউকে আপনার সম্পর্কে কিছু বলবো না।
কুলসুম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
----চিনতাম সাব। বড় বালা মানুষ আসিলো। ঐ বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল। আমার বয়েস তহন চৌদ্দ পনেরো হইবো।
----আর সুরাইয়া বেগমের ভাগ্নী রজনী?
----রজনী আফারে চিনমু না ক্যান? তার লগেই তো হারা দিন থাকতাম। রজনী আফা আর ওসমান ভাই চিঠি চালাচালি করতো। আমিই ঐ চিঠি তাগোরে পৌছাইয়া দিতাম। দুইজন দুইজনরে কী যে ভালা বাসতো। একদিন দুই জনে লুকাইয়া বিয়া কইরা ফালাইলো। খালাম্মা হেইদিন কী যে রাগ করলো। বাড়ির হক্কলে ডরাইয়া কাঁপতে লাগল। খালাম্মার রাগ সবাই জানে। তারপর অনেক দিন চইলা গেলো। হুনলাম ওসমান ভাই রজনী আফারে লইয়া অন্য কুনুখানে চইলা গেসে। কিন্তু তারা আবার ফিইরা আইলো। চৌধুরী বাড়িতেও এই নিয়া খুব ঘুসুর ঘুসুর হইতে লাগলো। তয় আমরা কামের মানুষ, নিচে থাকি সব সময়। তাই কিসু জানতে পারলাম না। তারপরে একদিন ওসমান ভাইয়ের আম্মা আইলো ঐ বাড়িতে। আগে কোনদিন উনি আসে নাই। আমিই উনারে হলঘরে নিয়া বসাইসিলাম। কিন্তু খালাম্মা যখন দেখা করতে নাইমা আইলো দুইজনই দুইজনরে দেইখা অবাক হইয়া গেলো। তারপরে খালাম্মায় ওসমান ভাইর আম্মারে উপরে নিয়া গেলো। ঐহানে কী কথা অইলো হেইডা আর আমি জানি না। পরে দেখসি ওসমান ভাইয়ের আম্মা কানতে কানতে বাইর হইয়া গেলো। এর দুই দিন পরেই ওসমান ভাইরে কে জানি খুন কইরা ফালাইলো। কাইট্টা টুকরা টুকরা কইরা নদীতে ভাসাই দিসিলো। মা গো! হেই কথা মনে অইলে অহনো শইলে কাঁটা দেয়।

তপু অবাক হয়ে কুলসুমের দিকে চেয়ে রইলো। পল্লবের দাদি ওসমান খানের মৃত্যুর দুইদিন আগে চৌধুরী বাড়িতে গিয়েছিলেন এটা সে জানতো না। পল্লবের মা বা দাদী কেউই কথাটা ওকে বলেন নি। এত বড় একটা কথা লুকিয়ে রাখার কী কারন থাকতে পারে?
-----
রমিজ মিয়ার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু বোঝা যায় শরীরে এখন আর আগের জোর নেই। ক্ষয়িষ্ণু চেহারা। রুগ্ন শরীর।
----কত বছর বয়স থেকে আপনি চৌধুরীদের চাকরি করতেন?
----জন্মের পর থাইকাই। আমার বাবাও ঐ বাড়িতে কাজ করতো।
----ওরা যখন মোহনপুরে আসে আপনি ওদের সাথেই ছিলেন?
----হ। চৌধুরী বাড়ির বেশিরভাগ কাজের লোকই উনাদের সাথে মোহনপুরে আসে।
----আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন?
রমিজ আলি একটু অবাক হলো। এই প্রশ্ন সে আশা করেনি। শীতল কণ্ঠে সে জবাব দিলো,
----নাই।
----নাই মানে? বিয়ে করেন নি আপনি?
----করেছি।
----বাচ্চা হয়নি?
----হয়েছিল। দুইটা ছেলে ছিলো আমার।
রমিজ আলি উদাস কণ্ঠে নির্লিপ্ত জবাব দিলো। কিন্তু সেই নির্লিপ্ততার আড়ালে একটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে বুঝতে পারলো তপু।
----ছিলো বলছেন কেন?
----কারন তারা অহন আর বাইচা নাই।
----ওহ! দুঃখিত।
----একজনের বয়স যখন পনেরো সে স্কুল থাইকা আসার সময় গাড়ির নিচে চাপা পইড়া মারা যায়। আরেকজনের বয়স যখন বারো তখন গুটি বসন্ত হইয়া মইরা যায়।
কণ্ঠে শীতলতা কিন্তু চোখে জল দেখা গেলো লোকটার।
---আপনি আর চৌধুরী বাড়িতে চাকরি করেন না কেন?
----বয়স হইসে। অহন আর শরীরে আগের জোর নাই। অকাজের জন্য কে কারে রাখে বলেন।
লোকটার কথায় একটা চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করলো তপু। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে লোকটা কাশছিলো আর হাঁপাচ্ছিলো।
----আপনার শরীর কি খুব বেশি খারাপ?
----হ। মরণ বাসা বানছে শরীরে।
----কী হয়েছে?
----ক্যান্সার।
তপু একটু থমকে গেলো। রমিজ মিয়া আবার একটু কেশে বলল,
----সব আমার পাপের ফল। আর কিসু না। অনেক পাপ করসি জীবনে। প্রথমে দুই বাইচ্চা গেলো। তারপরে বউ। অহন মরতাসি আমি ধুইক্কা ধুইক্কা। মরণের পরেও ধুকমু। আমার পাপের কোন ক্ষমা নাই।
----এই শেষ সময়টায় একটা ভাল কাজ করে যেতে ইচ্ছে হয় না আপনার? হয়তো সেই ভাল কাজ আপনার পাপের শাস্তিটা কম করে দিবে?
----আমার মত পাপীর দ্বারা কুনু ভালা কাজ কি সম্ভব সাব?
----সম্ভব হলে করবেন?
----হ করমু। একটা ভালা কাজ কইরা মরতে পারলে কিসুটা হইলেও শান্তি পাইমু।
-----ওসমান আহমেদকে চিনেন?
চমকে উঠলো রমিজ মিয়া। তারপর কাঁশতে শুরু করলো জোরে জোরে। তপু লোকটার অবস্থা দেখে আর কথা বাড়ালো না। শুধু নিজের ঠিকানাটা দিয়ে বলল,
----যদি কখনো আমাকে কিছু বলতে চান তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
রমিজ মিয়ার ঘর থেকে বের হয়ে এলো তপু। মাথাটা কেমন যেনো জট পাকিয়ে আছে। একটা গিট খুললে আরো দশটা গিট লেগে যায়। সব গুলো ঘটনা একে একে সাজানোর চেষ্টা করলো ও। সুরাইয়া বেগম, বোরহান উদ্দিন, ফারুক, তাহের এদের যে কেউ খুনী হতে পারে। কিন্তু কে যে আসল খুনী তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসেছে আরো একটা সংশয়। পল্লবের দাদির রহস্যময় আচরণ।
-----

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:২৫

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: উফ কী রহস্যরে বাবা
আগাক গল্প
সাথেই আছি

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:২১

নিভৃতা বলেছেন: তোমায় সাথে পেয়ে ধন্য আপুমনি। তোমার জন্য অনেক ভালোবাসা। ভালো থেকো।

২| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:০০

রাজীব নুর বলেছেন: আর একটু গুছিয়ে কি লেখা যায়? বেশ বেগ হতে হয় বুঝতে।

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:২৩

নিভৃতা বলেছেন: ঠিক বলেছেন। আরো গুছিয়ে লেখা শিখতে হবে। মন্তব্যে ভালো লাগা। ভালো থাকবেন।

৩| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:১৬

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অতুলনীয় উপস্থাপন

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:০০

নিভৃতা বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকুন।

৪| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৩৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ঘুর্ণি উঠেছে প্রবল.....

রহস্য জটা পাকাচ্ছে...

যাই সামনে :)

+++++++

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:৫১

নিভৃতা বলেছেন: আপনার মন্তব্য ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। ভালো থাকবেন সব সময়। শুভ কামনা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.