![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চৌধুরীদের বোটটার সাথে বিভু তাল মিলিয়ে হাটার চেষ্টা করছে । খুব একটা সমস্যা হচ্ছেনা। নদীতে এখন খুব স্রোত । স্রোতের বিপরীতে যেতেই বোটটি তার অর্ধেক শক্তি হারাচ্ছে । শঙ্খ নদীর পাশ ঘেঁষে গ্রাম । রাস্তাটি নদীর পারেই। বোটটি আবার ওপারে যাচ্ছে যাত্রী তোলার জন্য । বিভু নদীর অপর পারে চক্রবর্তী ঘাটে দুজন লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখল। যাহ্ , বোটটির সাথে হাটতে গেলে স্কুলে দেরী হয়ে যাবে বলে সে জোরে পা চালাল।
বিভু কখনও বোটে করে কোথাও যায়নি ।সত্যি বলতে কি সে স্কুল পর্যন্ত রাস্তাটাই ভালো মত চিনে।স্কুল ফেলে রাস্তাটি যে কোন কোন দুর জায়গায় গেছে তাদের নামগুলি বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে সে জানে বাকিটা কল্পনা করে নিয়েছে ।বাড়ি থেকে বেশি দূরে সে যায়না কখনও । ওর ক্লাসে অনেক ছাত্র আছে যারা প্রতিদিন অনেক দূর হতে বোটে করে আসে। এই তল্লাটে একটাই স্কুল । দূরদূরান্ত থেকে ছাত্ররা আসে। অনেকের বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় দেখে তার ঈর্ষা লাগে। ঈশ্ , তার বাড়িটা কেন যে স্কুল থেকে দূরে হয় নাই। তাহলে সে প্রতিদিন বোটে করে স্কুলে আসত। বেড়ানোও হত।সে যখন স্কুল গেইট এ বোটটি অনেক পিছনে।
গত কয়েকদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে ।নদীর পানি বাড়ছে । নদীর পানি বেড়ে গেলে উজান থেকে বড় বড় গাছের টুকরো ভেসে আসে। গাঁয়ের বলশালী যুবকেরা তখন প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়া গাছের টুকরো গুলি সাতরে ধরে কুলে নিয়ে এসে বিক্রি করে। উজানে লোকজন গাছ কেটে গাছের টুকরো নদীর পাড়ে জমিয়ে রাখে কারন এগুলো বোটে করে ভাটিতে বিভিন্ন স'মিলে বিক্রি করবে। তাই বর্ষাকালে হঠাত্ নদীর পানি বেড়ে গিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়লে পানির সাথে ঐসব গাছের টুকরো জ্বালানি কাঠ ভেসে চলে আসে। তখন উৎসবের মতো হয়। মানুষের মুখে মুখে তখন কে কত বড় গাছের টুকরো ধরল, কে কতবড় সাঁতারু , কে বীরত্ব দেখাল এইসব। বিভু স্বচক্ষে এসব দেখেনি । সব তার শোনা । মানুষের কীর্তি লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে বাড়ির অন্দরমহলে চলে আসে। মেয়েমহলে এসব আরও না না রংএ রাঙ্গিয়ে ভোর হতে রাত অব্দি আলোচিত হয়। নদীর পানি যখন বাড়ে তখন বিভুর নদীর পাড়ে যাওয়া নিষেধ । তার উপর এরকম অনেক নিষেধাজ্ঞা ।অথচ বিভুর সমবয়সী অন্য ছেলে মেয়ের বাবা মারা এমন করেনা। তারা দিব্যি চুটিয়ে স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে নারীদের কাছে যে বর্ণনা পায় তাতে তার একটু ভয়ও হয়। মনে হয় নদীর পাড়ে গেলে একটু পা ফস্কালেই ভেসে যাবে।
টিফিন পিরিয়ডে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। অনেক ছাত্র-ছাত্রী নদী পথে স্কুলে আসে। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে প্রধান শিক্ষক অমিয় বাবু তাদের স্কুলে আটকে রাখতে ভরসা পাননি। তিনি কয়েকদিন স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন
হঠাত্ ছুটি পেয়ে বিভুর ভাল লাগছিল না। স্কুল বন্ধ মানে সারাদিন ঘরে বসে থাকা। বসে বসে সারাক্ষণ ইংরেজি
ট্রান্সলেশন মুখস্থ করতে হবে ভেবে তার মন আজ বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তার ক্লাসের ছেলেরা ক্লাস এইট এর সাথে ফুটবল ম্যাচ নিয়েছে।সে বাড়ি না গিয়ে। খেলা দেখবে বলে মনস্থির করল। সে জানে কিছুক্ষণ পর দাদু তাকে খুঁজতে আসবে। তাই সে স্কুলের বারান্দায় এমন এক জায়গায় গিয়ে বসল যাতে রাস্তা দিয়ে আসার সময় দাদুকে দেখতে পায়। দাদু আসলে সে লুকিয়ে থাকবে। দাদু রাগ করবে। করলে করুক আজ সে খেলা দেখবেই দেখবে।
এই , বিভু, বাড়ি যাবি না?
বিভু ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফিরোজ তার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে । ফিরোজ হচ্ছে তাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ছেলে । তার বাড়ি উজানে ।সে কৌতুহলটা বুঝতে পারেনি এমনভাবে বলল , খেলা দেখব।
খেলা দেখবি ? শব্দ দুটো ফিরোজ এমনভাবে আওড়াল যেন সে খুব অবাক হল। প্রশ্নটা যেন সে নিজেকে করল।
কেন , আমি খেলা দেখতে পারি না ?
পারবি না কেন ? কিন্তু কখনও তোকে দেখিনাতো তাই জিজ্ঞেস করলাম।
এখন থেকে আমি সব খেলা দেখব ।বিভুর এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাক্য শুনে ফিরোজ খুব অবাক হয়। আজ , বিভু , তোর কি হয়েছে বলতো দেখি ?কিছু হয়নাই তো ।অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে ।বললাম তো কিছু হয় নাই। বলে বিভু ফিরোজের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে খেলায় মনযোগী হল। ফিরোজ তাকে আর ঘাটালো না।দূর থেকে চোখে চোখে রাখল।
বিভু ভেবেই নিয়েছিল ক্লাস এইট তাদের সিনিয়র বলে তারা খেলাই জিতবে ।কিন্তু ক্লাস সেভেন যখন একটি গোল দিল সে নড়েচড়ে বসল উত্তেজনায়। তার মনে হলো আসলেই তো তারা ক্লাস এইট এর চেয়ে ভাল খেলছে । সে পূর্ণ মনযোগ নিয়ে খেলাই ডুবে গেল। ক্লাস সেভেন আরও একটা গোল দিল। বিভু উত্তেজনায় কাঁপছে ।এসময় ফিরোজ মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে যেন ঘুম থেকে জাগাল। এই , বিভু। বিভু উত্তেজিত ভাবে বলল , কি ?তোর দাদু আসছে , দেখ।বিভু দেখল সত্যিই দাদু আসছে। সে করুন চোখে ফিরোজের দিকে তাকাল। ফিরোজ বলল , আয় আমার সাথে।কোথায় ?চল , গেলেই দেখতে পাবি।ফিরোজ বিভুর একহাত ধরে টানতে টানতে স্কুলের পিছনে নিয়ে এল।বিভু বলল , দাদুতো স্কলে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে ।তুই এখানে দাড়া , তোর দাদু কোথায় আমি দেখে আসি।ফিরোজ দেখল বিভুকে খূজে খুজে তার দাদু এগিয়ে আসছে ।সে বিভুকে স্কুলের পিছন দিয়ে হাঁটিয়ে রাস্তায় নিয়ে এসে বলল , চল্ , আশ্রমে যাই।আশ্রমে ?তা নয়তো কি। তুই এখানে থাকলে তোর দাদু দেখে ফেলবে না ? তোকে বাসায় নিয়ে যাবে তো।যাবি ?কিন্তু আশ্রম তো নদীর ওপারে , নৌকায় করে যেতে হবে ।তাতে কি হয়েছে ?নদীতে এখন স্রোত তো।আরে রাখ তোর স্রোত । তুই একটা ভিতুর ডিম । নদীপথে আমি প্রতিদিন স্কলে আসি না । তুই সাঁতার জানিস ?হ্যাঁ ।তাহলে আর চিন্তা কিসের ?বিভুর একটু ভয় ভয় লাগছে কিন্তু সে যে ভিতুর ডিম নয় সেটা প্রমাণ করতে জোর করে সে সাহসী হল।
নৌকা যখন মাঝ নদীতে এল ততক্ষণে বিভুর সমস্ত ভয় মুছে গিয়েছে ।ঘোলা পানিতে ঘোল কালো বর্ণের নৌকাটা নদীর মাঝখানে যেন পটে আঁকা ছবি ।বাতাসে পালটা শব্দ করে উড়ছে ।নদীর গর্জনে সব শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে ।কেবল বৈঠা আর পানির রিন রিন শব্দ শোনা যায় ।উফ্ , কি সুন্দর !সুন্দর না কচু। পানি ঘোলা। শীতকালে আমার সবচেয়ে সুন্দর লাগে। পরিষ্কার পানি। নীল আকাশের ছায়া দেখা যায় পানিতে । শুভ্র মেঘ ভেসে বেড়ায় আকাশে । নদীর তর্জন গর্জন নাই। কুয়াশা , হীম বাতাস। আর এখন , পুরো পাগলাটে , জংলী একটা নদী ।বিভু ফিরোজের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।আজ এখানে না আসলে ফিরোজের ভি তরের এই কোমলতা বোধহয় কখনও জানতে পারত না।
নদী পার হয়ে দুজনে জংলী রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। বিভু আগে কখনও আসেনি । ফিরোজ বলল , সাবধানে চলিস , চিকনা জোঁক আছে । জোঁকের নাম শুনে বিভূর সমস্ত শরীর শির শির করে উঠল।আগে বলিস নি কেন ?কি আগে বলিনি ?এই জোঁকের কথা।বললে কি হত । তুই তো দেখি আমাদের গ্রামের কলংক।গ্রামের ছেলে আবার জোঁক দেখে ভয় পায় নাকি ? সেদিন শহর থেকে মামা এসেছিল বেড়াতে ।সাথে মামাতো দুই ভাই। এমন ভিতু জন্মে দেখিনি।মাছ ধরবে মাছ ধরবে বলে আমাকে জ্বালাচ্ছিল।জাল নিয়ে ঝিলের পাড়ে এসে যখন বলি , সাবধান জোঁক আছে।দেখি দুটোর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে।এমন রাগ হল বললাম সাপও আছে কিন্তু ।শোনা মাত্র ছোট টা বাড়ির দিকে এমন ভোঁ দৌড় দিল একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি ।বড়টা আমার বয়সী ।লজ্জার খাতিরে যায়নি কিন্তু থাকতে ও চায় না ।সে বলল , কিছু মনে করো না। ও একটু ভিতু , আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসি।বলে আর এক ভোঁ দৌড়।হা- হা-হা ।ফিরোজ এমন ভাবে বলল বিভুর হাসি এসে গেল।
বিভু প্যান্টের পায়া গুটিয়ে নিল।ফিরোজ কিছুটা এগিয়ে গেছে । বিভু দেখল বূনো রাস্তা যেলকম হয় সেরকম রাস্তা ।সবুজ ঘাসে ঢাকা ।মানুষ চলতে চলতে তাদের পায়ের ছাপ তৈরি হয়েছে ।সে জোরে হাঁটা শুরু করল।রাস্তার দুপাশে নানা ধরনের জংলী ফুল।কিছু ফুল ছিড়ে বিভূ তার পকেটে পুরল।সে ভাবছে তার ফুলের গাছগুলোর কথা যেগুলো লাগিয়েছে বাড়ির উঠোনে ।মোরগ , গাদা আর বারোটা ফুল।তার মনে হচ্ছে অযত্নে বেড়ে উঠা এই জংলি ফুলগুলো তার সযত্নে লাগানো ফুলের চেয়ে কোন আংশে কম নয়।ফিরোজের তাড়ায় সে জোর পা ফেলে হাঁটতে লাগল।
বিভুর একটু ভয় করছে ।তাকে নিয়ে বোধহয় খোঁজাখুজি শুরু হয়ে গেছে এতক্ষণে ।কথাটা ফিরোজকে বলার সাথে সাথে সে বলল , তুই এত ভিতূ বলেই তোকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না। বাড়ির চিন্তা এখন মাথা থেকে ফেলে দে।বিভু বলল , কি আছে আশ্রমে ?ফিরোজ একটু লাজুক হাসল।মূখে একটূ রকাতিম আভা খেলে গেল ।বলল , চল্ না , গেলেই দেখতে পাবি। তারপর বিভুর পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল , আরে তোকে তো জোকে ধরেছে ।বিভু পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল দুটি জোঁক রক্ত খেয়ে ফুলে ফেপে উঠেছে ।সে ফিরোজের দিকে তাকাল অসহায়ের মতন।ফিরোজ বলে ভয় করে ? বিভু বলে , ঠিক তা না।জোঁক , সাপ এগুলোকে আমার ঘেন্না করে।ফিরোজ নিজের হাতে জোঁক দুটি ফেলে দিল।বিভু বলে , আমি যখন আশ্রমের কথা বলি তখন তুই লজ্জা পেলি কেন ? ফিরোজ উত্তর না দিয়ে হাসল।বিভু আর কোন প্রশ্ন না করে হাঁটতে লাগল।
চারদিকের নীরবতায় কেবল তাদের পায়ের শব্দগুলোই প্রমাণ করছে জঙ্গলে তারা ছাড়া আর কোন মানুষ নেই । কিছু জানা-অজানা পাখির কিছির-মিছির শব্দ শোনা যাচ্ছে ।গাছের শাখায় দুলতে দুলতে কখনও গম্ভীর ভাবে ডেকে উঠছে কৌন ঘুঘু ।চারদিক এমন নীরব বাতাসের মৃদু শব্দ পর্যন্ত শোনা যায় ।পায়ের নীচে শুকনো পাতার খস খস শব্দকে মনে হচ্ছে সংগীত ।একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। জানতে ও ইচ্ছে করছে না আশ্রম আর কতদূর ।ইচ্ছে করছে এমন নীরবতায় অনন্তকাল ধরে শুধু হেঁটে যেতে ।নীরবতা যে কি ভয়ংকর সুন্দর হতে পারে তা এই জঙ্গুলে পথে না হাঠলে বিভু কখনওই জানতে পারত না।এখানে নিয়ে আসার জন্য মনে মনে সে ফিরোজকে ধন্যবাদ জানাল।
প্রকৃতিতে বিভোর বিভূর তন্ময়তা ফিরোজ টের পেয়েছিল ।তার নিজের ও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সে কখনও কথা বলতে চায় না।সে শুধু আশ্রমবালিকা ললিতার কথা ভাবতে চায়।বিভুর উপর সে খুশি হল ।তারা প্রায় পনেরো মিনিট হেটে এসেছে ।অন্য কেউ হলে আর কতদূর আর কতদূর বলে পনেরো হাজার বার প্রশ্ন করে তার কান ঝালাপালা করে দিত।বিভূ তা করেনি ।তার বুক উত্তেজনায় লাফাচ্ছে। আর একটূ পরেই ললিতার সাথে তার দেখা হবে ।সে জানে বড়রা একে প্রেম বলে ।তবে তার বয়সীদের জন্য তা নিষিদ্ধ । সে বড়দের ঐ নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে।তার ভয় করে গিয়ে যদি ললিতার দেখা না পায়।মাঝে মাঝে ললিতা অন্য আশ্রমে যায় ।ললিতাকে সে বুঝতে পারে না।সে গেলে ললিতা সত্যই খূশি হয়।কিন্তু কোনদিন এতদিন আসনাই কেন বা আবার আসিও এ ধরনের কথা বলে না।তার আসা যাওয়ার কোন গুরুত্বই যদি ললিতার কাছে না থাকে তবে সে গেল কেন ললিতা খুশি হয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো কথা বলতে বলতে আশ্রমটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় ? ফিরোজ লক্ষ্যে করেছে আশ্রমে তাদের বয়সী কোনও ছেলে মেয়ে নেই।তাই বোধহয় সে গেলে ললিতা খুশি হয়।ললিতার মনে এর বাইরে আর কিছু নেই ! ললিতা তার কিশোর মনের এক গোপন বেদনার নাম।নিজেকে সে প্রবোধ দেয় সে যে মুসলিম এটাই হয়তো কারণ।
আশ্রমের গেট খুলতেই দেখল ডানদিকে নবীন গোঁসাই একমনে কাজ করে যাচ্ছে ফুলের বাগানে ।গেট খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখে একটূ হাসল।জিজ্ঞাসা করল , নতুন গোঁসাই এর নাম কি ?ফিরোজ বলল , বিভু।ভাল ভাল ,আমাদের একজন গোঁসাই বাড়ল।সামনে যেতে ইশারা করে আপন মনে আবার কাজ করতে লাগল।
আশ্রমে সবাই কিছু না কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।ললিতার কিজ আশ্রমের গাভী তিনটার দেখাশোনা করা।ফিরোজ বিভুকে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।ললিতাকে দেখে এতক্ষণ যে গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল তার থেকে মুক্তি পেল।Eআশ্রমটা সুন্দর সাজানো গোছানো ।বিভু তাই দেখছিল ।তার কিছে অচেনা বলে ফিরোজ যেদিকে নিচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছে ।সে বুঝতে পারল ফিরোজ এখানকার সবাইকেই চিনে এবং তারাও। সবাই কেমন ধ্যানে মগ্ন ।তার সাথে কেউই কোন কথাই বলল না।অনেকেই ফিরোজকেও এড়িয়ে গেল ।গোয়াল ঘরের পাশে এসে দেখল তাদেরই বয়সী এক মেয়ে গরুকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত ।তাদের পদশব্দে যখন সে পিছনে ফিরে তাকাল তখন বিভু মনে মনে বিষম খেল।এমন সুন্দর মেয়ে সে জীবনে দেখে নি।তার সৌন্দর্যকে বর্ণনা করাও তার কাছে দুরহ।
মেয়েটি তাদের দেখে এগিয়ে এল।বিভুকে দেখিয়ে ফিরোজকে জিজ্ঞাসা করল , নতুন গোঁসাইটা কে ?
আমার বন্ধু , আমরা একসঙ্গে পড়ি।
তাই , এবার বিভুকেই প্রশ্ন করল , নামটা কি তোমার গোঁসাই ?
রুপ সৌন্দর্যে বিভোর বিভুর ললিতাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে ।জানে সে কথাটা বলা ঠিক হবে নি।তার বয়সীদের এধরনের কথা বলা ঠিক না।তবু আজ তার মন বিদ্রোহী । আজ কোন নিয়ম না মানার প্রতিজ্ঞা সে আগেই করে রেখেছে ।ললিতা তাকে নাম জিজ্ঞাসা করেছিল।ললিতার চোখে চোখ রেখে সে বলল , তুমি খুব সুন্দর ।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ললিতা ।তার হাসি থামতেই চায় না। বিভুর নিজেকে বোকাবোকা লাগছে ।
যে কথাটা বলবে বলবে করে এতদিনে ও বলতে পারেনি ফিরোজ সেটা প্রথম দেখায় বিভুর বলে দেওয়াটা তাকে হতবুদ্ধি করে দিল।
ললিতা হেসেই যাচ্ছে দেখে এবার বিভুর মন রেগে যেতে আরম্ভ করল। কর্কশ স্বরে সে বলল- হাসি থামাও বলছি।
সেই স্বরে কি পেল ললিতা তা সেই জানে। হাসি থামাল বটে তবে একটুখানি ঝুলেই রইল। বলল , এমন একটা দামি কথা এভাবে খালি হাতেই বলে দিলে ?
মানে ?
বলছি এধরনের কথা বলার সময় সাথে একটা উপহার দিতে হয় তো।
বাহ্ , আমি জানতাম নাকি যে তোমার মত কাউকে এখানে পাব ?
তাহলে বললে কেন ?
বিভু আজ হার মানবে না। কিছুতেই না।কি যে করা যায় সে ভাবতে লাগল। ললিতা যে খেলা শুরু করেছে তাতে তাকেই জিততে হবে। হঠাত্ তার মনে পড়ল বুনো ফুলগুলোর কথ। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফুলগুলো মুঠোয় পুরে সে মুঠোটি ললিতার দিকে বাড়িয়ে খুলে দিল।বলল , এতে চলবে ?
বিলক্ষণ । হার মানলাম। স্বয়ং ভগবান আজ তোমার সাথে আছেন ।
ললিতা এবার সহজ হল।বলল-আজ তোমাদের সময় দিতে পারব না। রাতে কীর্তন হবে। আয়োজনে ব্যস্ত সবাই ।অতিথি তোমরা । খাবে চলো।খাওয়ার পাট চুকিয়ে ললিতা তাদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল।গেট বন্ধ করার আগে বলল- আবার এসো গোঁসাই ।
ললিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুদুর এসে বিভূ বলল , ভাবাই যায় না এরকম সুন্দর একটা মেয়ে আশ্রম বাসি হয়ে জীবন কাটিয়ে দিবে।
ফিরোজ বলল , ও আশ্রম বাসি না। ওকে কেউ দীক্ষা দেয়নি । ব্যাক্তিগত কোন বিপদের কারনে আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে। চলে যাবে যে কোনদিন।
ফিরোজ ভাবছে "আবার এসো গোঁসাই " কথাটা ললিতা কাকে বলেছে ।তাকে তো কোনদিন বলেনি। নিশ্চয়ই বিভুকে বলেছে ।তার কষ্ট হচ্ছিল খুব ।অনেক প্রিয় জিনিস হারানোর কষ্ট ।অনেক কষ্টে নিজেকে সহজ করে গম্ভীর মুখে পাশাপাশি হাটা বিভুকে জিজ্ঞাসা করল , এমন চুপচাপ কি ভাবছিসরে , বিভূ ?
বিভু বলল , বাড়িতে আজ কি কুরুক্ষেত্র হবে সেকথা ।
কথাটা শুনে কষ্টের মাঝেও ফিরোজের হাসি পেল।
হাসনা বানু আব্দুলের কাছে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে শুনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন।বৈঠক খানায় কয়েকজন দর্শনার্থী ছিল ,তিনি এড়িয়ে গেলেন। দ্রুত স্কুলের পথে চললেন।তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে । বর্ষার দিন।ভরা নদী ।বাধ ভাঙা জোয়ারের মত ছুটে আসা স্কুল ফেরত ছাত্র-ছাত্রীদের মুখ তন্নতন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে মাঠে এসে দেখলেন অনেকে ফুটবল খেলছে।তাদের মধ্যে না পেয়ে স্কুল বারান্দায় বসে খেলা দেখা কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন ফিরোজের সাথে বিভু স্কলের পিছনে গিয়েছে । স্কুলের পিছনে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে স্কুলের পেছন দিয়ে মুল রাস্তায় যাওয়ার ঘাস উঠে যাওয়া সরু রাস্তার উপর হঠাত্ চোখ পড়ায় তার মন আজানা আশংকায় হঠাত্ দমে গেল ।সরু পথ ধরে দ্রুত রাস্তায় এসে এবার কোথায় খুজবেন ভেবে পেলেন না। বিভু যদি এই লুকোচুরির খেলাটা না খেলত তাহলে তিনি হয়তো ভাবতেন বিভু বাড়িতেই গেছে কিন্তু এখন ভাবতে সাহস পেলেন না। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা কখনও কল্পনাতেও আসেনি।বিভু চোখের আড়াল হলে তিনি কখনোই স্বস্তিতে থাকেন না।তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন কি করে বিভুর খোজ মিলতে পারে।চোখের সামনে সব স্কুল ফেরত ছাত্র ছাত্রী । এদের মধ্যে কাকে জিজ্ঞাসা করবেন। আকাশের অবস্থা ভাল না। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। ভরা নদী।হঠাত্ তার মনে হল বিভু কি তবে ফিরোজের সাথে তাদের গ্রামে গেছে ? ফিরোজের বাড়ি গেলে বোটে যেতে হবে।তিনি ঘাটে চলে আসলেন।কোন বোট নেই ।একটা মাত্র নৌকা বাঁধা ।তাতে হারান নৌকার ভিতরকার পানি সেচে বাইরে ফেলছিল। হারান হাসনাবানুকে দেখে কাজ থামিয়ে জিজ্ঞেস করল ,কি দাদি ,নাতি খোঁজ ? তিনি মাথা নেড়ে সায় জানাতেই হারান আঙুল মাঝনদির দিকে তাক করে।হারানের ইশারা অনুসরন করে তিনি বিষ্ময়ে বিমুঢ় হলেন।বিভু আর ফিরোজ মাঝ নদিতে নৌকোয়। বিভূর মুগ্ধতা এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে ।হারানের নৌকা নিয়ে পিছু নিবেন ভেবেও তিনি পিছিয়ে এলেন । তার মনে হল বিভূ নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে।হারানকে জিজ্ঞেস করলেন , ওরা কোথায় যাচ্ছে তুই জানিস্? হারান বলল , মনে হয় আশ্রমে । ফিরোজকে প্রায় সময় একলা যাইতে দেখি।আজ তোমার নাতিরে জোটাইছে। ওরা আশ্রমে কি জন্য যায় ? তা জানিনা দাদি।তবে আশ্রমে বাচ্চারা গেলে লাড়ু খৈ মুড়ি দে। ঔসব খাওয়ার লোভে যায় মনে হয়। ব্যাখ্যাটা হাসনাবানুর মনপুত হল না। আশ্রমের ব্যাপারে খোজ নিবেন বলে তিনি মনে মনে ঠিক করলেন । খাওয়ার লোভে আশ্রমে যেতে বিভু এতদিনের অভ্যাস ভেঙে রাজি হবে না।ফিরোজ অন্য কিছুর কথা ভেবে তাকে এ সাহসী কাজে উৎসাহ জুগিয়েছে।কিন্তু তার ঘূর্নাক্ষরেও মনে হল না আজ বিভুর কারো উৎসাহের প্রয়োজন ছিল না।কিছু করতে সে উন্মুখ হয়েই ছিল। এখন অল্পেই হাঁফ ধরে। বাড়ি আসতেই হাফিয়ে গেলেন।বৈঠখ খানা খালি। তিনি স্বস্তি পেলেন।এ মুহূর্তে কথা চালানোর অবস্থায় তিনি নেই। নিজের ঘরে এসে তিনি একাকী বসলেন। বিভূকে ছাড়া বাড়ি ফেরা এবং কারো সাথে কথা না বলে নিজের ঘরে চলে যাওয়া জেবুন্নেসাকে অবাক করে। শাশুড়ির মুখের ভাব লক্ষ্য করে তাঁকে প্রশ্ন না করে তিনি মনুকে ডেকে সবিস্তারে ঘটনা জেনে নিলেন। বিভুকে না ফিরিয়ে তাঁর একাকী চলে আসা তাকে উদ্বিগ্ন করে। মনুকে বিভূর খোঁজে না পাঠিয়ে শাশুড়ির মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করতে করতে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলেন। বিভূকে নিয়ে তার তেমন চিন্তা হচ্ছে না।তার ধারনা বিভু যথেষ্ট বড় হয়েছে । শাশুড়িই বোঝার চেষ্টা করছেন না।আজ যা ঘটল একদিন তা ঘটতই।তবে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন সেটা অনুমান করা যাচ্ছে যদিও তার চেহারায় তার প্রকাশ ঘটবে না।বিভু ফিরে আলে তাকেও হয়ত কিছু বলবেন না।বকাতো দেবেনই না।বিভুকে তিনি আগলে রাখেন ঠিকই তবে সীমাহীন মায়া দিয়ে সেদিন অনেক ভয় মনে নিয়ে বাড়ি ফরে বিভূ।
এরকম একটা কান্ড ঘটানোর কারনে অপরাধ বোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।দাদুর সামনে যেতে তাল লজ্জা লাগছিল বলে সে ঘরের পিছনের কূয়োঘাটে একা একাবসেছিল।খুব অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে সে তখন যাচ্ছিল।নিজকে খুব একা লাগছিল।একদিকে যখন মানুষের অসহায়ত্ব বোধে কুয়ো পানি ,নিচের মাছ আর গাছের পতারা প্রকম্পিত তখন বিভূকে নিয়ে পুরোবাড়িতে তোলপার শুরু হয়েছে। নৌকা ঘাটে খবর নিয়ে জানা গেল শেষ বিকেলের দিকে তারা নদী পার হয়েছে । পথে দুই-একজন বলল তারা বিভুকে বাড়ির পথে যেতে দেখেছে।তাহলে গেল কোথায় ? চার দিকে লোকজন চলে গেছে খুঁজতে ।
হাসনাবানু সেই তখন থেকে ঘরে বসে আছে।কারও সাথে টু শব্দটি করছেন না।তিনি যদি নৌকা নিয়ে বিভুর পিছু নিতেন তাহলে এসব কিছুই হয়তো ঘটত না ।কিন্তু তিনি নিজেকে দোষ দেয়ার চেষ্টা করছেন না।ঘাটে দাড়িয়ে মাঝ নদীতে তিনি বিভুর যে উদ্ভাসিত চেহারা দেখছেন তা বিভুকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে তাকে উৎসাহ জুগিয়েছে ।বিভূর এমন রুপ তিনে দেখেছেন কিনা মনে পড়ে না।বিভূর সামনে যেন হঠাত্ বন্ধ পৃথিবীর দুয়ার খুলে গিয়েছিল যা তাকে বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ করেছিল।তার চোখের সামনে এখনো সেই চেহারা ভাসছে। তার মন বলছে বিভুর কোন বিপদ হয় নি।নৌকা পার হয়ে বিভুকে একা বাড়ির পথে দেখা গেছে ।সে যাবে কোথায় ? হঠাত্ তার সন্দেহ হল ,বিভু বাড়িতে লুকিয়ে নেই তো ! খাটে তিনি আধশোয়া অবস্থায় ছিছেন । উঠে বসলেন ।তারপর কাউকে কিছু না বলে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলেন ।ক্রমে তাঁর ধারনা জোরালো হতে থাকল।বাড়িতে না পেয়ে কুয়োর ঘাটে এসে বিভুকে দেখতে পেলেন।বিভু তাঁকে দেখা মাত্র ঝাঁপিয়ে কোলে পড়ে হুহুকরে কেঁদে দিল।তিনি পরম মমতায় নাতিকে আঁকড়ে ধরলেন।
*****************************
©somewhere in net ltd.