নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিমগ্ন নির্জন

নিমগ্ন নির্জন › বিস্তারিত পোস্টঃ

তিসরি-মঞ্জিল

২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২২



সত্যনারায়ণ কুন্ডু'র তখন রমরমা কাসা-পেতলের ব্যবসা। ষ্টিলের বাসন পত্রের ব্যবহার তখনো আসেনি। একটুআধটু এলুমিনিয়াম-হিন্দোলিয়াম এর বাহারী বাসন আসছে বাজারে। বাংলাদেশ থেকে অঝোর উদ্বাস্তুর ভিড় লেগেই আছে। অভাবে তাদের শেষ সম্বল কাঁসা-পেতলের ঘটি-বাটি-থালা বিকিয়ে যাচ্ছে জলের দামে। রাতারাতি আরো ফুলে ফেঁপে উঠছে আমাদের সত্যেন দাদু। এর সাথে চোরাপথে বাংলাদেশের পুরনো জাহাজের খোল ভাঙা পিওর তামা- পেতলে'র চাঙ্। হা গোবিন্দ,- এত পয়সা রাখি কোথায়। মাত্র তিনটে ছেলে চারটে মেয়ে। একাধারে রাস্তার দুপাশ জুড়ে আনাচে কানাচে, বাজারের মুখে সস্তায় দোকান ঘর কিনতে থাকলেন সত্য দাদু। ও দিকে চালে'র সাথে পাথর গুড়ো, সিমেন্টের সাথে গঙ্গামাটি, আটার সাথে পচা খুঁদের গুড়ো পাইল্ দিয়ে কত মানুষ 'পাতিলোগ' থেকে 'বাবুলোগ' হয়ে গেল ! দোকান ঘরের কাছাকাছি সারবাধা তিন ছেলের জন্য জম্পেশ তিনখানা বাড়ি বানিয়ে সত্যদাদু ঘুমের মধ্যেই ," টক করে টোক(ষ্ট্রোক)" হ'য়ে এই পোড়াকপালে চোরাচালান খ্যাত সীমান্ত শহর ছেড়ে সোজা আদি সত্যনারায়ণের কোলে উঠে পড়লেন। পড়ে রইলেন সত্য ঠাকুমা--লক্ষী দেবী-- ।
--হাঁ গোবিন্দ,--লক্ষী ছাড়া সত্যনারায়ণ তুমার কী কাজে লাগবে!--ওগো যাওয়ার সময় বলে যেতি পরলে না গো,--ওগো তুমার কুতায় কী আছে--- কত টাকা কুতায় লুকোয়ে রেকে তুমি না বইলে চইলে গেলে গো---- এ তুমার কী অলুক্কুনে মন ফ্যালানি গো------
©
ফটাফট্ তিন ভাইয়ের ব্যবসা আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো মা কে নিয়ে ! বাড়ি তো তিনটে,--কিন্তু মা,- লক্ষীবুড়ি থাকবে কোথায়! অনেক আলোচনা করে একমাস করে তিন ছেলের বাড়িতে পালা করে থাকার ব্যবস্থা হ'লো। ততদিনে ঠাকুমার মাজা বেঁকে গেছে, চোখ পুরো অন্ধ। সারাদিন বারান্দার কোনে মশারীর মধ্যে শোয়া-বসা-হরিনাম----।
" আমার সেদিন কবে হবে, আমি আশার আশে, ও দয়াল-- আছি বসে,--আমার সেদিন কবে হবে...."
©
বুড়ী বয়সে শালীর জম্ম ক্ষিদে বেড়েছে।

যত খাওয়া ততো হাগা। বেশি হাগলি রাত্তির জাগা।
বেশি জলে হিশি বাড়ে। রাত দুপুরি জ্বালায়ে মারে।

জানুয়ারি মাসের একত্রিশ তারিখের রাত পোহানার শীত ভোরেই বড় ছেলের তিন পুত্র,--কানাই-কেষ্ট-বলাই চ্যাঙদোলা করে অকম্মা ঠাকুমার ঠ্যাং-মাজা-ঘেটি ধরে মেজকাকার বাড়ির গেটে বসিয়ে দিয়ে যায়।
--ওরে দুমুষ্যে বিটারা,-পাছায় কনকনে ঠান্ডা নাগে তো----! ওরে ইট্টু রোদ উঠার ও টাইম দিসনে তুরা। পাছার নীচে দু'আঁটি বিচুলি গুঁজে দে--- সুনা-মানিক আমার !
--পাছায় ঠান্ডা লাগা শরিরীর পক্কে ভালো, আর এই ঘন কুয়াশায় চামড়া ভালো থাকে,--ঠাম্মা'---- বলতে বলতে ওরা নিজেদের বাড়ি ঢুকে গরম লেপের তলে সেটকে যায়। পাশের বাড়ির মেজ ছেলের দরজা খোলার অপেক্ষায় বসে থাকেন লক্ষী দেবী। রাস্তার তিনটে কুকুর বুড়ীর গা ঘেঁষে কুন্ডুলী পাকিয়ে বসে একটু অতিরিক্ত ওম্ এর আশায়--!
--মানুষের টাকা'র ওম্--মানুষের মনুষ্যত্বের ওম্--মানুষের পাপের ওম্----!!
©
--এসে পরিছেন ! আহারে,- আজ তো ফেব্রুয়ারি 'র এক তারিখ। এ্যাদ্দোম খিয়াল ছেলো না,--এই পুড়ামুকো নিতাই- গুপাল বুড়িরে ধরে দুতালা'র বারান্দায় তোল্--এই যে শোনেন বারান্দার কুনায় চুপচাপ বসপেন,--চা- চা করে পাড়া মাতায় তোলবেন না,--আমরা একুন অকেশান্ ছাড়া চা খাইনে-।--আমি সব কাজ সামলে চাটাই দিবানি--আপাতত পরিষ্কের খালি মেঝের পরে ইট্টু ঘুমোয় নেনগে-- একবারে দুকু্রি ভাত দিবানে----আর হাগা পেলি ঐ বাইরির বাতরুমির তি, বিন্দাবন তে আনা,- লাল রঙের তুষবস্ত্র আছে---বারবার ধু'তি হয়না , দুবার ঝাড়া দিলিই শুদ্ধ--ঐডা পরে হাগা-মুতা সেইরে নেন।--আপনি তো আবার কানার মরণ-- বলি ও নিতাই-গুপাল তোর বাপের এ পাপ সরাবি না কী ! বুড়ি না উঠলি গোবর ছড়া দিতি পাচ্ছিনে যে---ও গুপাল--নিতাই--জগারেও ডাক---ভারী মাল---তিনজন ছাড়া ওটপে না-----
--হাঁ গোবিন্দ----একি দশা গোবিন্দ ! ইরা তো খাতি না দিয়েই হাগতি কচ্ছে---!
এ কী দিনকাল এলো গো গোবিন্দ----!!
©
আর কডা ভাত দ্যাও বৌমা,--এত বড় দিন এতে পার হয় না গো---
--দেখিছিস বুড়ির নু্লা--!-কপালের চার আঙ্গুল বাদ দিলি, পুরো খোল ! এ খোল ভরাবে কিডা--! এ সাধ্যি আমাদের নেই---
--সারাদিনে এই তো দুডো ভাত, তাও ঐ কডা,--পেটডা চো চো করে--গায়ে বল পাইনে--মাতা ঘুরোয়-- ও বৌমা ,আজ তো একাদশী--ঐ দেড় খোন রুটি আর এট্টা নসোগুল্লায় প্যাট ভরেনা---তুমি মিছে কথা কোইয়েনা মা--আমারে নাকি দশডা নশো আর দশডা রুটি দেসো--ও নিতাই,--আমি তো চোহি দেহিনে--এই দ্যাখ আমি তো এহনো খাইনাই---দেহে যা দেড়কোন রুটি আর এট্টা নসোগুল্লা--! ক্ষিদের জ্বালায় রাত্তিরি ঘুম আসে না। হাঁ গোবিন্দ,-- আর কতদিন এভাবে গলাটিপে বাঁচায় রাখপা-- গোবিন্দ-----!!!
©
ফেব্রুয়ারির আঠাশ তারিখের রাত পোয়ানো পয়লা মার্চের ভোরে ঐ একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। নিতাই-গোপাল-জগা চ্যাংদোলা করে বুড়িকে ফেলে যায় ছোটকাকা'র ঘরের সামনে। লক্ষীবুড়ি দরজার ভেতরের ঘুমন্ত মানুষদের ডিষ্টার্ব করে না,--অপেক্ষা করে দোর খোলার।
আজ স্নান করেই ঢুকবে বুড়ি। দুটো মাত্র সাদা থান, ফাল্তু তেল লেগে নোংড়া হবে ব'লে, হাজার চেয়েও গায়ে মাখার জন্য একটুখানি সরষের তেল জোটেনা তাঁর। এই ঘরে চা দেয়, কিন্তু বাজারে বিস্কুট নেই তাই শুধু লিকার চা গেলে ঠাকুমা। মাজার বেদনায় পিঠের নীচে কোলবালিশ গুঁজে শরীর ধনুক করে ছিলা'র তার খুঁজে বেড়ায় নিষ্ঠুর অদৃষ্টের কাছে।
কী ছিলোনা তার! বাড়ি-গাড়ি-সোনা গয়না, ঘর ভরা সাতটা বাচ্চাকাচ্চা,-অঢেল বেহিসেবী টাকা! আর এখন এক পলকেই শরীর রথ টেনে চলার সারথীই অনুপস্থিত। স্থির রথ-নিশ্চল ঘোড়া মুখ গুঁজে কর্ণের পতন দেখছে। হা গোবিন্দ----, হয় সারথী হয়ে ঘোড়া ছোটাও -- নয় তিরবিদ্ধ করে মৃত্যু যন্ত্রণা দাও শেষবারের মতো---
©
অনেক দিন,--অনেক বছর পর তিন ছেলের খোলা বারান্দায় পাছা ঘষতে ঘষতে গোবিন্দ 'র ডাক এলো। এতদিন পর পরপারে সত্যদাদুর সাথে দেখা হবে লক্ষী ঠাকুমা'র। বাড়ি ভর্তি লোকজন। সৎকাজ সম্পন্ন হবে নবদ্বীপ এর গঙ্গাছোওয়া মহাশ্মশানে। তিন লরী শ্মশাণযাত্রী। এলাহী আয়োজন।
শ্রাদ্ধের সময় পরপর তিনটে প্যান্ডেল-- তিনজন আলাদা আলাদা পুরোহিত। এ প্যান্ডেলের মন্ত্র বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ও পক্ষকে।
মাঝে বিরামের দিন তিন প্যান্ডেলে তিন সুরে রামায়ণ গান । এ প্যান্ডেলে মরিচ বধ,--- তো ও প্যান্ডেলে সীতার হাত ধরে হ্যাচকা টান্---গন্ধমাদন---ও প্যান্ডেলে শক্তিশেল---।
উরি বাপরে অন্তঃকাদন----কান আর মাথার পিরিত ফেল....

নিয়মভঙ্গের দিন এলাহি খাওয়া দাওয়া সব বাড়িতেই। এঘরে রেওয়াজী খাসি, তো অন্য দিকে বিরিয়ানি, আর ছোটো ছেলের প্যান্ডেলে চার রকমের বাহারী মাছ,--কলকাতার বিখ্যাত রাঁধুনী। পাড়ার লোক, আত্মীয়স্বজন,- ব্যবসায়ী কূল দিশেহারা,- কে কোন প্যান্ডেলে ঢুকবে---! সব কটির রং ই যে ধবধবে সাদা......

"ও তোর জীবনবীণা আপনি বাজে
দূঃখ- সুখের দুই তারে ,
ভাঙা গড়ার নিত্য খেলা
জীবন নদীর দুই পাড়ে........"


মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫৩

রাজীব নুর বলেছেন: আপনি কি কলকাতার ব্লগার?

২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:০৫

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: হ্যাঁ,----আমি ভারতীয়----কলকাতার উপকন্ঠে বসবাস কারী----অপরিচিত মনন----
সবে জনসমক্ষে এসেছি---
সেই অর্থে ব্লগিং এর কিছুই বুঝিনা-----

আমার এক ভাই এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখানে আসা------

২| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৫২

কল্পদ্রুম বলেছেন: গল্প বলার ধরণ ভালো লেগেছে। সহজ ভাষায় লেখা আমাদের সমাজের পরিচিত পরিহাসের গল্প। তবে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরিচিত লাগছিলো। যদিও মোটের উপর কাহিনী বুঝতে কোন অসুবিধা হয় নি৷বরং চরিত্রগুলোকে আরো বাস্তবতার কাছাকাছি এনেছে৷আপনার লেখা বোধহয় এটাই প্রথম পড়লাম। শুভকামনা আপনার প্রতি।

২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:১৪

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে---
সাথে থাকবেন আন্তরিক মননে----

আরো কিছু অন্য প্রবাদের গল্প উপহার দেবার ইচ্ছে রইল-----

৩| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৪৫

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: হ্যাঁ,----আমি ভারতীয়----কলকাতার উপকন্ঠে বসবাস কারী----অপরিচিত মনন----
সবে জনসমক্ষে এসেছি---
সেই অর্থে ব্লগিং এর কিছুই বুঝিনা-----

আমার এক ভাই এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখানে আসা------

আমার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:১২

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: খুব ভালো থাকবেন-----

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.