নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
“যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো”
– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
কিছু কিছু মানুষ কখনও হারিয়ে যান না । অন্যভাবে বললে, আমরা তাদেরকে হারিয়ে যেতে দেই না । কালের স্রোত শুধু তাঁদের নশ্বর দেহটাকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়, রয়ে যায় তাঁদের বিশাল কর্মময় জীবন, তাঁরা বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে । যুগে যুগে এমন অনেক মানুষ পৃথিবীর আলোয় এসেছেন, আবার কর্ম করে চলেও গেছেন । রেখে গেছেন কিছু স্মৃতি আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা, হয়ে আছেন অমর । এঁদের জীবন সম্পর্কে জেনে আমরা অনেক কিছু শিখি, জীবনে চলার পথের পাথেয় সংগ্রহ করি, সংগ্রামের দীক্ষা নেই । এমনি একজন কর্মময় সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব ডাঃ ননী গোপাল সাহা এম,বি,বি,এস,(ঢাকা), ডি,ও,আর,সি,পি,এস(ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড) । পেশাজীবনে তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা চক্ষু চিকিৎসক । এই পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক, দরদী সমাজসেবক, মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ, সাহিত্যপ্রেমিক, প্রতিভাবান নাট্যঅভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব । তিনি ছিলেন ফরিদপুরের অন্যতম একজন সুবক্তা । একজন সৎ, সংগ্রামী, অকুতোভয়, প্রতিবাদী ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল যথেষ্ট । এই মহান কর্মময় মানুষটিকে নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে- এটা খুব ভালো একটি উদ্যোগ ।
শুরুতেই স্মৃতিচারণের পালা । দিনটি ছিল ২০ এপ্রিল, ২০১২ । ভার্সিটির ছুটিতে বাড়িতে এসেছি । বিকেলে প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধি পান্না বালা কাকুর আমন্ত্রণে ফরিদপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের আয়োজনে ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সার্ধশত রবীন্দ্র উৎসবে গেলাম, সেখানে “দর্শনীর বিনিময়ে বক্তৃতা” দিলেন ডাঃ ননী গোপাল সাহা । বক্তব্যের বিষয় ছিলঃ রসিক কবি রবীন্দ্রনাথ, আনন্দভুবনে কবি, গীতাঞ্জলি, ছন্দে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল” । এর আগে আমি কখনও তাঁর বক্তব্য শুনিনি । শুধু বাবা (কবি বাবু ফরিদী) ও পান্না কাকুর মুখে অনেক প্রশংসা শুনেছি তাঁর বাগ্মিতার । অনুষ্ঠানে অনেক কাছের মানুষ উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন অঞ্জলি বালা দিদা, আলতাফ কাকু, শিপ্রা আন্টি, পান্না কাকু, নিজাম কাকু প্রমুখ । ডাঃ সাহার অনুরোধে অসাধারণ দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন শিপ্রা গোস্বামী আন্টি, যা অনুষ্ঠানটিতে যোগ করেছিল বাড়তি মাত্রা । খালি গলায় এত শ্রুতিমধুর রবীন্দ্রসঙ্গীত আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি । মনে আছে টানা ২ ঘণ্টা এক ধ্যানে বক্তব্য শুনেছিলাম এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম । বক্তব্যের বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সামান্য, তাই বিচার-বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা করলাম না । শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, আর অবাক হলাম- ভদ্রলোকের কত জ্ঞান! এই বৃদ্ধ বয়সেও (৮১বছর) তাঁর এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং এতক্ষণ টানা বক্তৃতা দেয়ার গুন আমাকে মুগ্ধ করেছিল সেদিন । আলোচনা সভায় সদাহাস্যজ্জল এই পণ্ডিতব্যাক্তির জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার । সেই থেকে আমি তাঁর খুব ভক্ত । ( পরবর্তীতে মায়ের থেকে জানতে পেরেছি তিনি নাকি আমার বড় মেসোর (অধির বোস) খুব ভালো বন্ধু ছিলেন । তাঁর সাথে মেসোর ঘনিষ্টতার সুবাদে মেসোর বাসায় তাঁর নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল । সেজো মাসির অসুখে নাকি তিনি চিকিৎসা করেছিলেন ।) এরপর বেশকিছুদিন পর ঢাকায় থাকাকালীন অবস্থায় একদিন জানতে পারলাম ডাঃ সাহা আর নেই! আর তাঁর বক্তৃতা শুনতে পারবোনা! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল । সাথে সাথে তাঁর শেষ বক্তৃতার দিনে সশরীরে উপস্থিত থাকতে পেরে ইতিহাসের অংশ আমিও হয়ে গেছি- ভেবেই ভালো লাগছিল । এজন্য পান্না কাকুর কাছে আমি ঋণী । এই লেখাটি লেখার সহায়ক বই ডাঃ তৃষা সাহার শ্রুতিলিখিত ডাঃ সাহার আত্মজীবনীটিও তিনিই আমাকে দিয়েছেন ।
এবার সংক্ষেপে ডাঃ সাহার বিস্তৃত ব্যক্তিগত, কর্মময়, রাজনৈতিক, জনসেবক জীবনের দিকে আলোকপাত করা যাক । নিজের জীবনকে তিনি নিজেই এক লাইনে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- “আমার সমগ্র জীবনটাই যেন কালবৈশাখী ঝড়, যা শুধু ধ্বংসই করেছে, দিয়েছে সামান্য ।”(সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৮৯) । তিনি আরও বলেন- “আমার জীবন চলার পথ কখনই মসৃণ ছিল না, ছিল বন্ধুর, সমস্যা সংকুল । পারিবারিক জীবনও বর্ণাঢ্য, বৈচিত্র্যময় ছিল না । ছিল অতি সাধারণ । তবে আমি পারিবারিক জীবনে সুখী । পারিবারিক জীবনে আমার কোন দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সমস্যা নেই ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৯৮) ।
ডাঃ সাহা ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার অধীনে হাসামদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । বাল্যকালের প্রথম কয়েকটি বছর বেশ সাচ্ছন্দ্যের সাথেই কেটেছে তাঁর । কিন্তু বিপর্যয়টা নেমে আসে তখন, যখন তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েন । এই সময় হঠাৎ বাবার অকাল প্রয়াণে তাঁরা এক চরম অনিশ্চয়তা এবং হতাশার সমুদ্রে পড়েন । এই অবস্থায়ও হাল ছেড়ে দেন নি তিনি । চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেও মেধাবী ছাত্র হিসেবেই স্কুলে পরিচিত ছিলেন; ক্লাসে সবসময় প্রথম হতেন ।
স্কুল জীবন থেকেই ডাঃ সাহা ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী । ফরিদপুরের ঈশান উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে স্কুলের লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে নিয়ে পড়তেন । তিনি প্রথম যে উপন্যাসটি পড়েছিলেন, সেটা হল সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের “আনন্দমঠ” । প্রতিদিন যা পড়তেন, তা নিয়ে বিকালে বন্ধু মৃণাল ব্যানার্জি এর সাথে আলীমুজ্জামান ব্রিজের ওপর বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত গল্প করতেন । জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে তিনি কবিতা প্রেমিক হয়ে ওঠেন, যদিও ছাত্র জীবনে কবিতা পড়ার প্রতি তাঁর তেমন কোন আগ্রহ ছিল না । রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দিন, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন মল্লিক এর কবিতা পড়তে তাঁর খুব ভালো লাগতো । জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি, তাঁর ভাষায়- “আমার কবি নজরুল ইসলাম” । আধুনিক কালের কবিদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, জয় গোস্বামী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা তিনি সুযোগ পেলেই পড়তেন । পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর সাথে তাঁর ভগ্নীপতি উপেন্দ্রনাথ সাহার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল । সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে পল্লীকবি ও কানাই লাল শীলের গানেরও ভক্ত ছিলেন তিনি ।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ডাঃ সাহাকে নিয়ে তাঁর মেঝ দাদা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়া হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন এবং সেখানকার বাজারে একটি মুদিখানা দোকান খোলেন । পরবর্তীতে সেই দোকানের দায়িত্ব বর্তায় তাঁর এবং তাঁর এক নিকটাত্মীয় মাধবদার ওপর । সেখানে তাঁরা নিজেরাই রান্না করে খেতেন । খুব কষ্ট করে একা একাই লেখাপড়া করতেন তিনি, সাহায্য করার কেউ ছিল না । প্রাইভেট টিউটর এর কাছে পড়ার সুযোগ স্কুল জীবনে তাঁর হয়নি । এই স্কুলেই তিনি খুঁজে পান তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক হিমাদ্রী মুখোপাধ্যায়কে । তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষক; বাংলা সাহিত্য ও ব্যকরণে তাঁর ছিল অগাধ দখল । হিমাদ্রী স্যারের বিদায়ের দিন তাকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন ডাঃ সাহা এবং মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন । এটিই ছিল তাঁর প্রথম বক্তৃতা প্রদান । গুপ্তিপাড়ায় থাকাকালীন অবস্থায় তিনি Indian Student Congress এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । তখন তিনি কংগ্রেসের জাঁদরেল সব নেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন । সেদিনের সেই হাফ প্যান্ট পড়া বক্তাই পরবর্তী সময়ের সুবক্তা ডাঃ ননী গোপাল সাহায় পরিণত হন ।
ছোটবেলায় ভারতে থাকতে বর্ধমানের মিহিদানা তাঁর খুব প্রিয় ছিল । মিহিদানা খেতে বর্ধমান যাওয়ার কিছু মজার কাহিনী তাঁর আত্মজীবনীতে বর্ণিত হয়েছে । তাঁদেরকে তখন বলা হতো “মিহিদানা পার্টি” । এরপর দেশে ফিরে প্রিন্সিপাল বাবু অবনী মোহন চক্রবর্তীর কৃপায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে একটু দেড়িতে হলেও রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তির সুযোগ পান এবং পরীক্ষায়ও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে একমাত্র তিনিই লেটার মার্ক পেয়েছিলেন । তাঁর প্রিয় সাবজেক্ট ছিল পদার্থবিদ্যা ও গণিত । কিন্তু অভিভাবকদের ইচ্ছায় তাঁকে ডাক্তারি পড়তে হয় । তখন কোন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হতো না, উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতেই মেডিকেলে ভর্তি নেয়া হতো । ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানেই ডাঃ জাহেদের হাত ধরে তাঁর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ ।
এরপরেই এলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন । ডাঃ জাহেদ এবং খুলনার ডাঃ জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালার অনুপ্রেরণাতেই ডাঃ সাহা ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন । ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ইতিহাসের সাক্ষী সেই মিছিলে অন্যদের সাথে ডাঃ সাহাও ছিলেন । অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচে নি রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতেরা । ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে রফিক ও জব্বারের গুমকৃত লাশের থেকে আনা ছেরা কাপড় নিয়ে যে মিছিল হয়েছিল, ডাঃ সাহা তাতেও উপস্থিত ছিলেন । ভাষা শহীদদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারির বীর যোদ্ধারা- সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার বুলেটের আঘাতে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে, কিন্তু যে আদর্শের আগুন তাঁরা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে সে আগুন কোনদিন নিভে যাবে না। বাংলাদেশ- বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে সে আগুন ততদিন প্রজ্বলিত থাকবে ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ২০) ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং বাংলা একাডেমীর উৎসাহে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ১২৩ জনের সাক্ষাতকার নেয়া হয় । সেখানে ডাঃ সাহা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করেছেনঃ “যুগ যুগ ধরে এদেশের হিন্দু মুসলমান অতি সৌহার্দ্যের সাথে বসবাস করে আসছিল । ধর্মের গোঁড়ামির ওপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল । তারই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সারা দেশে মারাত্মক দাঙ্গা সৃষ্টি হয় । এ পরিস্থিতি মোটেই সমর্থনযোগ্য ছিল না ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ২১) । তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে ছিলেন সবসময় । রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, “১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন যে চেতনার জন্ম দিয়েছিল, যে আদর্শের আগুন প্রজ্বলিত করেছিল সেটাই অনুপ্রেরণা দিয়েছিল ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে । একটা জাতির চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটে তার মাতৃভাষার মাধ্যমে । একটা জাতির যুগ যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনা তার চিন্তা ভাবনার ফসল, তার ভাবলোকের ঐশ্বর্য্য নিয়েই সৃষ্টি হয় তার সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারা । তাই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য চেয়েছিল বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে । বাঙ্গালী জাতি সত্তাকে চিরতরে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল এক বিরাট ষড়যন্ত্র । ৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের বন্যায় ভেসে গিয়েছিল ষড়যন্ত্রের সব দূর্গ ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ২৪) ।
ডাঃ সাহা মেডিক্যাল জীবনে খুব পড়ুয়া ছিলেন । ছুটির দিনে তিনি ১৭/১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পড়তেন । এতই পড়ালেখা করতেন যে তিনি “BOOK WORM”- দুর্নামের ভাগিদার ছিলেন! ১৯৫৩ সালের প্রথম দিকের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ডাঃ জাহেদের প্যানেলে তিনি খেলাধুলা বিভাগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন । কাজেই, দেখা যাচ্ছে খেলাধুলায়ও তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল । তাঁর কণ্ঠে শুনি- “আমি খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলাম না । ছোটবেলায় হা-ডু-ডু খেলা ছাড়া আর কোন খেলায় অংশগ্রহণ করেছি বলে মনে পড়ে না । কিন্তু খেলা দেখতে আমি খুব ভালবাসতাম ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৪৪) ।
ব্রিটিশ ভারতের অগ্নিযুগের বিপ্লবী কমরেড ইলামিত্রকে জেল থেকে ছাড়িয়ে গোপনে চিকিৎসার নামে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা করার কাজে ডাঃ সাহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান । এর ফলে কমরেড অবর্ণনীয় নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়ে বলতে গেলে নতুন জীবন পেয়েছিলেন । ইলা মিত্র পরে সুস্থ হয়ে অনেক বছর বেঁচে ছিলেন এবং একবার ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টি থেকে এম,পি, হয়েছিলেন । ভুলে গেলে চলবেনা এর পিছে আমাদের ডাঃ সাহা ও ডাঃ জাহেদেরও অবদান ছিল ।
ডাঃ সাহা M.B.B.S final পরীক্ষা দেন ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে এবং কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন । এরপর ৬ মাস internship করেন । তখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন কুমিল্লার বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত । ইনিই সেই বিখ্যাত মানুষ, যিনি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন । সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র তিনজন সদস্য তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন- ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও প্রেমহরি বর্মন । ডাঃ সাহার মতে ধীরেন বাবু ছিলেন “এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক সৌম্যশান্ত অমায়িক সুপুরুষ” । (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ২৯) ।
বর্তমান বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক কর্মবীর প্রফেসর ইব্রাহিমের মতো মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য এবং অপার স্নেহ লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল ডাঃ সাহার । তিনি এর জন্য যার-পর-নাই গর্বিত ছিলেন । তাঁর অধীনে ডাঃ সাহা যখন জুনিয়র ফিজিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন, ঠিক তখনি Pakistan Observer পত্রিকা তাঁর (ডাঃ সাহা) সম্পর্কে এক মিথ্যা প্রচারণা চালায় । এর কারণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকুরী পেয়েও চাকুরী করা হয়নি তাঁর । সরকারি চাকুরীতে না থাকলে কমনওয়েলথ বৃত্তি পাওয়া যেত না বলে তিনি এখানেও নিরাশ হলেন । এসময় প্রফেসর ইব্রাহিমই ছিলেন তাঁর উৎসাহদাতা ।
ময়মনসিংহের মির্জাপুরে তখনকার আমলের সেরা রনদা প্রসাদ সাহার কুমুদিনী হাসপাতালে সিনিয়র হাউজ সার্জন হিসেবে কর্মরত অবস্থায় বড়দার ঠিক করা মেয়ের সাথে ডাঃ সাহার বিয়ে হয় । যদিও অনেকটা অজান্তে হঠাৎ করেই তাঁর বিয়ে হয় বলে তাঁর যথেষ্ট অভিমান ছিল, তবু “অজপাড়া গাঁয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া সেই কিশোরী” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৩২) তাঁর জীবনের যোগ্য অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন । তাঁর মুখেই শুনি- “আমার স্ত্রীর একটা অভ্যাস ছিল সে কথায় কথায় খিল খিল করে হেসে উঠতো । মানুষের হৃদয় জয় করতে এটা ছিল একটা বড় উপাদান ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৩৪) । আরেকবার তিনি তাঁর সুযোগ্য স্ত্রীর প্রশংসা করেছেন এইভাবে- “আমার স্ত্রী তেলজুড়ি মৃধা বাড়িতে থাকার সময় শাখা সিঁদুর পড়া ছেড়ে দিয়েছিল । প্রতিজ্ঞা করেছিল দেশ স্বাধীন না হলে বাকী জীবন আর শাখা সিঁদুর পড়বে না । ভারতে আটমাস অবস্থানকালেও সে শাখা সিঁদুর পড়ে নাই ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৬২) । স্ত্রীর দেশপ্রেমের প্রশংসা করে তিনি নিজের দেশপ্রেমেরও প্রমাণ দিয়েছেন এখানে । দাম্পত্য জীবনে ডাঃ সাহা অনেক সুখী ছিলেন, এগুলো তারই প্রমাণ ।
বিশাল কর্মপরিসরে ডাঃ সাহা বারবার বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন, চাকুরী হারানোর অবস্থাও সৃষ্টি হয়েছে কখনও কখনও । কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি কখনও । তিনি নিজেই বলেছেন- “আমি সারা জীবন যেখানে যখনই অন্যায় অবিচার হতে দেখেছি তখনি সেখানে প্রতিবাদ করেছি। এটা করতে গিয়ে কখনো আমার জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, আবার কখনো চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৩৫) । ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে তিনি মির্জাপুরের চাকুরী ছেড়ে দেন, যদিও মির্জাপুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে তিনি ভুলে যান নি । মির্জাপুর হাসপাতালের কাছে তিনি ছিলেন চিরঋণী । তখনকার দিনে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের চেয়ে মির্জাপুর হাসপাতালের নাম ও প্রচার অনেক বেশী ছিল । পূর্ব পাকিস্তানে ক্যান্সার চিকিৎসার একমাত্র কেন্দ্র ছিল সেখানে ।
ডাঃ সাহা ফরিদপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন ১৯৫৮-৬২ সালের মাঝামাঝিতে । ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর অভিনয়ের প্রতি অনুরাগ ছিল । আলীপুরের বিশিষ্ট বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব বাবু কিরণ চন্দ্র লাহিড়ীর (যিনি ছিলেন টাউন থিয়েটারের একজন কর্নাধার) হাত ধরেই ফরিদপুর টাউন থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে তাঁর পদার্পণ । তিনি এই থিয়েটারের সদস্য হয়ে প্রবেশ করে কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন দীর্ঘকাল । এখানে তিনি প্রথম যে নাটকে অভিনয় করেন তার নাম “পোষ্য পুত্র” । এই নাটকসহ বাকী সব নাটকেই তিনি ছিলেন নায়কের ভূমিকায় । এরপর সুদীর্ঘ ৪০ বছরে তিনি প্রায় অর্ধশত নাটকে অভিনয় করেন । টাউন থিয়েটার ছাড়াও ফরিদপুর কালেক্টরেট ক্লাব, গোয়ালচামট নাট্য সংস্থায়ও Tgagedy ও Romantic নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি । তবে তিনি নিজেকে Tragedy তেই বেশী সফল বলে দাবি করেছেন । অভিনয় জীবনে টেপাখলার মহিউদ্দিন সাহেবকে নিজের গুরু মানতেন তিনি । তাঁদের দুজনের সর্বশেষ এক সঙ্গে অভিনয় বছর সাতেক আগে “টিপু সুলতান” নাটকে । এটাই সম্ভবত ডাঃ সাহার অভিনীত জীবনের শেষ নাটক । নাটক ছাড়া যাত্রাপালায়ও অভিনয় করেছেন তিনি ।
ডাঃ সাহা বামপন্থী মনোভাব পোষণ করতেন । কমিউনিস্ট পার্টির করুণা দাস গুপ্তের দেয়া মহামতি লেলিনের জীবনী তাঁর ভেতর বামপন্থী মনোভাবের ভিত্তি রচনা করে । (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৩৯) । তখনকার সব দলের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদদের সাথেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল । তখনকার দিনে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের উপর তার কোন প্রভাব পড়তো না বলেই জানিয়েছেন তিনি । ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে Combined Opposition Party সংক্ষেপে COP (সম্মিলিত বিরোধী দল), যার একটি শাখা ডাঃ জাহেদের নেতৃত্বে তাঁরা ফরিদপুরে গঠন করেন । ফরিদপুর পরিবার পরিকল্পনা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ডাঃ সাহা । ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের কূটকৌশলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি COP এর হয়ে ফাতেমা জিন্নাহ এর পক্ষে প্রচার চালান (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৪৫) । ঐ সময় ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে গুলি বর্ষণের বিরুদ্ধে মোহন মিয়ার বক্তব্য তাঁকে খুব নাড়া দিয়েছিল । এসময় কানাইপুরে যে জনসভা আয়োজিত হয়েছিল সেখানে প্রদত্ত বক্তৃতাই ছিল তাঁর প্রকাশ্য রাজনৈতিক জনসভায় প্রথম বক্তৃতা । এরপর বোয়ালমারীতে তাঁর নিজের থানায় আবেগময় ভাষায় প্রদত্ত বক্তৃতাটি ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তৃতা । এই সময় তিনি ফরিদপুর অটোরিকশা এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন । পরে দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ফরিদপুর ট্রেড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট হন ।
১৯৬৯ সালের পিণ্ডি বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন । তখন ডাঃ সাহাকে মিথ্যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর আর্মি ক্যাম্পে । সেখানে চলে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন । এসময় তাঁকে সহায়তা করেন বলাকা হোটেলের মালিক নজা বিশ্বাস । জীবনে যার থেকে যতটুকুই সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি, তাই নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন । এই গুনটি সবার থাকে না । যশোরে ১৫ দিন থাকার সময় তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে । তিনি অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করেছেন, কিন্তু কখনই মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেন নি । মনে মনে তিনি তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, “ প্রয়োজনে মৃত্যুকে বরণ করবো, তবুও মিথ্যা স্বীকারউক্তি দেবো না” । (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৫২) ।
ডাঃ সাহার বহু প্রতীক্ষিত বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ হয় ১৯৭৪ সালের সম্ভবত মার্চ মাসে । মাত্র ২৫ পাউন্ড পকেটে নিয়ে তিনি ব্রিটেনের বুকে পাড়ি জমান । সেখানে ডাঃ হেলেন, দেলোয়ার হোসেন এবং তাঁর বন্ধু (আমার বড় মেসো) প্রয়াত অধীর বোসের ভাই এবং তাঁর স্ত্রী কুন্তলা বোস তাঁকে স্বাগত জানান । এই ডাঃ হেলেনের সাহায্য-সহযোগিতার কথা তিনি বারবার উল্লেখ করছেন এবং বিনম্র ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেন নি । মিসেস খান ভোর রাতে উঠে তাঁর জন্য রান্না করেছিলেন- এটাও তিনি ভোলেন নি, বরং প্রশংসা করেছেন বিদেশের মাটিতে এমন আপ্যায়নের, তাও অচেনা কারো জন্য । ব্রিটেনে রডহিল নামক স্থানে তিনি প্রথম ১৫ দিনের জন্য একটি Locum Job করেন । তারপর লেস্টরশায়ার এর একটি হাসপাতালে চাকুরী করেন । কুমুদিনির দু’বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগে রয়েল রবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে পরীক্ষা দিতে গিয়ে । সেদেশের মানুষ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “এ দেশের মানুষ কথা কম বলে, কাজ বেশী করে ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৭৭) । আরও বলেছেন, “এরা সবার উপরে স্থান দেয় মানবিক মূল্যবোধকে । মানুষের প্রতি এঁরা সহমর্মী ও সাহানুভুতিশীল । ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশ নাগরিক আর আজকের ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে অনেক তফাৎ ।আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, British people দের সম্পর্কে আমার ধারণা সবচেয়ে উঁচু ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৭৮) । এখান থেকে যেদিন তিনি পাস করলেন, সেদিনটিকে জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় আনন্দের দিন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৭৮) । । ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো এবং দেশে ফিরে আসাটাই নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করতেন তিনি । (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৮২) ।
দেশে ফিরে ডাক্তারির পাশাপাশি জনকল্যাণে মন দিলেন ডাঃ সাহা । ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে ডাঃ জাহেদ এর একান্ত প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে এবং তাঁর (ডাঃ সাহা) সহযোগিতায় ফরিদপুরের আলীপুরের রেডক্রস ভবনে “সানডে শিশু ক্লিনিকে”র কার্যক্রম শুরু হয়, যার কার্যক্রম তখনকার আমলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল । পাকিস্তান আমলে তিনি ফরিদপুর রেডক্রসের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর ছিলেন সাধারণ সদস্য । এসময় তাঁরা নিয়মিত প্রতি রবিবার শিশু রোগীদের দেখতেন । প্রাথমিকভাবে নিজেদের কিছু স্যাম্পল (sample) ঔষধ ও কয়েকটি কোম্পানির অনুদান থেকে পাওয়া ঔষধ দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন । পরবর্তীকালে পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব রকিবুদ্দিন পৌরসভা থেকে ২২ শতাংশ জমি প্রদান করেন এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবু বাকার কর্তৃক প্রদত্ত ২লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে শিশু চিকিৎসা কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয় । এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর সপ্তাহে ৬ দিন চলল সেবা প্রদান । এসময় ডাঃ সাহার নিজের চেম্বার থেকে অনেক রোগী অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে চলে যেত, কিন্তু তিনি তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ করেন নি; বরং বলেছেন- “...জগতের যে কোন কল্যাণকর, যে কোন মহৎ করমের মুলে থাকে ত্যাগ । ত্যাগ ছাড়া কোন মহৎ কার্য সম্পাদন করা যায় না।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৮৪) । ১৯৮২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর এই শিশু ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জেনারেল এরশাদ । তখন ৫০ শয্যার এই চিকিৎসা কেন্দ্রের যে কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়, তাতে ডাঃ সাহা সহ-সভাপতির আসন অলংকৃত করেন । এক কথায়, ফরিদপুরের স্বনামধন্য শিশু হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ডাঃ ননী গোপাল সাহা ।
ডাঃ সাহার চলার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না । জানামতে, দু’বার তাঁকে কারাভোগও করতে হয়েছিল । একবার জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে ৬ মাস জেল খাটতে হয়েছিল । পরে অবশ্য হাইকোর্টে রিট করে একতরফাভাবে মুক্তি লাভ করেন । তখন তিনি জেলখানার লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়তেন । সারাদিন বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতেন । ঐ ৬ মাসে লাইব্রেরীর গল্প-উপন্যাসের প্রায় সবই পড়ে ফেলেছিলেন তিনি, পড়েছিলেন খুব কষ্ট করে একটিমাত্র লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । জীবনের এই পর্যায়ে ডাঃ সাহার বই-প্রীতি ছিল লক্ষণীয় । তাঁর বেডরুমেও ছিল একটি ছোটখাট লাইব্রেরী ।
ডাঃ সাহা তাঁর জীবনে অনেক বন্ধু পেয়েছেন । তাঁর মুখেই শুনি- “আমি ছাত্র জীবন থেকেই খুব বন্ধুবৎসল ছিলাম । ছাত্রজীবনে আমার অনেক বন্ধু ছিল । কর্মজীবনেও আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক ।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৯৯) । কিন্তু ডাঃ জাহেদ ছিলেন তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু । সেই বন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি একাকী ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন এবং বন্ধুর অভাব বোধ করেন খুব । কর্মজীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তাঁরা দু’জন একসাথে চলেছেন, এমনকি মৃত্যুর মুহূর্তেও দু’জন পাশাপাশি ছিলেন । এমন বন্ধুত্ব আজকের দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল । বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভুলে যান নি তিনি, বলেছেন- “আমার সান্ত্বনা, আনন্দ ও গর্ব এই যে আমি ডাঃ জাহেদের সাথে ছিলাম, তাঁর পাশে ছিলাম । অতি সামান্য হলেও তাঁর মহতী কর্মকাণ্ডে আমার কিছু অবদান, কিছু ভূমিকা আছে । ” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৯৪) । এই ডাঃ জাহেদের উদ্যোগেই জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির ফরিদপুর জেলা শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সম্পাদক ছিলেন ডাঃ সাহা ।
ফরিদপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সেবামূলক প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথেও ডাঃ সাহা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন । ফরিদপুর লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি । প্রায় ৪০ বছর ধরে ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি পদে বহাল ছিলেন (মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) । ফরিদপুরের শ্রী শ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনের কার্যনির্বাহী কমিটিরও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনের পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী তাকেই অর্পণ করেছিলেন । ১৯৮১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গঠিত জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির ফরিদপুর শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান, পরে সভাপতিও হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন । সেই সময় বিনা পয়সায় চক্ষু শিবিরের আয়োজন করতেন তাঁরা । রবিবারের চক্ষু ক্লিনিকটি আজ জহুরুল হোক চক্ষু এবং জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছে । ১৯৮৩ সালের ২৫ নভেম্বর ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়, যার সদস্য ছিলেন তিনি ।
ডাঃ সাহা ছিলেন একজন সুবক্তা । ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত তিনি অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন । প্রাঞ্জল ভাষায়, সুন্দর করে বুঝিয়ে বক্তৃতা দেয়ার যে গুণ তাঁর মধ্যে ছিল, তা তাঁকে অন্যরকম এক উচ্চতায় আসীন করেছিল । রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম প্রভৃতি ছিল তাঁর বক্তৃতার বিষয় । তাঁর প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় কিছু বক্তৃতার মধ্যে আছেঃ ‘শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ’, ‘শ্রী শ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর’, ‘রবীন্দ্রনাথঃ আমাদের লোক’, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম’, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ‘লোক সংস্কৃতি’, ‘এইডস’, ‘১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন’ ইত্যাদি । এইসব বিষয়ে তাঁর বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান শ্রোতাদেরকে ভাবিয়ে তোলে, জ্ঞানের পরিধি বাড়ায় ।
ডাঃ সাহার পড়ার প্রচুর অভ্যাস থাকলেও লেখালেখির অভ্যাস কোনদিনই তেমন ছিলনা । তিনি নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে একথা স্বীকার করে গেছেন । (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ১০২) । যদিও একটি আফসোস ছিল (অভিযোগ নয়) এই যে- তাঁর অনেক পরিশ্রমের ফল নজরুলের ওপর লেখা প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার লেখাটি তিনি রাখতে পারেন নি । আবেগতাড়িত হয়ে তাঁর সহধর্মিণী কিছু বইয়ের সাথে সেই লেখাটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন ।
ডাঃ সাহার প্রিয় ক্লাব ছিল ফরিদপুর টাউন থিয়েটার ক্লাব । কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি এই ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন । তিনি ছিলেন যৌতুক প্রথার ঘোর বিরোধী । তিনি তাঁর ছেলেমেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেন নি, নেনও নি । (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ১০৪) ।
কর্মময় জীবনের শেষ একদিন হবেই, একথা জানতেন ডাঃ সাহা । তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের-
“ফুলদানি হতে একে একে
আয়ুক্ষীণ গোলাপের পাপড়ি পড়িল ঝরে ঝরে।
ফুলের জগতে
মৃত্যুর বিকৃতি নাহি দেখি।
শেষ ব্যঙ্গ নাহি হানে জীবনের পানে অসুন্দর।
যে মাটির কাছে ঋণী
আপনার ঘৃণা দিয়ে অশুচি করে না তারে ফুল,
রূপে গন্ধে ফিরে দেয় ম্লান অবশেষ।
বিদায়ের সকরুণ স্পর্শ আছে তাহে;
নাইকো ভর্ৎসনা ।”
-তাঁর মনকেও প্রভাবিত করেছিল এবং তিনি ইচ্ছা পোষণ করেন- “আমি আমার জন্মভূমিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই । এই বাংলাদেশের মাটি, আকাশ ও বাতাসে একদিন ছাই হয়ে মিশে যেতে চাই।” (সুত্রঃ১, পৃষ্ঠাঃ ৯৯) । এখানেই তাঁর দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় চাওয়া- পাওয়ার কিছু ছিল না ডাঃ সাহার । । জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, অনেক আশা ছিল তাঁর মনে, যার বেশিরভাগই পূরণ হয় নি । তবে তাঁর শেষ স্বপ্নটি পূরণ হয়েছে বলে তিনি তৃপ্ত ছিলেন । সেটা ছিল তাঁর আদরের নাতনী ডাঃ তৃষা এর বিয়ে । প্রাত্যহিক কাজ অসুস্থ শরীর নিয়ে যতদূর পারতেন করতেন । এভাবেই একদিন সময় ফুরিয়ে এলো । কাছের মানুষ, ভক্ত-গুণগ্রাহীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরপারের পথে যাত্রা করলেন ডাঃ ননী গোপাল সাহা । তাঁর প্রিয় কবি নজরুলের ভাষায়-
“বিদায়–সন্ধ্যা আসিল ওই ঘনায় নয়নে অন্ধকার।
হে প্রিয়, আমার, যাত্রা–পথ অশ্রু–পিছল ক’রোনা আর।।
এসেছিনু ভেসে স্রোতের, ফুল
তুমি কেন প্রিয় করিলে ভুল
তুলিয়া খোঁপায় পরিয়া তা’য় ফেলে দিলে হায় স্রোতে আবার।।
হেথা কেহ কারো বোঝে না মন
যারে চাই হেলা হানে সে’ জন
যারে পাই সে না হয় আপন হেথা নাই হৃদি ভালোবাসার।
তুমি বুঝিবেনা কি অভিমান
মিলনের মালা করিল ম্লান
উড়ে যাই মোর, দূর বিমান সেথা গা’ব গান আশে তোমার।।”
এভাবেই বিশাল কর্মময় এক জীবনের ইতি ঘটল । আমরা হারালাম একজন ঐতিহাসিক ভাষা সৈনিককে, হারালাম একজন সুবক্তাকে, একজন দেশপ্রেমিক, একজন দক্ষ মানবসেবক চক্ষু বিশেষজ্ঞকে । একের ভেতর এত গুণ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না । ডাঃ ননী গোপাল সাহাকে আমরা ভুলবনা, তাঁর প্রিয় ফরিদপুরবাসীরা তাঁকে ভুলে যাবে না । এমন নিবেদিতপ্রাণ ও প্রতিভাবান একজন মানুষকে চাইলেও ভোলা যায় না । ডাঃ সাহা আমাদের মাঝে একজন লিজেন্ড হিসেবে বেঁচে থাকুন অনন্তকাল -এই কামনায় তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি । জয়তু ফরিদপুর, জয়তু ফরিদপুরের মানুষ ডাঃ ননী গোপাল সাহা ।
............................................................................................................
লেখকঃ
দেব দুলাল গুহ (দেবু ফরিদী)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
http://www.facebook.com/dev.d.nipun
............................................................................................................
তথ্যসূত্রঃ
১) গ্রন্থঃ “আমার দাদু” (ডাঃ ননী গোপাল সাহার আত্মজীবনী)
শ্রুতি লেখিকাঃ ডাঃ তৃষা সাহা ।
২) প্রয়াত এ্যাডভোকেট কমল কৃষ্ণ গুহ (কবি বাবু ফরিদী) ।
৩) ডাঃ কৃষ্ণা মিত্র ।
৪) পান্না বালা ।
#ডা: ননী গোপাল সাহা:- এক মহান ব্যক্তিসত্তা, সংরামী পুরুষ।
২| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৫:৫৭
আহসানের ব্লগ বলেছেন: লিঙ্ক কপি করে রাখলাম ।
অনেক বড় লেখা সময় করে পড়ে নেবো !
৩| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:২৩
এহসান সাবির বলেছেন: কাল রাতে পড়েছিলাম..
ভালো লেগেছে।
৪| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৩০
সুমন কর বলেছেন: সময় করে পড়তে হবে। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪৫
এনামুল রেজা বলেছেন: তবু মনে রাখি..
প্রিয়তে নিলাম লেখাটা।