নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি সেই জন, যাকে খুঁজিছ অকারণ

স্বপ্নকে কখনো বেঁধে রাখতে নেই। স্বপ্ন হবে খোলা আকাশের মত, যার না আছে আদি, না আছে অন্ত।

নির্লিপ্ত আমি

নির্লিপ্ত আমি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্প : আচ্ছা কেন মানুষগুলো এমন হয়ে যায়

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:০০









শীতটা আজ বেশ ভালোই পড়েছে। বেলা বারোটা ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এখনও সূর্যের দেখা নেই। দুনিয়ার রীতিই এরকম, যখন যাকে প্রয়োজন, তখন তার দেখা পাওয়া যায় না।

সলিম আলীর মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণটা অবশ্য অন্য। শীত –টীত তার কাছে কোন ব্যাপার না। গরিব মানুষের চামড়া হবে গণ্ডারের চেয়েও শক্ত। যাতে শীত কি তার বাপও যেন শরীরে ঢুকতে না পারে। যার চামড়া যত শক্ত সে তত গরীব।

গতকাল জিন্দাবাজার এলাকায় বসে ছিলেন, ঠিক সুবিধা করতে পারেননি। মানুষ এখন আর ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দেয় না, মানুষের মন থেকে মায়া দয়া কমে গেছে। আরে ব্যাটারা ভিক্ষুকরাও তো মানুষ। আহা! আগে কি দিন ছিল, বসার কিছুক্ষনের মাঝেই থালাটা ভরে উঠত। থালায় পয়সা পড়লে যখন টং করে শব্দ হয়, শুনতে যে কি সুখ লাগে। আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এখন পয়সাও নাই, শব্দও নাই, সুখও নাই। সরকারের উচিত নিয়ম করা যে, সবাইকে বাধ্যতামূলক ভিক্ষুকদের টাকা দিতে হবে, যে টাকা দিতে ভুল করবে তার দুই দিনের সশ্রম কারাদণ্ড। এসব বাদ দিয়ে কি সব উল্টা পাল্টা কাজ করে বেড়ায়। না, সলিম আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবার আর কাউকে ভোট দিবেন না, গরীব হতে পারি কিন্তু রাগ থাকবে না এটা কেমন কথা। রাগ তো আর টাকা দিয়ে কিনতে হয় না। বরং যে যত গরীব তার রাগ তত বেশি হবে, রাগ কম হবে বড়লোকদের। রাগ বেশি হলে টাকা ইনকাম করবে কি করে।

এসব দার্শনিক চিন্তা ধারা করতে সলিম আলীর ভালোই লাগে। কেমন জানি নিজেকে জ্ঞানী জ্ঞানী মনে হয়।

এসব উঁচু লেভেলের চিন্তা করেও তার মেজাজটা ঠিক হচ্ছে না। মেজাজ খারাপের কারণ হল, দুই ঘণ্টা হল বসেছেন এর মধ্যেই গোটা পঞ্চাশেক মাইয়া মানুষ দেখেছেন, সমস্যা সেটাও না, সমস্যা হল এদের কারোরেই কাপড় চোপড়ের ঠিক নাই, শাড়ি পড়েছে পড়েছে আবার পেট দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ তো আবার শার্ট প্যান্ট পড়ে আছে। কোনদিন আবার লুঙ্গি পড়ে বেরিয়ে পড়ে। শার্ট প্যান্ট পড়বে পোলারা, মাইয়ারা কেন। গজব, গজব পরব সবগুলার উপর। এসব দেখতে তার ইচ্ছে করে না, মনে হয় চোখ বন্ধ করে থাকেন কিন্তু তারও উপায় নাই, চোখ বন্ধ করলে নিজের কেমন জানি মৃত মৃত মনে হয়।



‘বুঝলি রসু, মাইয়া হচ্ছে আমার শিউলি, নেক মাইয়া, দেখলেই কেমন জানি মনটা পবিত্র হইয়া যায়, আফসুস মাইয়াটা গরীব হইয়া জন্মাইছে। তুই বল, তুই ওরে কখন বোরকা ছাড়া দেখছিস? বল’



রসু, সলিম আলীর অ্যাসিস্ট্যান্ট। এসব কথায় কান দেয় না। এসব কথা শুনতে শুনতে তার মুখস্ত হয়ে গেছে। রসুর কোন কিছুই ভাল লাগে না, না পড়ালেখা করতে, না কাজ করতে। এই যে সলিম আলীর সাথে থাকে তার একটা গোপন কারণ আছে। রসুর মানুষ খুন করার খুব ইচ্ছা। সে চিন্তা করছে, সলিম আলিকে দিয়াই উদ্বোধন করবে। সলিম আলী মানুষ হিসেবে ভালো, একটু না অনেক বেশি ভাল। ভালো মানুষের দুনিয়াতে বেঁচে থাকার অধিকার কম, তাই সলিম আলিকে দিয়াই শুরু হোক। ভালো একটা দিনের অপেক্ষায় আছে, সুযোগ মত কাজটা শেষ করতে হবে।

‘হ, চাচা, শিউলি আপা খুবই ভালা একটা মাইয়া’

তবে রসু আজ সলিম আলীর একটা কথায় খুব চমকাল

‘বুঝলি রসু, চিন্তা করছি, এই বেগানা মাইয়াগো একটা শিক্ষা দেওন দরকার। তোকে ১০০ টাকা দিব, তুই এদের কারো প্যান্ট টা খুলে দিতে পারবি, তারপর দিবি জোড়সে একটা দৌড়, পারবি না?’



রসুর আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হইছে। চাচা বেশ রসিক আছে। তার পোকায় খাওয়া দাঁতগুলা বের করে কঠিন একটা হাসি দিয়া বলল, ‘পারুম না মানে, ১০০ বার পারব’

‘তাতো পারবিই, মাইয়া মানুষের কাপড় ধরে টানাটানি করতে তো ভালা লাগবই। সবই কেয়ামতে আলামত রে, সবই কেয়ামতের আলামত’







শিউলির মনটা আজ বেশ ভালো। অবশেষে অনেক কষ্ট করে বাবার জন্যে একটা হুইল চেয়ার কিনতে পেরেছে। শিউলি অনেক বারণ সত্ত্বেও তার বাবার ভিক্ষা করাটা বন্ধ করতে পারেনি। এখন বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। পঙ্গু একটা মানুষ সারাদিন ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ভিক্ষা করে, খারাপ লাগে, কিন্তু কথা না শুনলে কি করবে।

বাসায় ঢুকে দেখে বাবা মশারির ভেতর ঢুকে সিগারেট খাচ্ছে

‘তোমাকে না কতদিন নিষেধ করেছি মশারির ভেতর সিগারেট খাবা না’



‘অফিস থেকে ফিরলি?’

‘হ্যাঁ’

‘মা রে, মশারির ভেতর সিগারেট খাইতে যে কি মজা তুই কি বুঝবি, নিজেরে কেমন জানি নবাব নবাব মনে হয়’

‘নবাবরা কি মশারির ভেতর সিগারেট খেত নাকি?’

‘জানি না, কিন্তু এর ভেতর অন্য রকম এক মজা আছে’

‘তাই নাকি, দাও তো আমিও একটা টান নেই’

‘নাউজিবিল্লাহ, এইগুলা কি বলিস’

শিউলি হেসে বলে

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আর বলব না। এই নাও তোমার হুইল চেয়ার’

সলিম আলীর আনন্দে চোখে পানি চলে আসে।

‘বাবা, তুমি কি কাঁদছ নাকি?’

সলিম আলী ব্যাস্ত হয়ে বলেন

‘আরে না না, কাঁদব কেন?’

সলিম আলীর নিজের উপর রাগ লাগে। বয়স যে হইছে এ তারই ইঙ্গিত, অল্পতেই পানি চলে আসে। নাহ, কবরে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে।

‘মা রে, আমি জানি না আমি কবে কোন ভাল কাজ করছিলাম, যার জন্যে আল্লাহ তোকে আমার মাইয়া করে পাঠাইছে। মা রে, তুই অনেক বড় হ’

পর মুহূর্তেই নিজের বড় ছেলের কথা ভেবে মন টা খিচড়ে উঠে

‘অথচ আমার কুলাঙ্গার পোলাটার কথা ভেবে দেখ, বাপের প্রতি কোন মায়াই নাই। রাগ করে না হয় একটু কটু কথাই বলেছিলাম তাই বলে বাপরে ছেড়ে চলে যাবে? কোন পাপের ফলে যে এমন পোলা পাইছিলাম। ৫ বছর হয়ে গেল পোলাটারে দেখি না’

বলেই সলিম আলী আবার কেঁদে উঠেন।

‘থাক বাবা, কাইন্দ না, মনে কর আমিই তোমার পোলা’

সলিম আলী পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলেন

‘হ্যা রে মা, তুই ই আমার পোলা’







আয়নার দিকে তাকিয়ে শিউলির কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে, খুব অল্প সেজেছে কিন্তু কি সুন্দরই না লাগছে।

কি সুন্দরই না ও দেখতে কিন্তু......

‘বাবা, ভাত রান্না করে গেছি, ঠিক মত খেয়ে নিবা কিন্তু’

‘এদিকে আয় তো মা’

‘কি, বল’

‘এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? মাথাটা একটু নিচু কর’

শিউলি মাথা নিচু করল, সলিম আলী অনেকক্ষণ ধরে দোয়া পড়ে বললেন,

‘ঠিক মত যাবি’

‘আচ্ছা ঠিক আছে’

শিউলি বেরিয়ে পড়ল। আজ তাকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সেলিম কেন জানি দেখা করতে বলেছে।

সলিম আলী মেয়ের পথের দিকে তাকিয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন তারপর হাত জোড় করে দোয়া পড়তে লাগলেন, ‘আল্লাহ, তোমার অসীম কৃপা তুমি এমন একটা মেয়ের বাবা করে আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছ। এই বস্তিরই কত মাইয়াকে দেখি কত কুনেশায়, খারাপ কাজে মেতে আছে, কিন্তু আমার এই মাইয়াটা বেহেস্তের ফুলের মত পবিত্র। যখন আমার ওকে দেখার কথা তখন ওই আমাকে দেখছে, আমার সেবা যত্ন করছে। আমার এই পরহেজগার মাইয়াটাকে তুমি দেখ, আল্লাহ, ওর বিপদে আপদে পাশে থেক, আমীন’







কীন ব্রিজের নীচটা অনেক সুন্দর। কিন্তু সমস্যা হল বসার ঠিক মত কোন জায়গা নাই, শিউলি তাই দাঁড়িয়েই আছে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল কিন্তু সেলিম আসছে না।

এই শীতের মাঝেও ওর বেশ গরম লাগছে। অবশ্য অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে, গরম লাগারই কথা। ঘেমে পিঠটা কেমন চটচট করছে। বোরকাটা খুলতে পারলে ভাল লাগত কিন্তু বোরকা খুলাটা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছে না। সেলিমা আবার ওকে বোরকা ছাড়া দেখলেই রাগ করে।

অনেকক্ষণ পর অপেক্ষাটা যখন বিরক্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল তখনই সেলিম এল

‘ওহ, দেরি করে ফেললাম’

‘না,ঠিক আছে’

‘চল কোথাও বসা যাক’

‘সিলেট কিন্তু অনেক ছোট শহর, কেউ কিন্তু দেখে ফেলতে পারে’

‘আরে না কেউ দেখবে না, তুমি চল তো’

তারপর তারা চা টা খেল, বেশ কিছুক্ষন গল্প করল। একসময় শিউলি বলল,

‘তুমি মনে আমাকে কিছু বলতে চাইছ, তা ছাড়া তো আমাকে এভাবে ডাকার কথা না’

সেলিম কিছুক্ষন ইতস্তত করে বলল

‘আসলে তোমাকে ওইদিন যে বলেছিলাম.........’

শিউলির মনটা খারাপ হয়ে যায়। বেশ ভালোই লাগছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই পরিবেশটাকে কেমন জানি অস্বস্তিকরকর মনে হয়।

‘সেলিম আমি জানি না আমি কেন তোমাকে ঘৃনা করতে পারি না, তুমি আমার এতো বড় ক্ষতি করলে তারপরও কেন জানি তোমাকে ছাড়তে পারি না’

সেলিম অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একসময় শিউলির হাত ধরে বলে

‘ভয় পেয় না, আমি আছি তো। আর সগিরের ফ্ল্যাটটাও খুব ভাল, নিরিবিলি, কোন সমস্যা হবে না।’

শিউলি অসহায়ভাবে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিউলির একসময় খুব আকাশ হতে ইচ্ছে করত, মেঘে ঢাকা আকাশ না, নীল আকাশ। দেখেলেই কেন জানি মনে হয় আকাশটা হয়ত মুচকি মুচকি হাসছে, মনটাই ভালো হয়ে যায়।

সেলিম কিছুটা অধৈর্যের সুরে বলে,

‘তুমি যাবা?’

শিউলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ‘ হ্যাঁ, চল’





রিকসা টুং টুং শব্দ করে চলছে।

‘জানো সেলিম, আমার প্লেনে চড়ার খুব ইচ্ছা। কিন্তু, গরীব মানুষতো তাই স্বপ্নটা মনে হয় কখনই পূরন হবে না। তবে মজার ব্যাপার হল, রিকসায় উঠে চোখ বন্ধ করলে মনে হয় বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি। কর কর চোখ বন্ধ কর, দেখবা কি মজা’

সেলিম রীতিমত বিরক্ত, এইসব ছেলেমানুষি করতে ওর ইচ্ছে করছে না, সে এখন একটু পর কি হয় এই নিয়ে চিন্তিত, এরকম বেকুব মাইয়া মানুষ, ভয়ে যদি কেঁদে টেদে ফেলে বা শেষ মুহূর্তে না করে বসে তাইলেই কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে। শিউলিকে ওর এখন বড় দরকার, তাই ইচ্ছে না স্বত্বেও চোখ বন্ধ করল।

‘কি, অনেক মজা না?’

কচু মজা, কচুর ওড়াওড়ি। ওড়াওড়ি করবে পাখি, মানুষ কেন? যতসব ফালতু ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু মুখে তা বলল না

‘হ্যাঁ, খুব মজা’

একসময় ওরা গন্তব্যে পৌছে গেল।

‘সেলিম, আমার কিন্তু খুব ভয় করছে’

‘আরে ভয় পেও না, বেশিক্ষণ লাগবে না’

শিউলির মুখটা কেমন জানি শুকিয়ে আসছে। মাথাটা খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে পালিয়ে যায় কিন্তু তা সম্ভব না। ওর হাত পা শিকলে বাঁধা।

একসময় সেলিম বলল,

‘শুনো, অনেক মালদার পার্টি কিন্তু, লন্ডনি মাল। খুশি করতে পারলে অনেক টাকা খসাতে পারবা। মনে রাখবা দুনিয়াতে টাকাই সব। তোমার টাকা আছে তো তুমি রাজা, সকাল বিকাল তোমাকে সবাই সালাম দিবে, ভালোবাসা টাসা ফালতু ব্যাপার আর ভয় পাবা না, আমি বাইরেই আছি। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে যাও। আর মুখটা এমন পাংশু করে রাখবা না। যাও’





শিউলির মাথাটা কেমন ঘুরছে। গায়ে এক সুতা কাপড় নেই। কেমন জানি বমি বমি লাগছে। পশুটা সিগারেট টানছে আর শিউলির দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

শিউলির খুব কান্না পাচ্ছে। ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে গিয়ে একবার হারিয়ে গিয়েছিল, আবার হারিয়ে গেলে খারাপ হত। জীবনের প্রতি ঘেন্না চলে আসছে।

শিউলির ৪ মাস আগের কোন এক সুন্দর বিকেলের কথা মনে পড়ে গেল।

বাসে করে ঘরে ফিরছিল। বাস থেকে নেমে দেখে ভুলে ব্যাগ ফেলে এসেছে। ব্যাগ হারিয়ে ও যখন দিশেহারা তখন কে জানি পেছন থেকে বলল, ‘এটা মনে হয় আপনার ব্যাগ, আমি আপনার পেছনের সিটেই ছিলাম, দেখলাম আমি ব্যাগ ফেলে নেমে যাচ্ছেন, তাই......’

বিকেলের সোনালি রোদে কাউকে খারাপ লাগা বারণ, অসুন্দরকেও নাকি সুন্দর লাগে, সামান্য হয়ে যায় অসামান্য । সেলিম নামের মানুষটাকে তাই শিউলির ভালোই লাগে।

সেই ভালো লাগা কবে যে ভালোবাসায় রূপ নেয় তা বোঝার আগেই শিউলি একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে এরকমই এক সগিরের ফ্ল্যাটে।

শিউলির কেন জানি খারাপ লাগত না, সত্যি বলতে ভালোই লাগত।

মরুভূমিতে যে পানিই দেয়া হোক না কেন তা হোক লোনা পানি অথবা মিঠা পানি মরুভূমি যেমন তা পরম ভালোবাসায় বরণ করে নেয় তেমনি শিউলির অভাবে পূর্ণ, অনাদরে ভরপুর নিরানন্দ জীবনে সেলিমের ভালবাসা ছিল এক ফোটা স্বস্তির বৃষ্টির মত। তাইতো, সেলিমের বিষাক্ত আবদারগুলোকেও ভালোবাসা ভেবে ভুল করে সাদরে আগলে রাখত।

তারপর আরও একদিন, আরও একদিন, আরও একদিন।

কিন্তু তারপর একদিন

‘শিউলি, তুমি কি জানো আজ আমার পর তোমাকে ভোগ করার জন্যে বাইরে আমার অনেকগুলা দোস্ত অপেক্ষা করে আছে।’

শিউলি ভয়ে একদম মিইয়ে যায়। তা দেখে সেলিম বলে

‘আরে, পাগলী, মজা করলাম, তুমি তো শুধু আমার, তোমাকে আর কারো হাতে ছেড়ে দিতে পারি বল?’

শিউলি স্বস্তির হাসি হাসে। নিজের বোকামোতে নিজেই হাসে।

তারপর.........খেলা শেষে, হ্যাঁ খেলাই তো, সেলিম দুই বার হাত তালি দেয়।

ঘরের কোন এক দুর্গম কোন থেকে রসু বেরিয়ে আসে।

‘কি রে ঠিক মত ভিডিও করেছিস?’

রসু আস্তে করে বলে

‘জ্বি, ভাই’

কি রে, মিউ মিউ করিস কেন? এ তোর শিউলি আপা চিনতে পারছিস?

সেলিম শিউলিকে বলে

‘শিউলি, একটু আগে আমরা যা করলাম তার সব কিছু ভিডিও করা হইছে। আর কে করছে দেখতেই তো পারছ, রসু, চিনতে পারছ ওকে? তোমার বাবার আসিস্ট্যান্ট। হারামজাদাটা অবশ্য প্রথমে রাজী হয় নাই করতে, প্যাঁদানি দিতে হইছে। এরপর কি করা হবে জানো? এইটা ইন্টারনেটে ছাড়া হবে, আর রসুকে দিয়ে প্রচার করা হবে তোমাদের বস্তিতে।’

শিউলি কি বলবে বুঝে পায় না, ওর কাছে কেন জানি সব কিছু স্বপ্ন মনে হয়।

‘অবশ্য তুমি চাইলে আমি তা করব না, কিন্তু তার বিনিময়ে তো তোমাকে কিছু দিতে হবে। কি দিতে হবে তুমি বুঝতেই পারছ।’

শিউলি হতবাক হয়ে একবার সেলিমের দিকে একবার রসুর দিকে তাকিয়ে থাকে।

একসময় দেখতে পায় ঘরের ভিতর চারটে মানুষরুপী পশু ঢুকছে।

এরপর পৃথিবীটা কেমন জানি অসহ্য, দোজকের মত হয়ে যায়। ওর মনে হত রাস্তার প্রতিটি মানুষ বোধহয় ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে, করুনা করছে।

খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু মরার জন্যেও তো সাহস লাগে, তার অভাবে অথবা হয়ত অসহায় বাবাটার কথা ভেবে তা আর হয়ে উঠে না।

তার কিছুদিন পর শিউলি যে অফিসে কেরানির কাজ করত ঐখানে গিয়ে দেখতে পায় যে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার চাকরিটা নেই।



শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই, কি না করার চেষ্টা করে একমুঠো ভাতের জন্যে, একটা থাকার ছাদের জন্যে। কিন্তু কিছুতেই সফল হয় না।

তাইতো কোন এক ঘোর লাগা সন্ধ্যেতে চুপিচুপি উপস্থিত হয় সেলিমের কাছে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ শিউলি একজন পতিতা।

কিন্তু, এতকিছুর পরও শিউলি অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে সে সেলিমকে ঘৃনা করতে পারে না, হয়ত ভালোও বাসে না কিন্তু ঘৃনাও করে না।

ইচ্ছে করলেই বাঁচা যায়, ইচ্ছে করে হয়ত মরাও যায় কিন্তু ইচ্ছে করলেই কাউকে ঘৃনা করা যায় না।





আনোয়ারের এক দৃষ্টিতে তার উস্তাদ, কমরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে রীতিমত শীত শীত করছে, খুব সম্ভবত একটু একটু কাঁপছেও। কে জানি বলেছিল, ভয় পেলে নাকি কানের লতি ধরে থাকলে ভয় কমে। ঐ শালারে পেলে কষে পাছায় একটা লাত্তি মারত, ভয় তো কমেইনি উল্টা বেড়েছে।



আনোয়ারের ভয় পাওয়ার কারণ হল কমর একটু আগেই তার আরেক সাগরেদ অপুকে থাপ্পড় মেরে প্রায় আধ মড়া করে রেখেছে। মানুষ কথায় কথায় বলে, থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিবে, আনোয়ারের মনে হচ্ছে অপুর আসলেই দাঁত পড়ে গেছে। ওর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আসলেই পড়েছে কি না কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। উস্তাদের মেজাজ আসলেই সপ্তম না না অষ্টম আকাশে উঠে বসে আছে।

অপুর অপরাধ অবশ্য গুরুতর। উস্তাদ ওরে ভালো একটা নাপিত নিয়ে আসতে বলছে কিন্তু শালা নিয়ে আসছে ৬০ বছরের বুইড়া। তার উপর আবার ব্যাটার হাত কাঁপে।

উস্তাদ বলেই শুধু থাপ্পড়ের উপর দিয়া গেছে, আনোয়ার হলে ব্যাটার পাছায় লাত্তি মেরে ধড় থেকে পাছা আলাদা করে ফেলত। পাছায় লাত্তি মারা আনোয়ারের হবি।

কমরের মন আজ অত্যধিক ভাল। খুব সম্ভবত পৃথিবীর ১০ জন সুখি মানুষের একজন আজ সে। এর পেছনে কারণ দুইটা। এক, বস আজ অনেকদিন পর সিগন্যাল দিছে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বের হয়ে আসার জন্যে। প্রায় দুই বছর আগে এক খুনের জন্যে থাকে এতদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল দুই, অপুকে চড়টা ঠিক যুত মত মারা গেছে। সবসময় যুত মত চড় মারা যায় না। চড় দিতে পারার মজাই আলাদা।

এই অত্যধিক সুখের কারণে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মাথায় এবং মুখে জঙ্গল হয়ে যাওয়া চুল, দাঁড়ি আরো কিছুদিন রেখেই দিবে। নিজেকে কেমন জানি বাউল বাউল মনে হচ্ছে। বাউল হতে পারা সহজ কথা না।

‘আনোয়ার’

‘জ্বি, উস্তাদ’

‘চিন্তা করছি চুল, দাঁড়ি আজ আর ফেলব না’

‘খুবই ভালা সিদ্ধান্ত উস্তাদ, চুল দাঁড়িতে আপনাকে ঠিক নায়ক সালমান খানের মত লাগছে’

‘কি? সালমান খানের মতো? সালমান খানের কি এতো লম্বা চুল আর দাঁড়ি আছে নাকি?’

‘সরি উস্তাদ, অত্যধিক আবেগে বইলা ফেলছি’

‘হুম, কিন্তু সমস্যা কি জানিস, কেন জানি মনে হচ্ছে, দাঁড়িতে উকুন বাসা বেঁধেছে, বাঘ, ভাল্লুক থাকলেও খুব একটা অবাক হব না, হাহাহাহাহাহা’

আনোয়ার ঠিক বুঝতে পারছে না কি বলবে, এটাও বুঝতে পারছে না উস্তাদের মনটা কি ভালো না খারাপ। তাই চুপ থাকাই ভালো মনে করল।

‘আনোয়ার’

‘জ্বি, উস্তাদ’

‘কিছু মাল পানির ব্যবস্থা করা দরকার না?’

‘অবশ্যই উস্তাদ’

‘বাংলা হলে সবচেয়ে ভালো হয়। বিদেশি খাইতে খাইতে আসল জিনিসের স্বাধই ভুলে গেছি’

‘জ্বি, উস্তাদ। আপনি খাড়ান আমি নিয়া আসছি’

‘এখন না, আমি এলাকাটা একটু ঘুরে দেখি, সন্ধ্যের সময় এসব জিনিস জমে ভাল।’

‘জ্বি উস্তাদ’



কমরের কেন জানি সব কিছু নতুন নতুন মনে হচ্ছে। দুই বছর আগে অপারেশনে যাওয়ার আগে কি দেখে গেছিল আর এখন কি হইছে। এখন অবশ্য নদীর এপার আছে, ঐপার মানে জিন্দাবাজার, বন্দর এলাকাটা একটু ঘুরে দেখতে পারলে ভালো হত। পরক্ষনেই আবার সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করল। আজকের দিনটা একটু আরাম করি, মৌজ মাস্তি করি কাল না হয় ঘুরে দেখা যাবে।

সন্ধ্যের সাথে সাথে আবার হোটেলে ফিরে এল।

‘আনোয়ার’

‘জ্বি,উস্তাদ’

‘মাল আনছিস?’

‘জ্বি’

অনেকক্ষণ খাওয়ার পর মাথাটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করতে লাগল।

‘বুঝলি, আনোয়ার এইটা হল আসল জিনিস, আসল জিনিসের স্বাধই আলাধা’

‘জ্বি,উস্তাদ’

‘কি জ্বি জ্বি করছিস, ভাইরে আমার তো ওর কথা মনে পড়ে গেল রে, ওর কথা’

আনোয়ার ভাবল এই রে শুরু হইছে আরেক প্যাড়া

‘কার কথা উস্তাদ?’

‘রুনু, আমার রুনু’

‘রুনু ভাবীরে কই পাই এখন উস্তাদ’

‘ভাইরে তোর পায়ে পড়ি, তুই আমার উস্তাদ, একটা ব্যবস্থা কর না রে ভাই, কর না’

‘উস্তাদ, শহরে নাকি একটা হট মাল আছে, আনব?’

‘নতুন, নাকি ইউজ করা?

‘বেশিদিন হয় নাকি, কয়েকবার ইউজ করা, হইব?’

‘রুনু রে পাইলি না, ও আমার রুনু, কই তুমি?’

‘আনমু উস্তাদ?’

‘রুনু রে?’

‘না, ঐ মালটা রে?’

‘আন’

আনোয়ার কিছুক্ষন পর ফিরে এল

‘উস্তাদ, আনছি, আসলেই কিন্তু খুব কড়া মাল’

‘কে, রুনু, বেয়াদব, ভাবীকে কেউ এইরকম বলে?’

‘কি শুধু রুনু রুনু করছেন? এ আরও সুন্দর।‘

‘তাই নাকি?’

‘হ, আমাকেও একটু দিয়েন উস্তাদ’

‘হুম, আচ্ছা আমি গেলাম, রুমের ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিছিস তো? আমার কিন্তু মাল খাওয়ার পর বেশি লাইট সহ্য হয় না’

‘হ, উস্তাদ জানি, ডিম লাইট দিছি, আপনি যান’







শিউলির কেমন জানি লাগছে। রুমটা কেমন জানি অন্ধকার অন্ধকার। এর আগেও বেশ কয়েক জায়গায় গেছে, কিন্তু এখানে খুব বেশি অস্বস্তি লাগছে। ও আসতে চায়নি কিন্তু পলিটিক্যাল নাকি ব্যাপার স্যাপার আছে, তাই আসতেই হল।

লোকটা মনে হয় মাতাল হয়ে আছে, কি জানি গুনগুণ করছে, খুব সম্ভবত ‘রুনু রুনু’ করছে। এদিকে তাকাচ্ছেও না।

শিউলি কাশি দিল।

লোকটা মনে হয় শুনলই না।

এবার একটু জোরে

‘ও উ, তুমি চলে আসছ?’

কন্ঠটা কেমন জানি পরিচিত, পরিচিত মনে হচ্ছে। ঠিক মত বুঝাও যাচ্ছে না। কেমন জড়ানো গলায় কথা বলছে।

‘কা...পড় খুল’

‘কি?’

‘মাগী, কা...... খুল’

শিউলি কাপড় খুলল।

লোকটা রীতিমত ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ল।

শিউলির আগের অনুভূতিটা ফিরে এল। ওর কেন জানি অন্যরকম লাগছে, খুব অস্বস্তি। ওর বার বার মনে হচ্ছে কি জানি ঠিক নাই, কি জানি ঠিক হচ্ছে না।

বেশ কিছুক্ষন পর

‘ম......জা পেলাম, আনোয়ার লাইট জ্বালা’



এই বার শিউলি বুঝতে পারল, কি ঠিক নেই। ঐ দিকে লাইট জ্বালানো হয়েছে।

‘ভাইয়া, তুমি?’ শিউলি কান্না জড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল।

‘শিউলি, তুই?’







সলিম আলীর ঘুমটা আজ একটু দেরি করে ভেঙেছে, অবশ্য কাল একটু রাত করে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুম ভাঙতেই কিসের জানি গণ্ডগোল শুনতে পেলেন।

ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন বাসার সামনে অনেক লোক জড়ো হয়ে আছে।

‘কি, হয়েছে রে?’

একজন আঙ্গুল উচিয়ে দেখালো

‘চাচা, শিউলি’

সলিম আলী দেখলেন, তার আদরের মেয়ে শিউলি গাছের সাথে ফাঁস লেগে ঝুলে আছে। বড় আদরের মেয়ে।





পরিশিষ্ট ১: এই ঘটনার পর কমরকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই যেন সে হাওয়া হয়ে গেছে।



পরিশিষ্ট ২: সলিম আলীকে এখনও রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখা যায়। লোকটা আপন মনে কি জানি বিড়বিড় করে, খুব কাছে গেলে অল্প অল্প বুঝা যায়। সম্ভবত, ‘শিউলি আমার বড় ভালো মেয়ে, বড় নেক মেয়ে’ এই টাইপ কিছু একটা অনবরত বলতে থাকেন।



পরিশিষ্ট ৩: সেলিম বা সেলিমরা নতুন কোন শিউলি বা শিউলিদের বাসে, ট্রেনে খুঁজে বেড়াচ্ছে।



পরিশিষ্ট ৪: রসু কাউকে খুন করবে বলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কোথা থেকে জানি একটা চাকুও জোগাড় করে ফেলেছে। তবে সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। সে কমর,সেলিম বা নিজের মত খারাপ কাউকেই প্রথম খুন করবে বলে ঠিক করেছে।



মন্তব্য ৯ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:১২

অরুদ্ধ সকাল বলেছেন:
বেশ ঝরঝরে
খুব ভালো লাগলো।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৩৭

নির্লিপ্ত আমি বলেছেন: ধন্যবাদ জানবেন

২| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:১২

অরুদ্ধ সকাল বলেছেন:
বেশ ঝরঝরে
খুব ভালো লাগলো।

৩| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:২০

মোঃ আনারুল ইসলাম বলেছেন: গল্পটা সুন্দর। আসলে মেয়েদের ফুসলিয়ে এইভাবে ক্ষতি করা হয়।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৩৬

নির্লিপ্ত আমি বলেছেন: ঠিক তাই, ধন্যবাদ আপনাকে, ভালো থাকবেন

৪| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:১০

মামুন রশিদ বলেছেন: শেষটায় এসে.. নাহ, এটা বেশি হয়ে গেছে । এমনিতে গল্পটা ভাল লিখেছেন । শেষটা আবার ভেবে দেখতে পারেন ।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:২৮

নির্লিপ্ত আমি বলেছেন: আমার কাছে গল্পের শেষটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। তবে এক এক জনের চিন্তা ধারা, ভালো লাগা এক এক রকম।
মন্তব্য করার জন্যে ধন্যবাদ, অনেক ভালো থাকবেন।

৫| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:২৬

সুমন কর বলেছেন: আসলেই শেষটা একটু ভাবা যেতে পারে। তবে আপনি মামুন ভাইকে যে উত্তর দিয়েছেন, সেটার সাথেও একমত। ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন মত।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৫৬

নির্লিপ্ত আমি বলেছেন:
আমি শেষটা আসলে এরকমই করতে চাইছিলাম, আমি মনে করি এটাই আমার গল্পের প্রধান আকর্ষণ।
মন্তব্য করার জন্যে ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.