![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষ।
গল্পের নামঃ বীর গাথা
.
- আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছিস? (সাবের)
~ ওয়া আলাইকুমুস সালাম। (ইসহাক) আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি। তুই?
- আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভাল। আসবি তো?
~ না এসে কি পারা যায়? অবশ্যই আসব। কিন্তু বাকিরা?
- তারাও আসবে। আচ্ছা এখন রাখি। রাতে দেখা হবে।
~ আচ্ছা।
.
সাবের ও ইসহাক সাহেব হচ্ছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা সিনিয়র সিটিজেন। বয়স ৬৫ এর কাছাকাছি হবে। অন্যদিকে সাবের সাহেবের কথাবার্তা তার নাতি সুমন(১৫বছর) সব শুনেছে। সুমন বুঝার পর থেকেই দেখে আসছে প্রতি বছর এই তারিখের রাতে তার দাদা কোথায় যেন বেরিয়ে পরে। এই ব্যাপারে সুমনের বাবা অর্থ্যাৎ সাবের সাহেবের ছেলেও কিছু জিজ্ঞেস করে না। কারণ নিষেধ আছে। সুমন দু একবার জিজ্ঞেস করেছিল কাজের কথা বলেছিল। কিন্তু এত রাত ধরে কিসের কাজ?
.
সুমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে তার দাদাকে ফলো করবে। কিন্তু ওতো রাতে একা ফলো করাটা ঠিক হবে না। তাই কিছু বন্ধুবান্ধবকে বলে রাখলো। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হওয়ায় তারাও রাজি হল।
.
রাত ১১টা।
খাওয়া দাওয়ার একটু পরেই সুমনের দাদা বেরিয়ে পড়ল। সুমনের ঘরের বাইরে এক বন্ধু দাড়িয়ে ছিল। সে সুমনের দাদাকে ফলো করতে লাগল। বাবা মা ঘুমানোর পর সুমন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে লক করে বেরিয়ে পড়ল। তারপর সেই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে যথাস্থানে পৌছাল। ৪বন্ধু মিলে ফলো করতে লাগল।
.
= তোর দাদা এত রাতে কোথায় যাচ্ছে? (এক বন্ধু)
-- সেটা জানার জন্যই তো ফলো করছি।
= দেখ ভাই কোনো জঙ্গীটঙ্গী নয়তো?
-- আরে ধুর না। দাদা ৭১ এর মানুষ। যুদ্ধও করেছিলেন। চুপচাপ ফলো করতে থাক।
.
ফলো করতে করতে তারা একটা কবরস্থানে চলে এলো। কিন্তু প্রথমে বুঝল না যে এটা একটা কবরস্থান। কারণ তাদের নজর ছিল সাবের সাহেবের দিকে। হঠাৎ এক বন্ধু বলল
>> দোস্ত আআআআমরা তো কককবরররর স্থানে।
আশেপাশে তাকিয়ে সবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠল। সবাই কাপতে লাগল।
= মনে হচ্ছে তোর কথামতো ফলো করতে এসে ভুল করলাম।
-- ইয়ার ভয় দেখাইস না।
= তোর দাদা এখানে আসলো কেন? (কাপতে কাপতে)
-- আমি নিজেও জানি না।
.
~~ তোমরা কারা? এত রাতে এখানে কেন? (পিছন থেকে একজন বলল)
.
হঠাৎ ভারি কণ্ঠ শুনে সবাই পিছনে ফিরে তাকালো। তারপর যা দেখল তারে সবাই চিত্কার দিয়ে উঠলো। এমনিতেই তারা ভয়ে ছিল। তারওপর লম্বা দাঁড়ি সহ সাদা পাঞ্জাবি দেখে তাদের কাছে ভুত বলেই মনে হল। তারা ভয়ে চিত্কার করতে লাগল। চিত্কার শুনে সাবের সাহেব দৌড়ে এলেন।
.
- সুমন তুই এখানে কেন?
সুমন সব খুলে বলল।
সাবের সাহেব তাদেরকে বুঝিয়ে ভয় দূর করালো।
.
-- আচ্ছা দাদা এত রাতে তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে এখানে কেন দেখা করতে এলে?
- আগে তোদেরকে একটা গল্প শুনাই।
সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকালো।
.
সময়টা ৭১ এর জানুয়ারী মাস।
সাবের, কবীর, তুহিন, ইসহাক ও আবিদ তারা পাঁচ বন্ধু। একেক জন একেক জেলা থেকে এসেছে। ৫জনই ভার্সিটির রুমমেট। খুব দ্রুতই তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে আবিদ ছিল দেশপ্রেমিক। সবসময়ই দেশাত্মবোধক গল্প, গান, কবিতা নিয়ে মেতে থাকত। সবাই বলত দেশ পাগলা। যেখানে সেখানে সে তার দেশাত্মবোধক কবিতা, গান, গল্প বলতো। ভার্সিটির ছাত্ররাও মনোযোগ দিয়ে শুনত। খুব দ্রুত আবিদ ভার্সিটির সবার কাছে পরিচিত হয়ে গেল।
.
দেখতে দেখতে চলে এলো ফেব্রুয়ারি। সে ৫২ এর পর থেকেই এই ফেব্রুয়ারি মাসটা আসলেই যেন বাংলার আকাশটা লাল বর্ণের হয়ে যায়। আবিদ নানারকম কার্যক্রম চালাতে লাগল। ৭ই ফেব্রুয়ারি আবিদকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গেল। কিন্তু ভার্সিটির সবার আন্দোলনের ঝড়ের কারণে তাকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ছেড়ে দিতে হল। বের হয়েই আবিদ নেমে পড়ল ২১শে ফেব্রুয়ারির কার্যক্রম নিয়ে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব সড় হবে। সাবের, কবীর, তুহিন, ইসহাক তারাও আবিদের কার্যক্রমে সাহায্য করতে লাগল। চলে এলো ২১শে ফেব্রুয়ারি। বড়সড় করে একটা মিছিল ঢাকা ভার্সিটি থেকে বের হল। আবিদ শুধু ঢাকা ভার্সিটিতেই পরিচিত ছিল না। আশেপাশের সব ভার্সিটিতেও পরিচিত ছিল। আবিদের উদ্যোগেই জগন্নাথ সহ আরও কয়েকটি ভার্সিটি থেকে মিছিল বের হল। সবার উদ্দেশ্য হল একত্রিত হয়ে স্লোগান দিতে দিতে হাইকমিশনারের অফিসের সামনে যাওয়া। কিন্তু পথিমধ্যে হানাদার বাহিনীর হামলার কারণে তা হল না। কিন্তু একটা জিনিস সেদিন বুঝা গিয়েছিল বাংলার প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তি চায়।
.
চলে গেল ফেব্রুয়ারি, এলো মার্চ। জে জানতো আরেকটি নতুন ইতিহাস অপেক্ষা করছে। সেদিন ছিল ৭ই মার্চ, সকাল থেকে আবিদ খুব ব্যস্ত। জিজ্ঞাসার পর বলল, "আজ আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন।" আবিদ তার বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হল নতুন ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে। ব্জ্র কণ্ঠের সেই ভাষণে বুঝাই গিয়েছিল বাংলার আকাশ আজ মুক্তি পাগল হয়ে উঠেছে। ভাষণের সেই জাগরণ বাঙ্গালী জাতি কখনোই ভুলবে না। প্রতিটি কথায় রক্ত টগবগিয়ে উঠল। ভাষণের পরপরই বাংলার আকাশ গরম হয়ে উঠল।
.
আজ ২৫শে মার্চ, রাত ১১:৪০মিনিট।
সাবের, কবীর, তুহিন, ইসহাক মিলে লুডু খেলছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আর অন্যদিকে দেশ পাগলা আবিদ গান কবিতা লিখতে ব্যস্ত। আবিদ বলল, "তোরা একটু বস। আমি একটা কলম কিনে আনছি।" ওতো রাতে দোকানপাট বন্ধ থাকলেও নূর ভাইয়ের দোকানটা খোলা থাকে। তবে বাইরে থেকে বন্ধ থাকে। ভেতরে মুক্তি পাগলরা মিটিং করে সেখানেই ঘুমায়।
.
২৬শে মার্চ দিবাগত রাত ০২.৩৫ মিনিট।
.
সাবের, কবীর, তুহিন, ইসহাক সবাই ঘুমে মগ্ন। আবিদ নূর ভাইয়ের দোকানে মিটিং করছে। হঠাৎই বিকট শব্দ শুরু হল। সেই সাথে কান্না, আর্তনাদ, বাচাও বাচাও, পালাও পালাও শব্দে পুরো শহর কেপে উঠলো। হল থেকে থেকে সবাই বাহিরে এলো। আবিদ বাহির থেকে হলের দিকে দৌড়ে এলো। জানা গেল হানাদার বাহিনী হামলা করেছে। এবার উপায়? আবিদ বলল, "তোরা পিছনের দেয়াল টপকে সোজা নদীর পাড়ের দিকে পালা।" ইসহাক জিজ্ঞেস করল, "তুই?" জবাবে আবিদ উত্তর দিল, "তোরা যা। আমি উত্তর দিক থেকে আসছি।" অতঃপর সবাই দেয়াল টপকে নদীর দিকে পালিয়ে এলো।"
.
সকাল হল। এ এক নতুন সকাল। চারদিকে "জয় বাংলা" ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগল। রাত এবং দিনের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। রাতভর সবাই ভেবেছিল এই বুঝি হানাদারদের কাছে বন্দী হয়ে গেলাম। কিন্তু সকালে সবাই জানতে পারল মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সবাই ঝাপিয়ে পরেছে এই ঘোষণায়।
.
সাবের, কবীর, তুহিন, ইসহাক হলে এসে অনেক খোঁজাখুঁজির আবিদের লাশ কাঁটাতারে আবিদের লাশ ঝুলছে। পোষাক দেখেই বুঝল এটা আবিদেরই লাশ। কারণ পুরো ভার্সিটি জুড়ে এমন পোষাক আবিদই পরতো। চার বন্ধুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। নূর ভাই থেকে জানতে পারল আবিদ হাতে একটি মশালে আগুন ধরিয়ে হানাদার বাহিনীদের অনেকক্ষণ ধরেই বিভ্রান্ত করে রেখেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ধরা পরলো। হানাদার বাহিনীরা নৃশংসভাবে আবিদকে পদদলিত করে, গুলি দিয়ে জর্জরিত করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
.
গল্পের এই স্থানে এসে সাবের সাহেব নিজের চোখের পানি মুছলেন। সাবেরের বন্ধুরা এবং সুমন সহ সুমনের বন্ধুরাও নিজ নিজ চোখের পানি মুছলেন।
.
- কি হল তোমরা কাঁদছো কেন?
-- জানি না। মনের অজান্তেই চোখের পানি বেরিয়ে এলো। তারপর কি হল?
.
- তো শুনো।
.
সবাই মিলে কাঁটাতার থেকে আবিদের রক্তাক্ত দেহটি নামালো। হানাদারকে পদদলিত হওয়ার কারণে আবিদের চেহারা থেতলে গেছে। সারা বুক গুলিতে জর্জরিত। অঝোর বেগে কান্না করতে লাগল চার বন্ধু। নূর ভাই বলল, "দাফন দেয়া উচিত। এমনিতেই সারারাত পরে ছিল।" অতঃপর ভার্সিটি সংলগ্ন করবস্থানে আবিদকে দাফন করা হল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ভার্সিটি ও হল বন্ধ ঘোষণা করা হল। তাই তারা চার বন্ধু নিজ নিজ গ্রামে ঠিকানায় ফিরে গেল। রেখে গেল কিছু স্মৃতি। যা ভুলবার নয়। আবিদ কিন্তু সেদিন পালাতে পারত। কিন্তু পালায়নি। বরং মশালের আগুন দিয়ে হানাদার বাহিনীকে কিছুক্ষণ বিভ্রান্তের মধ্যে রেখেছে। যাতে ভার্সিটির বাকিরা পালানোর সুযোগ পায়। আবিদ সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিল অস্ত্র ছাড়াও বাঙ্গালীরা সাহসী। তাইতো আবিদ আজও বেঁচে আছে সাবের, কবীর, তুহিন, ইসহাকের মাঝে।
.
সাবের সাহেব ও তার বন্ধুরা আবার চোখের পানি মুছলেন।
-- দাদা এটাই কি সেই বীরের (আবিদ) কবর?
- হ্যারে দাদু ভাই। এখানেই বীর আবিদকে শায়িত করেছিলাম।
কথাটি বলে অঝোর বেগে কান্না শুরু করলেন সাবের সাহেব ও তার বন্ধুরা। সুমন ও তার বন্ধুদের চোখেও পানি।
.
কিছুক্ষণ নীরবতা রইলো। তারপর সাবের সাহেব বললেন,
- চলো আমরা মিলাদ মাহফিল করে বীর আবিদ ও তাঁর মত সকল আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
.
ইসহাক (হুজুর) দোয়া মাহফিল শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর তাদের সাথে শরিক হলেন কবরস্থানের দারোয়ান চাচাও। তিনি বিগত ২০বছর ধরেই এই এই রাতে এই চারজনের সাথে মিলাদ মাহফিলে শরিক হন।
.
(সমাপ্ত)
(গল্পটা কাল্পনিক)
.
"আসুন আমরা বাজনা না বাজিয়ে। সকল শহীদদের ও ২৬শে মার্চ দিবাগত রাতে প্রাণ হারানো বাঙ্গালীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।"
.
লেখাঃ নিশি চৌধুরী (রাত্রির আম্মু)
©somewhere in net ltd.