নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

নীলপরী আর বাঁশিওয়ালা

২৮ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:৪৮

আষাঢ়ের গল্পের আসর

সন্ধার পর থেকেই ঝুম বৃষ্টি। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে দিনের মত আলো করে। কান ফাটিয়ে দেয়া আওয়াজ। কারেন্ট নেই প্রায় তিন ঘণ্টার ওপর। চার্জারের আলো থাকতে থাকতে রাতের খাবার আগে আগে খেয়ে ফেলতে হল। গ্যাস প্রায় নাই নাই। নিভু নিভু গ্যাসে কোনোমতে ভাতটা রান্না করা গেছে। কিন্তু বাকি খাবার ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডাই বের করে খেতে হল। গরম করা গেল না। অবশ্য এটাকে আরেক রকম মজা হিসেবে নিয়েছে ছেলে মেয়েরা। আমি কোনোমতে দুয়েক লোকমা ভাত আর ঠাণ্ডা বেগুণ ভাজা দিয়ে খাবারের পাট শেষ করলাম। অন্যরা ঠাণ্ডা ঝোল সহ পাবদা মাছের তরকারি দেখলাম বেশ আরাম করেই খেলো। তবে ছোটটা বাদে। খাবার টেবিলে চার্জারের আলো কমে আসতে আসতে প্রায় সবার খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু সবার ছোট অরোরা ভাত নাড়া চাড়া করছে বেশি- খাবার খবর নেই। নোভা ধমক দিলো, “কি হলো? খাচ্ছিস না যে? খাওয়া শেষ কর তাড়াতাড়ি। আলো কমে গেছে।“
“মা, আজকে খেতে ইচ্ছা করছে না।“ রিনরিনে গলায় উত্তর দিল।
“খিদা নাই তোর?”
“নাহ। খিদা নাই।“
“আচ্ছা, রেখে দে। জোর করে খাওয়ার দরকার নাই। হাত ধুয়ে ফেল।"

অরোরা বাধ্য মেয়ের মত চেয়ার থেকে নেমে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে লাগল। বেসিনে হাত ধোঁয়াটা নতুন শিখেছে কিছুদিন হল। নলকা খুলে দুইহাত নলকার নিচে দিয়ে মুঠো খোলা বন্ধ, খোলা বন্ধ করে হাতের দিকে তাকায় ওপরের আলোতে। আজকে কারেন্ট না থাকায় বাতি জ্বলছে না। বার বার হাত ধুয়ে দৌড়ে ডাইনিং টেবিলের চার্জারের কাছে এসে আলোতে হাত দেখে আবার বেসিনের কাছে দৌড়ে যাচ্ছে। আবার ধুয়ে ফিরে আসছে। যেহেতু তার উচ্চতা আর বেসিনের উচ্চতা সমান, পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর করে উঁচু হয়ে দুই হাত বাড়াতে হয় তাকে। বুক আর থুতনি বেসিনের গায়ে কোনমতে আটকে থাকে। এর মাঝেই হাত ধুতে গিয়ে মুখ, জামা সব ভিজিয়ে ফেলে। এমনকি মেঝেতেও পানি ছিটকে আসে। নোভার অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। ওর কথা হল বাচ্চা মানুষ, ভুল করে করে শিখবে। সব যদি বড়দের মতই করতে হবে, ওকে আর বাচ্চা বলে লাভ কি? বাচ্চারা থাকবে বাচ্চাদের মত। ভুলে ভরা।
নোভা পাহারা দিয়ে সবার হাত ধুইয়ে রুমে ফেরত পাঠিয়ে টেবিল গোছাতে লাগলো। আমি খানিকক্ষণ বসে থেকে লম্বা লম্বা হাই তোলা শুরু করলাম। সারাদিন অফিসে বসে ল্যাপটপে কাজ করেছি। শেষ বিকেলে বৃষ্টির মাঝে বাজার হয়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে দেখি মূল রাস্তা থেকে বাসা পর্যন্ত সামনে হাঁটু পানি। অফিসের ব্যাগ আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে এই বিশাল পথ পানি ভেঙ্গে এসে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। এখন চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছে।
“এখানে বসে বসে হাই তুলছো কেন? রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো।“
“তোমাকে কোম্পানি দিচ্ছি।“ জোর করে চোখ খুলে রাখতে রাখতে উত্তর দিলাম।
“আমাকে হাই তুলে কোম্পানি দেয়া লাগবে না। আমি প্লেটগুলো ধুয়ে, ফ্রিজে খাবারগুলো ঢুকিয়ে আসছি। বসে বসে অলসের মত তাকিয়ে দেখা ছাড়া যেহেতু কিছু করছো না, গিয়ে শুয়ে পড়ো। তোমাকে দেখে আমারই ঘুম পাচ্ছে। আপাতত দূর হও সামনে থেকে।“
কথা সত্য। ঘুম সংক্রামক। হাই তুলতে দেখলে অন্যদের মধ্যে হাই তোলার প্রবণতা বাড়ে। আমি হাই তুলতে তুলতে বিছানায় ফিরে যাচ্ছিলাম। মোটামুটি কানের কাছে বাজ পড়ল বিরাট শব্দ করে। বাচ্চাদের রুম থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। আরীবার গলা ভেসে এলো, “বাবা? ও বাবা?”
আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে আবছা অন্ধকারে ওদের দরজার বাহিরের একটা বুকশেলফের কোনায় পায়ের কেনি আঙ্গুল দুম করে লেগে গেল। “বাবারে!” আপনাআপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দাঁত মুখ খিচিয়ে ফেলেছি অন্ধকারে।
সাথে সাথে বাচ্চাদের ভেতর হাসাহাসির শব্দ শুরু হয়ে গেল। অরোরার গলা শোনা গেল, “বাবা তুমি আবার ব্যথা পেয়েছো?”
বলা বাহুল্য নোভা এই বুক শেলফ বাচ্চাদের দরজার বাহিরে বসানোর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে হলেও আমি পায়ের কেনি আঙুলে বাড়ি খাই। বাড়ি খেতে খেতে আমার কেনি আঙ্গুল বাহিরের দিকে বেঁকে যেতে বসেছে। বাসার বাকি সদস্যদের মধ্যে কেউ একদিনও বাড়ি খায়নি। শুধু আমিই কেন খাচ্ছি সেটা একটা রহস্য!
মশারী লাগানো হয়েছে বিছানায়। বাচ্চাদের রুমে কোনো চার্জার বাতি জ্বলছে না। তবে একটা বড় টর্চ আছে, আমার বড় মেয়ে আরীবা সেটা ধরে বসে আছে বিছানায়। বাকি তিনজন কাঁথার নিচে ঢুকে পড়েছে। আরীবার চেয়ে তিন বছরের ছোট হচ্ছে সহজ। সহজের চেয়ে দুই বছরের ছোট জিহান, জিহানের চেয়ে আড়াই বছরের ছোট হচ্ছে অরোরা। এদের মাঝে কেবল অরোরাই এখন স্কুলে যায় না। আড়াই বছর হয়েছে কেবল ওর। জিহান কেজি’তে পড়ছে এলাকার একটা স্কুলে। সহজ পড়ে টু’তে। আরীবা ক্লাস ফাইভে। আজ বৃষ্টি বেশি দেখে কাউকে নোভা ছাড়েনি। নিজেও অফিসে যায়নি। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সারাদিন বাসাতেই ছিল। নোভার ভাষ্যমতে, “সারাদিন আমার মাথা খেয়েছে তোমার ছানাপোনাগুলো! এক সেকেণ্ডের জন্য বিছানায় পিঠটা লাগাতে পারিনি! তুমি তো অফিস গিয়ে নিজে উদ্ধার পেয়েছো! আমাকে কে দেখবে!” সে হিসাবে সারাদিন বাসায় খেলে ধুলে এতক্ষণে সব’কটার ঘুমিয়ে যাবার কথা। কিন্তু সবাই জেগে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। জুলজুল চোখে তাকাচ্ছে। বেড়ালের মত তাকাচ্ছে কাঁথার ফাঁক দিকে।
“বাবা, বাহিরে তো অনেক বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভয় করছে। তুমি আজকে আমাদের সাথে ঘুমাবে?” আরীবা টর্চটা ছাদের দিকে তাক করে বলল। ছাদ জুড়ে অন্তত ষাট সত্তরটা তারা আর চিকমিকে স্টিকার লাগানো। টর্চের আলোয় জ্বল জ্বল করছে রাতের আকাশের তারার মত। নোভা লাগিয়েছে এসব বাচ্চাদের নিয়ে। জানালার পর্দা একপাশে টানা। কাঁচের জানালার ওপাশের রাতের আকাশ আর থেকে থেকে জ্বলে ওঠা দিনের আবছায়া দেখা যায় পানির বিন্দুর আড়াল থেকে। সব দরজা জানালা ভাল করে লাগানো, তাও হাঁড় কাঁপানো কেমন একটা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। সম্ভবত ভেন্টিলেটর দিয়ে। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে বাহিরের বাতাসের শিস কাটার মত। টিভি সিরিয়ালে এরকম রহস্যময় বাতাসের শব্দ শুনেছি। বাস্তবে খুব কমই শোনা যায়।
“বাবা?” সহজ কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে ডাক দিলো, “তুমি মাকেও নিয়ে আসো। মা ভয় পাবে নাহলে একা একা।”
আমি পায়ের ব্যথাটা উহ্য করে এগিয়ে গেলাম বিছানার দিকে। তোশকের নিচ থেকে মশারীর কোনো বের করে বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, “তোদের মা এত সহজে ভয় পায় না। মনে নাই গত বছর তোর ফুপির বিয়ে থেকে ফেরার পথে আমাদের সিএনজিটাকে হাইজ্যাকার ধরেছিল? তোর মা কি করেছিল?”
সাথে সাথে গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে আরীবা, সহজ আর জিহান। কেবল অরোরার কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। তার মনেই নেই কি হয়েছিল। সে চিত হয়ে পায়ের আঙ্গুল আরীবার টর্চের ওপর দিয়ে ছাদে পায়ের আঙ্গুলের ছায়া দেখায় ব্যস্ত। এতটুকু পা ছাদের ছায়াতে কত্ত বড় দেখায়! ইয়া বিশাল বিশাল পায়ের আঙ্গুল!
আরীবা চোখ বড় বড় করে একহাত গালে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছো বাবা! মা’র অনেক সাহস। গুণ্ডাগুলো জিহান আর অরোরার দিকে ছুরি তাক করতেই মা হুট করে রেগে কাঁই হয়ে যেভাবে এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিয়েছিল বড় গুণ্ডাটার! যদিও পোকা ধরা দাঁত। তাও তো দাঁত! বাকিদের আর চড়ই দিতে হয় নাই! বড় গুণ্ডা নিজেই আমাদের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। কি আশ্চর্য ব্যাপার তাই না বাবা!”
সহজ বিস্ময় ভরা গলায় বলল, “মা’র হাতে অনেক শক্তি তাই না বাবা!”
জিহান মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু ঐ গুণ্ডা আঙ্কেল তো এখনো নিয়মিত আম্মুর হসপিটালে যায়। দাঁত চেক করাতে। কেন যায় বাবা? উনার কি বাকি দাঁতেও সমস্যা হয়েছে? পোকা? উনিও কি চকোলেট খান অনেক বেশি?“
আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। নোভা ডেন্টিস্ট না। কিন্তু সেই রাতে ঘটনাক্রমে মড়িয়া হয়ে চড় মেরে এলাকার (গুণ্ডা) আফজাল ভাইয়ের পোঁকায় খাওয়া দাঁত ফেলে দিয়েছিল- এটা সত্যি। এমনকি আক্কেল দাঁতের মাড়ির মাংস সহ সোজা করে দিয়েছে। ব্যথার সমস্যা মুহূর্তের মধ্যেই সমাধান হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন নাকি তিনি এই ব্যথা নিয়ে কোঁকাচ্ছিলেন। নোভার চড় খেয়ে সেই ব্যথা রাতারাতি উবে যাবার পর তিনি ডাক্তার আপা বলতেই গদ গদ হয়ে যান। নোভার হাসপাতালে দাঁতের সমস্যার রোগী নিয়ে নিয়ে হাজির হন দুই দিন পর পর। নোভা যদিও বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে যে সে দাঁতের ডাক্তার না, কিন্তু আফজাল ভাইকে সেটা বোঝানো সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে নোভা অন্য ডেন্টিস্টদের কাছেই রোগী রেফার করে দেয় এখন। জিহানের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে রোগী সাপ্লাই এখনো অব্যহত আছে। প্রথম প্রথম নোভা প্রায়ই বলত এসব। আগে অফিস থেকে ফিরে গজ গজ করতে করতে বলত, “শিহাব, আগে ভাবতাম গুণ্ডা ফুণ্ডা কঠিন জিনিস। এখন দেখছি গুণ্ডা সামলানো পাগল সামলানোর চেয়ে সহজ।“ এখন এসব বলাই ছেড়ে দিয়েছে। নতুন কোনো গল্প তো আর না।
রান্নাঘরের দিক থেকে নোভার ঠুক ঠাক, টুন টুন শব্দ ভেসে আসছে। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। কারেন্ট আসার নামই নেই। সম্ভবত ট্রান্সফর্মার ‘ফুটেছে’। আমাদের এলাকায় যে কোনো দূর্যোগে সবার আগে যেটা নষ্ট হয়, সেটা হচ্ছে ইলেক্ট্রিকের ট্রান্সফর্মার।
আরেকবার বাজ পড়ল। কিন্তু বাচ্চারা এবারে তেমন একটা ভয় পেলো না। আরীবা নতুন একটা খেলা শিখিয়েছে। ভয় পেলে সাহস বাড়াতে হলে নাকি সবার হাত ধরে ধরে শেকল বানাতে হয়। বাজ পড়লেই আরীবা, সহজ, জিহান আর অরোরা হাত ধরাধরি করে শেকল বানায়। যদিও এই মুহূর্তে প্রথম তিনজন হাত ধরে শেকল বানিয়েছে, অরোরার এক পা ধরে রেখেছে জিহান। ও ডিগবাজি আর হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে কাঁথার ভেতরে। শিকলের আরেক মাথায় আরীবা আমার ডান হাতের আঙ্গুল ধরে আছে। যত বড় শিকল তত বেশি সাহস। আরীবা বলল, “মা আসলে আমাদের সাহসের শিকল অনেক শক্তিশালী হবে! তাই না সহজ?”
সহজ অনুগত ভাইয়ের মত মাথা নাড়ালো, “ঠিক। আম্মু এসে ধরলে অনেক শক্তিশালী হবে!”
“মা আসবে না?” অরোরা কাঁথার নিচ থেকে জিজ্ঞেস করল।
“আসবে। তোমরা একশো থেকে উলটো দিকে ভেড়া গুণতে থাকো, মা চলে আসবে।“ আমি বললাম।
“ধুর বাবা! তাহলে তো ঘুমিয়ে যাবো! আমরা তো ঘুমাতে চাই না এখন!” জিহান এক হাতে সহজের হাত অন্য হাতে অরোরার পা ধরে রাখতে রাখতে হিমশিম খেতে খেতে বলল।
“তাহলে? এখন ঘুমাবে না তো কি করবে?” আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
“আমরা ভয় পেতে চাই। কিন্তু ঘুমাবো না। ভয় পাবো আর হাত ধরে বসে থাকবো। বাজ পড়ার শব্দ শুনবো। আর মা এলে গল্প শুনবো।“ আরীবা হাসি হাসি মুখে বলে।
“এটা আবার কেমন কথা! ভয়ও পেতে চাও, সাহসের জন্য মানব শেকলও বানাতে চাও! বাজের শব্দও শুনতে চাও!” আমি হকচকিয়ে যাবার মত ভাব করলাম।
“হুউ!” আরীবা টর্চ নিভিয়ে দিয়ে আবার হাত ধরল আমার। “আচ্ছা বাবা, তুমি তো অনেক লেখালেখি করো। তুমি ছোটদের জন্য বই লেখো না কেন?”
উন্মুক্ত বাম হাত দিয়ে মাথা চুলকালাম, এই উত্তর দেয়া মুশকিল। তাও আবার সাত বছরের বাচ্চাকে বোঝাতে গেলে সব বুঝবেও না। “একেবারে যে লিখিনি, সেটা ঠিক না। ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া তো লিখেছিলাম।“
“ওটা বাদে। বাকি সব তো বড়দের বই। আমাদের জন্য গল্প লেখো না কেন তুমি?”
“ইয়ে, আসলে আমার কাছে মনে হয় তোদের জন্য গল্প লেখাটা সবচেয়ে কঠিন কাজ! বড়দের জন্য লেখা অনেক সহজ।“
“কেন?” সহজ জিজ্ঞাস করল। যদিও সহজ বই পড়া তেমন ভাল করে শিখেনি। ছবিওয়ালা বই পড়ে ও আর জিহান। অরোরা পপ-আপ বই পড়ে টুকটাক। ছিঁড়ে তারচেয়েও বেশি। আমাদের ছানাপোনাগুলোর মধ্যে কেবল বইপড়া শিখেছে ভালমত আরীবা। নোভা ভাল ভাল ছোটদের দেশী বিদেশী বই কিনে দেয় ওকে বাতিঘরে নিয়ে। মোটামুটি ক্লাস সেভেন এইটের লেভেলের গল্পের বইও পড়া ধরে ফেলেছে এই বয়সেই। যদিও আমার লেখা বইগুলো নিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। পারার কথাও না এত তাড়াতাড়ি।
সহজের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নোভা চলে এলো চার্জার বাতি নিয়ে। “কারণ বড়দের বোকা বানানো অনেক সহজ। ছোটদের বোকা বানানো অনেক কঠিন। বড়দের ভুজুং ভাজুং লিখে তাই ভাঁজ দেয়া যায়। ছোটদের বইয়ে তো সেটা ভাঁজ দেয়া যাবে না। ধরে ফেলবে। তাই তোদের বাবা ছোটদের বই কম লেখে।“ মশারীর কোনা তুলে আমার পাশে উঠে বসল। চার্জার বাতিটা নিভিয়ে দিতেই ঘরময় ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো। এতক্ষণতো রান্নাঘরের দিক থেকে আলো আসছিল দরজা দিয়ে। এখন সেই আলোও নেই। কেবল জানালার কাঁচে বাহিরের বিদ্যুৎ চমকানোর আলো।
“তাই নাকি! বড়রা বোকা নাকি মা!” আরীবা ভীষণ অবাক হয়ে তাকায় নোভার দিকে।
“মোটামুটি। বড়রা সব বোঝে না। ছোটরা সব বোঝে। এই যে তুই ক্লাস ফাইভে পড়ে ক্লাস এইটের সহপাঠের গল্প পড়িস- এটা কি বড়রা পারে?”
“তাই তো!” আরীবা খুশিতে নড়ে চড়ে বসে।
জিহান মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু মা, বাবা যদি ছোটদের গল্প না লেখে, ছোটদের গল্প কে লিখবে? সবাই তো বড় মানুষ। ছোট মানুষ কি গল্প লেখে?”
“সেটাও তো কথা। ছোটদের গল্প তো আসলে ছোটদের লেখা উচিত।“ নোভা হাসি চেপে বলল।
“আচ্ছা তাহলে তো বাবা যখন ছোট ছিল, তখন ছোটদের জন্য লিখে রাখতে পারত। এরপর বড় হয়ে বই ছাপাতো?” সহজ উজ্জ্বল মুখে তাকালো আমার দিকে, “বাবা তুমি তোমার ছোটবেলায় গল্প লেখোনি ছোটদের জন্য?”
কি বিপদ! চোখ পিটপিট করলাম বার কয়েক। “ইয়ে, একেবারেই যে লেখিনি তা না। কিন্তু সব তো হারিয়ে ফেলেছি!”
“কি বলো! হারাবে কেন? তোমার লেখা গল্প তোমার মনে থাকবে না?” আরীবা প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠল।
অরোরাও কাঁথার ভেতর থেকে মাথা তুলে বোনের সাথে গলা মেলালো, “থাকবে না! থাকবে না!!”
আমি নোভার দিকে তাকালাম। নোভার চোখে হাসি। যেটার অর্থ হচ্ছে- নেও সামাল দেও।
আমি বোকার মত চার ছানাপোনার দিকে তাকালাম এক নজর। চারজনেই বুঝে না বুঝে আমার দিকে খুব আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। “ইয়ে, হালকা পাতলা কিছু মনে থাকার কথা। বড় হলে ছোটবেলার কথা মানুষ ভুলে যায় অনেকটা। গল্প লিখলেও সবটা মনে নেই।“
“কিছু তো মনে থাকবে! বাবা প্লিজ তোমার ছোটবেলায় লেখা গল্প শোনাও না!” আরীবা প্রায় মিনতি ভরা গলায় বলল। বাকিরাও গলা মেলালো, “বাবার লেখা ছোটদের গল্প শুনবো। যা মনে আছে, শোনাও বাবা, প্লিজ!”
আমি গাল চুলকালাম। ঘ্যাস ঘ্যাস করছে কদিনের সেভ না করা গাল। নোভার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি ট্রাই করতে পারি। তবে কোথাও আটকে গেলে তোদের মা বাকিটা জোড়া দিয়ে দিবে। তোদের মা না লিখলেও গল্প বানানোতে জুড়ি মেলা ভার।“
নোভা হাত নেড়ে আঁতকে উঠল, “আমাকে আবার টানছো কেন! আমি কি তোমার মত লেখক নাকি!”
“আরে তুমি তো চলতি ফিরতি লেখিকা। এত বড় সংসার একা একা লিখে ফেলেছো। চার চারটা ছানাপোনার চলমান কাহিনী- তোমার চেয়ে ভাল কে আর গল্পে কথা জোগান দিতে পারে? আমি আটকে গেলে টেনে নিও। মানে বড়দের লেখা লিখতে লিখতে অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে, শেষে ছোটদের গল্প বলার মাঝে যদি বড়দের গল্প ঢুকিয়ে বসি! তাই জোগান দিবে। ব্যস!“
সাথে সাথে অরোরা গলা মেলালো, “ব্যস! ব্যস!!” জিহানও “হু হু!” করে উঠল। সুর মেলালো সহজও। কেবল আরীবা ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলল, “শ-স্! সবাই চুপ। বাবা গল্প শোনাবে ছোটদের গল্প!”
লম্বা একটা দম নিলাম বুক ভরে। মেঘের ডাক শোনা যায়। আবছা অন্ধকারের মাঝে সামনে আমার শ্রোতা চার উৎসুক সন্তান আর স্ত্রী। ছোটবেলায় লেখা একটা গল্প দিয়ে শুরু করলাম।

নীলপরী আর বাঁশিওয়ালা

“আজ থেকে বহু বহু বছর আগের কথা। একটা শহর ছিল। শহরের নাম ছিল হিমাদ্রিনগর। পাহাড় ঘেষা শহর। উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড় আর পাহাড়ের নিচ দিয়ে এলোমেলো খরস্রোতা এক নদী। মেঘের অনেক কাছাকাছি ছিল কয়েকটা পাহাড়। মেঘ ফুঁড়ে পাহাড়ের চূড়া উঠে গিয়েছে সেখানে। পাহাড়ের কোলে নিচের শহর। বছরের চার মাস বরফ পড়ে, চার মাস ঝকঝকে রোদ আর জ্যোৎস্না, আর চার মাস বৃষ্টি বাদল। তবে সব ঋতুতেই নানান জাতের ফুল ফুটতো সেই শহরের সব বাগানে। শহরের ঠিক মাঝখানে ছিল বিশাল একটা পার্ক। হরেক রকমের ফুলের গাছ আর ফলের গাছ ছিল। প্রতিদিন বিকেলে সেই পার্কে শহরের সব বাচ্চারা হৈ চৈ করে খেলতে আসত।

সেই পার্কের মাঝে বিশাল একটা গাছ ছিল। গাছটার নাম কেউ জানে না। যে গাছের নাম নেই- এমন এক গাছ। পাতাগুলো ছিল নীল। বছরে একবার শুধু ফুল ফুটতো সেই গাছে। নীল সাদা আর লাল বেগুনী মিলে মিশ্র একটা রঙের ফুল। সমস্ত শহরের বাচ্চারা সেই ফুল নিতে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিত। কারণ সেই ফুল বালিশের পাশে মাথার কাছে নিয়ে ঘুমালে নাকি পরদিন ভোর বেলা একটা করে উপহারের বাক্স পাওয়া যেত। বাক্সে থাকতো বিচিত্র কোনো উপহার। বড়রা সেই ফুল নিলে লাভ হত না। ফুলের বিনিময়ে কেবল উপহার পাওয়া যেত যদি সেটা কোনো বাচ্চা নিয়ে ঘুমাতো।
শহরের বড়রা জানতো, কিন্তু ছোট বাচ্চারা জানতো না একটা মজার বিষয়। সেটা হচ্ছে সেই নাম না জানা গাছে থাকতো এক নীলপরী…”
“বাবা, নীলপরী দেখতে কতটুকু ছিল? টিংকার বেলের মত?” অরোরা রিনরিনে গলায় বলে উঠল।
আমি ভ্রু কুঁচকে ছোট মেয়ের দিকে তাকালাম। “গল্পের মাঝে কথা বলা নিষেধ। ফ্লো কেটে যায়।“
সাথে সাথে আরীবা ধমক লাগালো ছোটটাকে, “এই চুপ! কেউ কোনো কথা বলবে না! বাবা তুমি বলতে থাকো।”
আমি আবার শুরু করলাম।
“সেই গাছে থাকতো নীলপরী। নীলপরী অনেক অনেক বছর ধরেই সেই গাছের ওপরের দিকের একটা ডালে, পাতার আড়ালে ছোট্ট একটা কাঠের কেবিনে থাকতো। জাদুর কেবিন। বাহির থেকে দেখা যায় না। কিন্তু ভেতরে বিশাল স্পেশ। প্রায় ডুপ্লেক্স বাংলোর মত। সেই বাড়িতে আবার সুইমিং পুলও আছে। নীলপরী অবসর সময় জ্যোৎস্না রাতে সেই সুইমিং পুলে নেমে গোসল করত আর গান গাইতো। সেই বাংলোর দো’তলায় একটা পিয়ানো আছে, নীলপরী মনের সুখে সেই পিয়ানোতে সুর তুলে রাত বিরাতে বাজাতো। আবার নিচতলায় আছে অদ্ভুত এক রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরে নীলপরী রান্না করতে বসলে পুরো শহরে মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরত। সবাই ভাবতো, পার্কের ফুলগাছ থেকে ফুলের ঘ্রাণ বইছে।
এই নীলপরী কিন্তু শহরের বড়দের কাছে অনেক আগে থেকেই পরিচিত ছিল। বড়রা জানতো যে শহরে একটা পরী আছে যে বাচ্চাদের গান শোনায়, ভাল ভাল কাজ শেখায়। বলা যায় স্কুলের শিক্ষিকার মত সব অভিভাবকরাই জানতো নীল পরী আছে, কোথায় থাকে সেটা অবশ্য জানতো না, কিংবা দেখতে ঠিক কেমন। অল্প কিছু অভিভাবক তাকে মেয়রের অফিসে আসা যাওয়ার কারণে চিনলেও বেশিরভাগ মানুষই ভাল করে চিনতো না যে কোনটা আসলে নীলপরী। বাচ্চারাও না। আর শহরের মেয়র গোবুচন্দ্র সাহেবের সাথে নীলপরীর চুক্তি ছিল। প্রতিবছর সেই চুক্তি নবায়ন করা হত। চুক্তি হচ্ছে, শহরের সব বাচ্চাকে রাতের বেলা ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুমা পাড়াতে হবে। এমন ভাবে সবার বিছানার কাছে গিয়ে গান গাইবে যেন মনে হয় রূপকথার দেশ থেকে গান ভেসে ভেসে আসছে। সেই গান শুনে ঘুমিয়ে যাবে তারা প্রতিরাতে। সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখবে। আবার প্রতিদিন ভোরবেলা নীলপরী এসে বাচ্চাদের কানের কাছে ঘুম জাগানি গান গাইবে"
“বাবা ঘুম জাগানি গান কি?” জিহান ফস করে বলে বসল।
সাথে সাথে আরীবা জিহানের মাথায় চাটি মারল। “কথা বলতে নিষেধ করেছি না!”
আমি আবার শুরু করলাম।
“ঘুম পাড়ানি গান যেমন আছে
রাত্রী এলো আঁধার নিয়ে কঙ্কাবতী গায়’রে
খুকির চোখে ঘুমটি এলো স্বপন মেঘের ছায়’রে।

তেমনি ঘুম জাগানি গানও আছে। যেটা ফিসফিস করে নীলপরী বাচ্চাদের কানের কাছে গাইলে ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতো সবাই।
সূয্যি এলো রাঙা ঘোড়ায় চোখটি মেলে চাও,
ইস্কুলে যে ঘণ্টা দিবে এবার উঠে যাও।
দাঁতটি মেজে, মুখটি ধুয়ে চুল আঁচড়ে ঝুটি
অল্প ক’খান ক্লাস করবে, তারপরেতেই ছুটি!

নীলপরী প্রতিদিন নানান রকম গান গেয়ে বাচ্চাদের জাগাতো। ব্রাশ করতে, মুখ ধুতে, জামা কাপড় পড়তে, নাস্তা করতে, টিফিন নিতে- সব ধরণের ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিয়ে ওর গান ছিল। বাচ্চারা ভাবত, আরে! কোত্থেকে এত্ত সুন্দর করে গান ভেসে ভেসে আসে! কে তাদের এসব কাজ করতে বলে? পরীকে তো কেউ দেখে না। শুধু বড় মানুষেরা দেখে!”
“কিন্তু বাবা আমি তো জানতাম পরীদের শুধু বাচ্চারাই দেখতে পায়। বড় মানুষেরা দেখতে পায় না!” সহজ প্রতিবাদ করল। যথারীতি আরীবার চাটি খেয়ে মাথা ডলতে ডলতে চুপ হয়ে গেল।
“আমার গল্পে ছোটরা পরী দেখতে পায় না। বড় মানুষেরা পরী দেখতে পায়। আরেকবার ডিস্টার্ব করলে আমি কিন্তু গল্প বলা বন্ধ করে দিব।“ চোখ পাকিয়ে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালাম। যদিও অন্ধকারে তেমন কিছু একটা বোঝা গেল না। বা ওরাও আমার চোখ পাকানো দেখতে পেল না মনে হল।
“যা হোক। এভাবেই দিন চলছিল। মেয়র গোবুচন্দ্র বছর বছর কন্ট্রাক্ট রিনিউয়্যাল মানে নবায়ন করত নীলপরীর সঙ্গে। বাচ্চাদের নানান ধরণের শিক্ষামূলক গান শোনানো এবং ভাল ভাল কাজের উপদেশ ছড়ায় ছড়ায় দেয়ার জন্য গোবুচন্দ্রের এসিস্টেন্ট হবুচন্দ্র বিভিন্ন স্ক্রিপ্ট লিখে রাখত। নীলপরী এসে সেইসব স্ক্রিপ্ট দেখে বাছাই করে এটা সেটা কারেকশন, প্রুফ করে সেগুলো বাচ্চাদের জন্য গেয়ে শোনাতো। এমনকি বিকেল বেলা পার্কে খেলার সময় নীলপরী রঙধনু তৈরি করতে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উড়ে যেত।
নীলপরীর সঙ্গে মেয়রের বিভিন্ন চুক্তি ছিল। যেমন মাসে দুইবার রঙধনু দেখাতে হবে। বিনিময়ে শহরের সেরা ব্র্যাণ্ডের শো রুমে ফিফটি পার্সেন্ট ডিস্কাউন্টে পরীজামা কিনতে পারতো। রাতের বেলা বাচ্চাদের ঘুমের গানের সময় এ বি সি ডি নিয়ে গান করলে বিভিন্ন সুপার শপে ফ্রি তে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক শপিং করতে পারত। সকাল বেলার ঘুম জাগানি গান গাইলে সেই সাথে যদি মেয়রের নিজের ব্র্যান্ড গোবুচন্দ্র স্ট্যাশনারি নিয়ে গান গেয়ে যদি স্কুল ব্যাগ, পেন্সিল, ইরেজার, স্কেল বা জ্যামিতি বক্সের বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে- নীলপরী শহরের সেভেন স্টার হোটেল হিমাদ্রিটনে দুই রাত তিন দিন ফ্রিতে থাকার সুযোগ পেত। সাথে স্পা, জিম, সুইমিং আর সকালের ব্যুফে ব্রেকফার্স্ট। মোটামুটি বাচ্চাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল নীলপরী। এই নিয়ে মেয়র, অভিভাবকগণ এবং নীলপরী অনেক সুখে দিন কাটাচ্ছিল।
নীলপরীর দৈনিক রুটিন খুব সহজ ছিল। প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটায় স্পেশাল ঝিঁঝিঁ পোকার বোয়মে এলার্ম দেয়া থাকত। সেই এলার্মের আওয়াজে উঠে পড়ত। উঠে দাঁত মেজে, ডানা পিঠে লাগিয়ে, জামা বাছাই করে পরে…”
“বাবা? পরীদের তো ডানা থাকেই। পিঠে ডানা লাগাতে হবে কেন?” এবারে আরীবা নিজেই হতভম্ব গলায় বলে বসল।
নোভা উত্তরটা দিয়ে দিল, “তোদের আব্বার গল্পে সবকিছুই তার মত হবে। অন্যদের মত কেন হতে হবে? স্পাইডারম্যানের হাতের ভিতর থেকে জাল বের হয়, নাকি হাতে লাগানো মেশিন থেকে জাল বের হয় এটা মুখ্য বিষয় না। বিষয় হচ্ছে জাল বের হয় কিনা। এখানে নীলপরীর ডানা আলাদা ভাবে লাগানো যায়। ডানা নিয়ে জন্মাতে হয় না।”
“কিন্তু ডানা নিয়ে যদি জন্মই না হয়, ওকে পরী বলবে কেন?” আরীবা প্রতিবাদ জানায়।
আমি গলা খাকারি দিলাম, “গল্পে সব সম্ভব। জীবনে কোনোদিন দেখেছিস পরীরা জামা কিনতে সুপারশপে কিংবা শো রুমে যায়? আমার নীলপরী যায়। সো কোনো কথা হবে না। আরেকবার কথা বললে আমি মশারী থেকে বাহির।“
সাথে সাথে সবাই চুপ।
আমি শুরু করলাম।
“তো যা বলছিলাম। নীলপরী খুব ভোরে উঠে ডানা আলমারি থেকে বের করে পরিষ্কার করে পিঠে লাগিয়ে নেয়। এরপর জামা বাছাই করে জামাও পরে। এরপর বিভিন্ন আতর, খুশবু, সেন্ট, পারফিউম লাগিয়ে সাজগোজ করে। আইলানার, মাশকারা লাগায়।“
“কিন্তু পরীরা তো এমনিতেই অনেক সুন্দর। ওদের তো সাজার দরকার নাই।“ আরীবা ফস করে বলে উঠল।
“তুই কয়টা পরী দেখেছিস? সিনেমার নায়িকারা তো সিনেমায় দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু কয় কেজি স্নো পাউডার লাগায় শুটিং এর আগে, দেখেছিস? পরীরাও তেমনই। তাদেরও সাজগোজ করা লাগে। তারাও বিউটিপার্লারে যায়। বয়স লুকানো লাগে তাদেরও।“
“অ!” আরীবার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“তো যেখানে ছিলাম। নীলপরীর বয়স কিন্তু খারাপ না। মোটামুটি হাজার বছরের বেশি হবে। এর আগে অনেক শহরে ছিল। সেখানকার বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানি, ঘুম জাগানি, রঙধনু এসব করে বেরিয়েছে। পোস্টিং নিতে নিতে হিমাদ্রিনগরে এসে থেমেছে বিশ বছরের মত হবে। পার্কের মাঝের গাছটা পরীদের সার্ভিস সেন্টার থেকে লাগানো। সব শহরেই এই গাছ আছে। সেই স্ব স্ব শহরের স্ব স্ব পার্কের মধ্যের বিশাল গাছে সেই শহরের দায়িত্ব প্রাপ্ত নীলপরীরা থাকে। যার যার চুক্তি মত কাজ করে শহরের মেয়রের সাথে। নিজেদের ইনকামের একটা অংশ পরী সার্ভিসিং সেন্টারে বছরে একবার পাঠিয়ে দেয়। পার্ফমেন্সের ভিত্তিতে পরীরা সার্ভিসিং সেন্টার থেকেও ভাল রিটার্ন পায়। আমাদের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের মত…”
“শিহাব! তোমার গল্প কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের থেকে বড়দের দিকে চলে যাচ্ছে।“ নোভা হাসতে লাগলো আচমকা।
সাথে সাথে বাকিরাও হাসাহাসি শুরু করে দিল।
আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “বেশ। জটিল করবো না। সহজ রাখছি। …… তো নীলপরী তার গাছের স্পেশাল ফুল যেই বাচ্চারা নিয়ে মাথার কাছে রেখে ঘুমাতো, তাদের কাছে সুন্দর সুন্দর বক্সে ভরে গিফট দিয়ে আসত। কোনো বাক্সে থাকতো সুন্দর গানের ওয়াকম্যান। কোনো বাক্সে থাকত এমন বাইনোকুলার যা দিয়ে শনি গ্রহের বলয় পর্যন্ত দেখা যেত। কোনো বাক্সে থাকত সুন্দর রঙ পেন্সিল। অবশ্য সবই ছিল গোবুচন্দ্রের নিজস্ব কারখানা থেকে বানানো গিফট। যাতে পরদিন স্কুলের সব বাচ্চারা এসব গিফট দেখে দোকানে গিয়ে কেনার জন্য হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দেয়। মোটকথা, হিমাদ্রিনগরের অনেক বড় সেলিব্রেটি ছিল নীলপরী। সে যে ব্র্যাণ্ডে হাত দিত, মেয়রের পকেট ফুলে ফেঁপে ভরে উঠত!
নীলপরীর খুব ভক্ত এক বাচ্চা ছিল সেই শহরে। নাম জুনাইনা।"

সাথে সাথে অরোরা চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই!” জুনাইনা হচ্ছে অরোরার খেলার বান্ধবী। পাশের বাসায় থাকে। পিঠাপিঠি বয়স।
“না, পাশে বাসারটা না। আরেকটু বড় এবং আরেকজন। স্কুলে যায়। ক্লাস টু’তে পড়ে। খুব লক্ষী মেয়ে, তোদের মতই। নিয়মিত স্কুলে যায়, হোমওয়ার্ক করে, রাতে সবজি দিয়ে ভাত খায়, দশটা বাজতেই শুয়ে পড়ে, ভোরবেলা ওঠে, জগিং এ বের হয় বাবা মায়ের সাথে। পার্কে গিয়ে বিকেলে খেলা সবার সাথে। সে নীলপরীর এত ভক্ত ছিল যে প্রতিরাতে ঘুমাবার আগে তার স্কুলের ব্যাগের চেইন খুলে রাখতো, আর পড়ার টেবিলে চিরকুটে লিখে রাখতো, “নীলপরী, তুমি আমার গিফট এনেছো?”
আমাদের নীলপরী একটু সেলেব্রিটি গোছের পরী হলেও এই জুনাইনা মেয়েটাকে ভীষণ পছন্দ করতো। যদিও কোনোদিন সামনা সামনি এসে বলেনি যে সে’ই নীলপরী। কিন্তু কিছুদিন পর পর গোবুচন্দ্রের নতুন কোনো ব্র্যান্ড বা পণ্য বাজারে চালু করার জন্য মার্কেটিং করতে দিলে নীলপরী সবার আগে সেটা জুনাইনার ব্যাগে রেখে দিত। রেখে চেইন লাগিয়ে দিত। তারপর ইচ্ছা করে জুনাইনাকে মন ভুলানি ছড়া ঘুমের সময় শুনিয়ে দিত। যেন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ চেক না করে। স্কুলে গিয়ে চেক করে।
ঠিক তাই হতো। জুনাইনা ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ চেক করতে ভুলে যেত একদম। স্কুলে গিয়ে ব্যাগ খুলতেই কোনোদিন ওয়াকম্যান, কোনোদিন নতুন জ্যামিতি বক্স বের হত। সাথে সাথে সারা ক্লাসে হই চই লেগে যেত। কেউ কেউ আবার হিংসাও করত যে নীলপরী বুঝি জুনাইনাকেই ভালবাসে বেশি। অবশ্য অন্যদের ব্যাগেও গিফট পাওয়া যেত। তবে জুনাইনার বেশি।
সব মিলিয়ে এভাবেই ভালই দিন যাচ্ছিল হিমাদ্রিনগরের।
আমরা গল্পে, উপন্যাসে কিংবা রূপকথায় শুনেছি পরীরা নাকি অনেক ভাল হয়। তাদের মধ্যে কোনো ভুল ত্রুটি থাকে না। কিন্ত আমাদের নীলপরীর মধ্যে অহংকার ছিল। সে ভাবতো, এই শহর তাকে ছাড়া অচল। তাকে ছাড়া এই শহরের একটা দিনও হয় না, রাতও নামে না। এমনকি ঋতুও বদলায় না। তাকেই সব করা লাগে। এজন্য প্রতিবছর মেয়রকে কমিশন বাড়ানোর জন্য চাপ দিতে থাকতো নীলপরী। মেয়রও উপায় না দেখে নীলপরীর কন্ট্রাক্টে অনেক সুযোগ সুবিধা দিতে থাকে।
তো এরকম এক সন্ধ্যার ঘটনা। নীলপরী সবে মাত্র পার্কের ছেলেমেয়েদের সাথে আড়ালে আড়ালে গান গেয়ে খেলা শেষে, জামা কাপড় বদলে মানুষের মত সাজ নিয়ে একটা দামী রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খেতে গেল। সন্ধ্যার সময়, তার ওপর ঠাণ্ডার দিন। বরফ পড়বে কদিন বাদেই, হু হু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নীলপরী ডানাখুলে এসেছে। যেন কারো চোখে সেভাবে না পরে। রেস্টুরেন্টের এক কোণায় বসে পত্রিকা খুলে পড়তে পড়তে স্যুপ আর ফ্রাইড চিকেন অর্ডার দিল।

পত্রিকায় অনেক আজেবাজে কথা লেখা। কীসব ইন্টারনেট, মোবাইল, টিভি, ক্যাবল- এসব নাকি আসবে শীঘ্রই। বিনোদনের জন্য নাকি এসবের জুড়ি মেলা ভার। নীলপরী বাঁকা হাসি হাসল আপনা আপনি। বিনোদনের জন্য নীলপরী থেকে সেরা আর কি আছে? লোকজনের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এসব যন্ত্রের বাক্সের সামনে গিয়ে বসবে! যন্ত্রের বাক্সে কি আর সুর হয়? আনন্দ লাগে রঙধনু দেখার?
“আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দেবেন?” আড়ষ্ট স্বরে একটা গলা খুব কাছ থেকে শুনে চমকে উঠল নীলপরী। পত্রিকা থেকে মুখ তুলে বাহিরে জানালার দিকে তাকালো।
বাহিরে সন্ধ্যার হি হি ঠাণ্ডা বাতাসে ছেঁড়া, তালি দেয়া একটা কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে অস্বাভাবিক লম্বা আর শুকনো এক তরুণ। মাথায় হ্যাট দেয়া। সেই হ্যাটেও তালি দেয়া। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। বড় বড় চোখগুলোয় ক্ষুধার্ত দৃষ্টি। অনেকদিনের না খাওয়া একটা চেহারা। খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে নীলপরীর দিকে।
নীলপরী সামান্য বিরক্ত হয়ে বলল, “এখানে ভিক্ষে করতে এসেছ কেন? এটা দামী রেস্টুরেন্ট। এখানে ভিক্ষে করতে আসবে না। চলে যাও।“
“আপনি তো সব খাচ্ছেন না। বেঁচে যাওয়া খাবার থেকে যদি কিছু খেতে দিতেন? আমি অনেকদূর থেকে এসেছি। থাকা খাওয়ার জায়গা নেই।”
“কি বিপদ!” নীলপরী ভারি বিরক্ত হল। তবে ছেলেটা ঠিকই বলেছে। বেশি খাবার নিয়ে ফেলেছে সে। এত কিছু খেয়ে শেষ হবে না। নষ্ট হবে। কি মনে করে একটা ফ্রাইড চিকেন প্লেট থেকে তুলে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কঠিন মুখে বলল, “এখন দূর হও এখান থেকে। আর যেন ঘুর ঘুর করতে না দেখি। আমি শান্তি মত খেতে চাই।“
ছেলেটা খাবারটা নিয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো নীলপরীর দিকে। তারপর সরে গেল সেখান থেকে।
নীলপরী পত্রিকায় মন বসানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মন বসছে না। টিভি নামের বাক্স আর ক্যাবল, ইন্টারনেট নামের বিনোদন মাধ্যমের কথাগুলো ঘুরে ফিরে মাথায় আসছে। বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বরফ পরার আগে এরকম হুটহাট বৃষ্টি হয়ে ঠাণ্ডা নামে। এরপর চূড়ান্ত বৃষ্টি।
খেতে ভাল লাগছে না। খাবার অসমাপ্ত রেখে উঠে গেল। রাত নেমে গেলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে আবার বের হতে হবে ডানা লাগিয়ে, ভ্যানিসিং ক্রিম মেখে ভ্যানিস হয়ে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পার্কে ফেরার পথে হাতের বা পাশে বিশাল এক অন্ধকার দানবের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে নতুন শপিং মলটা। মেয়র গোবুচন্দ্র বানাচ্ছে এই শপিং মল। বাহিরের অনেক কোম্পানি নাকি বিচিত্র সব জিনিস নিয়ে ব্যাবসা করবে এখানে। নতুন নতুন অনেক জিনিস আসবে। ঠিক কি কি জিনিস আসবে তা জানে না। তবে পত্রিকায় লেখা হয়েছে, নতুন শপিং মল উদ্বোধন করলে সেখানে টেলিভিশন, কেবল, মোবাইল, ইন্টারনেটের দোকান নাকি আসবে। পত্রিকায় তো কত কিছুই লেখা থাকে। নীলপরী মাথা থেকে এসব ঝেড়ে হাঁটতে লাগলো। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। ছাতা আনতে ভুলে গেছে। দৌড়ে পার্কে গিয়ে ঢুকলো অন্যকেউ দেখে ফেলার আগে। ছুটে গিয়ে বড় গাছটার কাছে এসে সবে উঠতে যাবে, হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় দেখলো গাছের নিচে কে যেন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে! চমকে উঠলো নীলপরী।

“এই কে তুমি! এখানে কেন শুয়ে আছো?” বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নীলপরী জিজ্ঞেস করে।
শুয়ে থাকা মানুষটা কাঁপছে ঠাণ্ডায়। মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই চমকে উঠল নীলপরী। এতো সেই ছেলেটা! যাকে একটু আগে খাবার দিয়েছিল!
“এই তুমি এখানে কেন এসেছে? আমার পিছু নিয়েছো নাকি?” খানিকটা ভীত গলায় বলে নীলপরী।
“না তো!। থাকার জায়গা নেই দেখে ভাবলাম পার্কের এই গাছটার নিচে এসে শুয়ে থাকি। এই বৃষ্টিতে যাবো কোথায়? কেউ তো জায়গা দিচ্ছে না!” কাঁপতে কাঁপতে বলল ছেলেটা।
নীলপরী একটু নরম হল। দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটার জ্বর এসে গেছে। ঠিকমত কথা বলতে পারছে না। কিন্তু এই ছেলেকে তো বলা যাবে না যে সে নীলপরী। এমনকি ওপরে ডালের ভেতর যে বাসা রয়েছে তার, সেখানেও নেয়া যাবে না। নিলেই বিপদ। কি করা যায়!
“আচ্ছা তুমি এখানে থাকো। আমি তোমার জন্য ছাতা নিয়ে আসছি।“
“লাগবে না। আমার অভ্যাস আছে।“ কাঁপতে কাঁপতে বলল ছেলেটা।
কিন্তু নীলপরীর মায়া লাগলো। সে দৌড়ে গিয়ে কাছের একটা দোকান থেকে একটা ছাতা আর তাবু নিয়ে এলো ছেলেটার জন্য। নিজে নিজেই ভিজে ভিজে ছেলেটার জন্য তাবু লাগিয়ে দিল পার্কের আরেক মাথায়। গাছটা থেকে দূরে। ছাতা দিয়ে ছেলেটাকে সেই তাবুতে পৌঁছে দিল।
“আপনার নাম কি?”
“আমার নাম জানা লাগবে না।“
“আপনি জানেন, আপনি পরীর মত সুন্দর!” জ্বরের ঘোরে তাবুর ভেতর ছেলেটা বলতে থাকে ছেলেটা। নীলপরী বলে, “রাত হয়ে গেছে। আমি যাই। অনেক কাজ আছে আমার।“
“আপনাকে ধন্যবাদ কীভাবে দেই?”
“লাগবে না। সকাল হলে তাবু সহ বিদায় হবে। এটা হচ্ছে ফাইনাল কথা। পার্কে কারো থাকা নিষেধ।“
“কিন্তু আপনি তো পার্কে আছেন।“
“আমি চলে যাচ্ছি। ছাতা হারিয়ে ফেলায় খুঁজতে এসেছিলাম। পাইনি।“ কথা ঘুরিয়ে উত্তর দিল নীলপরী।
ছেলেটা আর কোনো কথা বলল না। জ্বরের মধ্যে ঘুমিয়ে গেছে ভেজা শরীরে। নীলপরী খুব অল্পই জাদু জানে। প্র্যাক্টিসের অভাবে জাদু প্রায় ভুলতেই বসেছে। তবে কাপড় শুকিয়ে দেয়া জাদুটা মনে আছে তার।
ছেলেটার জামার প্রান্ত ধরে নিচু সুরে মিষ্টি গলায় গাইলো,
সূয্যি যদি ডুবেও তবু রোদ তুমি থাইকো
কাপড় আমার শুকায় দেয়ার কথা তুমি রাইখো…

সাথে সাথে ছেলেটার এবং নীলপরীর ভেজা জামা থেকে বাষ্প হয়ে পানি উড়ে যেতে থাকে। দেখতে দেখতে ফটফটে শুকনো হয়ে যায় সব কাপড়। ছাতাটার দরকার এখন আর নেই। তাবুর মাঝে যেহেতু ছেলেটা আছে। ছাতাটা নিয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসে নীলপরী। পার্কের ঘাসের ওপর জমা পানিতে ছপ ছপ পা ফেলে দৌড়ে ছুটে যেতে থাকে মাঝের নাম না জানা গাছটার দিকে। হাতে সময় বড্ড কম আজ। বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে বের হতে হবে। তার আগে গায়ের হওয়ার জন্য আর ডানা লাগানোর জন্য ঘরে ফেরা দরকার।
সেই রাতে নীলপরী বাচ্চাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গান শুনাতে যাওয়ার সময় খেয়াল করল শহরের মাঝের দিক থেকে খুব মিহি আর অসম্ভব করুণ একটা বাঁশির সুর ভেসে আসছে। নীলপরী তার হাজার বছরের জীবনে কোনোদিন এত সুন্দর বাঁশির সুর শোনেনি। যে বাঁশিটা বাজাচ্ছে, তার ভেতর যেন কয়েক শতাব্দীর কষ্ট বিঁধে আছে। এত কষ্ট যে নীলপরী সেইরাতে মেয়রের চুক্তি অনুযায়ি গান গাইতে পারলো না। আপনা আপনি তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো টপ টপ করে। নীলপরী গান গাইলো বড় দুঃখের গান।
আমার দিবস গেল মিছে, আমার সন্ধ্যা ধ্রুবতারা,
জানান দিও তারে ছিলাম প্রেমে বাঁধন হারা।
আমি চাইনে যারে এই জনমে, এমন কেন লাগে,
এত্ত ব্যথা বুকের ভিতর হয়নি যেন আগে…

সেই রাতে ঘুমের মাঝেও পুরো শহরের বাচ্চারা কেঁদে কেঁদে উঠতে থাকে। আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আবার কাঁদে।
প্রতিটা বাড়ির বড়রা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। কি হল আজ! নীলপরী কি সুখের গান গায়নি ছেলেমেয়েদের কানে? কাঁদছে কেন সবাই?

অনেক রাত করে ক্লান্ত নীলপরী বাসায় ফেরে। বৃষ্টি ধরে এসেছে তখন। নিজের রুমের বিছানায় গিয়ে ডানা খুলেই এলিয়ে পড়ে বিছানায়। সে নিজেও জানে না সে কেন আজ এত কষ্টের গান গেয়েছে। এখনো চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। থামছেই না! কি মুশকিল। এত রাতে সেই বাঁশির উৎস খুঁজতে বের হওয়া সম্ভব না। থেমেও গেছে বাঁশির সুর। কিন্তু কান্না তো থামছে না। শুধু মনে হচ্ছে বুকের ভেতর খুব কঠিন একটা অজানা দুঃখ জমে আছে তার। সেই দুঃখটা নড়ে চড়ে উঠছে আজ হঠাৎ। নীলপরীর শৈশবের কথা মনে নেই। ভাসা ভাসা কিছু দৃশ্য মনে আছে। মা বাবার চারপাশে সে ডানা লাগিয়ে উড়ার চেষ্টা করছে মেঘের ওপর। মা খিলখিল করে হাসছে। বাবা হাসছে। আহা! কি সুন্দর সেই হাসি! কিন্তু মুখগুলো সব ঝাপসা। ভুলে যাচ্ছে ক্রমশ। হাজার বছর আগের স্মৃতি মনে রাখাটা সত্যি কঠিন। সেই দৃশ্যটার মাঝেও কেমন যেন একটা কষ্ট মিশে আছে।

পরদিন ভোর বেলা উঠতে উঠতে দেরি হয়ে গেল নীলপরীর। জেগে উঠে দেখে রোদ উঠে গেছে। এলার্ম বেজেছিল কিন্তু শুনতে পায়নি। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেল বাচ্চাদের জাগাতে। সবার বাড়ির মোড়ে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে হর্ন বাজাচ্ছে। কিন্তু কেউ ওঠেনি। নীলপরী তাড়াতাড়ি করে সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে সকালের পাটটা সারল। কিন্তু স্কুলের দেরি হয়ে গেছে সবার। যে জুনাইনা কোনোদিন স্কুলে দেরি করে যায়নি, সে’ই স্কুলে গেল ঘণ্টাখানেক দেরি করে। এমনকি স্যারদের বেতের বাড়ি আর ঝারি খেয়ে দিন শুরু হলো সব বাচ্চাদের সাথে। জুনাইনা মার খেয়ে ভীষণ হয়ে চিন্তা করে, নীলপরী আজ তাকে সময় মত ডেকে দিল না কেন?
অভিভাবকরাও সবাই ভাবছে কি ব্যাপার! নীলপরীর তো এমন হবার কথা না? নাকি বয়স হচ্ছে দেখে ভুলে যেতে বসেছে।
এ কান ও কান হয়ে কথা মেয়রের কাছে গিয়ে পৌছালো। নীলপরীকে মেয়র তলব করল হঠাৎ এই অবস্থা দেখে। “কি খবর নীলপরী? কাল রাতে হঠাৎ কন্ট্রাক্টের বাহিরে গান গাইলে যে? আবার আজকে দেরি করে বাচ্চাদের ঘুম থেকে উঠালে? স্কুলে তো সবাই বেদম পিটুনি খেয়েছে তোমার কারণে।”

নীলপরী কেবল উত্তর দিল, “শরীরটা খারাপ ছিল একটু।“
“ওমা! পরীদেরও অসুখ করে নাকি! কৈ আগে তো শুনিনি।“
“সবকথা তো আপনাকে শোনানো হবে না মেয়র সাহেব।“ তিক্ত কণ্ঠে বলল নীলপরী। “আমি যে কাজ করি, এখানে কোনো ছুটি নেই। কোনো বিশ্রাম নেই। এমনকি বিকল্পও নেই যে একদিন ছুটি কাটাবো বা অসুস্থ হলে কেউ দেখে দেবে।“
“হুম। তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। অন্যকোনো বিকল্প থাকলে একটা ব্যাবস্থা করা যেত।“ মেয়র গোবুচন্দ্র হঠাৎ কি যেন ভাবতে বসে গেলেন। নীলপরী রাগ নিয়ে উঠে চলে এলো। এত সামান্য একটা দিনের ব্যঘাতের জন্য কত কথা শোনাচ্ছে। কত অকৃতজ্ঞ এই শহরের মেয়র আর অভিভাবকেরা। নীলপরীরও তো সমস্যা থাকতে পারে। আর অবস্থা হচ্ছে এমনই যে তাকে ছাড়া ওদের চলবে না। তাও কথা শোনাতে হবে।
বাসায় ফেরার সময় খেয়াল করল পার্কের অন্যপাশের গতরাতের সেই তাবু কিংবা যুবক, কেউ নেই। তুলে নিয়ে চলে গেছে মনে হয়। ছেলেটার নামটা জানা হল না। সেদিনের পর আর কখনো দেখা হয়নি নাম না জানা সেই যুবকের সাথে। নীলপরী একমনে তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো আগের মত।
দিন গড়াতে লাগলো।

তারপর নতুন বছরের জন্য নীলপরীর সাথে মেয়রের চুক্তি নবায়নের দিন তারিখ এগিয়ে এলো। এরমাঝেই শহরে নতুন টিভির শো রুম খুলেছে। সেই সাথে মোবাইলের দোকানও। নতুন শপিং মলটা চালু হয়েছে। বিশাল সেই শপিং মলের ওপর একটার চেয়ে একটা বড় দোকান আর শো রুম। সেখানে আস্ত একটা ফ্লোর আগাগোড়া সব টিভি আর মোবাইলের দোকানে ভরা। সেই সাথে ক্যাবল কানেকশনের কয়েকটা দোকান বসে গেল রাতারাতি। ইন্টারনেটের লাইন ছিল না এই শহরে। গোবুচন্দ্র তার ব্যাবসা বাড়াতে ইন্টারনেট লাইনও নিয়ে এলো।
দেখতে দেখতে শহরের প্রতিটা বাড়িতে একটা করে টেলিভিশন কেনা হয়ে গেল। ক্যাবলের লাইন দেয়া হল ঘরে ঘরে। অনেক চ্যানেল। কোথাও সিনেমা হচ্ছে, কোথাও গান হচ্ছে, কোথাও কার্টুন হচ্ছে তো কোথাও পশুপাখিদের ওপর অনুষ্ঠান হচ্ছে। কোথাও তো আবার মারামারিও হচ্ছে! কি আশ্চর্য এক বাক্স! সেই সাথে মোবাইল নামের একটা যন্ত্র ঘরে ঘরে, এমনকি বাচ্চাদের সাথেও দিয়ে দেয়া হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট নামের অদৃশ্য এক সংযোগ। তার ছাড়াই সেই মোবাইলের স্ক্রিনে নানান পদের অনুষ্ঠান দেখা যায়। বাচ্চারা চকোমেলন আর হুহু টিভি নামের ভিউটিউবের কিছু চ্যানেলে বাচ্চাদের রঙ্গিন রঙ্গিন অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে আসক্ত হয়ে যেতে শুরু করল। আমাদের জুনাইনাও সেই দলে। প্রতিদিন বিকেল বেলা পার্কে গিয়ে দাপাদাপি করে খেলে বেড়ানো, ভোরবেলা বাবা মায়ের সাথে জগিং করতে বের হওয়া জুনাইনা টেলিভিশনের ভক্ত হয়ে যেতে থাকে। বাহিরে বের হওয়ার কথা মনেই থাকে না। এমনকি ব্যাগের চেইন খুলে চিরকুট লিখে রাখতেও ভুলে যেতে লাগলো জুনাইনা। কারণ টেলিভিশনের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ফোন। রাতে ঘুমাতে যাবার সময়েও মোবাইল হাতে নিয়ে গুতাতে থাকে এখন জুনাইনা।
নীলপরী প্রতিদিন সময় করে জুনাইনা সহ সব বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে যায়, জাগাতে যায়। কিন্তু এই মোবাইলের কারণে ঘুম পাড়াতে পারে না সঠিক সময়ে। ঘুমের গড়মিল হয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে অতিরিক্ত মোবাইল দেখে দেখে বাচ্চাদের চোখে চশমা লাগানো শুরু করে শহরের সব ডাক্তার। মেয়র গোবুচন্দ্র ব্যবসা বাড়াতে চশমার ফ্যাক্টরি খুলে বসেছে। সেই সাথে হেডফোনের কোম্পানিও দিয়েছে। সেই সাথে নীলপরীকে বলে দিয়েছে ফুলের বিনিময়ে উপহারের বাক্সে যেন গোবুচন্দ্রের কোম্পানির হেডফোন দেয়। তাহলে হু হু করে তার বিজনেস বাড়বে।

নীলপরী সেই চেষ্টাই করতে যায়। কিন্তু উপহার দেয়ার জন্য তো ফুল তুলতে হবে বাচ্চাদের। বাচ্চারা তো এখন আর পার্কেই আসে না। এমনকি ফুল ফুটে গাছের নিচে সব ছড়িয়ে থাকে। তাও বাচ্চারা আসে না। ফ্রি ফ্রিতে উপহার দিতে বলে গোবুচন্দ্র। নীলপরী বাধ্য হয়ে সেটাই করতে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে না। ভোর বেলা পর্যন্ত জেগে জেগে মোবাইল দেখছে। চ্যাট করছে, ভিডিও কলে কথা বলছে। গেম খেলছে।
উপায় না দেখে বাচ্চাদের স্কুলের লকারে হেডফোন লুকিয়ে রেখে আসে নীলপরী। তার একমাসের মধ্যে দেখা গেল শহরের সব বাচ্চারা এখন লাইন দিয়ে কানের ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে। কানে কম শুনছে সবাই। জুনাইনার মত মেয়ের চোখেও ইয়া বড় বড় চশমা লেগেছে। সেই সাথে কানের জন্য ড্রপ কিনতে হয়েছে এই হেডফোন আসার পর। কানের চিকিৎসা বেড়ে গেছে হু হু করে এই শহরে। গোবুচন্দ্র এখন কানের ড্রপ দেয়ার জন্য ওষুধের ফ্যাক্টরি খুলে বসার ধান্দায় উঠে পরে লাগে। আগেই শহরের সব পরিত্যাক্ত আর খালি অংশে নিরাপদ দূরত্বে অনেকগুলো ফ্যাক্টরি বসিয়েছিল সে। এবার শহরে আর ফ্যাক্টরি বসানোর জায়গা না থাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ড্রইং এ দেখায় শহরের পার্কটা উঠিয়ে দিয়ে ওখানে ওষুধের ফ্যাক্টরি বসানো যাক। “পার্কের আর কি কাজ স্যার? বাচ্চা কাচ্চা তো কেউ পার্কে যায় না। এরচেয়ে একটা জনকল্যাণে ওষুধ ফ্যাক্টরি হোক। মানুষের উপকার হবে। কি বলেন?” গদগদ হয়ে বলে।
“খাসা! খাসা আইডিয়া নিয়ে হাজির হয়েছো ইঞ্জিনিয়ার!” গোবুচন্দ্র মহা খুশি হয়ে সেই প্ল্যান পাশ করে দেয়।

ওদিকে নীলপরী আকাশে রঙধনু তৈরি করতে থাকে বিকেল বেলা। কেউ দেখতে আসে না। আগে জুনাইনা নামের মেয়েটা নিয়মিত আসত পার্কে। নীলপরীর গাছটার সামনে চিৎকার করে আনন্দিত হয়ে নাচতো যখন রঙধনু উঠতো আকাশে। এখন আর কেউ আসে না। নাচেও না। হাসেও না। নিরাশ হয়ে নিজের গাছের বাসায় গিয়ে মুখ ভার করে বসে থাকে নীলপরী। এর মাঝে একদিন শুনতে পায়, তার সাথে নাকি সব চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছে মেয়র গোবুচন্দ্র। এসিস্টেন্ট হবুচন্দ্র নীলপরীকে এমনটাই জানান দিল।
“নীলপরী, আমার মনে হয় তোমার অন্য কোনো শহরে চলে যাওয়া উচিত। শুনলাম পার্কটাও ভেঙে দিয়ে ওষুধের ফ্যাক্টরি খুলবে। কালো ধোঁয়ায় নীল আকাশ আরো ঢেকে যাবে!” মলিন মুখে হবুচন্দ্র জানালো।
নীলপরীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। “ওখানে তো আমার কোয়ার্টার! আমি কোথায় যাব! কত বছর ধরে এখানে আছি আমি! আমার পোস্টিং অর্ডারও আসেনি।”
“আমি জানি। কিন্তু গোবুচন্দ্র স্যারকে এটা বোঝাবে কে? তাছাড়া বাচ্চারাও তো এখন খেলতে আসে না আর।“ হবুচন্দ্র দুঃখী মুখে বলে।
“আমি গোবুচন্দ্রের সাথে কথা বলবো। আমাকে জিজ্ঞেস না করে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত কি করে সে নেয়!” নীলপরী রেগে যায়।
“স্যারের সাথে তো দেখা করতে পারবেন না। এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। অনেক ঝামেলা। স্যার এখন আর কাউকে দেখা দেয় না। স্যারের বিশেষজ্ঞ প্যানেল আছে, কর্মী বাহিনী আছে, উপদেষ্টা আছে। তাদের সাথে আলাপ করে দেখতে পার। কিন্তু লাভ বিশেষ হবে না মনে হয়।“
নীলপরী চেষ্টা করে অনেক। কিন্তু গোবুচন্দ্রের দেখা মেলা ভার। আসলেই তাকে আর আগের মত পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে টিভির ভেতর তাকে দুই তিন মিনিটের বক্তৃতা দিতে দেখা যায়। এর বেশি কিছু না।
মন খারাপ করে নীলপরী মানুষের সাজে শপিং মলে গিয়ে শপিং করার চেষ্টা করে। কিন্তু পেমেন্ট করতে গিয়ে দেখা যায় তার একাউন্টে টাকা নেই। যেসব সুবিধা বা ডিস্কাউন্ট ছিল, সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নীলপরী হতভম্ব হয়ে বাসায় ফিরে আসে। ফেরার পথে দেখে পার্কের সামনে অনেক বড় বড় বুলডোজার আর ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যার সময়। বাহিরে হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ব্যারিকেড দেয়া,
“ভেতরে যাওয়া নিষেধ। উন্নয়নের কাজ চলছে।“
নীলপরীর চোখ ফেটে কান্না আসে। এতদিন এই শহরের সবার জন্য সে কত কিছু করেছে। অথচ আজকে তার থাকার জায়গাটাও কেড়ে নিতে বাঁধছে না কারো। কেউ কোনো কথাই বলছে না। আর বলবেই বা কারা, যাদের জন্য পার্ক ছিল- তারাই তো খেলতে আসে না বছর হয়ে যাচ্ছে।
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নীলপরী ভিজতে ভিজতে নাম না জানা গাছটার কাছে এসে দাঁড়ালো। অবাক ব্যাপার। গাছের নিচে সেই যুবকটা একই জরাজীর্ণ পোশাকে বসে আছে। পাশে সেই তাবুটা ভাঁজ করে ফেলে রাখা। টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে সেও।
“এই ছেলে, এখানে কি?”
“তোমার তাবুটা ফেরত দিতে এসেছিলাম।“
“তোমাকে কে বলেছে এখানে এলে আমাকে দেখতে পাবে? আমি এখানে থাকি নাকি?” নীলপরী খেয়াল করল ছেলেটা এবারে তাকে আপনি বলার বদলে তুমি তুমি করে কথা বলছে।
“হ্যাঁ, আমি জানি তুমি এখানেই থাকো। তোমার নাম নীলপরী। তুমি এই গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালের একটা বাসায় থাকো।“ হাসলো ছেলেটা।
চমকে উঠল নীলপরী। দুই পা পিছিয়ে গেল অজানা শংকায়, কম্পিত কণ্ঠে বলল, “ত-তুমি আমাকে কীভাবে চিনতে পারলে? তুমি জানলে কী করে যে আমি এখানেই থাকি?”
“জানি জানি।“ রহস্যময় হাসি হাসলো ছেলেটা। “এও জানি যে তুমি বিপদে পড়েছো। পার্কের বাহিরের যে ওই বড় বড় বুলডোজার আর ক্রেন, তোমার এই পুরো পার্কটাকে খুড়ে ফেলার জন্য আনা হয়েছে। এরমধ্যে তোমার এই গাছবাড়িটাও আছে।“
“ত-তুমি কে?” নীলপরী আরো পিছিয়ে যায়।
“আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি যখন অভুক্ত ছিলাম, তুমি আমাকে খাইয়েছিলে। আমি যখন জ্বরে কাঁপছিলাম, আমার থাকার জায়গা ছিল না, তুমি আমার মাথা গোজার ঠাঁই করে দিয়েছিলে। আমি বন্ধুত্বের কথা মনে রাখি নীলপরী। আমি জানি যে তুমি বিপদগ্রস্থ। তোমাকে কেউ সাহায্য করার জন্য আসছে না। যাদের শৈশব তুমি গড়ে দিয়েছিলে একসময়, তারা তোমাকে ভুলে গেছে। তুমি অনেক একা হয়ে গেছ।“
হঠাৎ নিজের পায়ের ওপর ভর টিকিয়ে রাখতে পারলো না নীলপরী। হাঁটু ভেঙে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠল বৃষ্টির মাঝে। কিন্তু রুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। পরীরা কাঁদলে মানুষের মত কান্নার শব্দ হয় না। মনে হয় যেন নূপুরের শব্দ হচ্ছে।
ছেলেটা আস্তে আস্তে উঠে এসে নীলপরীর কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো।
নীলপরী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে ছাড়াই এখন সব বাচ্চারা স্কুলের জন্য ঘুম থেকে ওঠে। আমাকে ছাড়াই ওরা সবাই ঘুমাতে যায়। আমি প্রতিদিন ওদের জানালায় গিয়ে দেখি। কেউ আমাকে মনে রাখেনি। কারো মনেই নেই যে ওরা আমার গলায় গান শুনতে পেত। পার্কে খেলতে এলে কেউ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে আমি জাদুমন্ত্র বলে সারিয়ে দিতাম। রঙধনু দেখতে চাইলে রঙধনু দেখাতাম। বরফের দিনে বাসার সামনে গিয়ে তুষার মানব বানিয়ে দিতাম। ফুলের গিফটের বদলে যখন পেন্সিল রাবার দিতাম, সেই বাক্সে আমি খুশির মন্ত্র পড়ে দিয়ে আসতাম যেন সবাই সারাদিন হাসি খুশি থাকে। কিন্তু ওরা আমাকে ভুলেই গেছে। আমারই দোষ। আমিই বেশি বেশি করে লোভ করে বাচ্চাগুলোর এটা সেটা চাহিদা বাড়তে দিয়েছি। মেয়র গোবুচন্দ্রকে সাহায্য করেছি। তারই ফল পাচ্ছি এখন। আমাকে একা একা এই শহর ছেড়ে কাল চলে যেতে হবে। আমাকে কেউ মনে রাখেনি। আমাকে সবাই ভুলে গেছে…”
ছেলেটার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নীলপরী। ছেলেটা খুব দৃঢ় গলায় বলে, “তোমাকে কেউ ভোলেনি। তুমি বাসায় যাও। লম্বা একটা ঘুম দাও। সকাল হতেই দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।“
নীলপরী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালো, “সব ঠিক হয়ে যাবে মানে?”
“সব আগের মত ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথা বিশ্বাস করো। যদিও জানি বিশ্বাস করার মত আমি কেউ নই তোমার কাছে।“ ছেলেটা হাসলো। ওকে টেনে ঘাস থেকে তুলে ওঠালো। পরীদের ওজন থাকে না এটা শুনেছিল। কথাটা আংশিক সত্য। নীলপরীকে টেনে তুলতে গিয়ে খেয়াল করল ওর ওজন একদম নতুন জন্ম নেয়া বাচ্চাদের মত মাত্র কয়েক পাউন্ড।
নীলপরী বৃষ্টির মাঝেই হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছতে গিয়ে আইলানার, মাশকারা সব মাখামাখি করে ফেলল। “আমাকে ভূতের মত দেখাচ্ছে, তাই না?” কান্নার মাঝেও হাসলো।
“নাহ। তোমাকে আগের চেয়েও অনেক সুন্দর লাগছে। পরীরা কাঁদলে তাদের অনেক নিষ্পাপ লাগে। আগে জানা ছিল না।“ ছেলেটা হ্যাটটা সোজা করে বলল।
নীলপরী ছেলেটাকে ওখানে রেখে গাছের ডালে উড়ে এলো। ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে অদ্ভুত স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল। যদিও জানে না কেন!

গভীর রাতে হঠাৎ ভীষণ সুন্দর একটা বাঁশির সুর ভেসে আসতে শুরু করে পুরো শহর জুড়ে। টিপটিপ বৃষ্টির মাঝ দিয়ে ঘুমের মাঝে শহরের কেউ জানতে পারে না দূর পাহাড় থেকে শয়ে শয়ে রাতের পাখি উড়ে আসছে। বন বাদার দাপিয়ে নাম না জানা অসংখ্য রাতের পশু দৌড়ে নেমে আসছে লোকালয়ে। এমনকি শহরের আরেকপ্রান্ত থেকে তীব্র একটা ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে। সেটা ঘুরতে ঘুরতে সবার প্রথমে শহরের সব মোবাইল টাওয়ার, ডিসের এন্টেনা আর ক্যাবলের লাইন উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। দ্বিতীয় দফায় ট্রান্সফর্মারের লাইন উড়িয়ে দিল। সারা শহরে নেমে এলো অন্ধকার। পাখির ঝাঁক উড়ে এসে পার্কের গাছে গাছে জড়ো হওয়া শুরু করলো। বুলডোজার, ক্রেন সব ভেঙে দুমরে উলটে দিয়ে চলে গেল ভারি ভারি পশুর পাল। শহর পেরিয়ে অন্যদিক দিয়ে হারিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
বাঁশির শব্দে গভীর রাতে কারেন্ট যাওয়া শহরে সবাই একে একে জেগে উঠল। কি মিষ্টি সেই সুর। কি হাহাকার সেই সুরে। কি এক আনন্দ। রাতের বাতাসে মিশে যেন বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দেয় সেই বাঁশির সুর।
প্রতিটা বিছানায় উঠে বসা বাচ্চাগুলো মোবাইল ফেলে দিয়ে, হেডফোন ছুঁড়ে দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। বৃষ্টির মাঝে ভিজতে ভিজতে হাসতে থাকে সবাই। এই শহরের মধ্যরাতে এত এত শিশু আর কোনোদিন বারান্দায় এসে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে হাসেনি। বাঁশির সুরের সাথে সেই হাসির শব্দ মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে।



নিজের বাসা থেকে নীলপরী সব দেখতে থাকে। পরীদের দৃষ্টি অনেকদূর পর্যন্ত যায়। জুনাইনা চশমা খুলে বাসার ছাদে উঠে খিলখিল করে হাসছে আর ভিজছে। একটু একটু করে আগের মত নাচতে শুরু করেছে। গুনগুন করে গাইছে। নীলপরী বহুদূর থেকে জুনাইনাকে প্রাণভরে দেখে। এসব দেখে তার ঘুম আসে না আর। গাছের নিচে ভেজা ঘাসের ওপর হেঁটে হেঁটে সেই ছেলেটা বাঁশি বাজাচ্ছে এখনো। কত জাতের রঙিন পাখি এসে নামছে তার পায়ের কাছে। নীলপরীর চোখ ভিজে আসতে থাকে।
শেষ রাতে যখন সব শান্ত হয়ে গেছে, নীলপরী নিচে নেমে আসে। সূর্য ওঠার অপেক্ষায় আছে। পার্কের একটা বেঞ্চে ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে। বেঞ্চে, গাছের ডালে, চারপাশে যতদূর চোখে যায় শত শত পাখি।
“তুমি কে?” নীলপরী জিজ্ঞেস করে।

“আন্দাজ করো তো আমি কে?”
“আন্দাজ করতে পারছি না।“ নীলপরী হাল ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে এসে বসে।
কোটের পকেট হাতড়ে একটা ময়লা দোমড়ানো ভিজিটিং কার্ড বের করে এগিয়ে দেয় ছেলেটা নীলপরীর দিকে।
ভোর হতে থাকা আবছা আলোয় দোমড়ানো সেই কার্ডের লেখাটা পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য মূর্তির মত পাথর হয়ে যায় নীলপরী। কার্ডে লেখাঃ
“হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা
ইঁদুরের উৎপাত থেকে বাঁচতে যোগাযোগ করুন।"

“ত-তুমি আসলেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা?” কথা সরছে না নীলপরীর মুখ থেকে। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া।
হাসতে থাকে ছেলেটা, “হ্যাঁ। আমিই। তবে আমাকে নিয়ে অনেক উদ্ভট কাহিনী প্রচলিত আছে। আমি নাকি আস্ত শহরের ছেলে মেয়েদের নিয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলাম সমুদ্র কিংবা পাহাড়ের আড়ালে। আর ফিরিনি।“
“আসলেই কি তাই?”
“আরে ধুর! ছেলেপেলে নিয়ে আমি কি করবো? হ্যামিলনের মেয়র তোমাদের হিমাদ্রিনগরের মেয়রের মত এটা ঠিক আছে। কিন্তু ছেলেমেয়ের ওপর ক্ষোভ দেখিয়ে আমার কি লাভ? ওদের নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। পরের দিনই তো ফেরতও দিয়ে গেছি। সেটা নিয়ে দেখি কারো কোনো উচ্চ বাচ্চ নাই! বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে একটা স্কুল মেরামত করিয়েছিলাম পাশের শহরে। ভাল কাজের দাম নাই আসলে।“
নীলপরী কাগজটা ফেরত দিতে দিতে বলল, “আমি কেবল শুনেছিলাম তুমি মন্ত্রমুগ্ধ করার মত বাঁশি বাজাতে পারো। কিন্তু এত ভাল বাঁশি বাজাতে পারো জানতাম না।“
হা হা করে হাসতে থাকে ছেলেটা।

সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। সকাল হতেই ক্যাবলহীন, ইন্টারনেটবিহীন পুরো শহরের সবাই পার্কের দিকে চলে আসলো। রঙিন সব পাখি দেখে মুগ্ধ সবাই! কি আশ্চর্য সব সুন্দর পাখি! কোত্থেকে এলো! এমনকি বহুদিন পর আকাশের শেষ কোণায় বিশাল এক রঙধনু উঠেছে। বাতাসের মাঝে নীলপরীর মিষ্টি গানের স্বর ভেসে বেড়াচ্ছে।
“আকাশ জুড়ে হাসিয়ে দিয়ে গেলাম মনে রেখো,
আমায় ভুলে গেলেও তুমি আমার হয়েই থেকো…”

শহরের মেয়র বেচারা গোবুচন্দ্র একাধারে ট্রান্সফর্মার, মোবাইল টাওয়ার, ডিসের সব এন্টেনা, ক্যাবল লাইন, ইন্টারনেটের লাইন সহ তার মেয়র টিভির প্রধান অধিদপ্তর লণ্ডভণ্ড হয়ে উড়ে যাওয়ার পর অধিক শোকে কথা হারিয়ে ফেলেছে। কথা বলতে গেলেই তার গলা দিয়ে পাখির আওয়াজ বের হয়। কিচির মিচির কিচির মিচির কু কু! ডাক্তারেরা তাকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলেছে, “গলা কেটে অপারেশন করতে হবে। বিশাল সমস্যা! কীভাবে হল মেয়র সাহেব!”
মেয়র সাহেব ডাক্তারের কথা শুনে দুটো কিচির মিচির করেই ফিট হয়ে গেছে।
আর নীলপরী? নীলপরী সেই আগের মত পুরো শহরের বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায়, ঘুম ভাঙায়, সুন্দর সুন্দর গান শেখায়, রঙধনু বানায়। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সঙ্গে নাকি ইদানীং সন্ধ্যার পর রেস্টুরেন্টের কোনায় চুপচাপ পত্রিকা মুখেও বসে থাকতে দেখা যায়। গল্প বিশেষ করে না কেউই। তাছাড়া কে’ই বা চিনবে তাদের?


(সমাপ্ত)

মন্তব্য ১৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।
অনেক বড় গল্প। সমস্যা নেই। আজ হাতে অনেক সময় আছে।

২| ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:০২

রাজীব নুর বলেছেন: এরকম গল্প আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি।
কারন আমার কন্যাকে প্রতিদিন গল্প বলতে হয়। আমার স্টোকে যত গল্প ছিলো সব বলা হয়ে গেছে।

২৮ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৪১

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকবেন। গল্প শুনে আপনার মেয়ে কি বলল জানাবেন।

৩| ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:২০

শায়মা বলেছেন: বাহ অনেক দিন পর অবশেষে সুদীর্ঘ গল্প!!!

২৮ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৫:৩৫

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ এবং ঈদের শুভেচ্ছা।
আপনি দেখছি খুবই নিয়মিত ব্লগে থাকেন।

৪| ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫১

শায়মা বলেছেন: খুব নিয়মিত থাকি একটু কিন্ত খুব নিয়মিত লিখতে পারিনা। এখন ঈদের ছুটি চলছে তাই আছি।

২৮ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:১৮

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: আমিও। ঈদের ছুটিতে আজকে ব্লগ আইডি খুজে উদ্ধার করলাম, ঝেড়ে পুছে পরিষ্কার করে লেখতে বসলাম বলা যায়!

৫| ২৮ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৩৯

অপু তানভীর বলেছেন: আরে শিহাব ভাই যে! পথ ভুলে আজকে ব্লগ মুখী হলেন মনে হচ্ছে !

২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:১০

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: আরে ব্যাচেলর তানভীর ভাই যে! হ্যাঁ ভাই, পথ ভুলে চলে এসেছি ঈদের সময়ে। গল্প নিয়ে এসেছি। পড়তে থাকেন ভাই। আরো আসছে।

৬| ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:৫১

অপু তানভীর বলেছেন: আমার ব্লগ জীবনে এক সময়ে ব্লগের আসার একটা কারণই ছিল আপনার লেখা পড়া। ব্লগ তো ছেড়েছেন বিয়াশাদী করার পরে দেখা যাচ্ছে লেখালেখিরও নাম নেই। কালবীরের শেষ কবে আসবে কে জানে !

৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১৪

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: এই পত্রাঘাতের ঠেলাতেই একদিন দেখবেন কালবীরও এসে গেছে।

৭| ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৯:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে আবার এলাম। কে কি মন্তব্য করেছেন সেটা জানতে।

৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১৫

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: মানুষ জন বিশেষ নাই ভাই। সামুতে হাহাকার

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.