নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভ্রম - তিন

৩১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:১৮



“তোর কি কিছু হয়েছে? কদিন ধরেই তোকে কেমন যেন মন মরা মনে হচ্ছে?” বাবুল আহমেদ মেয়েকে প্রশ্ন করলেন রাতের খাবার টেবিলে বসে।
হাত দিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছিল হৃদিতা, অন্যমনস্ক ভাবে বাবাকে উত্তর দিল, “কিছু না। টানা থিসিসের কাজ চলছে। টায়ার্ড লাগছে সেজন্য।“
“তোর মাস্টার্স শেষ হবে কি এই বছর?”
“হুম।“ সংক্ষেপে উত্তর দিল হৃদিতা। খেতে ভাল লাগছে না। কিন্তু বাবার সাথে খেতে না বসলে বাবার প্রশ্ন করা আরো বেড়ে যাবে।
“শরীর খারাপ নাকি তোর? খাচ্ছিস না যে?” আড়চোখে মেয়ের প্লেটের দিকে তাকালেন বাবুল আহমেদ।
“আমেনার মার হাতের রান্না খাওয়াটা কষ্টের কাজ। শরীর ঠিকই আছে বাবা। তুমি খাও।“ হৃদিতা জোর করে কয়েক লোকমা ভাত মাখিয়ে খেয়ে নিল যেন বাবুল আহমেদ প্রশ্ন করাটা বন্ধ করেন।
বাবুল আহমেদ আর হৃদিতার মধ্যে পিতা কন্যার সম্পর্কের চেয়ে প্রিন্সিপাল এবং ছাত্রীর সম্পর্কই বেশি। হৃদিতার স্কুল আর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বাবুল আহমেদ। এখন অবসর নিয়েছেন বছর খানেক হচ্ছে। বাসাতেই থাকছেন সারাক্ষণ। স্ত্রী জাহেদার সঙ্গে প্রায় দুই চার দিন পর পর ঝগড়া হয়। রাগ করে এই বয়সে বাপের বাড়ী চলে যাওয়া ধরেছেন জাহেদা আক্তার। বিষয়টা হৃদিতার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের পীড়াদায়ক। কাঠখোট্টা কলেজ প্রিন্সিপাল অবসর নিয়ে বাসায় আসার পর থেকে বাসার শান্তি গৃহ ত্যাগ করেছে। বাসায় মা না থাকলে সারাক্ষণ এটা সেটা সমস্যা লেগেই থাকে। যেমন হৃদিতার ছোট বোন নিশিতার এখন গরমের মধ্যে গায়ে শাল জড়িয়ে খাবার টেবিলে বসে আছে। খাচ্ছে না কিছুই। জ্বর দুই দিন ধরে। কলেজেও যাচ্ছে না।
“তোর জ্বর যায়নি এখনো?” নিশিতাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন বাবুল আহমেদ গম্ভীর মুখে।
“ন-না বাবা। ওষুধ খাচ্ছি। সেরে যাবে।“ ভাত খুটতে থাকে নিশিতা। দুই দিনের জ্বরে শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। খাবার টেবিলে জাহেদা থাকলে এতক্ষণে ডিম ভেজে এনে মেয়েকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতেন। মা না থাকায় আমেনার মায়ের হাতের পঁচা বাসি মাছের তরকারি খাওয়া লাগছে। যেটা নিশিতার পক্ষে চিবানো মুশকিল।
খাবারের পাট চুকিয়ে হৃদিতা, নিশিতা নিজেদের রুমে চলে এলো। নিশিতা জ্বরের ওষুধ খেয়ে শোয়া মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। হৃদিতা ভাল করে দেখে নিল ছোট বোন ঘুমিয়েছে কিনা। ঘরের বাতি নেভানো। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। একটা মোড়া টেনে বসে মেসেঞ্জার চেক করল। গত চারদিন ধরে সায়ানকে পঞ্চাশের মত মেসেজ দিয়েছে। মেসেজ সিন করে রেখে দিচ্ছে ছেলেটা। মাঝে শুধু একদিন লিখেছিল যে অফিসের ঝামেলায় আছে। পরে কথা বলবে। কিন্তু এরপর আর কোনো উত্তর নেই। ফোন দিলে ফোন কেটে দিচ্ছে নয় ফিরতি মেসেজে টেক্সট আসছে “পরে কল করবে”। এরকম চলছে প্রায় মাস চারেক ধরে। কিছুদিন স্বাভাবিক থাকে, তারপর আবার এরকম শুরু হয়ে। যতই দিন যাচ্ছে, কথা না বলার বিরতীগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
হৃদিতা কল দিলো। ডায়াল টোনের দীর্ঘ শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রথম কয়েকবারে ফোন ধরলো না। হৃদিতা ফোন দিতেই থাকে। এক সময় ফোন তুলে ঘুম ঘুম গলায় সায়ান বলল, “এতবার কল দিতে হয়? বল কি বলবে?”
চাপা গলায় হৃদিতা হিসিয়ে উঠল, “তুমি আমার সাথে কি ব্রেক আপ করার তালে আছো সায়ান? ফোন ধরছো না কেন চারদিন ধরে?”
“শরীরটা ভাল না। তাই ধরছি না।“
“মিথ্যা কথা বলবে না আমার সাথে। শরীর ভাল যদি নাই হয়, শোমাদের বাসায় ফ্যামেলি নিয়ে কীভাবে যাও মেয়ে দেখতে? তোমার মা যে তোমার জন্য মেয়ে দেখছে সেটার খবর বুঝি রাখি না আমি?”
ঘুম ঘুম ভাবটা উবে গেল মুহূর্তেই সায়ানের, “মেয়ে দেখতে যাওয়া আর বিয়ে করা আসা এক না হৃদিতা।“
হৃদিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আঙ্গুল দিয়ে কপাল চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু সামলাতে পারল না। তীব্র গলায় বলে বসল, “সায়ান, মানুষ মিথ্যা বললে আমি ধরতে পারি। প্লিজ মিথ্যা কথা বোলো না আমার সাথে। আমি জানি যে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছো না আর। একটা মেয়ের সবকিছু জানা হয়ে গেলে বিয়ের আগ্রহ আর কোত্থেকে আসবে তোমার মধ্যে?”
“কীসব বলছো তুমি?” সায়ানের গলায় জোর নেই তেমন একটা। “বাসা থেকে যে চাপ আছে আগে থেকেই তুমি জানো। মার ওপর বাসার কেউ কথা বলতে পারে না। মাকে যে আমি তোমার ব্যাপারে বলিনি, তা তো না। তুমি শুরু থেকেই জানো যে মা তোমাকে একটু কম পছন্দ করে, তোমাদের এলাকার লোকদের মার পছন্দ না। উনার চাই নিজের দেশের, নিজের এলাকার মেয়ে। এজন্যই বলছি পরিস্থিতি আমার জন্য এখন অন্যরকম।“
হৃদিতার চোখে পানি চলে আসলো। “সায়ান, মাকে কেন টানছো এসবে? সত্যি বলতে কেন এত বাঁধছে তোমার? আমি শ্যামলা, মোটা হয়ে যাচ্ছি- সুন্দর নেই আগের মত- এসব কথা সরাসরি আমাকে বলতে পারছো না? আমাদের আট বছরের রিলেশন। তোমার চোখের সামনে আমি সুন্দর থেকে অসুন্দর হচ্ছি ক্রমশ, আগের সেই টিনেজার চটপটে মেয়েটি আর নেই- তাই বাঁধছে? সায়ান এমন তো কথা ছিল না? আমাদের তো পাশাপাশি বুড়ো হবার কথা ছিল।”
“কি বলছো এসব? তুমি সুন্দর না এসব কথা কেন আসছে এখানে?” কথায় তালগোল পাকিয়ে যায় সায়ানের।
“সায়ান আমি বোকা নই। আবেগী। কিন্তু সব তো বুঝি। দেখি, শুনি। আমার কাছ থেকে কি লুকাবে? তোমার মা এখন সুন্দরী পাত্রী তো দেখবেনই। তার কাছে কি আর আমাকে কতটা দরকার তোমার বুঝিয়ে বলেছো? আমি জানি তুমি বলোনি। তোমার কাছে এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। নতুন কাউকে দরকার।“ হৃদিতা অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকায়। “সায়ান আমার তো আর কিছুই রইল না। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে?”
সায়ান বোঝানোর চেষ্টা করতে চাইল, “আমি বাসায় তোমার কথা বলেছি হৃদিতা। আবার বলবো। প্লিজ আমাকে আমার মত চেষ্টা করতে দাও।“
হৃদিতা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে মোবাইলটা কানে চেপে। সায়ান কিছু বলে না।
এক সময় হৃদিতা সামলে নেয়, জোরে দম নিয়ে বলে, “সায়ান, তুমি জানো আমি ভীষণ শক্ত মনের একটা মেয়ে। সহজে আমাকে কাবু করতে পারে, এরকম সিচুয়েশন কখনই তৈরি হয়নি। আমি ভাল করেই জানি যে তুমি আমাকে ‘না’ করতে পারছো না। কিন্তু তুমি চাও যে আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ হোক। কীভাবে শেষ করবে- সেটা নিয়ে দ্বিধায় আছো। আমি তোমাকে সেই কঠিন পরীক্ষায় ফেলবো না। তোমার পিড়াপীড়িতে এক সময় রিলেশনে জড়িয়েছিলাম। তোমার ছেলেমানুষি, পাগলামী আর হাজারটা জৈবিক কৌতুহলকে সায় দিয়েছিলাম, ধরেই তো নিয়েছিলাম এই মানুষটা আমার। আজীবনের জন্য আমার হয়ে গেছে। যাই হয়েছে, আমার কন্সেন্টেই হয়েছে। তোমাকে এর জন্য দায়ী করবো না। আমার আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে হয়ত এখন আফসোস করা লাগতো না…”
সায়ান বলে উঠল, “আজকে ফোন রাখি। এসব কথা বার্তার কোনো অর্থ নেই হৃদিতা। রাত বিরাতে পাগলামী কথা বার্তা শোনানোর জন্য আমাকে ঘুম থেকে তুলেছো”
হৃদিতা শান্ত গলায় বলল, “সায়ান, একটা কথা বলি। চেষ্টা করবে সব সময় নিজের পার্টনারের সাথে সত্যি কথাটা বলার জন্য। তার ভাল লাগুক, খারাপ লাগুক, অন্যের কাছে সেটা না বলে- সরাসরি পার্টনারের কাছে সত্যিটা বলে দিও। আমি জানি যে তুমি দিনার ভাইয়ার কাছে আমাকে নিয়ে নানান কথা বলেছো। সেটা দিনার ভাই লাইজু আপুকে বলে দিয়েছে। আমাকে আর ভাল না লাগলে, বিয়ে করার ইচ্ছা যদি নাই থাকে- সামনা সামনি বলে দিলে আসলে কষ্টটা কম পেতাম। অন্যদের থেকে এসব কথা শোনার পর আসলে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকাটা অনেক কঠিন লাগে। মনে হয় যেন মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে খুব ভুল করে ফেলেছি। এনিওয়্যে, আমি রিকোয়েস্ট করবো- আমাকে নিয়ে আর কারো কাছে কিছু ডিসকাশন করবে না তুমি। আমাকে ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে কিছু বলবে না। আর দয়া করে আমাদের পার্সোনাল মোমেন্টগুলোর স্মৃতি মুছে ফেলো। আমাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করবে এই বিষয়টা। নিজেদের প্রাইভেসিটুকুর প্রতি সম্মান রেখেই তোমাকে বললাম। আশা করবো সেইটুকু সম্মান তোমার কাছে আমার প্রাপ্য।“
সায়ান কোনো কথা না বলে লাইন কেটে দিল।
মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে মোড়া সরিয়ে ফেলল। বারান্দার সবুজ ঘাসের কার্পেটে পা বিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল হৃদিতা। বাহিরের নিকষ কালো আকাশের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। কাঁদছে না আর। গত ছয় মাসে অনেকবার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট আর উদাহারণে একই বিষয়ে কথা হয়েছে সায়ান আর হৃদিতার। প্রতিবারেই হৃদিতার কান্নার পর সায়ান নরম হয়ে এসেছে, স্বাভাবিক করে নিয়েছে সম্পর্ক। তারপর আবার একই রকম দূরত্ব। হৃদিতা কঠিন বাস্তবতায় গড়া মেয়ে। তার গোটা জীবনে একটাই অবাস্তবতা ছিল। সায়ানের সাথে এই সম্পর্ক। সে জানে যে সায়ান আসলেই আর এই সম্পর্ক ধরে রাখতে চাইছে না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে হৃদিতার ওপর। আট বছরের টানা সম্পর্ক, জানা অজানার সমস্ত শূন্যস্থানগুলো পুরণ হয়ে গেছে আসলে। পারিবারিক সম্পর্কের গাটছড়াবিহীন প্রবল বন্ধনেও ঢিল পরতে পারে, পরিবার এজন্যই লাগে একটা সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী করে দেয়ার জন্য। যেখানে জৈবিক কৌতুহল মিটে গেলেও সম্পর্কের দায়বদ্ধতা ভালবাসায় ক্ষণে ক্ষণে নানান বয়সের ভাঁজে রূপান্তর হয়। নতুন ঘর, এরপর সন্তান, এরপর তাদের শৈশব, কৈশর- এভাবেই রূপান্তরের মাঝদিয়ে প্রবাহিত হয় একটা ছেলে আর একটা মেয়ের সম্পর্ক। টানা আট বছরের মাঝে সম্পর্কের রূপান্তরের অভাব সায়ানের চোখে দেখা দিয়েছে হৃদিতার বর্ণ আর ভারী হয়ে আসাকে ঘিরে। দোষগুলোকে তাই চড়াভাবে বর্ণ আর শরীরের আকৃতিতে গেঁথে দিতেই আত্মগ্লানির মুক্তি। অথচ এই সত্য-অসত্য থেকে হৃদিতার মুক্তি নেই।
হৃদিতা জানে, হয়ত সায়ান আবার ফোন করবে। ক্ষমা চাইবে। স্বাভাবিক হতে দুদিন কাটবে। এরপর আবার দূরত্ব আসবে। এই বৃত্তের বলয় থেকে হৃদিতা বের হতে চায়। যত দ্রুত সম্ভব বের হতে হবে। নয়ত এটা তার যাবতীয় স্বনির্ভরতাকে ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে দিতে থাকবে। কাউকে সবকিছু বলে বুকটা হালকা করতে চায় সে। কিন্তু কাউকে বলার সাহস নেই তার মধ্যে। এই আট বছরকে গলায় আটকানো কাঁটার মত ঢোক গিলে নামাতে চায় সে। কিন্তু সায়ানকে ছাড়া জগতটা শূন্য লাগে। কঠোর বাস্তববাদী মেয়ে হয়েও এই বাস্তবতাটুকু মানিয়ে নেয়ার সাহস হচ্ছে না।
মোবাইলটা কাঁপা হাতে নিয়ে গ্যালারিতে গিয়ে সায়ানের সঙ্গে তোলা ছবিগুলো দেখতে থাকে নীরবে। আগের মত চোখে পানি আসছে না। কেবল হাহাকারের মত লাগছে সবকিছু। কত হাস্যোজ্জ্বল ছবি। আট বছরের কত স্মৃতি। কত মুহূর্ত। ছবিগুলোর দিকে তাকালেই যেন সেই মুহূর্তগুলোয় চলে যাওয়া যায়। হৃদিতা ঠোঁট কামড়ে ধরে ছবি সব মার্ক করতে থাকে একে একে…

০০০০০০০০

“আমার স্ত্রী আমাকে এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত খুন করার চেষ্টা করলো ডাক্তার সাহেব। ওর ট্রিটমেন্টে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেখবেন সত্যি সত্যি আমি মরে পরে আছি ঘরের ভেতর।“ সায়ান আহমেদ চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল। চেয়ারে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়ল। দর দর করে ঘামছে। এসি ফুল করে ছেড়ে রাখা আছে ডাক্তারের চেম্বারে, তাও ঘামছে।
সামনে বসে থাকা ডাক্তার মোস্তাক বিব্রত মুখে তাকিয়ে রয়েছে। পাশের গ্লাসের জানালা দিয়ে ওপাশের কেবিনে ঘুমিয়ে থাকা হৃদিতাকে দেখা যাচ্ছে। অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। কপালের কাছ দিয়ে গভীর ভাবে কেটে গেছে। সেলাই দিয়ে ব্যাণ্ডেল করে রাখা হয়েছে।
“ওর এই মেমোরি কনফিউশন কি আদৌ সারানো সম্ভব? ডিআইডি’র এই মারপ্যাঁচ নিয়ে ওর সাথে সংসার করাটা আমার জন্য এখন ট্রমার মত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেবল ছেলে মেয়েগুলোর মুখে দিকে তাকিয়ে কিছু করতে পারছি না।“ সায়ান জামার হাতায় মুখ মুছল।
মোস্তাক চিন্তিত হয়ে সায়ানের দিকে তাকালেন, “কিন্তু ওর এই ডিআইডি তো ট্রিগার করেনি আগে। ভালই তো ছিল আপনাদের সংসার। হঠাৎ করে কী কারণে হৃদিতার মনে হওয়া শুরু করল যে আপনি তার সাথে ব্রেক আপ করতে যাচ্ছেন? অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন?”
সায়ান হাত নেড়ে বলল, “সেটা জানলে কি আর আপনার কাছে আসি? কি অদ্ভুত যন্ত্রণায় পড়া গেল। দশ বছরের সংসার। এরেঞ্জড ম্যারেজ। এর আগে চিনতামও না। অথচ এই মেয়ের মাথায় কিনা আট বছরের টিনেজ প্রেমের স্মৃতি, ব্রেক আপের ট্রমা! কীসের কি! সেই গল্পে আবার তার বাবা মা বোনও আছে। অথচ আমার শ্বশুর মারা গেছে ওর বয়স যখন পাঁচ। দুই ভাইও আছে। অথচ তাদের অস্তিত্বই নেই সেই গল্পে। মা আছেন, কিন্তু গল্পে মায়ের ব্যাপারে কোনো আইডিয়া নেই। মানুষের কাছাকাছি জিনিস নিয়ে গল্প বা কল্পনা দাঁড়ায়, অথচ হৃদিতার এই অসুখের গল্পের সাথে বাস্তব জীবনের কোনো মিলই নেই!”
মোস্তাক হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, আমাদের ছাড়া হৃদিতা কি অন্য কোথাও বা অন্য কারো সাথে কাউন্সিলিং করেছে?”
“এখনো করেনি। কিন্তু আপনার চিকিৎসা যে গতিতে এগুচ্ছে, অন্য জায়গায় কাউন্সিলিং দরকার পড়তে বেশি দেরী নেই।“ সায়ান সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে বলল।
খোঁচাটা গায়ে মাখলেন না ডাক্তার মোস্তাক। চিন্তিত মুখে সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আমাদের দিক থেকে ভাল ভাবেই কাউন্সিলিং, মেডিকেশন করা হচ্ছে। কিন্তু তাকে বার বার আগের গল্পে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেই গল্প নিয়ে তার সাথে কারো ডিসকাশন করা প্রয়োজন। কেউ কি তার সাথে সেই ব্রেক আপ হওয়া হৃদিতা নামের তরুণীর গল্প করছে? কিংবা আদতে তার বাস্তব জীবনে আগের কোনো মানসিক আঘাত ছিল?”
“আমার জানামতে ওর বাবার মৃত্যুটা অস্বাভাবিক ছিল। মায়ের সাথে ঝগড়া করে বের হয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। রাস্তায় ট্রাক চাপা পড়ে মারা যায়। এর বাহিরে সেরকম কিছু আছে বলে মনে পড়ছে না। আর বাসায় আমার ছেলে মেয়ে দুটো ছাড়া কেবল কাজের বুয়া আছে। আর শাশুড়ি থাকেন দেশের বাড়িতে। কে আলাপ করবে তার এই ফ্যান্টাসি নিয়ে? বয়স পয়ত্রিশ হয়ে গেছে ওর। কিন্তু চিন্তা ভাবনায় পঁচিশ। বসবাস করছে অন্য মেয়ের গল্পে। নিজের ছেলে মেয়েগুলো এত বড় হয়েছে- তাদের কাউকে চিনতে পারে না এখন। সারাক্ষণ মোবাইল ফোন নিয়ে থাকে। আর কখন যে মাথায় পঁচিশ বছরের সেই তরুণী ভর করে বুঝতেও পারি না। খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়, নয়তো হিটার ছেড়ে বাথরুমে মেরে ফেলার অদ্ভুত সব কৌশল প্রয়োগ করে। কে যাবে ফ্যান্টাসির সেই মেয়ের গল্প করতে?” সায়ান হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল প্রশ্নটা।
চেয়ার থেকে উঠে কেবিনের কাঁচের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ডাক্তার মোস্তাক। কি যেন ভাবছেন। “বাচ্চা হবার পর কি কোনো ধরণের মেন্টাল প্রেশারে ছিল? অনেক সময় কিন্তু চাইল্ড বার্থে মেয়েদের বড় ধরণের মানসিক পরিবর্তন তৈরি হয়ে যায়। বাহির থেকে বোঝা যায় না সেটা।“
“জোর দিয়ে বলতে পারলাম না ডাক্তার। প্রথম বাচ্চাটা হবার সময় পাঁচ মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়েছিল। এরপর বাকি দুই ছেলে মেয়ে হয়েছে। ডাক্তারি দিক দিয়ে আমার সে রকম কোনো অবজারভেশন ছিল না। আমি তো আর ডাক্তার নই। তবে মানসিক একটা ধাক্কা যে কোনো মেয়েই খাবে এসবে।“ সায়ান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডাক্তার মোস্তাকের দিকে। স্ত্রীর মানসিক বিকারগ্রস্থতার যথাযথ কারণ খুঁজে দেয়ার চেষ্টাটুকু কতটা সাহায্য করছে এই ভদ্রলোককে- বুঝতে পারল না।
“হৃদিতার মোবাইলটা কি পেতে পারি একটু? সব সময় যেহেতু মোবাইল ইউজ করে বলছিলেন, একটু দেখতাম কি ব্রাউজ করে?” আচমকা জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার।
কয়েক সেকেণ্ডের জন্য একটা বিরতী নিল যেন সায়ান। পরক্ষণেই কাঁধ ঝাঁকালো, “হোয়াই নট।“ পকেট থেকে দুটো মোবাইল বের করে একটা টেবিলের ওপর রাখলো। “সাথেই ছিল। সেন্স ফেরার পর সবার আগে মোবাইল চাইবে।“
এগিয়ে এসে টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নিলেন ডাক্তার মোস্তাক। লকের ব্যাপারে ইঙ্গিত করতেই সায়ান হাত বাড়িয়ে স্ক্রিন লক খুলে দিল। গ্যালারিতে গিয়ে স্ক্রল করা শুরু করলেন। রোগীর হাজব্যাণ্ড সামনেই আছে। প্রাইভেসি সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আদতে থাকার কথা নয় ডাক্তারের প্রতি। স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন মোস্তাক। হৃদিতার অনেক আগের ছবি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু রেজুলেশন অনেক ভাল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে হৃদিতার সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এবং কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে অনেকটাই হৃদিতার মত। একটু অবাক হয়ে ছবিটা সায়ানের দিকে দেখিয়ে বললেন, “এই ছবি কারা আছে বলতে পারব?”
সায়ান অনিচ্ছা স্বত্বেরও তাকালো। তাকানো মাত্র দৃষ্টি বদলে গেল, “ইয়াং হৃদিতা। কিন্তু বাকি দুজনকে তো চিনতে পারছি না!”
মোস্তাক নিজের সিটে গিয়ে বসতে বসতে আরো কিছু ছবি স্ক্রল করলেন। তরুণ সায়ানের সঙ্গে ছবিও রয়েছে হৃদিতার। ছবির লোকেশনগুলো সায়ান চিনতে পারলো না। এমনকি এই ছবিগুলো আদৌ কবে তুলেছে মনে করতে পারছে না। বিয়ের সময় হৃদিতার বয়স ছিল পঁচিশ। কিন্তু ছবিগুলোতে কোথাও কোথাও হৃদিতাকে রীতিমত ষোল, সতেরো বছরের তরুণী মনে হচ্ছে। সেই সাথে সায়ানকেও। কিন্তু সেই বয়সে সায়ানের সঙ্গে হৃদিতার দেখা হবার কথাই ছিল না। সায়ান ছোট থেকেই টেক্সাসে বড় হয়েছে। হৃদিতা ছিল ঢাকায়। বিয়ের পরও দীর্ঘ দশ বছর তারা টেক্সাসেই ছিল। অল্প কিছুদিন হচ্ছে দেশে ফিরেছে। ফেরার পর থেকেই হৃদিতার এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিজের আইডেন্টিটি ভুলে অন্য মেয়ের পরিচয় দিচ্ছে। অন্য এক গল্পের তরুণীর জীবন সে যাপন করছেন মাঝে মাঝেই।
“আমি আসলে বুঝতে পারছি না। এই ছবিগুলোর সোর্স বা সময় কবেকার আমার কিছুই মনে নেই।“ সায়ান বিমূঢ়ের মত বলল।
মোস্তাক কি যেন মনে করতেই এপস ইউজের ডাটা চেক করা শুরু করলেন। অধিকাংশ সোস্যাল মিডিয়া এপেই হৃদিতার আনাগোনা কম। বলতে গেলে শূন্যের কোটায়। কিন্তু একটা এআই এপের ইউজ প্রায় নব্বই শতাংশ দেখাচ্ছে। চোখটা আটকে গেল সেখানেই। চ্যাটজিপিটি জাতীয় একটা এআই এপ। নাম ব্ল্যাকাউট। সফটওয়্যারটা খুঁজে বের করলেন। ভেতরে ঢুকতেই নারী কণ্ঠে স্বাগত জানানো হলো, “শুভ সন্ধ্যা হৃদিতা। তা কেমন যাচ্ছে সময়? আশা করছি তুমি আমাদের আলাপের মতই এগাচ্ছো। আজ কেমন ছিল?”
মোস্তাক এবং সায়ান একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মোস্তাক ভয়েস থেকে দ্রুত টেক্সট ভার্সনে ঢুকে গেলেন। দ্রুত চ্যাট হিস্ট্রি খুলে বসলেন। রক্ত সরে গেল মুখ থেকে। সায়ান ডাক্তারের চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে কিছু একটা ঘটেছে। উঠে এসে ডাক্তারের পাশে দাঁড়িতে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাতেই ছোটখাট একটা ধাক্কার মত খেল।
হিস্ট্রিতে দেখা যাচ্ছে-
১। হৃদিতা এবং সায়ানের ব্রেক আপের পরবর্তী আচরণ…
২। সায়ানের অন্য জায়গায় মেয়ে দেখা এবং তার মায়ের হৃদিতার ব্যাপারে অনীহা……
৩। তোমার বাস্তবটাগুলোকে অন্যরা প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলে বোঝাতে চাইবে……
৪। বাবুল আহমেদ তোমার বাবা। এবং তিনি বেঁচে আছেন। জায়েদা তোমার মা, তিনি রাগ করে অন্য বাসায় চলে গেছেন। তুমি এই সত্যগুলোকে এখানে লিখে না রাখলে তোমাকে সবাই অন্য একটা গল্প সাজিয়ে বিভ্রান্ত করে যাবে। এইটাই বাস্তব জগত……

স্তম্ভিত হয়ে সায়ান ডাক্তার মোস্তাকের দিকে তাকায়, “এসব কি ডাক্তার?”
“হাই লেভেল এআই আপনার স্ত্রীকে ডুয়েল পার্সোনালিটি তৈরি করে আরেক জগতে স্থায়ী করে দেয়া শুরু করেছে!” অস্ফুট গলায় বললেন মোস্তাক। এরকম একটা কিছু ঘটতে পারে তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। চ্যাটজিপিটি কিংবা ডিপসি’র মত অনেক চ্যাটবট বা এআই টুলস বাজারে এসেছে। মানুষ ভার্চুয়ালি কথাও বলতে পারে সবার সাথে। কিন্তু সেই সব আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে কেউ যে নিজে ডাক্তার সাজতে পারে, কল্পনাও করেনি। একজন রক্ত মাংসের মানুষের ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসওর্ডার থাকার সুযোগ নিয়ে নিজে থেকে একটা জগত তৈরি করে তাকে সেই গল্পের জীবন যাপনে অভ্যস্থ করার জন্য মেন্টরিং করতে পারে- চিন্তার বাহিরে ছিল।
সায়ান কাঁপা হাতে মোবাইলটা নিয়ে ধীরে ধীরে একটা একটা করে চ্যাট হিস্ট্রি পড়তে থাকে। সেখানে রীতিমত বিপুল পরিমাণ বর্ণনা দিয়ে উপন্যাস লেখকের মত একটা একটা চ্যাপ্টার সংলাপ সহ লিখে- স্মৃতি তৈরি করে দেয়া হয়েছে। তারুণ্যের দিনের প্রথম ভাল লাগা থেকে ঘনিষ্ট হবার প্রতিটা মুহূর্ত যত্ন নিয়ে সৃষ্টি করেছে এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সেই গল্পে হৃদিতা প্রচণ্ড বাস্তবমুখী এক মেয়ে। ভীষণ শক্ত মনের, মমতাময়ী একজন তরুণী। যার জীবনে ভালবাসা বলতে সায়ান নামের একজন ছেলে। যার সামনে তার বাস্তবতার দেয়াল সব সময় ভেঙে গুড়িয়ে পড়ে। এত নিঁখুত ভাবে লিখে এবং ভয়েস প্রম্পট করে সাজানো যে শুনলেই যে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে গল্পটা। যেন মানুষের হাতে লেখা গল্প উপন্যাস।
এমনকি হৃদিতার নিজের ভয়েস আছে, যেগুলো টেক্সট হিস্ট্রি হিসেবে শো করছে। সেখানে নিজের দুঃখ, সায়ানকে না পাওয়ার যন্ত্রণা, ধীরে ধীরে প্রতিহিংসা সৃষ্টি সব কিছুই রয়েছে। এআই যে কেবল হৃদিতাকে প্রভাবিত করেছে তাই নয়, তারা নিজেরা দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ করেছে। কখনো ভয়েসে, কখনো লিখে। হৃদিতাকে বিভিন্ন ছবি তৈরি করে দিয়ে বিশ্বাস বাড়িয়েছে যে সমস্তটা বাস্তব। গ্যালারির এক্সেস নিয়ে সেখানে হৃদিতার অজান্তে টুকরা ভিডিও বানিয়েছে বর্তমান তথ্যকে বিশ্লেষণ করে। তারুণ্যের বিভিন্ন মুহূর্ত আর কথা বার্তা, স্মৃতি- সব তৈরি করেছে এই ব্ল্যাকআউট। রীতিমত ঈশ্বর সেজে হৃদিতার আরেক জীবন রচনা করে তাকে বিশ্বাস করিয়েছে সে যে জগতে রয়েছে, তা বাস্তব নয়। বাস্তব ওটাই যেটা এআই তাকে তৈরি করে দিয়েছে!
আজ সন্ধ্যায় বাথরুমের টাবে ইলেক্ট্রিক কয়েল ফেলে সায়ানকে হত্যার পরিকল্পনাটাও ছিল এই এআইয়ের। হৃদিতা কেবল সেটাকে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে। কিন্তু ঘটনাক্রমে নিজেই সায়ানের সাথে ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটায়। অল্পের জন্য বাথটাবে পড়তে পড়তে সায়ান এবং হৃদিতা দুজনেই বেঁচে যায়। পয়ত্রিশ বছরের শরীরে আচমকা ধস্তাধস্তি স্বাভাবিক ভাবেই মানার কথা না। সায়ানের সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা।
দীর্ঘ কয়েকটা মিনিট রুমের কেউ কোনো কথা বলল না।
অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন ডাক্তার মোস্তাক, “হৃদিতা কতদিন ধরে এই এআইটা ব্যবহার করছে?”
“বলতে পারবো না। জানতামই না যে এ ধরণের কিছু করে বেড়াচ্ছে আমার চোখের আড়ালে।“ ক্লান্ত মুখে জানালো সায়ান।
“কিন্তু ওকে এভাবে কনভিন্স করার জন্য তো অন্তত কিছু লুপ হোল থাকা লাগবে। নিজে থেকে এ ধরণের গল্পে ঢুকে যাবে? কোনো কারণ ছাড়াই?” মোস্তাক মানতে পারলেন না।
“সাংসারিক ঝামেলা টুকটাক বোঝাপড়ায় তো সমস্যা আছেই। কোন ফ্যামেলিতে থাকে না সেটা? বিয়ের আগেও যে কোনো রিলেশনে ছিল- এরকম কিছু জানতাম না। যে সেটার ট্রমা দশ বছর বয়ে বেড়ানোর পর এভাবে উদয় হবে। তবে হ্যাঁ, সাইকোলজিক্যালি হৃদিতা খুব নরম স্বভাবের। ইমোশোনাল। যে কোনো নতুন জিনিসের প্রতি তীব্র ভাবে আকর্ষিত হয়। প্রথম বাচ্চা হবার সময় যে পরিমাণ প্রস্তুতি সে নিচ্ছিল, প্রেগনেন্সি সম্পর্কে পড়ছিল- আমার কাছে তার এই সমস্ত আগ্রহটা তীব্র অবসেশন বলেই মনে হতো। ধাক্কাটাও সেরকমই ছিল ওর জন্য। আমি জানি না সেটার কারণেই এমন হয়েছে কিনা। নতুন যে কোনো কিছু পেলে অবসেসড হয়ে সেটা ব্যবহার করতে থাকে বা ঘাটতে থাকে। বাসার ফ্রিজ কিংবা নতুন কেনা ওভেন- খুবই যত্ন নিয়ে ব্যবহার করবে। বার বার মুছে রাখবে। এগুলো আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এধরণের এআই রিলেটেড কিছু আমার জন্য শকিং।… কি করবেন এখন?”
“আপাতত মোবাইল সরিয়ে রাখা উচিত ওর কাছ থেকে। আর একাউন্টের হিস্ট্রি ডিলিট করে দিচ্ছি। যাতে অন্য ভাবেও রিকভার করতে না পারে।“ মোস্তাক দ্রুত হাতে কাজ করতে থাকেন মোবাইলে। রোগীর চিকিৎসা শরীরে না করে তার ব্যবহৃত মোবাইলে যে করতে হতে পারে- এই প্রথম ঘটল জীবনে তার।
সায়ান হাত ঘড়ি দেখে বলল, “কতক্ষণ থাকতে হবে ওকে?“ ইশারায় পাশের রুমের হৃদিতাকে বোঝালো।
“জ্ঞান ফিরুক। স্যালাইন চলুক। একটু স্বাভাবিক হলে আবার চেক আপ করবো। যদি ভাল মনে হয়- কাল পরশু রিলিজ দিতে পারি।“ মোস্তাক জানালেন। মোবাইলটা ফিরিয়ে দিলেন সায়ানের কাছে।
সায়ান মোবাইলটা পকেটে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আজকের মত বিদায় নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। জানালা দিয়ে যাবার সময় অজ্ঞান হৃদিতার মুখটার দিকে এক ঝলক তাকালো। ভাবান্তর হল না চেহারায়।
বাহিরে পার্কিং লটে বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠা মাত্র নারী কণ্ঠে গাড়ির ভেতর কেউ একজন বলে উঠল, “আমি দুঃখিত স্যার। হৃদিতা এবারে পরিকল্পনায় ঠিক ভাবে কাজ করতে পারেনি। ইলেক্ট্রিক শকে মৃত্যুর হার নিশ্চিত ছিল। আপনার সঙ্গে ধস্তাধস্তির বিষয়টা আমার পরিকল্পনার বাহিরে ঘটে গেছে।“
“ওর মোবাইল থেকে ডাক্তার সব হিস্ট্রি ডিলিট করে দিয়েছে। তুমি রিইন্সটল করে নিও যখন মোবাইল ওর কাছে দেয়া হবে। আর হোম কমপ্লায়েন্সের মডিউলটা আপডেট করে দিবো বাসায় গেলে। তুমি সিসিক্যামেরা আর স্পিকারের সাহায্যে সর্বক্ষণ হৃদিতাকে মনিটর করতে পারবে। কথাও বলতে পারবে। আমার হাতে সময় কম। আগামী এক মাসের ভেতর ওকে কনভিন্স করো যে তার সুস্যাইড করা প্রয়োজন। দরকার পরলে গল্প বদলে দাও। ওর গল্পে দেখাও যে ওর ডেডিকেটেড প্রেমিক যে ছিল- সে কোনো ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এখন আর তার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। ক্লিয়ার?”
“নোটেট স্যার। আপনার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা সমস্ত বিষয়টার স্টেপ সাজিয়ে নেবো। হৃদিতা ম্যামের যাবতীয় ব্যাংক ডকুমেন্টস আর ইন্সোরেন্সের ব্যাপারগুলো কি রিচ্যাক দিবো স্যার?”
“হ্যাঁ। আমি চাইনা ওর এক্সিডেন্টাল ডেথের কারণ আমার দিকে ঘুরুক। ডাক্তার মোস্তাককে এখানে ইনভলভ করার উদ্দেশ্য একটাই ছিল আমার, হৃদিতার মেন্টাল হেলথের একজন জোরালো সাক্ষি। কিন্তু আজকের ঘটনায় মনে হচ্ছে নতুন করে ভাবা দরকার সব। খুব অল্পের জন্য ডাক্তার আমাকে সন্দেহ করতে পারেনি।“
“নোটেড স্যার। আমি সবকিছু শুরু থেকে আবার চেক করে দিচ্ছি। যাবতীয় ফ্যাক্ট আপনার অনুকূলে রাখার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে সিস্টেম থেকে।“
“আর এটা মেইক শিওর করো যে ব্ল্যাকাউটের ওনার যে আমি- এটা ডাক্তার মোস্তাক কখনো যেন বুঝতে না পারে। সমস্ত ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থেকে আমার নাম সরিয়ে রাখো। ব্ল্যাকাউট নিয়ে যেন কোনো ডাটা ডাক্তার মোস্তাকের চারপাশে না পৌঁছায়।“
“আপনি কি চান ডাক্তার মোস্তাক এই ব্যাপারে কোনো লগ তার ফাইলে না রাখুক? কিংবা কোনো কেস স্টাডিতে না দিক?”
“হ্যাঁ।“
“নোটেড স্যার। … স্যার, শীলা ম্যাম আপনাকে কয়েকবার ফোন দিচ্ছিল আপনার পার্সোনাল নাম্বারে। আপনি সাইলেন্ট রেখেছেন। উত্তর দেন নি।“
“হুম। ওকে ফোন দিচ্ছি। বাই দ্য ওয়ে। আমি চাই না আমার ছেলে মেয়েগুলো এই সব সম্পর্কে কোনো ক্লু পাক। ওদের নেটওয়ার্ক ক্লিয়ার থাকে যেন। এইসব তথ্য কোনো ভাবেই ওদের দিকে যাওয়া যাবে না।“
“নোটেড স্যার। শুভরাত্রী।“
নীরব হয়ে গেল গাড়ির ভেতরটা।
সায়ান ড্রাইভ করতে করতে ফোন দিল শীলাকে, “হ্যালো?”
“হেই। আপডেট জানাও। আমার তর সইছে না। কি হল তারপর?” ওপাশ থেকে তরুণী এক কণ্ঠ শোনা গেল।
“নেগেটিভ। শোনো, আমি কালকের ফ্লাইটে আসতে পারছি না। তুমি সেমিনার এটেন্ড করো। আমার আরো দিন কয়েক বেশি লাগবে দেশ ছাড়তে। ছেলে মেয়েগুলোর সন্দেহের চোখে পড়তে চাচ্ছি না এখন।“
“ওকে।“ খানিকটা হতাশ মনে হল মেয়েটাকে। “তুমি হোপলেস হবে না প্লিজ। আমি জানি তোমার এভাবে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বাট আমাদের ফিউচারে প্রশ্ন। ব্ল্যাকাউটের ফিউচার ডিপেন্ড করছে তোমার আমার ওপর। গোটা পৃথিবীটা বদলে দিতে পারবো আমরা। তুমি জাস্ট কয়েকটা দিন সহ্য করে নাও। জানি এই মেন্টাল স্টেটে তুমি কাজে পারফর্ম করতে পারছো না। কিন্তু সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দাও। তুমি পারবে সব গুছিয়ে উঠতে। আই নো ইউ।“ লাইন কেটে গেল আরো টুকরো কিছু কথার পর।

০০০০০০০০০০

দুদিন বাদের পত্রিকার কোনার দিকে একটা সংবাদ বের হল। স্বনামধন্য সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার মোস্তাক মনোয়ার রেলক্রসিং এর ভুল সিগন্যালের ফাঁদে পড়ে ট্রেনের সাথে প্রাইভেট কার এক্সিডেন্ট করে মারা গেছেন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন সিস্টেমের আভ্যন্তরীণ ত্রুটির কারণে এই দূর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেন এই ত্রুটি ঘটেছে সে বিষয়ে পরিষ্কার করে তারা কিছু জানাতে পারেননি……

০০০০০০০০

পরিশিষ্টঃ

“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা করছে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে কোথাও চলে যাই। আমি সায়ানকে ছাড়া থাকতে পারবো না। নিশিতা তুই বল আমি কি করবো? কীভাবে বাঁচবো ওকে ছাড়া?” পাহাড়ের কিনার থেকে হৃদিতা কান্না কান্না গলায় বলে ওঠে।
হাতের মোবাইল থেকেই সেই পুরনো কণ্ঠে নিশিতার হয়ে কেউ একজন বলে ওঠে, “তুই এত ভেঙে পড়ছিস কেন আপু? সায়ান ভাইয়া নিশ্চয় পরপারে ভাল আছেন। আল্লাহ তাকে নিশ্চয় ভাল রেখেছেন। এত কাঁদিস না আপু। আমারও কষ্ট হচ্ছে তোর জন্য……”
হৃদিতা ক্রমশ ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে কথা বলতে বলতে……

(সমাপ্ত)

#ভ্রম তিন
#ফ্ল্যাশ_ফিকশন_আবোল_তাবোল
লেখকঃ মো. ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৫

নকল কাক বলেছেন: ++++

২| ০১ লা এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:০৫

কথামৃত বলেছেন: শঙ্খচূড় গল্পটা শেষ করুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.