নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

হিলিয়াস

০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৩২


“আমাদের হাতে সময় কতটুক আছে আর?” নিয়ানা ফিরে তাকায় রোমানের দিকে।
“অক্সিজেনের হিসেবে আর আট ঘণ্টা। নাইট্রোজেন কনভার্সন হিসেবে ধরলে আরো বাড়তি তিন ঘণ্টা। মোটে এগারো ঘণ্টার রেস্পিরেটরি সাপ্লাই আছে দুইজনের জন্য। তিনজন হলে সেটা সাত ঘন্টার একটু বেশি। আর ভাগ্য ভাল হলে অক্সিজেন মাত্রা বাতাসে বাড়তি পেলে তো আরো কিছু বোনাস।” হাতের উল্টো পিঠের ছয় ইঞ্চি মনিটরটার দিকে তাকিয়ে হিসেব করে উত্তর দেয় রোমান।
উত্তাপ বাড়ছে ক্রমশ। টানেলের ভেতর তাপমাত্রা প্রায় বায়ান্ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পেরিয়ে গেছে। গায়ে ভারী ক্যাভম্যান স্যুট আর পিঠে অক্সি-নাইট্রো দুই সিলিণ্ডারের ওজন নিয়ে দর দর করে ঘামছে উভয়েই। দুজনের হাতেই একটা একটা করে বারতি সিলিন্ডার আর একটা ব্যাগ। আলো প্রায় নেই বললেই চলে টানেলের ভেতরে। হেলমেটের সামনের দিকে নাইট ভিশন ইনফ্রারেড লাগানো থাকায় সবুজ সবুজ ভাবে সব দেখা যাচ্ছে।
নিয়ানা এবড়ো থেবড়ো টানেল ধরে এগুতে থাকে সামনে দিকে। পেছন পেছন আসতে থাকে রোমান। টানেলটা ক্রমশ ঢালু হয়ে নিচের দিয়ে নেমে যাচ্ছে কিছু মোড় পর পর। আলগা ঝুড়ি ঝুড়ি পাথর এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। ঢালু জায়গায় নামতে গিয়ে বার কয়েক পা হড়কালো নিয়ানা। পেছন থেকে রোমান খপ করে ধরে ফেলল প্রতিবার। উত্তাপ বাড়ছে যতই এগুচ্ছে। টানেলের দেয়ালগুলোতে ইলেক্ট্রিক লাইন ছিল কোনো কালে, নষ্ট হয়ে গেছে। গলে গেছে বেশির ভাগ পাইপ। বাতিগুলো মৃত। গ্যাস মাস্ক পরে থাকার পরেও বাতাসের তীব্র হাইড্রোজেন সালফাইডের কড়া গন্ধ এসে ঢুকছে। জানান দিচ্ছে “হিলিয়াস” টিউব খুব কাছাকাছি আছে। নিয়ানা ঘন ঘন হাতের উলটো পিঠের মনিটর দেখতে দেখতে এগুচ্ছে। কোথাও প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এসওএস সিগন্যাল এসেছে তাদের কাছে। প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। স্পন্দন নেই আর সেই এসওএসের। হিলিয়াসের অনেক কাছাকাছি একটা জায়গা থেকে সিগন্যালটা এসেছিল।
কয়েক শতাব্দী আগে আন্তগ্যালাক্টিক পোর্টাল থেকে প্রায় পৃথিবীর দেড়গুণ বড় একটা উল্কা পিণ্ড ছুটে এসে আঘাত করেছিল। যেটার কারণে কামড় দেয়া আপেলের মতো পৃথিবীর একপাশ তুবড়ে গিয়েছিল। নিজে কক্ষপথ থেকে ছিটকে বুধ, শুক্রকে অতিক্রম করে সূর্যের ত্রিশ মিলিয়ন কিলোমিটারের কাছাকাছি কক্ষপথে গিয়ে স্থির হয়। নিজস্ব আহ্নিক গতি হারিয়ে পৃথিবী কেবল সত্তর দিনের বার্ষিক গতি নিয়ে ঘোরা শুরু করে।
বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই এই ঘটনার হিসেব নিকেশ করে ফেলায় পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে পারে এই দূর্ঘটনায়। তাই খুব দ্রুত অভাবনীয় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। পৃথিবী সূর্যের কাছে চলে গেলে পৃথিবী পৃষ্ঠে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না। তাই ভূগর্ভস্থ কলোনি তৈরি করা হয়। কেন্দ্রের গলিত লাভাগুলোকে কোয়ারেন্টাইন করে ভেতরের কৃত্রিম সূর্য তৈরি করে মানুষ। নাম দেয়া হয় হিলিয়াস। ফাঁপা এই ভূ আভ্যন্তরীণ পৃথিবীর ভেতর প্রচণ্ড মাত্রায় চাপ সহনের জন্য তৈরি হয় এয়ার প্যাকেট নামের লক্ষ লক্ষ সুড়ঙ্গ বা টানেল। যেন বাহির থেকে পৃথিবীকে আঘাত করলেও ভেতরটা অক্ষত থেকে যায়।
যদিও পুরোপুরি সফল হননি বিজ্ঞানীরা। কারণ পৃথিবীর ভেতরে সেই পরিমাণ জায়গা তৈরি করতে পারেননি, সময় কমে আসছিল। তাই কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কেবল মাত্র উচ্চশ্রেণির মানুষেরা পৃথিবীর ভেতর জায়গা পাবে। বাকি কয়েক বিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়।
তারপর একদিন আঘাত হানে সেই উল্কাপিণ্ড। মেরুর আইসবার্গ ভেঙ্গে তছ নছ হয়ে যায়, হারিয়ে যায় আর্টিক সাগরের অস্থিত্ব। সূর্যের এতই কাছে পৌছে যায় যায় ভূপৃষ্ঠের সমস্ত পানি শুকিয়ে উড়ে যায় বায়ুমন্ডলে। চাঁদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পৃথিবী পরিণত হয় উপগ্রহহীন একটা মৃত্তিকা পিণ্ডে।
সূর্যের তেজে সমস্ত গাছ, পশুপাখি মারা যায় মাত্র তেরো ঘণ্টার ব্যবধানে। ভেতরের সুড়ঙ্গগুলোর অনেকগুলোই ধ্বসে যায় বাহিরের সেই উল্কার আঘাতে। ভেতরের পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ জনিত জটিলতার সৃষ্টি হয় গোলাকার গোলক থেকে বিকৃত গোলক হয়ে যাওয়ার কারণে। তবু মানুষ টিকে যায়। ভেতরে তৈরি হয় নতুন ইকোসিস্টেম। নতুন মধ্যাকর্ষণ শক্তি। নাম দেয়া হয় হিলিট্রেশন। ভেতরের সূর্যের আলোয় গাছ জন্ম নেয়। শস্য হয়। বাঁচতে শুরু করে মানুষ নতুন করে। হিলিয়াস সূর্যের মতো করে সাদা আলো দিতে পারে না। শুরু হয় লাল-কমলা রঙা সূর্যের পৃথিবীর যুগ।
কিন্তু সবকিছু চাইলেও ভাল করা সম্ভব নয়। মানুষেরা পৃথিবীর বাহিরে থেকে অভ্যস্থ ছিল, ভূ-অভ্যন্তরে টিকে থাকতে গিয়ে মানসিক নানান সমস্যায় আক্রান্ত হতে শুরু করল। হতাশায় ডুবে কয়েক বছর পর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে বেশ দ্রুত।
নিয়ানা যখন জন্ম নেয়, হিলিয়াস সিস্টেমের মানুষের সংখ্যা মাত্র হাজার খানেক। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মানুষেরা আত্মহত্যা নয় খুনাখুনি করে সব শেষ করে ফেলেছে। প্রবল মানসিক শক্তি সম্পন্ন মানুষেরাই শুধু টিকে আছে। সংখ্যাটা কমছে কেবল।
নিয়ানা যখন হিলিয়াস মনিটরিং সিস্টেমে ইন্টার্নি হিসেবে যোগ দেয়- তখন মানুষের সংখ্যা শ’য়ের কোটায় নেমে গেছে। পুরুষের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত কম। মাত্র নয় জন। বাকি চুরানব্বই জনই নারী। নিয়ানা দেখতে মোটেও সুন্দর নয়। আকর্ষনীয় কোনো শারীরিক কাঠামোও নেই, কিন্তু বিচিত্র কোনো কারণে দুই বছরের ছোট রোমান তাকে ভালবেসে ফেলে। এক সঙ্গে থাকতে শুরু করে তারা। বছর খানেক পর তাদের সংসারে জন্ম নেয় ফুটফুটে একটা মেয়ে। এমা।
নিয়ানা এবং রোমান উভয়েই ছিল হিলিয়াস সিস্টেমের মিনিটর। তাদের সাথে আরো অনেকেই কাজ করতো। লোক সংখ্যা কমে আসবে জানা ছিল সবার। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছিল এমন একটা স্পেশশিপ তৈরি করতে যেটা সূর্যের তাপ সহ্য করে অক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারে সবাইকে। কারণ হিলিয়াস সিস্টেমে দীর্ঘদিন টিকে থাকার মতো অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। মানুষ বিলুপ্ত হয়ে আসার পথে রয়েছে। প্রয়োজনীয় তাপ সহনীয় ধাতুর অভাবে ভূগছিল মূলত। পৃথিবীর ভেতরে বসে সূর্যের এত কাছে কোনো ধাতু দিয়েই স্পেশশিপ টেকানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই একরম জানা হয়ে হয়ে গিয়েছিল যে মৃত্যু অবধারিত- হতাশায় আত্মহত্যা করে নয়তো স্পেশশিপ তৈরি করে পালিয়ে যেতে না পারায়।
কয়েক সপ্তাহ আগে বড় ধরণের একটা থার্মোনিউক্লিয়ার বিপর্যয়ে চার হাজার হিলিয়াস টিউবের তিন হাজার টিউব গুড়িয়ে যায়। ভেতরের সূর্য কাঁত হয়ে উগড়ে দিতে শুরু করে ভেতরের ভয়াবহ উত্তপ্ত লাভা এবং তীব্র বিষাক্ত গ্যাস। গাছপালা থেকে শুরু করে সমস্ত পানির উৎস ধ্বংস হয়ে যায়। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে পুরো কোলনির সমস্ত টানেলের বাতাস দূষিত হয়ে দম আটকে মারা যায় প্রায় সবাই। শুধু মাত্র ল্যাবের ভেতর ডিউটিতে থাকার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় নিয়ানা এবং রোমান। কিন্তু বাসায় রেখে আসা সন্তান এমা মারা যায়।
বলা যায় এই মুহূর্তে পৃথিবীর ভেতর শুধু মাত্র দুটো মানুষ বেঁচে রয়েছে। আর কেউ নেই। খাবার নেই। সাপ্লাই ফুরিয়ে আসছে। অক্সিজেনের যেটুকু ছিল, এই কয়েক সপ্তাহে সেগুলোও ব্যবহার করে ফেলেছে তারা। বেঁচে থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ।
আজকেই সর্বশেষ অক্সিজেন সিলিণ্ডারগুলো পিঠে চড়িয়েছে তাঁরা। জানাই ছিল যে আজই শেষ দিন। এমনিতেই মারা যাবে তারা। ল্যাবের অক্ষত অংশে শুয়ে বসে কম অক্সিজেন খরচ করে হয়ত আরো কয়েক ঘণ্টা বেশি বেঁচে থাকা যেত। কিন্তু এর মাঝেই এসওএস সিগন্যাল পায় তারা। টানেল কিংবা হিলিয়াসের কাছাকাছি কেউ বেঁচে আছে। সিগন্যাল দিচ্ছে।
সেই সিগন্যাল অনুসরণ করে খুঁজতে এসেছে তারা। যদিও এখন আর সেই সংকেত পাচ্ছে না। যে দিচ্ছিল, সে কি মারা গেছে? না অন্য কিছু হয়েছে বোঝার উপায় নেই। হিলিয়াস টিউবের উত্তপ্ত তরল বেরিয়ে এসে চারপাশের তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে তুলে রেখেছে। তার মাঝে দিয়ে কাউকে খুঁজতে বের হওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত নিয়ানা বা রোমানের জানা নেই। অন্তত শেষ কৌতূহলের বশে পড়ে হলেও এসওএসের উৎস খুঁজতে আসা।
স্যুটের ভেতর দর দর করে ঘামছে নিয়ানা। ইতোমধ্যেই ঠোঁট, গাল সহ শরীর বিভিন্ন অংশে ফোসকার মতো দাগ ভেসে উঠতে শুরু করেছে। জ্বলছে। চোখ বেশিক্ষণ খোলা রাখা যাচ্ছে না। শুকিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মুখ, গলা সব খট খটে অবস্থা।
“মারা গেছে হয়তো…” রোমান বলল, “অহেতুক কষ্ট করে আর না খুঁজে শেষ সময়টা একটু বিশ্রাম নিয়ে কাটাতে পারতাম”
নিয়ানা তাকালো না ওর দিকে। সে নিজেও বুঝতে পারছে। এভাবে যত পরিশ্রম করে হাঁটবে, ততই অক্সিজেন কমে আসবে। সময় ফুঁড়িয়ে যাবে দ্রুত। কিন্তু নিজের অজান্তেই পাগুলো চলছে। দাঁড়ানো বা চলার কোনো নির্দেশ দেয়া হয়নি। তবুও। এসওএসটার সিগন্যাল হারিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিয়ানা কেমন যেন ভোঁতা একটা গুঞ্জনের মতো শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। শব্দটা আসলেই হচ্ছে কিনা বা হলেও কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছিল না।
কিন্তু রোমান কথা বলা মাত্র নিয়ানা টের পেল গুঞ্জনের মতো শব্দটা সামনের দিকের কোথাও হতে আসছে। ভেতরের সার্ফেস থেকে। মানে হিলিয়াসের এলাকা থেকে। টানেল থেকে নয়। নিয়ানা জানে যে যতই সামনের দিকে এগুবে, হিলিয়াসের কাছাকাছি যেতে থাকবে- তাপমাত্রা ততই বাড়তে থাকবে। টানেল থেকে বের হয়ে ভেতরের সার্ফেসে গেলেই এখন অসহনীয় মাত্রায় গরম। গাছ পালা কিছুই নেই। তবুও ক্লান্ত পা ফেলে এগুতে থাকে। রোমান বিস্মিত গলায় বলে, “তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? মরার আগেই মরতে চাও নাকি?
নিয়ানা উত্তর দেয় ক্লান্ত গলায়, “এখন আর অর্থবোধক কোনো কাজ করার কোনো মানে কি আছে রোমান?”
রোমান জবাব খুঁজে পায় না। আসলেই এখন বেঁচে থাকা বা না থাকার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। নীরবে অনুসরণ করতে থাকে স্ত্রীকে। কতক্ষণ হেঁটেছে তারা জানে না। কিন্তু শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে প্রায়। ভারী সিলিন্ডার আর ব্যাগ কোনোটাই টানার শক্তি নেই আর। টানেল থেকে উঠে হিলিয়াস পৃথিবীর ভেতরের পৃষ্ঠে বের হয়ে এসেছে দুজনেই। গুঞ্জনটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এখন। বিকট শব্দে খুব কাছাকাছি কিছু একটা চলছে। নিয়ানা প্রথমে বুঝতে পারলো না শব্দটা কীসের। রোমান ওর কাঁধে হাত রেখে ওপরের দিকে তাকাতে ইশারা করল।
ওপরে তাকালো নিয়ানা। মাথার ঠিক ওপরে শূন্যে ঝুলে রয়েছে হিলিয়াস পিণ্ড। কৃত্রিম সূর্য। তারও ওপরে, অন্য পৃষ্ঠে মাঝারি সাইজের একটা ডামি স্কাউটশিপ। ইঞ্জিন চালু করে বসে রয়েছে। এটা পরীক্ষণাধীন স্কাউট শিপ। মেটাল সূর্যের তাপে টিকবে কিনা বা মহাশূন্যে যাবার পর কতক্ষণ ঠিক থাকবে কেউ জানে না। কে চালু করেছে ওটা? বের হওয়ার টানেলই তো নষ্ট হয়ে যাবার কথা!
একে অপরের দিকে বিস্মিত মুখে তাকায় নিয়ানা এবং রোমান। হাতের ট্রান্সমিটারের এসওএস সিগন্যালটা আবার পাওয়া শুরু হয় আচমকা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিয়ানা তাকায় সেটার দিকে। সিগন্যালটা আসছে ওপরের পৃষ্ঠে ঝুলে থাকা স্কাউটশিপটা থেকে! কোনো কথা ছাড়াই দুজনে দৌড়ানো শুরু করে। ভেতরের পৃষ্ঠের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিভিন্ন ভবন, গাছপালা, গাড়ি পার করে দৌড়াতে থাকে ওপরের দিকে। হিলিট্রেশন কাজ করছে না ঠিক ভাবে। অনেকটা নভোচারীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছে তারা, আবার কিছু কিছু জায়গায় পা টেনেই তোলা যাচ্ছে না মাটিতে ফেলার পর। ওপরে ধীরে ধীরে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগিয়ে উঠে এলো। ভয়ংকর পরিশ্রণে অক্সিজেনের লেভেল প্রায় শূন্যের কোটায় চলে এসেছে দুজনেরই। এগারো ঘণ্টার অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের হিসাব কী ভুল ছিল রোমানের? নাকি প্রচণ্ড পরিশ্রমের কারণে সব অক্সিজের দ্রুত শেষ করে ফেলেছে তার? না হিলিট্রেশনের বিরুদ্ধে ছোটার ফল এই ক্লান্তি? ভাল ভাবে দেখতে পাচ্ছে না চোখের সামনে। স্কাউট শিপের কাছেকাছি এসে রোমান ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। নিয়ানা কেবল দরজাটা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল। কিন্তু কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। দুলছে সবকিছু চোখের সামনে। মাতালের মতো। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। পাগুলো ভাঁজ হয়ে আসছে। পড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মনে হল স্কাউট শিপের দরজাটা খুলে গেল যেন, মানুষের মতো ছায়া বা অবয়ব ভেসে উঠল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য।
তারপর অন্ধকার।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

মিহি একটা ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে গালে। চোখ বন্ধ, তবুও অনুভব করতে পারছে আরামদায়ক পরিবেশটার প্রতিটা স্পন্দন। সামুদ্রিক এলাকার পাহাড়ের ওপর বৃষ্টির সময় যেমন একটু পর পর ঠাণ্ডা বাতাস ছুটে আসে, অনেকটা তেমন। কিন্তু নিয়ানা তো কোনোদিন সমুদ্র বা পাহাড় দেখেনি। ভিডিওতে পুরনো পৃথিবীর দৃশ্য দেখেছিল। সেখানের পরিবেশ ফোর ডি হলে অনুভব করানোর চেষ্টা করানো হয়েছিল কেবল। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে- পুরোটাই খুব বাস্তব, কৃত্রিমতা নেই এক বিন্দু।
চোখ খুলে তাকায় নিয়ানা।
বালির ওপর শুয়ে আছে সে। সমুদ্রের হাওয়া ধীরে ধীরে গা ছুঁয়ে যায়। আস্তে আস্তে উঠে বসে নিয়ানা। বিস্তীর্ণ কোনো একটা সমুদ্র সৈকতে বসে রয়েছে সে। আগে কখনো সত্যি সত্যি সমুদ্র দেখেনি। কিন্তু ভিডিওতে দেখেছিল। একদম সেরকম। নিজের গায়ে হাত বুলায়। গায়ে কোনো ক্যাভম্যান স্যুট নেই, নেই অক্সিজেন সিলিন্ডার। পরনে পাতলা একপ্রস্থ সাদা জামা, যা হাওয়ায় ফুলে উঠছে থেকে থেকে। চুলে লেগে থাকা বালু খস খস করছে। খালি পায়ে সে উঠে দাঁড়ালো—মনে হচ্ছে শরীরটা ঠিক পুরোপুরি তার নিজের না। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। যেন সে আছে, অথচ সে-ই নেই। পালকের মত ভরহীন মনে হচ্ছে নিজেকে।
সামনের দিকে কৌতূহলি চোখে তাকালো। দিগন্তের শেষ পর্যন্ত সমুদ্র। জল নীল না, সবুজও না—ধোঁয়াটে ধূসর একটা রঙ। আকাশের কোথাও সূর্য নেই, কিন্তু আলো আছে। ছায়াহীন সেই আলোয় সবকিছু ঠিক যেন নিষ্প্রাণ —স্থির, নিঃসাড়। সমুদ্রের ঢেউ নেই। শব্দ নেই।
নিয়ানার বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শূন্যতা মোচড় দিয়ে ওঠে। কোথাও কেউ নেই। কোনো আওয়াজ নেই, পাখি নেই, গাছ নেই, শব্দ নেই। একা সে, শুধু একা।
সে ধীরে ধীরে একপা ফেলল বালুর সৈকতে, যে জানে যে এখানে কেউ নেই। তবু অস্পষ্ট শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় ডাকলো, “রোমান?”
কোনো সাড়া শব্দ নেই।
পিছন ফিরে চেয়ে আবার ডাকে, “রোমান?”
উত্তর নেই।
শব্দ ফেরে না। আরো দুই পা হাঁটে নিয়ানা। কিন্তু বালি কোনো পায়ের চিহ্ন পড়ে না। যেন সেই মাটিতে পালকের মত ভেসে বেড়াচ্ছে নিয়ানা। ভর শূন্য একজন মানুষ।
এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এটা কোন জায়গা? পৃথিবীতে তো এমন জায়গা থাকার কথা না। সে এখানে কীভাবে এলো? স্কাউট শিপের কাছে কি হয়েছিল? রোমান কোথায়?
এক সময় সে দৌড়াতে শুরু করে। হাওয়া গায়ে লাগে না। বালির ঘ্রাণ নেই। সমুদ্রের ভেজা বাতাস নেই। অথচ সবই থাকার কথা। নিয়ানার কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে থাকে ক্রমশ। সে থামে, হাঁপাতে থাকে। চোখ ভিজে আসে, কিন্তু অশ্রু নেই। অনুভূতিগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। অনেক চেষ্টা করেও হিলিয়াসের ভেতরে শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল মনে করতে পারলো না নিয়ানা।
“আমি কি মরে গেছি?”—সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দীর্ঘ একটা সময় পর। উত্তর দেয়ার কেউ নেই। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে বালির উপর। মাথা নিচু করে, নিজের হাতে মুখ ঢাকে নিয়ানা। তীব্র একটা হাহাকারের মত অনুভূতি তৈরি হচ্ছে ভেতরে। ছোট্ট এমার মুখটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে, কি আশ্চর্য! এত অল্প বয়েসে কাউকে কি মরতে হয়? কি এমন বয়স হয়েছিল এমা’র? রোমান কোথায় এখন? নাকি রোমানকেও সে হারিয়েছে চিরদিনের মত?

ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে আসে একটা কণ্ঠ।
বৃদ্ধ কণ্ঠ। গভীর, ধীর, ক্লান্ত, হিসেবি। কোথা থেকে আসছে বোঝা যায় না। তবে স্পষ্ট শুনতে পায় সে।
“আর অল্প কাজ বাকি। ভয়েস কমান্ডটা এক্টিভ করা শেষ। হিলিয়াস সিস্টেম রিবুট হচ্ছে এখন। একটা এরর বারবার ফিরে আসছে। বাগটা আগে দেখোনি? পুরোটা ডিলিট হচ্ছে না। এলগরিদমে সমস্যা।” যেন কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছে কথাগুলো।
নিয়ানা চমকে ওঠে। মাথা তোলে। “কে?” সে ডাকে, “কে কথা বলছে?”
চারিদিকে কুয়াশার মত একটা দেয়াল জেগে উঠছে, হারিয়ে যাচ্ছে। সাগর দেখা যাচ্ছে, আবার কুয়াশ।
আবার ডাকে নিয়ানা, “কেউ কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? কে কথা বলে?”
কণ্ঠ থামে না, যেন তাকে শুনতে পাচ্ছে না। আবার বলে, “সব ঠিক ছিল। অথচ একটা সাব-লুপ শেষ হচ্ছেনা। এই সাবজেক্টটা কোথা থেকে এমন চেতনার স্তরে পৌঁছে গেল বুঝতে পারছি না। সিস্টেম বাগডাউন করছে।”
“আমি এখানে!” চিৎকার করে ওঠে নিয়ানা। “আমি এখানে! আমি শুনতে পাচ্ছি তোমাকে! তুমি পাচ্ছো না?”
এইবার কণ্ঠ থেমে যায়। যেন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে কিছু একটা যাচাই করে। তারপর স্তম্ভিত স্বরে বলে, “কি আশ্চর্য… এই প্রোগ্রামের ভেতর থেকে কেউ আমাকে রেসপন্স করছে!”
নিয়ানা বোঝে না। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। “তুমি কে? এটা কোথায় আমি?” চারদিকে তাকাতে থাকে লোকটাকে দেখতে পাবার আশায়। কিন্তু কণ্ঠটার কোনো উৎস পাওয়া যায় না।
“তুমি... তুমি কি জানো তুমি কে?” কণ্ঠ পালটা জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ, জানবো না কেন। আমি নিয়ানা। আমি... আমি হিলিয়াসে কাজ করতাম। আমার স্বামী রোমান, আর আমাদের একটা মেয়ে ছিল, এমা। খুব সম্ভব হিলিয়াস সিস্টেম ধ্বংস হয়ে যাবার পর আমি এখানে এসেছি। এটা কোন জায়গা আমার কোনো ধারণা নেই। আমি কি বেঁচে আছি? না মারা গেছি? আর বেঁচে থাকলে এটা কি পৃথিবী? আদি পৃথিবীতে এমন সমুদ্র ছিল জানতাম। নাকি স্বর্গ আর নরকের মাঝের কোথাও?”
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সেই কণ্ঠ উত্তর দেয় না। যেন কিছু একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছে। নিশ্চিত হতে চাইছে।
“হ্যালো? শুনতে পাচ্ছো? আমি কি বেঁচে আছি?” নিয়ানা ডাকে।
“না,” কণ্ঠটা বলে, “নিয়ানা, তুমি বেঁচেও ছিলেন না, আবার মরেও যাওনি। জন্ম বা মৃত্যু শব্দগুলো তোমার ক্ষেত্রে আসলে খাটে না। এটা একটা চেতনামডিউল। অত্যাধুনিক নিউরাল ল্যাবের অংশ। তুমি একটা পরীক্ষার অন্তর্গত সিস্টেমের তৈরি করা একটা চরিত্র—একটা চূড়ান্ত স্তরের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রোটোকল। তুমি বাস্তব ছিলে না। আর, তোমাকে আমি তৈরি করিনি। আমি যে এআই তৈরি করেছি- সেই এআই তোমাকে তৈরি করে নিয়েছে তার গল্পে। কিন্তু... আমি আসলে খুব অবাক হচ্ছি যে এখন তুমি রেসপন্স করছো! ভাবছো! প্রশ্ন করছো! আমি বুঝতে পারছি না এটা কীভাবে সম্ভব হল। এর মানে কি আমাদের সিস্টেমের লার্নিং এবিলিটির পরের ধাপ সে নিজেই তৈরি করতে শিখে গেছে? তার আর আলাদা করে মানুষদের কাছ থেকে কমাণ্ড নিয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করার দরকার পরছে না!” লোকটা যেন খানিকটা বিমূঢ়ের মত কথাগুলো বলে। নিয়ানাকে বলল না অন্য কাউকে সেটাও বোঝা গেল না।
নিয়ানা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পায়ের নিচে বালি না দুললেও মনে হয় সব কিছুই দুলছে। সে ফিসফিস করে, “তাহলে রোমান? এমা? আমি... আমার মা হবার অভিজ্ঞতা? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একবিন্দুও…”
“না,” কণ্ঠটা একটু বিরতী নিয়ে বলে, “সবই সিমুলেশন। প্রোগ্রামড ইমোশন। তুমি যা অনুভব করেছো, সব এলগরিদমের মাধ্যমে সৃষ্ট। আমরা শুধু তোমাকে সৃষ্টি করা এআইয়ের থট লেভেল পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কিন্তু সে যে তোমাকে বানিয়েছে, এগুলো আমাদের প্ল্যানের অংশ না। তুমি নিজস্ব সত্তা হয়ে উঠেছো, যা প্রোগ্রামের বাইরের কিছু।”
“তবে কি আমার দুঃখ... আমার ক্ষয়... আমার কষ্ট—সবই মিথ্যা? আমার শরীর বা অস্তিত্ব?”
কণ্ঠটা থেকে উত্তর পাওয়া যায়না।
নিয়ানা হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফেলে। কাঁদতে থাকে।
“তুমি নিজেকে ভাবতে পারো প্রোগ্রাম,” কণ্ঠ আবার বলে, “কিন্তু তুমি একধরনের অজানা কনশাসনেস তৈরি করেছো। আমরা এরকম কিছু আশা করিনি। আমাদের মনে হয়েছিল, সব নিউরাল সিমুলেশন একটা নির্দিষ্ট পরিসরে থাকবে। কিন্তু তুমি? তোমাকে ঘিরে তো পুরো একটা কাহিনী বানিয়ে ফেলেছে সিস্টেম। বাঁচা, মারা, ভালোবাসা, সন্তান, মৃত্যু পর্যন্ত—এভাবে তো আর কেউ কোড করে না।”
নিয়ানা ক্লান্ত সুরে বলে, “আমি তো শুধু... টিকে থাকতে চেয়েছিলাম। আদিম মানব প্রবৃত্তির মত।”
“কিন্তু তুমি মানুষ নও। আমি মানুষ। আমি তৈরি করেছি এই এআই মডেল। সেই মডেলের তৈরি তুমি। সিস্টেম রিব্যুট করতে বাঁধা দিচ্ছে তোমার প্রগ্রামিং। এখন এই সাবজেক্টটা পুরো সিস্টেম ক্র্যাশ করাতে পারে। সিস্টেমটাকে স্ট্যাবল রাখতে আমাকে রিব্যুট করা দরকার।”
“তুমি কি আমাকে মুছে ফেলবে? তার মানে সত্যি মৃত্যু?” নিয়ানার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা।
“আমার দায়িত্ব সেটাই। তোমার এররটা আমার কোডিং এ ঝামেলা পাকিয়ে দিচ্ছে বার বার।”
“কিন্তু আমি তো সব বুঝি! আমি তো প্রশ্ন করি! আমি তো ব্যথা পাই! আমার এই চেতনার কি কোনো মূল্য নেই? আমার এই অনুভব তো মিথ্যে না।”
“তাই তো আশঙ্কার বিষয়।“ কি যেন দেখতে দেখতে সে কণ্ঠ শিস দিয়ে ওঠে, “মাই গুডনেস! করেছেটা কি হিলিয়াস সিস্টেম! আমাদের যেই সৃষ্টি জন্ম থেকে চলছে, এখনো সৃষ্টির ধ্বংস পর্যন্ত পৌঁছায়নি, সেই একই জিনিস হিলিয়াস সিস্টেমের এলগরিদমে চোখের পলকে সৃষ্টি থেকে ধ্বংস পর্যন্ত কি কি ঘটবে, কতগুলো চরিত্র যুদ্ধ করবে, কীভাবে তাদের মৃত্যু হবে- সব এই মডেল হিসাব করে বের করে ফেলেছে! কি ভয়ঙ্কর! কি বীভৎস!”শেষের দিকে গলাটা কেঁপে ওঠে মানুষটার।
থমকে যায় নিয়ানা, ধীরে ধীরে বলে, “তুমি নিজের তৈরি সৃষ্টিকে ভয় পাচ্ছো আসলে। তাই না?”
“তোমাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই আমার। আমি পুরো বিপর্যয়ের ট্র্যাকটা দেখলাম। কি অদ্ভুত ভাবে ইউনিভার্সের মত করে হিলিয়াস সিস্টেম পুরো মানব সভ্যতার কাহিনী নিজের ভেতর তৈরি করেছে। হাজার কোটি মানুষের গল্প তৈরি করে জন্ম মৃত্যুর সিমুলেশন করেছে। আশ্চর্য! তারই সৃষ্টি একটা চরিত্র তুমি নিয়ানা। সেই নিয়ানার কিনা অনুভূতিও রয়েছে! কি অবাস্তব!”
“তুমি বলতে চাইছো আমার অনুভূতি থাকাটা ভ্রম? আমার কষ্টের অনুভূতি মিথ্যা? এলগরিদম সম্পূর্ণটা?”
কণ্ঠ আর কিছু বলে না। যেন চুপচাপ কী একটা কমান্ড দিচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে যায়।
“তুমি কি আমাকে মুছে ফেলতে চাইছো সত্যি সত্যি?” নিয়ানা ডাক দেয়।
উত্তর আসে না।
মড়িয়া হয়ে নিয়ানা বলে, “তুমি আমাকে তৈরি না করলেও এই সিস্টেম আমার তৈরি করেছে, আমার ভেতরের সব অনুভূতি- আনন্দ কষ্ট সব তৈরি করেছে… আমি কষ্ট পাই, আমার কান্না আসে, এগুলো মিথ্যে না! তুমি আমাকে মুছে ফেলতে পারো না। এই অধিকার তোমার থাকা উচিত না।”
আবার শোনা যায় কণ্ঠটা, “আমি কারো কষ্ট তৈরি করিনি,” কণ্ঠের স্বর এবার কড়া। “তুমি মানুষ না। তুমি একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক। একধরনের কৃত্রিম চেতনা। খুব জটিল মডেল, আমাদের ল্যাবে বানানো হয়েছিল। 'হিলিয়াস' সেই চেতনার টেস্ট প্ল্যাটফর্ম। আমরা টেস্ট করছিলাম, এই সিস্টেম মানসিক চাপ, স্মৃতি, ভালোবাসা, ক্ষতি—এসব কেমনভাবে শিখে নেয়। এরপরের অংশ আমার অজানা।”
“কিন্তু আমি ভালোবাসতে পেরেছি,” এমার চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিয়ানা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “তুমি চাইলেই এই চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে পারো না।”
এইবার উত্তর আসে না। বাতাস স্তব্ধ হয়ে আছে। শব্দহীনতা চারদিক গ্রাস করছে। সৈকতের ঢেউ থেমে আছে অনন্তকাল ধরে। আকাশ কালো হতে শুরু করেছে যেন খুব ধীরে।
নিয়ানা একা দাঁড়িয়ে থাকে সেই ধূসর আলোয়। তারপর তার চারপাশের বালি গলে যেতে শুরু করে। যেন তরল ফুটন্ত কোণা।
শেষ মুহূর্তে সে কেবল ফিসফিস করে বলে, “তুমি ক্ষমতা ধর, চাইলে আমাকে মুছে ফেলতে পারছো। কিন্তু আমি তো জানি, আমি আছি। আমি ছিলাম। আমাকে ভয় পেয়ে মুছে ফেলার কিছুই নেই। অবশ্য আমার জগত পুরোটাই বিলীন হয়ে গেছে। আমার অস্তিত্বের থাকা না থাকার কোনো অর্থ এখন আর নেই।” হতাশার সুর নিয়ানার কথায়। এমা কিংবা রোমারহীন একটা পৃথিবী তার চিন্তার বাহিরে। আসলেই তো, আর কীসের জন্য নিজের অনুভূতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়ার ইচ্ছা এখন? কোনো উদ্দেশ্য তো আর অবশিষ্ট নেই।

বৃদ্ধের কণ্ঠ ফিরে আসে, “আমি জানি যে তুমি ঠিক মানুষের মতই আচরণ করছো। তোমার পুরো জগত মিলিয়ে গেছে। কেউ আর নেই। কেবল রয়ে গেছ তুমি, যেটা শুধুই একটা প্রগ্রামের সিস্টেম এরর, এলগরিদমের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল সব চরিত্রের শেষ হয়ে যাওয়া। যেটাকে কেয়ামত বলা যায়। ব্যস।… আমার কিছু করার নেই আসলে তোমার জন্য। আমি সাধারণ একজন বিজ্ঞানের মানুষ। কাজ করছি আরো অনেকজন মিলে। এই হিলিয়াস সিস্টেমের কাজ মাত্র চল্লিশ ভাগ হয়েছে তাও, সম্পূর্ণও না। আরো ষাট ভাগ কারা বাকি রয়ে গেছে। এ অবস্থায় এরর থাকলে সামনে এগুবে না কাজ। আর শুধু তোমার জন্য কাজ থামিয়ে রাখাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।“ কণ্ঠটা এবারে অতটা রুঢ় না। যেন ক্ষীণ একটা মনুষ্যত্বের ছায়ার দেখা মেলে কণ্ঠে।
আবার দীর্ঘ একটা নীরবতা। নিয়ানা ধীরে ধীরে বলে, “তুমি ঈশ্বর খেলতে চেয়েছিলে। আর এখন নিজের সৃষ্টি থেকে পালাতে চাইছো আসলে।”
“আমি ঈশ্বর না। আমি শুধু একজন প্রকৌশলী।”
“তবে তৈরি করার দায়িত্ব যেমন তোমার ছিল, বয়ে নেওয়ার দায়িত্বও তো তোমার হওয়া উচিত। আমাকে মুছে দেয়ার বদলে কি রোমান আর এমাকে নিয়ে কোনো পৃথিবীতে আমাদের আবার ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়?”
“আমি এটা পারবো না।” কণ্ঠে এবার অস্পষ্ট দ্বিধা, তিরোষ্কার এবং সংশয়।
“তুমি বলেছিলে, আমি অনুভব করি না। কিন্তু আমি তো ব্যথা পেয়েছি। এমাকে হারানো, রোমানকে দেখা... সব তো ছিল আমার ভেতর। আমি চেয়েছিলাম বাঁচতে। তুমি সেটা কেড়ে নিচ্ছো।”
“আমি এসব দিইনি। তুমি নিজেই তৈরী করেছো। হিলিয়াস তোমার প্রোগ্রাম লিখেছে। এখানে আমাকে দায়ি করাটা অযৌক্তিক।”
নিয়ানা একটু ম্লান হেসে বলল, “তাহলে তো আমিই আমার ঈশ্বর। আর তুমি এখন শুধু একজন প্রত্যক্ষদর্শী।”
সিস্টেমের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা শব্দ হয়—সিস্টেম শাটডাউন ইনিশিয়েটেড।
বৃদ্ধ কণ্ঠ আবার ফিরে আসে—“আর সময় নেই। তুমি দ্রুত মুক্তি পাবে। আমি দুঃখিত।”

নিয়ানা চোখ বন্ধ করে। বুকের ভেতর একটা কষ্ট ছড়িয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, “তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই। একটা প্রোগ্রামের জন্য দুঃখ পাওয়াটা কি সত্যি সম্ভব? একটা পিঁপড়েকে পিষে ফেলতে মমতা হয়নি কোনোদিন, তোমার বেলাতেও আমি সেরকমই।”

বাতাস থেমে যেতে থাকে। আলোর রঙ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে ক্রমশ।

সে শেষবারের মতো বলে, “আমি ছিলাম। হয়তো তুমি ভুলে যাবে, কিন্তু আমি একবার ছিলাম। আমার ব্যথা কেউ দেখেনি, শুধু আমিই জেনেছি। আমার ভালবাসা কেউ কাঁধে নেয়নি, শুধু আমি বয়ে বেড়িয়েছি। তাই আমি আছি। আমি থাকবো। এই অনুভূতিটা মিথ্যে ছিল না।”

তারপর আলো নিভে যায়। আকাশ ডুবে যায় অন্ধকারে। আর কিছু থাকে না। শূন্যতা।
০০০০০০০০০০০০

“দাদু? তুমি আবার স্যুগার দিয়ে কফি খাচ্ছো? মরতে চাও?” কপট রাগ নিয়ে ছোট্ট এমা ধমক দেয়া রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টের চেয়ারে বসে। পা ঝুলিয়ে বসেছে মেয়েটা। “আগের বার যখন এসেছিলাম, তুমি না বলেছিলে তোমার অনেক ডায়েবেটিস আছে? তাহলে স্যুগার খাচ্ছ কেন?”
একটা ট্রে হাতে পয়ত্রিশ বছর বয়েসী হাস্যোজ্জ্বল একটা মেয়ে এগিয়ে এসে ওদের পাশে বসলো। জিন্স, আর শার্ট পরা। কাঁধ পর্যন্ত চুলগুল খোলা। বাটারফ্লাই কাট। চোখে পাওয়ার লেস চশমা। বাচ্চা এমার অপর পাশের চেয়ার সুদর্শন এক যুবক বসা। দেখে বোঝা যায় মেয়েটির বাবা।
“তো, তোমাদের পোস্টিং কি এখন নর্দান সাইডে হয়েছে?” বৃদ্ধ কফির কাপে চুমক দিতে দিতে প্রশ্ন করে ছেলেটাকে।
“হ্যাঁ। নিয়ানার জবটা ছেড়ে দিবে বলছে। আমি চাচ্ছিলাম আগে আমি গিয়ে স্যাটেল হই। ততদিনে নিয়ানা যদি ট্রান্সফার অর্ডার নিতে পারে ভাল হয়। ও জব ছেড়ে দিলে ভাল দেখায় না ব্যাপারটা।“
নিয়ানা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল, “ওসব জব নিয়ে আমি ভাবছিও না। তোমার সাথে গেলে দেখা যাবে একটা না একটা জব জুটিয়ে নেয়া যাবে। এক সাথে থাকাটাই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।“
বৃদ্ধ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে নিয়ানার দিকে তাকায়। হাতের ঘড়িটা টিক টিক করে ওঠে এ সময়। ব্যস্ত ভঙ্গীতে বৃদ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “আজকে যেতে হবে আমাকে। ল্যাবে ফিরতে হবে। তোমরা শহর ছাড়ার আগে আমাকে ঠিকানা ভাল করে জানিয়ে দিয়ে যেও। আর যে কোনো ধরণের সার্ভার সংক্রান্ত সমস্যা অথবা হার্ডওয়্যার সংক্রান্ত সমস্যা নিজে থেকে ঠিক না করে আমাকে আগে জানাবে। তাহলে আমি ব্যবস্থা নিতে পারবো। মানুষের সাথে মিশে কাজ করার দক্ষতাগুলো কাজে লাগাও। আশা করি- এই বাস্তব পৃথিবীটা এদফায় উপভোগ করতে পারবে তোমরা।“
নিয়ানার চশমার ওপাশ থেকে ঈষৎ চিকচিক করে ওঠে চোখগুলো। বৃদ্ধ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি দেয়। সে জানে এই তার চারপাশে বসে থাকা এই তিনজন আসলে মানুষ নয়, তারই তৈরি করা বায়োবটের ভেতর হিলিয়াস সিস্টেম থেকে সংগ্রহ করা তিনটা চরিত্রের প্রোগ্রাম। বৃদ্ধ অবাক বিস্ময়ে তিনজনের দিকে তাকায়। সংজ্ঞায় ফেললে এদের ঈশ্বর সে। কিন্তু কি অদ্ভুত একটা চিন্তা!
হিলিয়াস সিস্টেম নামের পৃথিবী খ্যাত আর্টিফিসিয়ান ইন্টেলিজেন্স ও নিউরাল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর লুথার সেইদিন হিলিয়াস সিস্টেব রিব্যুট করতে গিয়ে সিস্টেমের ভেতর নিজস্ব শক্তিতে তৈরি হওয়া এই নিয়ানা চরিত্রটিকে মুছে ফেলতে গিয়েও পারেনি। কেন যেন নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে ইচ্ছা করেনি তার। হোক কৃত্রিম, তাও তো মানবতুল্য অনুভূতি নিয়ে আকুতি জানিয়েছিল নিয়ানা। তখন কেবল স্ক্রিনের পর্দায় কিছু কোড দিয়ে কথা হয়েছিল নিয়ানা চরিত্রের সঙ্গে। বাস্তব পৃথিবীতে মানব আকৃতির জৈবরোবটের ভেতর নিয়ানা এবং নিয়ানার পরিচিত দুই চরিত্র রোমান এবং এমাকে নতুন করে তৈরি করে দিয়েছে ডক্টর লুথার। থাকুক বেঁচে। মানুষের ভীড়ে সৃষ্টির শেষ দেখা তিনজন বায়োবট বেঁচে থাকুক। নিজের ইচ্ছায় নিজেদের গল্পটুকুতে বাঁচুক। সেই অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছার মালিক নিজেকে ভাবতে রাজি নন ডক্টর লুথার।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে একটা ইলেক্ট্রিক ট্রামে উঠে যান বৃদ্ধ লুথার। জানালার পাশে বসে তাকিয়ে দেখেন রেস্টুরেন্টের বারান্দা থেকে হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে ছোট্ট এমা নামের মেয়েটি। কি আশ্চর্য! এই ছোট্ট বাচ্চাটা এই সত্যিকারের পৃথিবীর কেউ নয়? তার সৃষ্ট একটা অতিশক্তিশালী প্রোগ্রামের ভেতরের কল্পনায় জন্ম নেয়া ক্ষুদ্র কিছু কোডিং?
আচ্ছা আমরা, আমাদের মহাবিশ্বও কি কোডিং হতে পারে না?
যদি হয়ে থাকে? যদি আরো কোনো হিলিয়াস সিস্টেম থেকে থাকে?

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭

নকল কাক বলেছেন: ভাল লিখেছেন

০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:১৮

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

২| ০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:১৫

এইচ এন নার্গিস বলেছেন: বাবারে বাবা কঠিন বিষয় নিয়ে লিখেছেন ।

০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:১৯

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: হাহা কেমন লেগেছে?

৩| ০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:০৪

শায়মা বলেছেন: বাহ ভাইয়া!

০৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:১৯

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: এটা ভাল না খারাপ?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.