![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যাত্রা - The Journey
নিটোল আহমেদ
মৃত্যু একটা যাত্রা যেখান থেকে কেউ ফেরত আসে না। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তরের মানুষ এমনকি পশু পাখিও এটা বিশ্বাস করে এবং মৃত সঙ্গীকে তাদের নিজেদের মত করে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে শেষ বিদায় জানায়। এটি তারই কথন|
লেখক বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুড়ে বেড়িয়েছেন। অনেক মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি তিনি দেখেছেন। তার ‘যাত্রা’ লেখাটিতে মৃত ব্যক্তিকে অন্তহীন যাত্রার জন্য শেষ বিদায় জানানোর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রচলিত বিভিন্ন রেওয়াজ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
পূনশ্চ: (এটা কতগুলো গল্পের ছলে লেখা সত্য ঘটনা নির্ভর একটি গদ্য রচনা। এটি কোন ধর্মীয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের দৃষ্টিকোন থেকেও লেখা হয়নি। লেখক শুধুমাত্র তার অভিজ্ঞতার মানবীয় বর্ননা করেছেন। কোন ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।)
সত্য গল্প ১- ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের কাকের গল্প (সময় ১৯৯১-১৯৯৫ সাল)
১৯৯১ সাল| আমি তখন স্কুলের সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি। হোস্টেলে থাকি। স্কুলের ২২ টা মাঠের সবগুলোই আমার খেলার যায়গা। কিন্তু আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাতেও গোল্লা (০)। বোকাও ছিলাম। ক্লাসের স্মার্ট বন্ধুরাও তেমন পাত্তা দিত না। তাই ঘাসফুলের ডগা চিবানো আর স্কুলের অজস্র বড় বড় গাছগুলোতে বাসা বানিয়ে থাকা কর্কশ কাকের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ভালই কাটছিল।
প্রায় রাতেই হোস্টেলে ঘুমানোর সময় হঠাৎ যেকোন সময় হাজার হাজার কাকের ভয়ংকর কর্কশ কন্ঠ আর ডানা ঝাপটানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত। এরপর দেখলাম দিনের বেলাতেও হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কাক কেন এই উদ্ভট কান্ডটা করে। আবার ছোটবেলা থেকেই আমি খুব একটা ভৌতিক ব্যাপার বিশ্বাস করতাম না। যাই হোক, প্রায়ই দেখি কোন কোন যায়গায় কাকের মরদেহ পরে আছে। দেখে মনে হত কোন কিছু এটাকে ছিড়ে খেয়েছে। আমি ভাবলাম বিড়াল বা সাপ হবে।
একদিন দেখি কালো কিছু একটা গাছ থেকে নিচে পরে গেল। সাথে সাথেই অনেকগুলো কাক ক্ষিপ্র গতিতে মাটিতে লুটিয়ে পরা মরা কাকের দিকে উড়ে গিয়ে চিৎকার করতে করতে ঠোট দিয়ে ঠোকর দিতে দিতে মৃত কাকটির নাড়িভুড়ি ছিড়ে ফেললো। তখন ও তারপর অনেকগুলো কাক মৃত কাকটিকে কেন্দ্র করে চিৎকার করতে করতে চক্রাকারে অনেকক্ষন উড়তে লাগল। মনে হচ্ছিল কাকগুলো কোন ধর্মীয় আচার পালন করছে। এরপর এরকম কাকের মৃত্যু আচার অনেক দেখেছি।
যাই হোক নিউটনের আপেল গবেষনার মত আমি অধম নিটোল কাকের মৃত্যু উৎসব নিয়ে প্রথম গবেষণা করিনি। বাংলায় অনেক পুরানো বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আপনারা হয়ত সবাই জানেন। "কাকের মাংস কাক খায়।" কথাটি যেই অজানা লেখক প্রথম লিখেছিলেন, তিনি ভুল লেখেন নাই। কিন্তু তিনি সম্পূর্ন ঘটনা প্রবাহ দেখার সুযোগ পাননি। আমি তার অসমাপ্ত গবেষনার ইতি টানছি।
অতয়েব এটা প্রমানিত-কাকেরও কাকের প্রতি মানুষের মত আত্মিক টান আছে। শুধু কাক নয়, অন্যান্য প্রানীকুলেও একই রকম টান আছে।
সত্য গল্প ২- দক্ষিণ ভারত, মাইকেল মধুসুদন রায়ের মেঘনাদ বধ কাব্যের রাবন রাজ্যের একটি সত্যি গল্প (সময় ২০০১ সাল)
একদিন রাতে দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই শহরের একটি বড় রাস্তায় একা একা হাঁটছি। হঠাৎ এক যায়গায় রাস্তার উপর সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে, প্রচুর আলো জ্বালিয়ে, মাইকে জোরে ধর্মীয় গান ছেড়ে একটা ছোটখাট পার্টি দেখে কৌতুহল বসত আড় চোখে দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি সামিয়ানার ভেতরে একটি কফিনের কাঁচের স্বচ্ছ গ্লাসের নীচে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো একটা কিশোরী বালিকা ঘুমিয়ে আছে। খুব দূঃখ লাগলো। এতটুকু একটা মেয়ে-সুন্দর এই পৃথিবীটা আর উপভোগ করতে পারবে না। আর কোনদিন খেলতে পারবে না। আবার মনে হলো কি সৌভাগ্যবতী মেয়েটা। মা, বাবা, ভাই, বোন, পরিবার, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধু বান্ধবীরা সবাই তার ছোট্ট জীবনটার উদযাপন করতে কত বড় আয়োজন করেছে। তার প্রতি গর্ব বোধ করলাম।
ইচ্ছে হচ্ছিল ইস! যদি মেয়েটাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেখাতে পারতাম- দেখ তোমাকে সবাই কিভাবে স্মরণ করছে। তাহলে আমি নিশ্চিত মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে একটা হাসি দিয়ে দৌড়ে কোথাও লুকাতো।
অবশ্যই ভালোবাসার মানুষকে শেষ বিদায় জানানো অসম্ভর কঠিন একটা কাজ। আমিও ২৪ বছর বয়সে আমার মাকে চির বিদায় জানিয়েছি। অনেকদিন ভেবেছি:-
ইস! কবর থেকে যদি আমার মা অলৌকিকভাবে জীবিত হয়ে ফেরত আসতেন।
যাই হোক তারপরও আমি সৌভাগ্যবান। পৃথিবীর অনেক মানুষ (আমি কাউকে কাউকে চিনি) জন্ম নেবার সময় তাদের মা হারিয়েছেন। তাদের প্রতিটি জন্মদিনই দূঃখের। তাদের চাইতে পৃথিবীতে দূঃখী আর কেউ হতে পারে না। আবার ঘটনা পরিবর্তনও আমরা করতে পারি না।
তাই আসুন আমরা সবাই শোককে শক্তিতে পরিনত করি। সুন্দর মনের মানুষই কেবল পরিবার, প্রতিবেশি, সমাজ, দেশ, মহাদেশ, মানবকূল ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারে। আমি আর আপনি প্রথমে একটা ভালো উদাহরন সৃষ্টি করি।
সত্য গল্প ৩ – মৃত্যূ পথযাত্রী একটা কুকুর, তার কুকুর বন্ধুরা আর আমি
ঢাকার আজিমপুর সরকারী কলোনী (সময় ১৯৯৬ সাল)
এবার একটা কুকুরের গল্প বলবো। কুকুরটির কোন নাম নেই। এটাও একটা সত্য গল্প। ঘটনাটি ঢাকার আজিমপুর সরকারী কলোনীর একটি পুরানো চারতলা বাড়ির। আমি, আমার বাবা-মা,ভাই-বোন, দাদী আর আমাদের দীর্ঘদিনের গৃহ সহকারী দালানটির ১ তালায় থাকি। নতুন উঠেছি ফ্লাটটাতে। আমার দায়িত্ব পরলো প্রতি রাতে দালানটির কলাপ্সেবল মেইনগেট আটকানো। ভালই লাগত গেট লাগানোর নাম করে পড়াশোনা বাদ দিয়ে হাফ পেন্ট আর সেন্ডো গেন্জি পড়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে।
অকস্যাৎ হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একদিন উড়ে এসে জুড়ে বসল অসুস্থ, মৃত্যূ পথযাত্রী, ভীষণ দূঃগন্ধযুক্ত একটা কুকুর। কুকুরটা প্রতিরাত ১১টার একটু আগে কলাপ্সেবল গেট লাগানোর নির্ধারিত সময়ের একটু আগে ভেতরে গুটিয়ে শুয়ে থাকতে শুরু করল। আবার মায়াও লাগল বেচারার প্রতি। আমার রাতের আকাশ দেখা বন্ধ হলো। ভয়ে ভয়ে, নাক বন্ধ করে, এক নিস্বাসে গেট টেনে বন্ধ করে দ্রুত ঘরে এসে স্বাস নিতাম। তবুও কুকুরটার একটু আরামের জন্য এইটুকু কষ্ট করতে দ্বিধা বোধ করতাম না।
একদিন, সম্ভবত পরের দিনের কলেজের কোন পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমার মা অন্যরাতের একটু আগে গেটটা আটকাতে বললো। দ্বিধায় পরে গেলাম কুকুরটা এখনো গেটের ভিতরে ঢুকেছে কিনা। যাই হোক গেট আটকাতে গিয়ে দেখলাম কুকুরটা এখনো আসেনি। সময় নেই। তাই তাড়াতাড়ি মাত্র গেটটা আটকে ফেলেছি আর দেখলাম ৪-৫ টা কুকুর অসুস্থ কুকুরটাকে নিয়ে আসছে।
তারাও আমার গেট আটকে ফেলায় ক্ষুব্ধ, মনোক্ষুন্ন। ঘেউ ঘেউ করে কুকুরগুলি চিৎকার করতে থাকল। আমার মনে হচ্ছিল আমি কুকুরগুলোর ভাষা বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি তাদের আর্তি ও অনুরোধ। আবার ভয়ও পেলাম। গেট খুলে এতগুলা ক্ষুব্ধ কুকুর সহ অসুস্থ কুকুরটাকে ঢুকতে দেয়া বিপজ্জনক। কমড়ে দিতে পারে। আর অসুস্থ কুকুরটার অসহনীয় দূঃগন্ধ তো আছেই। তাই সে রাতে কুকুরটাকে আর করুণা করতে পারলাম না।
মন খারাপ করে ঘরে ঢুকলাম। পরের দিনও মনটা ভাল ছিলো না। অনুশোচনায় পুরলাম সারাটা দিন। যাই হোক ঐ রাতে ইচ্ছে করেই আরেকটু দেরি করে গেট আটকাতে গেলাম। দেখলাম কুকুরটি নেই। গন্ধও নেই। মনে হল কুকুরটি অপমানিত হয়ে আসেনি। আমিও গেটের বাইরে আকাশ ছুঁতে গেছি।
দেখি কুকুরগুলো ঘাপটি মেরে বসে আছে আমার সাথে বোঝাপরা করার জন্য। আমাকে দেখে ভীষন গর্জনে তেড়ে আসতে থাকলো আমার দিকে। আমিও ভয়ে উসাইন বোল্টের স্পিডে দৌড়ে ঘরে ঢুকে ঘরের মেইন দরজা শাবল দিয়ে আটকালাম।
এরপর থেকে কুকুরগুলো উধাও। অসুস্থ কুকুরটিকেও আর কখনো দেখিনি। গল্পটা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।
অনেক অনেক দিন পর এক রাতে কলোনীর কারো বাসা থেকে ঘরে ফিরছি। একটা ঝোপের পাশে দিয়ে যাবার সময় আমার হঠাৎ আবার অসুস্থ কুকুরটার বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমি না চিনলেও কুকুরগুলো আমার গায়ের গন্ধ ঠিকই চিনে গেল। আপনারা জানেন বোধ হয় কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের কয়েক হাজার গুন বেশি।
যাই হোক কুকুরগুলো গর্জন করলেও আমাকে আর তাড়া করলো না। বিক্ষুব্ধ কুকুরগুলো চাইলে আমাকে কামড়ে মেরে ফেলতে পারতো। আর অন্ধকার ঘটনাস্থলের ধারে কাছে কোন মানুষ ছিল না যে এসময় আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। আমিও ভয়ে হন্তদন্ত হয়ে, তাড়াতাড়ি সাবধানে ঘরে ফিরেছি।
আমার মা-বাবা কেউ ঘটনাটা খুব একটা জানতেন না। শেষের অংশ আমি পরিবারের কাউকেই আগে বলিনি।
যাই হোক, আমার এই গল্পটা পড়ে বুঝলেন তো যাত্রা প্রতিটি প্রাণীকুলের জন্য কত বড় গুরুত্বপূর্ন?
আত্ম সমালোচনা: লেখকের বাংলা ভাষায় দখল খুব বেশি নেই। তিনি নিয়মিত লেখেনও না। তিনি একজন শিক্ষানবিস, অপেশাদার, শখের লেখক। যেকোন বানান ও ব্যাকরণগত ভুলের জন্য তিনি অগ্রিম নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী।
©somewhere in net ltd.