![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়টা ১৯৮৪ সালের কোন সময়। তবে ভালবাসার গল্পের আগে আপনাদের বাংলাদেশের অত্তন্ত দুঃখজনক ইতিহাসের একটু জ্ঞান দিয়ে নেই। ইদানিং ফেইসবুকে নোয়খালী নিয়ে প্রচুর ট্রল হচ্ছে। আপনাকে নিয়ে কেউ অবমাননা করলে আপনি দুঃখ পাবেন। কাজেই মজা করে কাউকে অপমান করে তার মনে আঘাত দেবার আগে একটু ভাবার জন্য অনুরোধ রইলো।
১৯৮৫ সালের ২৪-২৫শে মের ভয়াবহ ঐতিহাসিক ঊরির চরের সাইক্লোন হয়। বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। নতুন দেশ। গোছানোর অনেকটাই বাকি। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ ঝড়ে নোয়াখালী, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলের প্রায় ১১,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল যাদের অধিকাংশই নোয়াখালীর ঊরির চর দ্বীপের। ঊরির চরে তখন প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সেখানে তখনও সাইক্লোন শেল্টার স্থাপিত হয়নি। ঐ ১রাতের ঝড়ের তান্ডবে দ্বীপের ৪০ শতাংশ লোক মারা যান ও তাদের পচা গলা বিকৃত লাশগুলো জোয়রের পানিতে ভাসতে ভাসতে উপদ্রুত জেলাগুলোর আরও গভীরে আসতে থাকে। আমার বাবা ঐ উদ্ধার ও লাশ সৎকার অভিযানের এক কর্মী ছিলেন।
এখনও ঢাকার জাতীয় যাদুঘরে ঊরির চরের সাইক্লোনের ধ্বংশলীলার রেপ্লিকা দেখতে পাবেন। আমার যতটুকু মনে পড়ে যুক্তরাজ্যের নেচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামেও ঐ ঝড়ের উপর কয়েকটা হৃদয়বিদারক ছবি আর সংক্ষিপ্ত বর্ননা নিয়ে একটা সেকশন দেখেছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও থাকতে পারে।
এবার গল্পে আসি। সময়টা ১৯৮৪ সালের কোন সময়। ঊরির চরের সাইক্লোনের ১ বছর অগের ঘটনা। আমার বয়স ৬/৭। বাবার কর্মস্থলের সুবাদে নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগন্জ (বশুর হাট নামেও পরিচিত) উপজেলায় থাকি। একদিন বাবার অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী ও তাদের পরিবার আর সন্তানদের নিয়ে পিকনিক হয় পাশ্ববর্তী কবির হাট উপজেলার নীচু এলাকার ধুধু প্রান্তরে সদ্য সমাপ্ত একটা সাইক্লোন শেল্টারে। দেখার কিছুই নাই। চার পাশে শুধু ঘাসের মাঠ। মাঠে অনেকগুলো কালো কালো সারা গায়ে নোংরা কাদা মাখা মহিশ চড়ছে। কোন বড় গাছ নেই যে ছায়ায় দাড়াবো। মাঠে লোকজনও নেই। সূর্যের প্রখর আলোয় শেলটারের কোনদিকে তাকানো দায়। ভাল কথা শেল্টারে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। আর ঘুর্নিঝড়ের ক্ষতি থেকে বাচানোর জন্য সীমিত ছোট ছোট জানালা। কাজেই এতগুলো মানুষের নিশ্বাস আর সবকিছু মিলিয়ে প্রচন্ড উত্তপ্ত। মনে হচ্ছিল কেন যে এই পিকনিকে আসতে হল!
বসার যায়গাও অপ্রতুল। খেলাও যাচ্ছে না। দাড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন বিরক্তির চরমে পৌছালাম তখন আমার মা অফিসের ড্রাইভারের তত্বাবধানে আমাকে আর আমার বয়সী আরও কয়েকটা ছেলে শিশুদের এলাকা পরিদর্শনে পাঠালো। শর্ত খুবই কঠিন। একদম দৌড়াদৌড়ি করা যাবেনা, ড্রাইভার ভাইয়ের সাথে সাথে থাকতে হবে। বেশি দূর যাওয়া যাবে না। কোন কিছু খাওয়া যাবেনা। পকেট মানি পেলাম যতদূর মনে পড়ে ৫টাকা। সম্ভবত এটাই আমার প্রথম পকেট মানি। আমিও উত্তেজিত এতগুলো টাকা নিয়ে কতকিছু যে কিনতে পারব! আর আদেশ অমান্য করে খাবার কিনে খাওয়ার দুষ্টুবু্দ্ধি তো করেই ফেলেছি।
ড্রাইভার ভাই আমাদের বেশি দূর নিলেন না। ছোট্ট একটা টং দোকানে গিয়ে ভ্রমন শেষ করলেন। আমাদের কোনকিছু কিনতে বারণ করলেও বাধা দিলেন না। দোকানে নেবার মত তেমন কিছু ছিলও না। ৫টাকায় মোটা মোটা রঙ্গিন সুইটবলের একটা ছোট্ট বাক্স আর কমলা রঙ্গের একটা শিঙ্গারা কেনা গেল।
শিঙ্গারা আগে কখনো দেখিনি। নামও শুনিনি। এত সুন্দর এর গরন, রং-হৃদয়টা কেমন যেন আনচান করে উঠলো। অবাক নয়নে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। তখন প্রেম, ভালবাসা শব্দগুলো জানতাম না। আর প্রেমের অনুভুতি, লক্ষন সম্পর্কে কেউ শিখায় ও নি। কিছুটা বয়স বাড়ার পরে শব্দ দুটোর সাথে পরিচয় হয়। তারও অনেক পরে ১৪ বছর বয়সে বুঝেছি এই আনচান অনুভুতিটা ছিল শিঙ্গারার প্রতি প্রেমে পড়ার সূচনা।
ঐ কমলা শিঙ্গারাটা অবশ্য পুরানো বাসি ছিল। আর ভীষন ঝাল। সম্ভবত রাখাল আর কৃষকদের উপযোগী করে কয়েকদিন ধরে বিক্রি করার মত করে বানানো। এখন খেলে অবশ্যই প্রেমে পরতাম না।
আর এখন এমন প্রেমে যে পড়েছি-এত বছর পরে আজও যেকোন সস্তা সাধারন রেস্তোরার সামনে শিঙ্গারা দেখলে সাথে সাথে না কিনে খাওয়া পর্যন্ত মাদকাসক্তের মত সারা গাঁ কাঁপতে থাকে, পা যেন কোন অদৃশ্য চুম্বকের আকর্ষনে আটকে যায়। শিঙ্গারা না খাওয়া পর্যন্ত মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে থাকে। আর শিঙ্গারাটা খাবার পর মনের ভেতরে একটা পরী নেচে উঠে আর আমি আনন্দে শিহরিত হই।
মাঝখানে ৯ বছর যুক্তরাজ্যে বসবাস করেছি। অনেকদিন সেখানে শিঙ্গারা পাইনি। ২০১১ সালে ভ্রমণে কর্নোয়াল (Cornwall) [ইংরেজরা উচ্চারন করে কলমল] গেছি। সেখানের জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতের শহর নিউকিউই (Newquay) তে মরিস পেস্তিস (Morris Pasties) নামের এক বেকারীতে ঢুকেছি স্নেকস খাবার জন্য। বেকারীটা ১০০ বছরের বেশি পুরানো কিন্তু ১৯৭১ থেকে নতুন মালিকানাধীন। কিছুক্ষন আগে গুগল করে দেখলাম যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী ও জননন্দিত অনেক টেলিভশন চ্যানেল ও পত্রিকার গবেষনায় নিয়মিত শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব অর্জণ করছে কর্নওয়ালের সেরা পেস্টি হিসেবে।
ছবিতে শেতাঙ্গ মহিলাটি মরিস পেস্তিস বেকারীর বর্তমান মালিকের স্ত্রী ও ম্যানেজার। উপরের ওভেনটি ১০০ বছরের পুরানো। তবে ভেতরে কিছু সংস্কার করে কয়লার পরিবর্তে বৈদ্যুতিক উপযোগী করা।
কর্নিশ পাস্তি দেখতে বাংলাদেশের পুলি পিঠার মত। গমের ময়দা দিয়ে বানানো। ভেতরে কর্নোয়ালের স্থানীয় গরুর মাংশের ঝুরঝুরা মাংস, স্থানীয় শবজী আর আলু দিয়ে ভর্তার মত করে বানানো। তবে এটা বাংলাদেশের শিঙ্গারার মত ডুবা গরম তেলে ভাজা না। রুটির উপরে হালকা মাখনের প্রলেপ দিয়ে অল্প আঁচে অনেক দীর্ঘ সময় ওভেনে বেক করা।
কর্নিশ পাস্তি পুলি পিঠার মত হওয়ার একটা ঐতিহাসক স্বাস্থসম্মত কারন আছে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সময় শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবাই কয়লা, লোহা আর বিষাক্ত ধাতু নিয়ে কাজ করত। আর এখনকার মত নিরাপদ রাবারের গ্লাভসও ছিলনা। তাই হাতের আঙ্গুল থেকে বিষাক্ত পদার্থ খাবারে যেন না যেতে পারে তাই কর্নিশ পাস্তিতে মোটা শক্ত পুলি বা ক্রাস্ট থাকত যেন ক্রাস্ট হাতে ধরে খেয়ে ক্রাস্টটা ফেলে দিতে পারে। এতে সংক্রামন ও বিষক্রিয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
ছবিতে আমার স্ত্রী ওভেন থেকে মাত্র বেড় হয়ে আসা তাজা কর্নিশ পাস্তি খাচ্ছে।
বেকারীর ডেকোরেশনে রাখা প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাইকেলটার সাথে ছবিটা না দেখালে তো আর প্রেস্টিজ থাকে না!
কর্নিশ পাস্তি টা বেশ দামের ছিল। তবে অনেক বড়। কিন্তু খেতে অপূর্ব। আমার কাছে খেতে অনেকটা শিঙ্গারার মত লাগল। ইউরেকা! আমার প্রথম প্রেমিকার যুক্তরাজ্যের সংস্করন পেয়ে গেছি। তারপর আর দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়নি। বার্মিংহাম শহরে কর্নিশ পাস্তির কয়েকটা দোকান পেয়ে গেলাম। গ্রিগস (Greggs) নামের একটা বেকারী চেইন যুক্তরাজ্যের আনাচে কানাচে তা খুব শস্তায় বিক্রি করা শুরু করলো। এরপর সবই ইতিহাস। শিঙ্গারার কথা মনে হলেই কর্নিশ পাস্তির দোকানে দৌড়ে যেতাম।
২০১৩ সালের শেষের আবিষ্কার করলাম আমার বাসা থেকে অনেকটা দূরে স্মলহিথ নামে বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকায় মিষ্টিদেশ নামের স্বনামধন্য বাংলাদেশী মিষ্টি+বেকারী+রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে বাংলাদেশী শিঙ্গারা পাওয়া যায়। ভালই হল এবার বাংলাদেশের প্রিয়তমাকে পাওয়া যাবে। ভালও বানায়। কিন্তু সমস্যা হল এরা খুব অল্প বানায়। প্রায়ই খালি হাতে বিষন্ন মনে ঘরে ফিরতে হত।
এখন দেশে ফিরে এসেছি। ঢাকার সস্তা হোটেলের জনপ্রিয় হালকা নাস্তা শিঙ্গারা। প্রায় সবখানেই সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পাওয়া যায়। কাজেই প্রেমিকার সাথে দর্শন নিয়মিত।
মাইলস এর প্রথম প্রেম নিয়ে একটা গান আছে।
“প্রথম প্রেমের মত
প্রথম কবিতা এসে বলে
হাত ধরে নিয়ে চলো
অনেক দুরের দেশে
কত পথ প্রান্তর ঘুরে ফিরেছি
পাইনিতো আজো তোমায়
সেই পথ চলা শেষ হলে
কাছে এসে যেও বলে
এই তো আমি
এই তো আমি
তোমারই আশায় বসে থেকেছি
নাম ধরে ডাক দিলে কে গো তুমি
ফিরে এলে আজ কাছে
ভালোবাসা যত আছে
দিলাম তুলে
দিলাম তুলে
প্রথম প্রেমের মত
প্রথম কবিতা এসে বলে
হাত ধরে নিয়ে চলো
অনেক দুরের দেশে”
প্রথম প্রেমের অনভুতিটা এখনও সতেজ, অটুট। তবে গানটি বিরহের। আমার জীবনের নয়।
পুনশ্চ: স্ত্রীর সাথে আমার মধুর সম্পর্ক। আমরা দুজনই শিঙ্গারা খুব পছন্দ করি।
২| ১৩ ই জুন, ২০১৭ রাত ৩:০১
ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: আহা সিংগারা। আমার তো খুবই পছন্দ। আমার এখানে ইন্ডিয়ান রেষ্টোরেন্টে পাওয়া যায়, আবার আমিও শেফ বাসায় এনে একসাথে ১০ ডজন করে বানিয়ে সংরক্ষন করে রাখি, বিকালে চায়ের সাথে ভালোই যায়।
ঢাকা থাকলেও রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসি।
৩| ১৩ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৯:৫১
অশ্রুকারিগর বলেছেন: আহা! শিঙ্গারা ! পৃথিবীর সবচেয়ে মজাদার খাবার। আপনার দেখি শিঙ্গারার সাথে প্রথম দেখা একদম মনে আছে। খুব ভাল লাগলো পড়ে।
৪| ১৩ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:১৩
নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: প্রিয়তে থাকুন ভাই।
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই জুন, ২০১৭ রাত ১:১২
সচেতনহ্যাপী বলেছেন: কর্নিশ পাস্তি বা আরো যত সুন্দর নামই হোক না কেন, আলু এবং কলিজার পুর দিলেই সে আদি/অকৃত্তিম সিঙ্গারা
।। আমারও প্রথম না হলেও ভালবাসায়.....।। আরেকটি আছে ডালপুড়ি।। এর জন্য আমি ২০ কিলো ড্রাইভ করতেও রাজি
।।