নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক ৷ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখাপড়া করেছি জাহাঙ্গীরনগর, নটিংহ্যাম ও কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বুলবুল আশরাফ

খুব সাদামাটা একজন মানুষ। অনেক কিছু করতে চাই। মাঝে মাঝে কনফিউজড থাকি, কী চাই, কী করতে চাই- এসব বিষয়ে।

বুলবুল আশরাফ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত: এক উত্তাল সময়ের অসহায় সমর্পণ

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৪

৮০ এর দশককে বিবেচনা করা হয় ব্যান্ড সঙ্গীতের উত্থানের এক উত্তাল সময়, আর ঠিক সেই সময়ে আমাদের বেড়ে উঠা। তখন ঢাকার অধিকাংশ তরুনদের মুখে মুখে ফিরত নানা রকম জনপ্রিয় ব্যান্ড এর গান। ব্যান্ড এর গান তরুনদের নানাভাবে মাতিয়ে রাখত যেখানে গানের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম, বিরহ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও সমাজের নানাবিধ অসামঞ্জস্য ছিল অন্যতম। অথচ বাংলাদেশের ব্যান্ড কিংবা রক সঙ্গীত নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি বা গবেষণা হয়নি। তারপরও যে গুটিকতক লেখার কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি সেগুলো হচ্ছে লতিফুল ইসলাম শিবলী রচিত ‘বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন’, মিলু আমান রচিত ‘রক যাত্রা’ এবং সাম্প্রতিক সময়ে মাকসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের রকগাথা: আজম খানের উত্তরাধিকার’। এই সবগুলো বইয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একজন সঙ্গীতজ্ঞ এর চোখে বাংলাদেশের রক সংগীত ও তার ইতিহাসকে দেখা। এখানে ‘বাংলাদেশের রকগাথা’ বইটি মাকসুদুল হক রচিত, আজম খান কে কেন্দ্র করে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। এই বইয়ের মাধ্যমে মাকসুদুল হক, যিনি ভক্তকূলের নিকট মাকসুদ নামেই অধিক পরিচিত, নিজের আবেগকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন সেটি বাংলাদেশের রক সংগীতের গুরু হিসেবে খ্যাত আজম খানের প্রতি বাংলাদেশের কোন সঙ্গীত শিল্পীর অন্যতম নিবেদন হিসেবে দেখতে পাই। এই আজম খান এর হাত ধরেই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধত্তোর সময়ে বাংলার মানুষ এক নতুন ধরনের সঙ্গীতের স্বাদ আস্বাদন করতে শুরু করে। যদিও তার পূর্বের প্রজন্ম এই নতুন ধারার সঙ্গীতকে ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি। সেই ঐতিহ্য আমাদের বেড়ে ওঠার সময়েও লক্ষ করি। হয়তো এ কারণেই ব্যান্ড সঙ্গীত এখনোও মূলধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে পারেনি।
খুব সংক্ষেপে যদি আমরা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এই ধারার উদ্ভব ও বিকাশ মূলত ষাটের দশকের শেষভাগে। এই সময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং বিকাশের পেছনে বাঙ্গালীর আত্মপরিচয় এবং তার সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। যে কারণে এই সময়ে ধর্ম-ভিত্তিক পরিচিতির বাইরে বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আর তাই ষাটের দশকে বাঙালি পরিচিতির বিনির্মাণের নানা প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই। এই সময়টাতে যেমন বাঙালিয়ানার দিক নির্দেশনা ছিল, ঠিক তেমনি আমাদের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা সংগীতের প্রভাবও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পশ্চিমা ধাঁচের সঙ্গীতের প্রভাবে বাংলাদেশে রক সঙ্গীত এর বীজ মূলত এ সময়েই প্রোথিত হয়, যার বহি:প্রকাশ আজম খান ও তার সমসাময়িক অনেকের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই। পরবর্তিতে আমরাও সেই উত্থানের এক অনিবার্য সাক্ষী হয়ে পড়ি।

এই রক সঙ্গীত সাধারণের নিকট ব্যান্ডসঙ্গীত হিসেবেই অধিক পরিচিত ছিল যা শুরুতে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সংগীতচর্চার জন্যে যেসকল সংগীত উপকরণ প্রয়োজন ছিল সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ব্যয়বহুল হবার কারণে সাধারণ মানুষের জন্য এই চর্চা কল্পনার অতীত ছিল। ঠিক একারণে সংগীতের এই ধারাটি শুরু থেকে সমাজের ‘এলিট’ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধারার পরিবর্তন ঘটে এবং এই শ্রেণীর ধারণা থেকে বের হয়ে আসে এবং তরুন সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। যা ব্যান্ড সঙ্গীতের তুমুল জনপ্রিয়তাকে নির্দেশ করে।

আমরা যারা ৮০ এর দশকের আগে বা তার পরে জন্মগ্রহণ করেছি, তাদের নিকট ব্যান্ড সঙ্গীত একটি অনন্য রূপ নিয়ে হাজির হতে শুরু করে। যখন আমরা বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে কথা বলি একে একে আমাদের সামনে চলে আসে আজম খান থেকে শুরু করে আরো বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞদের নাম যাদের নাম আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে প্রয়াত হ্যাপী আখান্দ, লাকী আখান্দ ও আইয়ুব বাচ্চুর কথা সর্বাগ্রে চলে আসে। হ্যাপী আখান্দ এর অসামান্য মেধার জন্য তাকে বাংলা গানের অকালে ঝরে যাওয়া নক্ষত্র হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়। তার সাথে আরেক অকাল প্রয়াত দুর্দান্ত গিটারিস্ট নয়ন মু্ন্সীর (মুন্সী নয়ন হিসেবেও কোথাও কোথাও পাওয়া যায়) নামও চলে আসে, যাদের অবদান বাংলা ব্যান্ড জগতে অসামান্য। ব্যান্ড সঙ্গীত তার অকল্পনীয় এক উচ্চতায় উঠতে থাকে এই সময়ে। কিন্তু ৯০ এর শেষ ভাগ হতে নতুন শতাব্দীর শুরুতে আমরা এই সঙ্গীত ধারার মলিন রূপ দেখতে শুরু করি। যা আমাদের তথা আমাদের সঙ্গীত জগতের জন্য অত্যন্ত দুখ:জনক একটি বিষয়।

অনেকে এর পিছনে এই সঙ্গীত জগতের নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কথা বলেন যেমন, একটি ইন্ডাস্ট্রি হতে না পারা, কিংবা কেবলমাত্র হালের সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে ধাবিত হওয়া, শিল্পির যথাযথ মূল্যায়ন না করা এবং প্রযুক্তি তথা ইউটিউবের মত প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব কিংবা ক্রমাগত পাইরেসির স্বীকার হওয়া ইত্যাদি। এইসবই খুব যুক্তিযুক্ত কথা, কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু ঘটতে থাকে যা আমাদের পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আধুনিক বাংলা সঙ্গীত কিংবা সমসাময়িক বাংলা সঙ্গীতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও একটি প্রতিষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রি আমরা গড়ে তুলতে পারেনি। এর সাথে আরো বেশকিছু কারণকে চিহ্নিত করা যায় যা আমাদের সঙ্গীতজগতকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে। প্রথমেই যে বিষয়টির কথা এখানে বলা যায় সেটা হল বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির উত্থান এর সাথে আমাদের দেশের সংগীত ধারার মানিয়ে নিতে সমর্থ না হওয়া। দ্বিতীয়ত, আশি ও নব্বই দশকে আমরা ব্যান্ড এর ধারণা কে যেভাবে সংজ্ঞায়িত হতে দেখেছি পরবর্তীকালে একক ব্যক্তি নির্ভর সঙ্গীত আয়োজন এর প্রতি প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ক্রমাগত আগ্রহী হয়ে একক ক্যারিয়ার গড়বার একটি প্রবণতার কারণে ব্যান্ড দলে কোন্দল এর আবির্ভাগ এবং অনিবার্য ফলাফল হিসেবে দলে ভাঙ্গন।

ব্যান্ড সঙ্গীতে দলীয়ভাবে কাজ করবার যে ধরনের সক্ষমতা গড়ে ওঠার কথা সেটি ধীরে ধীর কমতে থাকে। যা বেশ কয়েকটি ব্যান্ড এর ভাঙ্গা গড়ার এর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাই। তৃতীয়ত, ব্যান্ড যেহেতু একটি দলীয় সঙ্গীত পরিবেশনের একটি প্রক্রিয়া সেখানে পরবর্তী নেতৃত্ব গড়ে তোলার ব্যর্থতার দায় খুব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। যদিও এসব বিষয়গুলো যে কেবলমাত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই দেখা যায় সেটি হয়তো বলা ঠিক হবে না কেননা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও বিভিন্ন ব্যান্ড এর ভাঙ্গন কিংবা ব্যর্থতার পিছনেও একই ধরনের কারণ বা প্রবণতা দেখতে পাই। চতুর্থত, বিশ্বায়নের প্রভাবে শ্রোতার গান শোনার অনেক বিকল্প থাকার কারণে সমসাময়িক সঙ্গীত থেকে শুরু করে ব্যান্ড সঙ্গীত থেকে অনেক শ্রোতার মুখ ফিরিয়ে নেবার প্রবণতা। আর তাই অনেককে বলতে শোনা যায় যে আমাদের সমসাময়িক সংগীত মানসম্মত গায়কী, গানের কথা এবং সুর এর কারণে তার আবেদন হারিয়েছে। যার সাথে বৈশ্বিক সংগীতের উপর নির্ভরশীলতার প্রবণতার কথা আমরা এখানে নিয়ে আসতে পারি। অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রোতার কানে যে সংগীত ভালো লাগবে সে সেটি শুনবে এর সাথে ট্রেন্ড এবং সমসাময়িক ধারার সাথে শ্রোতা নিজেও নানাভাবে অভিযোজিত হতে থাকে। ফলে এই সময়ের শ্রোতাকে ধরে রাখতে হলে, এই সময়ের প্রেক্ষাপটে সংগীত তৈরি এবং বিপণন করতে হবে। প্রথাগত সিডি ক্যাসেটের প্রতি বিমুখতা যেহেতু শুরু হয়েছে সেহেতু সংগীতের বিপণন ব্যবস্থাপনাতে এক ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

এতটা হতাসার মাঝেও আমরা সঙ্গীত নিয়ে নতুন প্রজন্মের অনেককেই নানা নিরীক্ষা করতে দেখি যা আমাদের আশার আলো দেখায়, সেগুলোকেও যথাযথভাবে শ্রোতার নিকট পৌছানোর প্রচেষ্টা হাতে নিতে হবে। নতুন অনেক ব্যান্ড উচ্ছ্বসিত হবার মত কাজ করছে, তাদেরকেও ভাবতে হবে কি করে শ্রোতার নিকটে আরও কার্যকর ভাবে পৌছানো যায়। বর্তমান সময়ে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে শ্রোতার নিকট পৌছানোর প্রবণতা আমরা বাইরের বিশ্বে দেখতে পাই। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে সেই নতুন নতুন বিষয়গুলোও আমাদের বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। সাথে আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রির পাইরেসি বন্ধ করার চেষ্টা হাতে নিলে আবারও হয়ত মানুষ প্রিয় শিল্পী ও ব্যান্ড এর গানের এলবাম বা গান কিনে শুনবে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের পাইরেসি নিয়ন্ত্রণের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে খুব ভালোভাবেই চলচ্চিত্রের পাইরেসি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। একই ধরনের প্রচেষ্টা যদি সমসাময়িক সংগীত ধারার ক্ষেত্রেও নেয়া হয় হয় তাহলে হয়তো সংগীতের পাইরেসি খুব দ্রুতই নির্মূল করা সম্ভব। সর্বোপরি, সাম্প্রতিক সময় এবং শ্রোতার গান শোনার রুচি ও প্রবণতাকে মাথায় রেখে যদি সঙ্গীত আয়োজন করা যায় তাহলে হয়তো আমাদের সঙ্গীত তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।



লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রথম আলোতে

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে তথ্যবহুল লেখার জন্য ধন্যবাদ। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের স্বর্ণ যুগ ছিল বলা যায়। এই সময় বেশ কিছু চির সবুজ গানের সৃষ্টি হয়েছিলো। গানের অনেক ধারার মধ্যে ব্যান্ড সঙ্গীতও একটি শক্তিশালী ধারা বলা যেতে পারে। আশা করি আবার ব্যান্ডের গান সমাজে জোয়ার তুলবে আগের মত।

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১০

বুলবুল আশরাফ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়বার জন্য। আমিও এই প্রত্যাশাই করি। ভালো থাকবেন।

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১১:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটি পড়লাম। অনেক সময় লাগলো।
বেশ কিছু বানান এডিট করে ঠিক করে নেবেন।

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৪৩

বুলবুল আশরাফ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.