নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এন সি নীল

মানুষ হবার প্রচেষ্টায়

নীলমেঘ আমি

nu

নীলমেঘ আমি › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি প্রগতিশীল তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের দাবীতে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠন।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৩৪

২০০৬ সালের অক্টোবরের কথা, তৎকালীন বিএনপি সরকার মেয়াদের শেষপ্রান্তে এসে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ নামে একটি ভয়াবহ আইন করেছিল। এই আইনের অধীনে ইন্টারনেট জগতে কারো ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত বা উস্কানি প্রদান অথবা মানহানি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিলো। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধ অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুন ব্লগারদের নেত্রিত্তে সারা দেশের মানুষ একত্রীত হলে, স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী “হেফাজতে ইসলাম” নামে নতুন একটি ইসলামিক দল এই ব্লগারদের নাস্তিক দাবী করে তাদের ধর্ম অনুভূতি রক্ষার আন্দোলনে নামে। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গণজাগরণ মঞ্চের ৪ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হয় ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে।



হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে চাপ ছিল আইনটি সংশোধন করে সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির দন্ড যোগ করার। প্রথম দিকে সরকার হেফাজতের দাবিকে উড়িয়ে দিলেও অবশেষে তারা আইনটি সংশোধন করে। নতুন আইনে ফাঁসির বিধান যোগ না হলেও হেফাজতের দাবির প্রতি সরকারের নমনীয়তা বিশেষভাবে দৃশ্যমান। "তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধ্যাদেশ ২০১৩" নামে সংশোধিত এই অধ্যাদেশটি অনেক বেশী কঠোর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে এর অনেক ধারাই সংঘাতপূর্ণ। যেখানে ২০০৬ সালের আইনটি বাতিলের দাবী ছিল আমাদের সেখানে আইনটি তো বাতিল করেই নি বরং আইনটির সব কিছু বহাল রেখে শাস্তি সহ আরও অনেক বিষয় বর্ধন করা হয়েছে, নিম্নে সেসব বিষয় নিয়ে একটু আলোকপাত করছিঃ



# ২০০৬ সালে প্রণীত আইনে শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর, সর্বনিম্ন শাস্তি নির্ধারণ করবে আদালত। কিন্তু ২০১৩ সালে প্রণীত অধ্যাদেশে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ৭ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

# ২০০৬ সালে প্রণীত আইনে অপরাধ নন-কগনিজেবল ছিল। কিন্তু নতুন আইনে এটি হবে কগনিজেবল অর্থাৎ ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে।

# আগের আইনে সব অপরাধ জামিনযোগ্য ছিল। কিন্তু নতুন আইনে অপরাধ জামিন অযোগ্য করা হয়েছে।

# আগের আইনে মামলা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হত। কিন্তু নতুন আইনে পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে মামলা করতে পারবে।



আইনটির ৫৭ (১) ধারায় বলা আছে— “কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷”



প্রথমত বলবো এটা একটা অস্পষ্ট আইন। বাংলাদেশের পেনাল কোডে অপরাধের সংজ্ঞা এমনভাবে দেয়া হয় যেন অপরাধ করার আগেই একজন মানুষ বুঝতে পারে কী কী করলে তা অপরাধ বলে গন্য করা হবে। উদাহরন স্বরূপ পেনাল কোডের ১৭৭ ধারার কথা বলা যেতে পারে, যেখানে ইচ্ছেকৃত ভাবে ভুল তথ্য দেয়া বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে, তা স্পষ্ট করে শুধু বলাই হয়নি, দুইটি উদাহরন দিয়ে তার স্বরুপও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু আইসিটি আইনের ৫৭ (১) অনুচ্ছেদে অপরাধের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা একেবারেই স্পষ্ট নয়, অভিযুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত কোন লেখকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় যে কী লিখলে তা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।



মিথ্যা, অশ্লীল, অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ, মানহানি, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটার সম্ভাবনা, ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত, উস্কানি প্রদান প্রভিতি শব্দ গুলো আপেক্ষিক। এই শব্দ গুলো একেকজনার কাছে একেকরকম। একজনার কাছে ধর্ম মিথ্যা তো আরেকজনার কাছে একমাত্র সত্য, একজনার কাছে ন্যুডিজম অশ্লীল তো আরেক জনার কাছে এটি শিল্প, একজনার কাছে ধর্ম অনুভূতি হাস্যকর তো আরেকজন এর জন্য জীবন দিতেও কার্পণ্য করেনা। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যার নিজের বুদ্ধি আছে তাকে লেখার মাধ্যমে অসৎ হতে উদ্বুদ্ধকরণ ব্যাপারটা হাস্যকর। একই ভাবে কোন ধরণের মন্তব্যকে ‘কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান’ বলে চিহ্নিত করা হবে, তারও কোন সীমারেখা টানা নেই। আমার কোন লেখায় আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে তা লেখার পর তার প্রতিক্রিয়ায় বুঝা যেতে পারে এর আগে না। এখন প্রশ্ন হল অশ্লীল, মিথ্যা, অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ করে, ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত এইটা কে নির্ধারণ করবে? প্রশ্নের উত্তর হল এটি আমাদের অশিক্ষিত পুলিশরা নির্ধারণ করবে। এইবার বাংলাদেশের বিদ্যমান অন্যান্য আইনের সাথে এই আইনটির তুলনা করছিঃ



আপনি যদি কোন দাঙ্গা বা রায়টে যোগ দিয়ে সরাসরি কোন সহিংসতায় অংশগ্রহণ করেন, তাহলে বাংলাদেশের পেনালকোডের ১৪৭ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ২ বছরের জেল। এই দাঙ্গায় আপনি যদি এমন কোন মরণাস্ত্র নিয়ে বের হন যা দ্বারা কাউকে হত্যা করা সম্ভব, তাহলে পেনালকোডের ১৪৮ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ৩ বছরের জেল এবং সর্বনিম্ন শাস্তি বিজ্ঞ আদালত নির্ধারণ করবেন। কিন্তু আপনি যদি ‘ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে’ এমন কিছু প্রকাশ করেন যা থেকে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটার ‘সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়’, তাহলে আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!!!



আপনি যদি কোন ভাবে কাউকে চিঠি লিখে বা ফোন করে বা সরাসরি হত্যা করার বা ব্যাপক ক্ষতি সাধন করার হুমকী প্রদান করেন, তাহলে পেনালকোডের ৫০৬ ধারা অনুসারে তার শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছর, আর যদি এই হুমকী বেনামে করে থাকেন, তাহলে পেনালকোডের ৫০৭ ধারা অনুসারে শাস্তি সর্বোচ্চ আরো ২ বছর। কিন্তু আপনার অনলাইন কোন লেখাকে কেউ যদি ‘উস্কানী’ হিসেবে নিয়ে থাকে, তাহলে আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!!!



আপনি যদি মুদ্রিত কোন মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করে বা অন্য যে কোন উপায়ে কারো মানহানি করেন বা কুৎসা রটনা, তাহলে পেনালকোডের ৫০০ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ২ বছরের জেল এবং সর্বনিম্ন শাস্তি বিজ্ঞ আদালত নির্ধারণ করবেন। কিন্তু অনলাইনে আপনার কোন লেখায় কেউ যদি প্রমাণ করে যে তার মানহানি ঘটেছে, তাহলে সংশোধিত আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!!!



বাংলাদেশে আপনি যদি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কারো বাড়িতে অনুপ্রবেশ করে কোন নারী বা পুরুষকে বিরক্ত বা উত্যক্ত করেন, তাহলে পেনালকোডের ৫১০ ধারা অনুযায়ী আপনার শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টার জেল বা ১০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড এবং বিজ্ঞ আদালতের মতানুসারে সর্বনিম্ন শাস্তি আরো কম হতেই পারে। কিন্তু আপনি যদি অনলাইনে এমন কিছু প্রকাশ করেন, যা ‘মিথ্যা ও অশ্লীল, এমনকি প্রাপ্তবয়ষ্ক কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন’, তাহলে সংশোধিত আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!!!



এছাড়া তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে অপরাধ জামিন-অযোগ্য এবং সব অপরাধকেই আমল যোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমলযোগ্য অপরাধ কেউ করলে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের বিধান রাখা হয়েছে। একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যায় না। তাই কোনো অপরাধকে বিচারের পূর্বেই জামিন-অযোগ্য বলা যায় না। পুলিশ এখন জাজ, জুরি, এক্সিকিউশনের কাজ করবে। একথা ঠিক যে, ইন্টারনেট কেন্দ্রিক সাইবার অপরাধ পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি আইনী পরিকাঠামোর আওতায় একে মোকাবিলা করতে হবে কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন বিঘ্নিত না হয় এদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।



এই রকম একটি গন বিরোধী আইন বাতিলের এবং প্রগতিশীল তথ্য-প্রযুক্তি আইন বাস্তবায়নের দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর সোমবার সর্বপ্রথম রাজপথে প্রতীবাদ সমাবেশ করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠন। এই সংক্রান্ত একটা পেজ ও খোলা হয় ফেসবুকে। সমাবেশের সমস্ত আয়োজনে সংগঠনের সদস্যরা থাকলেও কৌশলগত কারণে সংগঠনের নাম ব্যাবহারে বিরত থাকে তারা। কারণ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আইন ও অধ্যাদেশের ক্ষেত্রে একক ব্যাক্তি বা সংগঠনের মাধ্যমে বিরোধিতা করার থেকে সামগ্রিক জনসাধরনের মিলিত বিরোধিতা অনেক বেশী কার্যকর ও নিরাপদ। নিম্নে সমাবেশের কিছু চিত্র দেয়া হলঃ





প্রতিবাদ সমাবেশের একাংশ। বক্তব্য রাখছেন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠক এবং গবেষক খান আসাদ।





প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন গণজাগরণ মঞ্চের তরুন নেত্রী লাকি আক্তার।





খুন করেও জামিন পায় তারা, আর মুক্তচিন্তার অপরাধে জামিন অযোগ্য আমরা।





থাকিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং সরকার, নতুন করে ব্লাশফেমি আইনের কি দরকার?





পুলিশের হাতে জাজ, জুরি ও এক্সিকিউশন, মহামান্য আদালতের আর নেই কোন টেনশন।





পরিশেষে বলবো, স্বাধীন মত প্রকাশ একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া নির্ভর সাধারণ মানুষের এই মত প্রকাশের সুযোগটি প্রায়শই সুশাসন দিতে ব্যর্থ সরকারের বিপক্ষে যায়। পৃথিবীব্যাপী সরকারগুলো তাদের শাসনকার্য অধিক জনমুখী, উন্নত ও কার্যকর করার পরিবর্তে সামাজিক মাধ্যমের সদস্যদের মত প্রকাশের বিষয়কে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে। এই আইনটির মধ্যে সেই লক্ষণ স্পষ্ট। অপরাধী ও সাধারণ ব্যবহারকারীকে এই আইন সমানভাবে দেখছে এবং যেকোনো বিরুদ্ধ মতকে আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ সরকারকে করে দিচ্ছে এবং এর শাস্তি জামিন-অযোগ্য পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করছে।অবিলম্বে এই আইন বাতিল করে জনকল্যাণকর ও প্রগতিশীল আইন বাস্তবায়ন করে সরকার নিজেকে কল্যাণমুখী প্রমাণ করবে এই আমাদের প্রত্যাশা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.