নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার গল্পটা হোক পৃথিবীর সেরা গল্প ।কারন আমি হতে চাই একজন সত্যিকারের জীবন শিল্পী ।

নুরুন নাহার লিলিয়ান

নুরুন নাহার লিলিয়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

রহস্য গল্প ; হিনামাতসুরি

০১ লা জুন, ২০১৫ সকাল ৮:২১

হিনা একটি পুতুল । জাপানিজ সংস্কৃতিতে মার্চের ৩ তারিখে এই হিনামাতসুরি বা কন্যা উৎসব হয় । মেয়েদের সুখ ,স্বাস্থ্য এবং সাফল্য প্রার্থনা করে এই আয়োজন হয় । সরকারী ছুটি না থাকলেও প্রায় প্রতি ঘরে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এই হিনামাতসুরি শুরু হয় । পনেরটি বিভিন্ন রকমের পুতুল দিয়ে হিনামাতসুরি স্টেজ সাজানো হয় । সেখানে দুইটি পুতুল হল রাজা আর রানি । হিনা পুতুল যদি মার্চের ৪ তারিখে কেউ নামায় তাহলে সেই বাড়ির মেয়ের দেরিতে বিয়ে হয় । এখানে এমন অনেক রকমের সংস্কার আছে । গত বছর সিটি সাপ্পোরো সেন্টার থেকে বিদেশীদের জন্য হিনামাতসুরি উৎসব এর আয়োজন হল । আমি আর আমার স্বামী লটারির মাধ্যমে রাজা রানি নির্বাচিত হলাম । অনেক ফটোশুট শুরু হল । তা দেখে আমাদের সাথে যোগ দেওয়া মাইকো ইয়ামাউচি কেমন যেন করে তাকাচ্ছিল । পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা অতিথিদের মাঝে মাইকোর তির্যক দৃষ্টি আমার নজর এড়িয়ে গেলনা । খুব শান্ত আর স্থির হয়ে আমার মস্তিষ্কের কোথায় যেন আঘাত করতে লাগলো ।মাইকো আমার খুব কাছের জাপানিজ মেয়ে বন্ধু । এমন আরও একটি আন্তর্জাতিক জাপানিজ অনুষ্ঠানে মাইকো দোভাষী হিসেবে আমাদের গাইড ছিল । ও একটি বিমান সংস্থাতে চাকুরি করলেও ইংরেজি দোভাষী হিসেবে অনেক অনুষ্ঠানে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে । আমি তখন জাপান এ নতুন এসেছি। জাপানিজ ভাষা জানি না । এখানে অনেক জায়গাতেই মানুষ ইংরেজি জানে না । হোক্কাইডো আইল্যান্ডটাতে বেশির ভাগ বৃদ্ধ মানুষের বসবাস । তরুন তরুণীরা চাকুরি এবং জীবিকার প্রয়োজনে টোকিওতে থাকে । কারও কারও সেকেন্ড হোম । হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয় কে কেন্দ্র করেই সাপ্পোরো মূল শহরে লোকজন দেখা যায় । আর এই বিশ্ব বিদ্যালয়ে আমার স্বামী গবেষণা করছেন । এই জায়গা থেকে একটু দূরে গেলে গভীর পাহাড় আর অরণ্য । আর কিছু নদী । নিসর্গ আর সৌন্দর্য এক সাথে হয়ে যেন কোন দৃশ্যমান নিঃশব্দ কবিতা । হোক্কাইডো সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করলেও এক গভীর নিঃসঙ্গতা আমার ভিতরে তৈরি হয়েছিল । মাইকো ইংরেজি জানে এবং এখানকার স্থানীয় মেয়ে । তাই অল্প কয়দিনেই খুব ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এদিক সেদিক ঘুরতে যাওয়া । সংসারের টুক টাক কেনা । অবসরের কোন বিকেলের কফি পানের সঙ্গী হিসেবে মাইকো আমার সাথে থাকে । একটি সাধারন সম্পর্ক সুন্দর ভাবে চলছিল । সংসারে আমি আর আমার স্বামী । স্বামী ব্যস্ত থাকাতে মাইকো কে অনেক সময় কাজের ফাঁকে ডাকি । তবে অল্প কয়দিনে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম যখন মাইকো আমার বাসায় আসে খুব আনন্দ অনুভব করে এবং ও ঘুমিয়ে পড়ে । আমি মনে মনে ভাবি হয়তো কাজের জায়গা থেকে এসেছে তাই ক্লান্ত । কারন এখানে কাজের চাপ অনেক থাকে এবং কেউ কেউ মদ পানে অভ্যস্ত । আমি নিশ্চিত আমার বাসায় কখনও সে মদ পান করে আসেনি ।এমন অনেকদিন ওকে আমার বাসায় ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে পাঠিয়েছি । এখানে বেশিরভাগ পরিবার গুলোতে আঠারো বছর হয়ে গেলে সবাই একা আলাদা বাসায় থাকে । মাঝে মাঝে মা বাবার সাথে দেখা করতে আসে । মাইকোর সাথে কথা বলে জেনে ছিলাম । ওর বয় ফ্রেন্ড ছিল । সম্পর্কছেদ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে সঙ্গি খুঁজছে । একদিন তোবেতসু নামের একটি জায়গায় বসবাসকারী বাংলাদেশি পরিবারের সাথে আমাদের ভাল সম্পর্ক । তাদের নতুন বাচ্চা হয়েছে । সাপ্পোরো শহর থেকে দূরে । ট্রেন দিয়ে যেতে হবে । আমি মাইকো কে বললাম । ও বিদেশীদের সাথে পরিচিত হতে পছন্দ করে । তাই রাজি ও হল। বিয়ে ,বাচ্চা আর পরিবার আমাদের বাংলাদেশীদের কাছে অনেক অর্থপূর্ণ । কিন্তু অনেক সমাজে হয়তো তা এখন একটু আলাদা অর্থ বহন করে । বাংলাদেশী আতিথেয়তায় মাইকো খুব মুগ্ধ । আমি আর ভাবি অনেক কথা বাংলায় অনেক দিন পর বলতে পেরে খুব খুশি । হঠাৎ দেখি মাইকো ঘুমিয়ে গেছে । ওই পরিবারের বাচ্চাটিকেও সে কোলে নেয়নি । আর সেখানেই পরিচয় পর্বের এক ফাকে আবিস্কার করেছিলাম মাইকো বিবাহিত ছিল । যা আমার কাছে লুকিয়ে গেছে । আমি তাই মনে মনে ভাবলাম আমার আর আমার স্বামীর সম্পর্ক দেখলে ও মজা করেই বলতো ,ওহ ! তোমাদের সুখ আমাকে হিংসাত্মক আর ধ্বংসাত্মক করে তুলছে ।আমি ভাবতাম ,হয়তো মজা করে । যেহেতু বয় ফ্রেন্ড খুজচ্ছে তাই আমি ওকে বলতাম ,খুব শীঘ্রই তুমি সুখে ভেসে যাবে । তোমার রাজ কুমারকে পেয়ে যাবে । ভাল করে খুঁজো ।
তোবেতসু থেকে আসার পর কিছু দিন মাইকোর দেখা নেই । তারপর একদিন সে ইমেল করে জানাল যে সে টোকিও গিয়েছিল । আমার জন্য একটা পুতুল এনেছে । পুতুল সংগ্রহ আমার শখ । আমার বাসায় অনেক রকমের পুতুল আছে ।সে এনেছে একটি ছোট মিনি পুতুল । আমি রান্না ঘরের একটা বিশেষ জায়গায় রাখলাম । এখানে প্রায় সব বাসায় রান্না ঘরে আগুন এবং দুর্ঘটনার আগাম ব্যবস্থা নিতে সেন্সর মেশিন লাগানো থাকে । আমি সেদিকটায় পুতুলটা রাখলাম । আর সেদিন থেকেই ঘটনা গুলো ঘটেছিল যাচ্ছিলো । কারন ছাড়াই নিঃশব্দ দুপুরে রান্না করতে করতে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠতো । দরজা খুলে দেখতাম কেউ নেই । প্রচণ্ড রহস্যময় বাতাসে গা শির শির করে আসতো । হাড় হিম হয়ে যেতো । কখনও ফ্রাই পেনের তেল পড়ে গ্যাসের চুলার আগুন দপ দপ করে উঠত । হঠাৎ অনুভব করতাম গাড়ো ও অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে আমার রান্না ঘর । আর ওই মিনি পুতুলটা কোন ভাবে দরজা খুলতে দিচ্ছে না । সেন্সর মেশিন ও কাজ করছে না ।দিনে দুপুরে অবিশ্বাস্য শিহরণ । এখনও চিন্তা করলে দম বন্ধ হয়ে যায় । আমার স্বামী বিজ্ঞানের মানুষ । এই দ্বন্দ্ব মুখর অভিজ্ঞতা আর রহস্য তার কাছে হাসির বিষয় । এতো দিন অভিজ্ঞতা গুলো আমার বিশ্বাসে অনেক দ্বন্দ্ব নিয়ে বিচরন করছিল । কিন্তু সেই হিনামাতসুরির অনুষ্ঠানের মাইকোর হিংসাত্মক তির্যক চোখ জোড়া যেন ভয়ংকর কোন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আমার জীবনে এলো । অন্য কোন পৃথিবী থেকে সমগ্র শক্তি নিয়ে পিশাচের রাজত্ব করতে চাইলো । হিনামাতসুরি অনুষ্ঠানে অনেক ধরনের জাপানিজ সংস্কৃতি বিদেশিদের কাছে তুলে ধরা হয় । আমরা রাজা রানি নির্বাচিত হওয়ায় আমাদের বিয়ের কিমনো পরানো হল । সেই ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ বিয়ের পোশাক পরিয়ে আমাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির যেমন অরিগামি,ইকেবানা,সবুজ চা পান সহ আরও অনেক আয়োজন । অরিগামি হল কাগজ দিয়ে বিভিন্নি ধরনের জিনিস বানানো হয় । ইকেবানা হল ফুল সাজানো । আমার স্বামী খুব সিরিয়াস মানুষ । হেয়ালি বুঝে না । খুব মনোযোগ সহকারে সে অরিগামি বানাচ্ছিল । আর মাইকো দেখে অভিভুত আর আমাকে দেখিয়ে বলছিল ,বেশির ভাগ বিদেশি অরিগামি বানাতে গেলে বিরক্ত হয় ।তোমার স্বামী খুব মনোযোগী । দেখ কি মনোযোগ ।
আমি সাধারন ভাবে বললাম ,সে সব সময় সিরিয়াস এবং মনোযোগী ।
হিনামাতসুরি থেকে আসার দুইদিন পর । খুব সাধারন নিয়মে প্রতিদিনের কাজ করছি । তখন রাত দশটা । হঠাৎ কলিংবেল বাজছে । আমি তখন হোক্কে নামের এক ধরনের জাপানিজ মাছ গ্যাসের চুলার নিচে বিশেষ জায়গায় বারবি কিউ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই মাছ শুধু হোক্কাইডোতেই পাওয়া যায় । সবার খুব পছন্দ । দরজা খুলে দেখি মাইকো । আমি একটু অবাক হলাম । কারন সে আসার আগে সব সময় ফোন কিংবা ইমেল
করে । তখন মার্চ মাস। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। সে ব্যাগ এবং জ্যাকেট রাখতে রাখতে বলল , আজকে তারাতারি কাজ শেষ । তোমার স্বামী ফিরেনি?আমিও কিছু মাছ নিয়ে এসেছি । আমার ব্যাগ এ আছে ।
আমি বললাম, দেরি হবে। তোমার মাছ গুলো রাখো । পরে দেখব ।আমি হোক্কে মাছ বারবিকিউ করছি। তুমি এসেছ ভাল হয়েছে। সে এগিয়ে গেল রান্না ঘরে। আমি তখন টিভি চালু করে আমার ড্রয়িং রুম গুছাতে
গেলাম । হয়তো তিন চার মিনিট হবে । রান্না ঘর থেকে চুক চাক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । দরজা সামান্য খুলতেই আমার মাথা ঘুরে গেল। মাইকো একটি মানুষের বারবিকিউ করা হাত এনে দিয়ে বলল , আমি আজকে অনেক গুলো মানুষের হাত এনেছি। মানুষের হাত বারবিকিউ খুব মজা ।নাও খাও।
প্রচণ্ড ভয়ে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল । আমার সমস্ত শরীরে দ্রুত বিদ্যুৎ প্রবাহ শুরু হল। আমি অনুভব করলাম আমার শরীরের ভিতর কলকলানি রক্তের খরস্রোত । আমার হাড় হিম হয়ে এল । আমি বাক শূন্য হয়ে যাচ্ছি । আমি বুঝলাম পিশাচ আমার ঘরে । আমার ভিতর থেকে অন্য কেউ বলে উঠলো ,কি চাও তুমি পিশাচ ?
সে চুক চাক করে হাড় একাগ্র চিত্তে চিবাতে চিবাতে বলল , আমি ঘর,স্বামী আর বর চাই । সুখ শান্তি আর ভালবাসা । এগুলো নিতে এসেছি ।
আমি বললাম , এগুলো ছাড়া আমার আর কিছুই নেই । কি দোষ আমি করেছি ।
ওর মুখে রক্তের লালা । ভয়ংকর উল্টানো দুটো চোখ । ও হো হো করে হেসে উঠলো । তারপর বলল , তুমি পিশাচকে ডেকে এনেছ । তোমার জীবনে জায়গা দিয়েছ । আমরা মানুষের মধ্যেই বিচরন করি । আর তুমি মানুষ রূপী পিশাচকে চিনতে ভুল করেছো । তোমার মস্তিষ্ক এবং দৃষ্টি আরও বিচক্ষন করো ।এখন ধ্বংসই তোমার পরিনাম ।
এর পরের ঘটনা আমার জানা নেই । আমি অনুভব করলাম কেউ আমাকে ডাকছে । আমি চোখ খুললাম । আমার নিস্তেজ শরীর আর মন নিয়ে সব কিছু বুঝে উঠতে কেমন যেন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছিল । শুধু বুঝলাম আমার স্বামী বলছে ,তারাতারি ডিনার রেডি কর। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে ।
হয়তো আবার সাধারন নিয়মে জীবন চলে । দুই সপ্তাহ পর মাইকো ইমেল এলো , আমি তোমার বাসায় আসতে চাই । তুমি কবে ফ্রি আছো ?
আমি উত্তর দিলাম , আমি এখন ব্যস্ত ।
যে রহস্যের সঙ্গ মানুষের চিন্তার বাইরে আর জীবন কে দুর্বিষহ করে তুলে তা ত্যাগ করা উচিত । আমার বুকের ভিতর সেই দুক দুক ভয়ংকর শব্দটা আবার অনুভব করলাম । গায়ের লোম গুলো শিউরে উঠলো । তবু ও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে নিজেকে বুঝালাম জীবনের জন্য অনেক ভালবাসার রহস্যের সাথে দৃষ্টির বিচক্ষনতা ও জরুরি ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.