নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আসলে একজন ভীষণ খারাপ মানুষ। তবে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে দুর্দান্ত অভিনয় করতে পারি বলে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। সে হিসাবে আমি একজন তুখোড় অভিনেতাও বটে!!!

অজ্ঞ বালক

ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলো কুড়িয়ে এখানে নিয়ে এসে ছুঁড়ে ফেলা হয়!!!

অজ্ঞ বালক › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাইকো(?)লজিকাল(!) গল্পঃ বাবা

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৬

"পাগলায় তোমার কি হয়?" জড়ানো গলায় প্রশ্নটা করে লোকটা পিচিক করে থুতু ফেলল টেবিল থেকে হাতে তুলে নেয়া ছাইদানিতে।

"বাবা।" আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম।

নিজের কাছেই অস্বাভাবিক লাগছে। বাবা! আমি আমার বাবার কাছে এসেছি? আজ থেকে এক সপ্তাহ আগেও যেখানে আমি জানতাম আমার বাবা মৃত। মার আলমারিতে তুলে রাখা কয়েকটা ছবিতেই শুধু যাকে দেখতাম। ফরসা-গোল মুখ - ঠিক আমার মতন। নাকটা মার পেলেও চোখগুলো যে বাবার সেটা ছবি দেখলেই বুঝা যেত। যেই বাবা আমি জন্ম নেওয়ার আগেই মারা গিয়েছেন রোড এক্সিডেন্টে, সেই বাবা। জীবিত আছেন এখনো আর আমি জানতামও না!

"হেই পাগলার যে পোলা আছে সেইডা তো ফাইলে লেখা নাই।" পান চিবাতে চিবাতে আবার জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

মফিজ উদ্দিন। নামটা বড় করে লেখা দরজার বাইরে। পদটা এডমিন অফিসার হলেও সেই একলা হাতে দেখাশোনা করে এই প্রতিষ্ঠান। আমি এখন আছি সাভারের নরসিংহপুরে। এর আগে একবার নিজে নিজে উত্তরায় খালার বাসায় গিয়েছিলাম। অবশ্য মাই বলেছিল। সেখানে আজকের এই অভিযানের কথা কেউ জানে না। না, কেউ জানে না বলাটা ঠিক হবে না। মামুন জানে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মামুন। একই সাথে ধানমন্ডি গভঃমেন্ট বয়েজ স্কুলের ক্লাস এইটে পড়ি আমরা। এমনকি বাসাও একই গলিতে। ও থাকাতেই মা আমাকে একলা স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এমনিতে আমি বাধ্যগত ছেলে। কাজেই মা জানতো তার এই অনুমতির অন্যায় সুযোগ আমি নেব না। নিতামও না। কিন্তু, কি থেকে যে কি হল! নিয়তি - এই একটা শব্দ ছাড়া আর কিই বা বলতে পারি আমি।

"আমি উনার ছেলে। আপনি চাইলে আমার জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেট আপনাকে দেখাতে পারি।" আমি দৃঢ় গলায় বললাম। পাশের সীটে বসা মামুন উশখুশ করছে।

"ঐগুলা দশ টাকা দিলে নীলক্ষেতেই পাওন যায়, আসল নকল বুঝুম কেমনে আমি কও দেহি। তা তোমার মা-র নামডা জানি কি?"

শালায় আমার পরীক্ষা নিচ্ছে। "মরিয়ম খান। আর আমার বাবার নাম মাসুদ খান। আমার মা ব্র্যাকে আছেন। আমাদের বাসা লালমাটিয়ায়। স্থায়ী ঠিকানা মুন্সিগঞ্জ।" ইচ্ছে করেই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলাম আমি। মনে মনে নিজেকে বলে চলছি উত্তেজিত হওয়া যাবে না। একদমই না।

কুতকুতে চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মফিজ উদ্দিন। আমাকে যাচাই করছে। শালা যে একটা ঘাগু মাল দেখলেই বোঝা যায়। "নাহ, ঠিক আসে। তা মনে করো পাগলার চেহারার লগে তোমার চেহারা একদম খাপে খাপ, ময়নার বাপ। কিন্তু, তোমারে তো আমি এমনে এমনেই দেখা করবার দিতে পারি না। একটা নিয়ম আছে বুঝোই তো। এইটা তো আর যেই সেই প্রতিষ্ঠান না। ঢাকার ওয়ান অব দা বেস্ট মেন্টাল ইন্সটিটিউট, হ্যাঁ, বুঝছ। একটা প্রসিডিউর আছে তাই না?"



আমিও তো তাই ভেবেছিলাম। মামুনও আমাকে বার বার বলেছিল, এভাবে দেখা করতে পারবি না। বলেছিল যাতে মা-কে সরাসরি প্রশ্ন করি যে কেন উনি মিথ্যা বলেছেন আমার সাথে এতগুলো বছর ধরে। কি প্রশ্ন করবো? কি জবাব দিবে আমাকে মা? ভাবতে গিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল এই বিশাল পৃথিবীতে যেন আর একফোঁটাও অক্সিজেন নেই। এই অবস্থায় আমি আর থাকতে পারছিলাম না। তাই এখানে আসা। দেশের অন্যতম সেরা মেন্টাল হসপিটাল - মনোন্নয়ন। ওদের ওয়েবসাইটে তাই লেখা। এখানে যে কোন সুস্থ মানুষ নেই তা আমি জানি। মার ব্যাগের থেকে চাবি বের করে ছাপ নিয়ে, ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে সেই চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলে বাবার রেকর্ড ফাইলগুলো আমি দেখেছি। অদ্ভুত কিছু টার্ম লেখা ছিল সেই ফাইলে। সেগুলো নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে অনেকটা তৈরি হয়েই আমি এসেছি। মামুন আমাকে বার বার প্রশ্ন করেছে যে বাবার সাথে দেখা করে কি লাভটা হবে আমার? একটা পাগল মানুষের থেকে কীইবা জানতে পারবো আমি? ওকে কি করে বুঝাই, লাভ লোকসান পরে। বাবার সামনে আমাকে একবার দাড়াতেই হবে। জানতে হবে কি হয়েছিল ২০১০ সালের ১৫ই অক্টোবর।

"জি। তা তো অবশ্যই। কিন্তু আসলে আমি এখানে ঠিক মা-র অনুমতি নিয়ে আসি নি। উনি আসলে চাচ্ছেন না, আমি আমার বাবা-র সাথে দেখা করি।" আমি আস্তে করে টোপ ফেললাম।

মফিজের চোখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো। জিহ্বা দিয়ে চুকচুক শব্দ করতে করতে বলল, "আহহা। কি দিনকাল আইল। পোলারে বাপের লগে দেখা করবার দিতে চায় না। পাগল হউক, বাপ তো। কিন্তু এইখানে তো বাজান আমি কিছু করতে পারি না। বুঝোই তো।"

"পারেন, কেউ যদি পারে তবে সেটা আপনিই।" পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে টেবিলের উপর আস্তে করে ঠেলে দিলাম আমি, তবে ছাড়লাম না। আজকে কোচিং এ মডেল টেস্টের টাকা জমা দেয়ার কথা এই মাসের বেতন সহ। সেটা পরে হবে। আগে বাবার সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। মাকে কি বলব তাও জানি না। "এখানে পাঁচ হাজার টাকা আছে। এটা আপনার জন্য যদি আমাকে বাবা-র সাথে দেখা করার বন্দোবস্ত করে দেন।" এখনও খামটা ধরে আছি আমি।

হাতের নীচ থেকে সরসর করে সরে যাচ্ছে খামটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। এই দেশে কিভাবে কি হয় তা ক্লাস এইটের বাচ্চা ছেলেরাও জানে। "আহা, টাকা পয়সার কথা না। বুঝোই তো, পাগল মানুষ। ট্রিটমেন্টের মইধ্যে আছে। হিসাব কইরা সবাইর সাথে দেখা করানি লাগে। মাসে একবার - বেশিও না, কমও না। তা তোমার মা-তো আইসা গেল গত সপ্তাহেও। পাগলায় তো কথাই কইল না। পাগলা কওয়াতে আবার মন খারাপ কইরো না। হে হে হে। তুমি আমার ছেলের বয়সী। তোমার কাজ আমি এমনেই কইরা দিতাম। বস এইখানে, আমি ব্যবস্থা করতাসি।"

বহু কষ্ট করে হাসি হাসি মুখটা ধরে রাখলাম আমি।

---------------------------------------------

রুমটা পুরোপুরি সাদা রঙের চুনকাম করা। রুমের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিল আর দুইটা মাত্র চেয়ার। সেগুলোও সাদা রঙের। তবে আমার চোখ গেল হালকা ছাই রঙের জামা পড়ে থাকা মানুষটার দিকে। উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যিনি। বাবা।

"তোর নাম কি?" মৃদু গলায় প্রশ্ন করলেন বাবা।

আমি তখন মাত্র রুমে ঢুকেছি। নিজের আবেগের রাশ টেনে ধরে চেয়ারে বসতে বসতে আস্তে করে জবাব দিলাম আমি। "মহিবুল খান।"

"আর ডাক নাম?"

"মুকিত।"

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন বাবা। আমার দিকে তাকালেন যখন মনে হল এক স্বচ্ছ আয়নায় চোখ রাখছি আমি। এই চোখ আমার প্রতিদিন দেখা হয়। সকালে দাঁত মাজার সময়, স্কুলে বা কোচিং-এ যাওয়ার আগে চুল আঁচড়ানোর সময়। এতটাই পরিচিত। উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরার ভীষণ ইচ্ছা করলো আমার। জোড় করে নিজেকে থামালাম আমি। আমরা ছাড়াও রুমে আরও দুজন এটেনড্যান্ট আছে। কোনধরনের শারীরিক স্পর্শ যে করা যাবে না সেটা মফিজ সাহেব আমাকে খুব ভালো করে বলে দিয়েছেন। উনিও নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি জড়িয়ে ধরতে চাবো। সেটাই স্বাভাবিক।

"তুই এখানে এসেছিস কেন? তুই জানিস না আমি একজন পাগল?"

সেটা আসলে এই প্রথম মনে হল আমার। চোখের দেখায় একদম স্বাভাবিক লাগছে বাবাকে। মফিজ উদ্দিন আমারই টাকায় আমাকে আর মামুনকে পেপসি খাওয়াতে খাওয়াতে বলছিলেন যে বাবার কথা না বলার সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষ করে মা যখন ভিজিট করতে আসেন বাবা নাকি কোন কথাই বলেন না। এমনকি অনেক সময় জোড় করে দুই চোখ বন্ধ করে রাখেন। মাঝে মাঝে কথা বলেন যখন ছোট মামা আসেন দেখা করতে। সেটাও তার মেজাজ মর্জির উপর। সেখানে আমি ঢুকতে না ঢুকতেই বাবার এমন প্রশ্নবাণ... "আপনি আমাকে চিনেছেন?"

"আমার রক্ত তো। চিনেছি। তুই আমার সন্তান। আমার আর রিম-এর। মানে মরিয়মের, তোর আসল মা-র।"

"আসল মা মানে?"

"মানে, এখন তুই যার কাছে বড় হচ্ছিস, যাকে তুই মা বলে ডাকিস সে আসলে তোর মা না।"

আমার মনে হল রুমটা বন বন করে ঘুরতে শুরু করছে। "এসব মিথ্যা কথা বলবেন না।" চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি। এটেনড্যান্ট দুইজন একসাথেই নড়ে উঠলো। আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার বসলাম আমি। "একদম বাজে কথা বলবেন না মা-র সম্বন্ধে। আমি আপনার কাছে অন্য প্রসঙ্গে এসেছি। আমি জানতাম না আপনি জীবিত আছেন বা আমাকে জানানো হয় নি। আমি জানতাম অক্টোবরের ১৫ তারিখ, ২০১০ সালে আপনি গাড়িতে করে বাসায় ফেরার সময় ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। আপনি সেখানেই মারা যান। মা তখন পিছনের সিটে ছিলেন তাই বেঁচে যান, তবে মা-র মুখের এক পাশে ভাঙ্গা কাঁচ লেগে কেটে যায়। এটাই আমি জানতাম। আমিও ছিলাম গাড়িতে কিন্তু আমার কিছুই হইয় নি। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সব আঘাত থেকে বাঁচান" গরগর করে বলে চললাম আমি। "এক সপ্তাহ আগের কথা। রাতের বেলা আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি মার রুম থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে মা-র রুমে যাই কিন্তু দরজার বাইরে থেকে শুনি মা, ছোট মামার সাথে ফোনে কথা বলছেন। আপনাকে নিয়ে। আপনি যে জীবিত সেটা সেই প্রথম জানতে পারি আমি। এবং আপনি যে পাগল সেটাও।" বলতে ইতস্তত বোধ করলেও মুখ দিয়ে কথাটা বলেই ফেললাম আমি।

বাবার চোখে যেন একটু কষ্টের ছায়া পড়লো। মৃদু হেসে বললেন, "তারপর..."

"তারপর! তারপর শুনতে চাইছেন আপনি? তারপর একজন ভালো ছেলের থেকে আমার অধঃপতন। মার সিন্দুক খুলেছি চাবি বানিয়ে শুধু আপনার কথা জানতে, মার মোবাইলে অটো কল রেকর্ডার চালু করেছি আপনাকে নিয়ে কোন কথা হল কিনা শুনতে, কোচিং-এর টাকা দিয়ে ঘুষ দিয়েছি আপনার সাথে দেখা করার জন্য। এটাই তারপর।" হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম আমি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বাবার দিকে। আমার দিকেও নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন তিনি। মুখ খুললেন, যেন নিজেকেই বললেন, "তোকে আমার কিছু বলার নেই।"

"কিন্তু, আমার তো জানার আছে।" আবারও গলার পারদ উঁচুতে চড়ে গেলো আমার। "আমার জানতে হবে কি হয়েছিল অক্টোবরের ১৫ তারিখ? কি ঘটেছিল যে কারণে তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হল? কেন আমাকে বলা হল তুমি মৃত? কেন, আমাকে জানতেই হবে।"

ধীর গলায় বাবা বলতে শুরু করলেন।

"রিমের সাথে আমার বিয়েটা আমার এক দুঃসম্পর্কের চাচা ঠিক করে দিয়েছিলেন। বাবা-মা, কিংবা কাছের কোন আত্মীয় স্বজন নেই আমার, সেটা নিশ্চয়ই জানিস।" মাথা নাড়লাম আমি মৃদু। দাদাবাড়িতে কেউ নেই এটা আমি ছোট বেলা থেকেই জানি। দাদা আর দাদী মারা গিয়েছেন অনেক দিন হল। দাদা ছিলেন একমাত্র সন্তান আমার বড় দাদার, ঠিক যেমন আমি বাবা-র। বাবা বলে চলছেন, "তারপরও তখন আমি ইউএনডিপি-তে চাকরি পেয়েছি, দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমার যোগ্যতা দেখে তোর নানা আর না করেননি। রীতিমতন অনাথ আমাকে যেন ছেলে হিসেবে দত্তক নিয়েছিলেন তারা এই বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। তোর মা তখন মাত্র অনার্স শেষ করেছে, মাস্টার্সে ভর্তির আগেই চাকরি হয়ে যায় ওর। একই সাথে পড়াশোনাও চলতে থাকে। আমিও ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী ছিলাম কিন্তু আমাদের বোঝাপড়া ছিল দারুণ। প্রতিদিনই আমরা বাইরে বের হতাম হাটতে, বা রিক্সা দিয়ে ঘুরে আসতাম। লং ড্রাইভের কথাটা রিম একদিন তুলেছিল তাই এদিক সেদিক করে ব্যাংক থেকে একটা লোণ নিয়ে আমি একটা গাড়িই কিনে ফেললাম। প্রতি উইক-এন্ডেই আমরা ঢাকার বাইরে বেড়িয়ে পড়তাম। এরকম একটা ড্রাইভেই এক্সিডেন্টটা হয় আর সব পালটে যায়। দিনটা ছিল ২০১০ সালের মে মাসের ১৩ তারিখ...।"



"দাঁড়ান। দিনটা হবে অক্টোবরের ১৫। আপনি ভুল বলছেন।" আমি হাত তুলে থামালাম। বাবা এক মুহূর্ত থমকে বললেন, "আমার কোন ভুল হচ্ছে না। আগে শুনে দেখ, পরে কথা বলিস।"

কাহিনী চলতে থাকলো, "... বৃহস্পতিবার রাত। রাস্তায় একটু ভিড় বেশিই থাকে। জ্যামটা ছুটে যাওয়ার পর সাভার থেকে একটা টান দিলাম জোরসে গাড়ি নিয়ে। নতুন চালানো শিখলেও নিজের উপর আমার প্রবল আত্মবিশ্বাস। ইচ্ছে পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে রাতের খাবার খাবো। তারপর ফেরি পার হয়ে বগুড়া। দুইদিন ছুটি নিয়েছি। বেশ ঘোরাঘুরি হবে। কিন্তু, ভাগ্য আমাদের থামিয়ে দিল। মানিকগঞ্জে একটা মাইক্রো-বাসের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। দুই দিন পর আমি হাসপাতালে জেগে উঠি আর উঠেই জানতে চাই রিমের কথা। সাথে সাথেই রিম রুমে আসে আমাকে দেখতে, পাশের সীটে থেকেও অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল ও; এত বড় একটা এক্সিডেন্টে যেটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা। রিমকে দেখে চমকে উঠি আমি। এ কে? এ তো মরিয়ম না!"

আবারও। তবে কি আসলেই বাবা পাগল। মনের তীব্র ক্ষোভ, অভিমান, আবেগ সব কানা হয়ে চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। কিন্তু, মা বলে ছেলেদের এভাবে কাঁদলে হয় না। তাদের অনেক শক্ত মনের মানুষ হতে হয়। নিজেকে সামলে উঠলাম। বাবার রোগের ব্যাপারে ফাইলে লেখা ছিল প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার। ব্রাকেটে লেখা ক্যাপ-গ্রাস ডিল্যুশন। এটা নিয়ে অনেক পড়েছি আমি এই কয় দিনে। জানি অনেক কিছুই। বাবার কথা তাই কান দিয়ে ঢুকছে কিন্তু কিছু যেন শুনছি না আমি।

"...মরিয়মের সাথে বিয়ের তিন বছর হয়ে গিয়েছে ততদিনে। খুব ভালো করেই তাকে চিনি। তোর বয়স তখন মাত্র দুই মাস। তোর আসল মার সাথে এই নতুন মেয়েটার অনেক কাজ মিললেও কিছু জিনিস মিলছেই না। তোর মা চোখে রিম-লেস চশমা পড়তো, এই মেয়েটা লেন্স পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করলে বলল এক্সিডেন্টের পর থেকে নাকি কাঁচের চশমা পড়তে তার খুব ভয় হয়। তোর মার চুল ছিল অনেক লম্বা, খুব শখেরও ছিল। কিন্তু এই মেয়েটা একদিন হঠাৎ ববকাট করে আসলো চুলগুলো। আমাকে বলল আমিই নাকি এটা করতে বলেছিলাম কিছুদিন আগে। অথচ আমি কিছুই জানি না। আচ্ছা, এগুলো না হয় ছোট খাটো বিষয়। ওর গায়ের কাপড়ের মাপ মিলছিল না কেন তাহলে। অনেকগুলো নতুন কাপড় কিনতে দেখলাম একদিন, বলল পুরনোগুলো আর গায়ে লাগছে না। হাই হিল পড়া ছেঁড়ে দিল। এভাবে কয়েক মাস যায় আর আমি নিশ্চিত হতে থাকি আমার সন্দেহের ব্যাপারে।" বাবা থামলেন। একজন এটেনড্যান্টকে হাতের ইশারা করাতে সে বাইরে বের হয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো, সেই সাথে পকেট থেকে দুই তিনটে ওষুধ বের করে দিল।বাবা ওষুধগুলো মুখে দিয়ে আগে গিলে ফেললেন, এরপর পানিটা এক ঢোকে শেষ করলেন। চমকে উঠলাম আমি। এটা তো আমি করি। মা হাজার বকেও পাল্টাতে পারেননি। পানি দিয়ে ওষুধ খেতে গেলেই মুখে থেকে যায় আমার। শুধু এক এভাবেই খেতে পারি আমি।

পানি খাওয়া শেষে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "কোথায় যেন ছিলাম?" আমি কিছু বলার আগেই মনে পড়লো বাবার, "হ্যাঁ। আরও কিছু জিনিস দেখলাম আমি। এক্সিডেন্ট বা ঐ দিনের ঐ নির্দিষ্ট সময়ের কোন কিছুই মেয়েটা ঠিক করে বলতে পারে না। জিজ্ঞেস করলে বলে তার মনে নেই। যেই মেয়ের সাথে তিন বছরে আমার কোন কথা কাটাকাটি হয় নি, তার সাথে এখন প্রতিদিন ঝগড়া হয়। গাড়ির ইনস্যুরেন্স ক্লেইম করে পেয়ে আবারো গাড়ি কিনেছিলাম আমি। কিন্তু এবার একদিনও বাইরে লং ড্রাইভে নিতে পারলাম না রিমকে। বলতো তার নাকি খুব ভয় করে। খুব মেধাবী মেয়ে ছিল অথচ দেখলাম পড়াশোনাই করছে না আর, এককথায় বলল ভালো লাগছে না করতে। খুব পজিটিভ মেয়ে ছিল মরিয়ম, তোর আসল মা। কিন্তু, এই মেয়েটা কথায় কথায় বলতো তার জীবনে আর কিছু হবে না। সে একটা ফেলিওর। তোকে জন্ম দিয়েও ভুল করেছে সে। এমনকি নিজেদের বাসায় বেড়াতে যেতেও চাইতো না সে, নিশ্চয়ই ভয় করতো বাবা-মা, ওর এই নকল সেজে বসে থাকাটা ধরে ফেলবেন। অক্টোবরের ১০ তারিখ। আমি রুমে ঢুকে দেখি তোর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। এর মধ্যে তোকে দুধ খাওয়ানোও বন্ধ করে দিয়েছিল। আসল মা তো না। খাওয়াবে কি করে..."

অসম্ভব। নিশ্চয়ই কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। হাত পা থরথর করে কাঁপছিল আমার। আমার চোখ দিয়ে এবার দরদর করে পানি পড়তে থাকলো। বাবা সেদিকে দেখেও না দেখার ভান করে বলতে থাকলেন, "সারারাত তোকে কোলে করে বসে থাকলাম আমি। সকাল হতেই সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে সম্ভব নয়। আমার সন্দেহগুলো সবার কাছে প্রকাশ করতে হবে। খুলে দিতে হবে এই ধোঁকাবাজের মুখোশ। তাই, ১৩ তারিখ বাবা-মা আর তোর ছোট মামাকে বাসায় আসতে বললাম। জরুরী কথা আছে আর রিমকে যাতে না জানানো হয় এ কথাও বললাম। যেই মেয়েটা একবার আমাকে বলেছিল কোনদিন ডেলিভারির সময় সমস্যা হলে যেন আমি অবশ্যই বাচ্চাটাকে বাঁচাই, নিজের মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল সেই কথা - তার এভাবে তোর দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছিল তোকে খুন করে ফেলতে চায় সে। আমি সেটা হতে দিব না।"

বাবা একটু থেমে যেন স্মৃতিটা আবার ঝালাই করে নিলেন, "কিন্তু যেরকম ভেবেছিলাম তার কিছুই হল না। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না আমার কথা। সবাই আমাকে বলতে থাকলো যে আমার কোন ভুল হচ্ছে। এক পর্যায়ে বলল রিম নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ। এক্সিডেন্টের পর থেকে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগছে। আমি বুঝতে পারলাম, এরকম হতে পারে ভেবে আগেই নিজের সাফাই গেয়ে রেখেছে মেয়েটা। সেই সাথে নিশ্চয়ই নকল ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেখিয়ে সবাইকে বোকা বানিয়েছে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এই মেয়েটাকে মেরে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হবে। আসল রিম, তোর মা আবার ফিরে আসবে আমার জীবনে। আর তাই, ফল কাটার ছুড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি মেয়েটার ওপর। কিন্তু মেরে ফেলার আগেই সবাই আমাকে ধরে ফেলে। আমার মাথায় একটা ফুলদানি দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিল তোর মামা। জেগে দেখি আমি হাসপাতালে, সেখান থেকে এই পাগলাগারদে। অথচ আমি পাগল না। বিশ্বাস কর আমি পাগল না।"

"আপনি পাগল।" চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আর সহ্য হচ্ছিল না। "আপনি পাগল, পাগল, পাগল।" ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলাম আমি। ভুল হয়েছে এখানে আসাটা। খুব ভুল হয়েছে। মা-র কথাই ঠিক। আমার বাবা আসলে মৃত। পিছনে ধস্তাধস্তির শব্দে ফিরে তাকালাম একবার। বাবা উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে আসতে চেয়েছিলেন। এটেনড্যান্ট দুইজন দৌড়ে এসে আটকিয়েছে। জাপটে ধরে রেখেছে বাবাকে। বাবা ঐ অবস্থায় হাউমাউ করে বলছেন, "ঐটা তোর মা না। তোকে মেরে ফেলবে ঐ মেয়েটা। তোর মা না, ঐটা অন্য কেউ। বিশ্বাস কর ঐটা তোর মা না।" দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম করিডোরে। মার কাছে অনেক ক্ষমা চাওয়ার আছে আজ আমার।

---------------------------------------------

"...অনুসন্ধানে জানা যায় যে খুনি মহিবুল খান (১৪) গতকাল রাত আনুমানিক দেড় ঘটিকার দিকে তার মা মরিয়ম খান (৩৯) - কে একটি ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, খুন করার পর মহিবুল নিজেই ধানমন্ডি থানায় ফোন দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে মহিবুলকে খুনের অস্ত্র হাতে বাসার ড্রইং রুমে বসে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার করে। মরিয়মকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃতের দেহে উপর্যুপরি দেশী অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ কালে মহিবুল ক্রমাগত বলতে থাকে, "এই মহিলা আমার মা নন। আমার বাবা এই ব্যাপারে সব জানেন। উনি আপনাদের বুঝিয়ে বলতে পারবেন।" এ বিষয়ে একটি মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। মৃত মরিয়ম খানের ছোট ভাই মোহাইমেন চৌধুরীর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, "মরিয়মের স্বামী একজন মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি। সে বর্তমানে মনোন্নয়নে চিকিৎসাধীন আছে, প্রফেসর আনোয়ারা বেগমের অধীনে।" প্রফেসর আনোয়ারা বেগমকে ফোন করলে তিনি তার রোগীর ব্যাপারে কোন তথ্য প্রকাশে অপারগতা জানান। তবে আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে, খুনি মহিবুলের পিতা মাসুদ খান (৪৪) পূর্বেও মৃত মরিয়ম খানের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে মানসিক রোগী প্রতিপন্ন হন ও মনোন্নয়নে অন্তরীন অবস্থায় তার চিকিৎসা চলছে। তিনি দাবী করতেন মৃত মরিয়ম খান তার প্রকৃত স্ত্রী নন...।"

অক্টোবর ১৬, ২০১৮ সালের দৈনিক মানুষ্যজমিন হতে সংগৃহীত খবরের অংশবিশেষ

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:১২

রাজীব নুর বলেছেন: ভয়াবহ।

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:১৩

অজ্ঞ বালক বলেছেন: ভয়াবহ হওয়াটাই স্বাভাবিক B-)

২| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৫

করুণাধারা বলেছেন: বুঝলাম না, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন, নাকি কল্পনা?

যাই হোক গল্পটা চমৎকার হয়েছে, রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম।

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০৯

অজ্ঞ বালক বলেছেন: ইয়েস। =p~ আপনার মতন পড়ুয়ারে যদি তাক লাগাইয়া দিবার পারি তো গল্প লেখা সার্থক। সত্যি না। কল্পনা। আপনার মন্তব্যে আসলেই অনুপ্রাণিত হইলাম। ধইন্যবাদ। :-B

৩| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০৯

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: পৃথিবীটা দিন দিন ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুর হচ্ছে।এভাবে একদিন ইহার ধ্বংস ঘটবে।

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১৩

অজ্ঞ বালক বলেছেন: বুঝতে পারসি আপনার মন্তব্যের কারন তবে আমার লেখার এসপেক্ট সোশাল ছিল না, ছিল সাইকোলজিকাল। সেইটা মনে হয় ক্লিক করে নাই। :| উপরে করুনাধারার কমেন্টেও মনে হইতাসে সোশাল ফিকশন হইয়া গেসে। কেমনে কি? হতাশ হইয়া গেলাম আবারও। :(

৪| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১৩

পবিত্র হোসাইন বলেছেন: ওরে বাবা !!!
মাথার উপ্পে দিয়ে গেল !! #:-S

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৭

অজ্ঞ বালক বলেছেন: একটা লাফ দেন। হাটুতে ব্যাথা থাকলে একডা মোড়া নিয়া আইসা উইঠা দাড়ান। মাথার মইধ্য দিয়া যাইবো। =p~ মন্তব্যের জন্য ধইন্যবাদ ভ্রাতা।

৫| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৫

বলেছেন: বাউরে!! আন্নে তো দেহি ঘাগু গল্পকার!!


টানটান উওেজনায় ভরপুর গল্পে ++++


শুভ কামনা --

পর্ব আকারে দিলে সবাই পড়তে পারতো।।

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১:৫৯

অজ্ঞ বালক বলেছেন: বাউরে বাউ!!! যেই প্রশংসা কইচ্ছেন, আগামী তিনদিন আর কিছু খাওয়া লাগতো না। পেট ভরি গেছে। মনও। ধইন্যবাদ ভ্রাতা। আর ঐ পর্ব আকারে দিলে আমিই লেখার আগ্রহ হারাইয়া ফালাইতাম। শেষ করতে আর পারতাম না।

৬| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:২২

এম.জে. রহমান বলেছেন: ভালো লেখা তবে অনেক দীর্ঘ।

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ২:০০

অজ্ঞ বালক বলেছেন: ভালো লেখা দীর্ঘ হইতে হয়। নিয়মে আছে। যেমন আন্না কারেনিনা, ওয়ার এন্ড পিস ইত্যাদি ইত্যাদি। আমারটাও সেই লেভেলের লেখা তো তাই।

৭| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৭:৪১

কিশোর মাইনু বলেছেন: ওয়াও।
অসাধারণ গল্প।
শুরুর দিকে সত্যি ই মনে করেছিলাম।
কমেন্ট পড়ে বুঝলাম, এটা গল্প।
অসাধারণ ভাই।।।
চালিয়ে যান।

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:৫৪

অজ্ঞ বালক বলেছেন: ধইন্যবাদ ভ্রাতা। সবাই এইডারে সত্যি ভাবাতে আমারও টেনশন হইতাসে। অক্টোবরের ১৬ তারিখের পেপারগুলা খুঁইজা দেখতে হইবো!!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.