নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আসলে একজন ভীষণ খারাপ মানুষ। তবে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে দুর্দান্ত অভিনয় করতে পারি বলে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। সে হিসাবে আমি একজন তুখোড় অভিনেতাও বটে!!!

অজ্ঞ বালক

ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলো কুড়িয়ে এখানে নিয়ে এসে ছুঁড়ে ফেলা হয়!!!

অজ্ঞ বালক › বিস্তারিত পোস্টঃ

মহাভারত - প্রথম অংশ: পূর্বপুরুষগণ (১)

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:০৯

"রাজা জন্মেজয়, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। পুনরাবৃত্তি ঘটে চলে একই ঘটনার, বার বার। আপনার বংশের ইতিহাসেই এই কথার প্রমাণ রয়েছে।"

০১ - চন্দ্রবংশ

একজন ব্যক্তি যদি তার জীবনকালে যথেষ্ট পরিমাণে পুণ্য অর্জন করে থাকে তবে মৃত্যুর পর সে দেবতাদের চিরকালীন আবাসস্থল - পুণ্যলোক স্বর্গে প্রবেশ করতে পারে। স্বর্গকে সেখানে বসবাসকারী দেবতারা ডাকেন অমরাবতী নামে। সেখানে কোন দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুই নেই। সব স্বপ্নই সেখানে সত্যি হয়ে যায়, মনের সকল আশা সেখানে পূর্ণ হয়ে যায়।

এই অক্ষয় সুখের স্থান, স্বর্গ, নিজেদের অধীনে রাখার জন্য দেবতারা নিয়মিত নিজেদের চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী অসুরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার শক্তি দেবতারা পান যজ্ঞ থেকে। আর দেবতাদের জন্য সেই যজ্ঞ পালন করেন দেবগুরু বৃহস্পতি। তার পাশে বসে বৃহস্পতির স্ত্রী, দেবী তারা, লক্ষ্য রাখেন যাতে এই যজ্ঞ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, সফল হয়।

কিন্তু, একদিন তারা বৃহস্পতিকে ছেঁড়ে চন্দ্রদেবের সাথে পালিয়ে গেলেন। কাঠখোট্টা, আবেগ-বিবর্জিত বৃহস্পতির সাথে আর মানিয়ে উঠতে পারছিলেন না তারা। বৃহস্পতির ধ্যান-জ্ঞান বলতে শুধু যজ্ঞ, আচার, রীতি-নীতি। তাই, প্রেমিক চন্দ্রের অমোঘ ভালোবাসার টানে তিনি ঘর ছাড়লেন।

দেবরাজ ইন্দ্রকে ডেকে বৃহস্পতি নিজের দাবী স্পষ্টভাষায় বলে দিলেন, "যদি চাও আমি তোমাদের হয়ে যজ্ঞ করি, যদি চাও সেই যজ্ঞ সফল হোক আর তোমরা স্বর্গে রাজত্ব করতে থাকো, তবে এখনি তারা-কে ফিরিয়ে আনো আমার কাছে।

দেবতারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেন। কিন্তু, কিছুতেই সবাই একমত হতে পারছিলেন না। তারা-কে কি জোড় করে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে আনা উচিত? সেই স্বামী যে তারা-কে চাচ্ছে শুধুমাত্র তার যজ্ঞ পালন করতে একটু সুবিধা হয় বলে? নাকি তারাকে তার প্রেমিক চন্দ্রের সাথেই থাকতে দেয়া উচিত? যেই চন্দ্র তারাকে সেই জিনিস দিয়েছে যা দেবী কিংবা মানবী সকলেরই একান্ত কাম্য - ভালোবাসা? অনেক তর্ক-বিতর্ক শেষে দেবতারা সিদ্ধান্ত নিলেন: তারার নিজের খুশীর চাইতে, যজ্ঞ হওয়া আর স্বর্গের অধিকার নিজেদের দখলে রাখাটাই বেশি জরুরী। কারণ যজ্ঞ না হলে, দেবতারা যে শুধু অসুরদের সাথে লড়াইয়ে আর পেরে উঠবেন না, তা নয়। যজ্ঞের শক্তি ব্যতীত, পৃথিবীতে আলো, বৃষ্টি, সুখ, সমৃদ্ধি কিছুই থাকবে না। থাকবে শুধু অন্ধকার, খরা, দুঃখ আর অনটন। কাজেই, তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরে আসতে হবে। এটাই দেবতাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই তারাকে ফিরে আসতে হলো। কিন্তু, ফিরে আসা তারাকে দেখে সবাই হতবাক। তারা যে সন্তানসম্ভবা! চন্দ্র আর বৃহস্পতি - দুইজনই তারার গর্ভে থাকা শিশুর পিতা হওয়ার দাবী করলেন। কিন্তু, তারা এই ব্যাপারে একেবারেই নীরব থাকলেন। তিনি কিছুতেই জানাতে চাচ্ছিলেন না যে তার গর্ভে থাকা শিশুর পিতা আসলে কোনজন? এমন সময় সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে তারার গর্ভ থেকে জন্মপ্রত্যাশি শিশুটি বলে উঠলো, "মা, আমাকে বলুন, কে আমার পিতা? আমি জানতে চাই। সত্য জানতে চাওয়াটা আমার অধিকার।"

এই অভূতপূর্ব ঘটনা দেখে সকলেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। শিশুটির সত্য জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সকলকে মুগ্ধ করলো। দেবতারা ঘোষণা দিলেন এই শিশু বড় হয়ে বুদ্ধির নিয়ন্ত্রক হবে, সত্যকে মিথ্যা হতে পৃথক করতে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে মানুষদের সহায়তা করবে। তার নাম হবে বুধ।

নিজ সন্তানের এই জিজ্ঞাসা তারাকে মুখ খুলতে বাধ্য করলো। তিনি নতমস্তকে বললেন, "প্রিয় সন্তান, চন্দ্রদেবই তোমার পিতা।"

ক্রোধ বৃহস্পতিকে অন্ধ করে তুলল, রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি চিৎকার করে অভিশাপ দিলেন, "চন্দ্র আর তারার অবৈধ ভালোবাসার চিহ্ন এই সন্তান ক্লীব হয়ে জন্মাবে। সে পুরুষও হবে না, হবে না কোন নারী।"

এই নিষ্ঠুর অভিশাপ শুনে দেবতারাও আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। দেবরাজ ইন্দ্র বলে উঠলেন, "বৃহস্পতি, যেই সন্তানকে আপনি আজ অভিশাপ দিলেন, সেই সন্তান কিন্তু আপনার পরিচয়েই সকলের নিকট পরিচিত হবে। চন্দ্র তার পিতা নয়, তার পিতা আপনি - বৃহস্পতি। জমিতে বীজ বপন যেই করুক না কেন, ফসলের উপর অধিকার থাকে শুধুমাত্র জমির মালিকের। আপনিই শাস্ত্রমতে তারার স্বামী। কাজেই বিবাহের আগে ও পরে, আপনার দ্বারা বা অন্য কারোর দ্বারা, তারার গর্ভজাত সকল সন্তানের পরিচয় হবে একটাই। বৃহস্পতির সন্তান।"

একসময় তারা জন্ম দিলেন বুধ-কে। না-পুরুষ, না-নারী, আবার দুইয়ের মিশ্রণে এক অদ্ভুত সৃষ্টি। আসলে আবেগপ্রবণ চন্দ্রের বংশধর হলেও, দেবরাজ ইন্দ্রের কারণে সে বড় হতে থাকলো যুক্তিবাদী বৃহস্পতির ঘরে।

সেই দিন থেকেই, স্বর্গ ও মর্ত্যে আইনের প্রচলন শুরু হল। আইন তার জায়গায় সর্বদা স্থির থাকবে। যেটা দেখতে বা শুনতে সঠিক মনে হচ্ছে, আইন, নিয়ম বা প্রথা যদি তাকে অন্যায়, অনুচিত বলে রায় দেয় তবে সেটাই মেনে নিতে হবে। বিয়েই নির্ধারণ করবে সন্তানদের পরিচয়। আর একারণেই জন্মেজয়ের প্রপিতামহ অর্জুনকে পাণ্ডব বলে অভিহিত করা হবে। অথচ, সকলেই জানতো যে রাজা পাণ্ডু সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন।

০২ - বুধের অর্ধাঙ্গিনী

বুধ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগলো। মাঝে মাঝেই তার মনে হতো, আদৌ কি সে কখনো কাউকে খুঁজে পাবে যাকে সে বিয়ে করতে পারবে? আর বিয়ে করবেই বা কাকে? সে কি পুরুষ হবে? নাকি নারী? তারা সবসময়ই জোর দিয়ে বুধকে বলতেন, "তোমারও বিয়ে হবে, সংসার হবে। এ নিয়ে এত চিন্তা করো না।"

"কিন্তু, কিভাবে সেটা সম্ভব হবে মা? আমি কি স্বামীর খোঁজ করবো নাকি স্ত্রীর? আমি তো পুরুষ নই, নই নারী? কার সাথে বিয়ে হবে আমার?"

"ভাগ্য যার সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে তার সাথেই হবে," তারা নিষ্কম্প কণ্ঠে বলতেন। "সব ঘটনার পিছনেই কারণ থাকে। তোমার পিতা যে অভিশাপ দিয়েছেন, নিশ্চয়ই তার পিছনে কোন দৈব-সংযোগ আছে। কারণ ছাড়া সেটা ঘটে নি। কাজেই নিশ্চিন্ত থাকো। দেখবে, সব ঠিক ঠিক মিলে গিয়েছে।"

আর, তারার কথাই ঠিক হলো। বুধ একদিন ইলা নামের এক রমণীকে দেখে প্রেমে পরে গেলেন।

কিন্তু, ইলা আদতে নারী ছিলেন না। তার প্রকৃত পরিচয় হলো তিনি মানবজাতির প্রথম রাজা মনুর (বৈবস্বত মনু) পুত্র, যুবরাজ সুদ্যুম্ন।

একদিন সুদ্যুম্ন শিকার করতে এক বনে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু সেই বন ছিল মহাদেবের মন্ত্র-আরোপিত বন। তার মন্ত্রবলে সেই বনের সকল পুরুষ প্রাণীর লিঙ্গ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সিংহ হয়ে গিয়েছিল সিংহী, হরিণ হয়ে গিয়েছিল হরিণী। শিব তার স্ত্রী শক্তিকে খুশী করতে এই বনের উপর এমন মন্ত্র পড়েছিলেন। আসলে এই বনে, শক্তি আর শিব বিশ্রাম নিতেন, মিলিত হতেন। আর শক্তি চাইতেন না সেই সময় কোন পুরুষ, তা সে মানুষই হোক বা অন্য কোন জন্তু-জানোয়ার, এসে তাদের বিরক্ত করুক। সুদ্যুম্ন যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি তার পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলেছেন, তিনি দেবী শক্তির নিকট তার এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি চেয়ে ধ্যান শুরু করলেন। কিন্তু দেবী বিনয়ের সাথে বললেন, "দেবাদিদেব শিবের মন্ত্র বিনষ্ট করা আমার সাধ্যের অতীত, তবে আমি এই মন্ত্রে কিছুটা পরিবর্তন করে দিচ্ছি। এখন থেকে শুধুমাত্র রাতের বেলায় তুমি নারী হয়ে থাকবে আর দিনের বেলায় তুমি তোমার পুরুষাকৃতি ফিরে পাবে।"

কাজেই সুদ্যুম্নের জন্য উপযুক্ত সঙ্গী ছিল বুধ। বুধ পুরুষও ছিল না, নারীও ছিল না। আবার সুদ্যুম্ন একই সাথে পুরুষ ছিল, আবার নারীও ছিল। বুধ আর ইলার অনেক সন্তানাদি হয় যাদেরকে ইলার গর্ভজাত কিংবা আইলা বলা হয়। তাদের তুলনামূলক সু-প্রচলিত নাম হচ্ছে চন্দ্রবংশীয়, চন্দ্রের বংশধর - যদিও এই নামকরণ নিয়ে বৃহস্পতি কিংবা দেবতারা কেউই সন্তুষ্ট ছিলেন না। আর এই নামের সাথে সাথেই এই বংশের রাজাদের মধ্যে সহজেই আবেগপ্রবণ হয়ে যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার একটা ধারা শুরু হয়, ঠিক চন্দ্রদেবের মতন।

একসময় চন্দ্রবংশীয়রা নিজেদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ভুলে যাবে। ভুলে যাবে যে তাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা বুধ পুরুষ বা নারী কিছুই ছিলেন না, কিংবা ইলাই যে সুদ্যুম্ন ছিলেন ভুলে যাবে তাও। অর্জুনের শ্যালক শিখণ্ডিকে তারা উপহাস করবে। তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে কারণ সে ক্লীব। অথচ সেই শিখণ্ডীই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পান্ডববাহিনীর রক্ষাকর্তা হয়ে আবির্ভূত হবেন। এটাই মানবজাতির স্বভাব, তাদের নিজেদের তৈরি করা নিয়মের জালে তারা আটকে যায়। তারা অতীতকে ভুলে যায়, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যায়।

০৩ - প্রণয়াসক্ত পুরুরবা

চন্দ্রবংশীয় রাজা পুরুরবা একদিন উর্বশী নাম্নী এক রমণীকে নদীতে স্নানরত অবস্থায় দেখলেন। রাজা জানতেন না যে উর্বশী একজন অপ্সরা ছিল, দেবলোকেই যার বসবাস। কালেভদ্রে মর্ত্যলোকে আগমন করে আবার দেবলোকে ফিরে যায় উর্বশী। উর্বশীকে দেখে রাজার মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলেন। অবশ্য রাজার দোষ দিয়ে লাভ নেই। উর্বশীর সৌন্দর্য সুবিদিত ছিল। উর্বশী যখন হেঁটে যেত, জঙ্গলের সকল প্রাণীরাই তাদের স্বাভাবিক সব কাজ ফেলে উর্বশীকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। শিকারি প্রাণীরা শিকারকে হাতের কাছে পেয়েও ভুলে যেত বধ করার কথা, মাছেরা ভুলে যেত সাঁতার কাটার কথা, পাখিরাও গাছের ডালে বসে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকতো। চলার পথে থাকা প্রতিটি ঘাস, তৃণলতা, ঝোপের পাতা, গাছের ডাল ঝুঁকে এসে একটু স্পর্শ করতে চাইতো উর্বশীকে।

পুরুরবা উর্বশীর প্রেমে পড়ে গেলেন। তিনি সটান উর্বশীর কাছে গিয়ে বললেন, "প্রিয়, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি রাজা পুরুরবা তোমাকে অনুরোধ করছি, আমার রানী হয়ে আমার জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোল।"

উর্বশী খেলাচ্ছলে পুরুরবাকে বলল, "নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে, সেগুলো পূরণ করতে পারলে আমি আপনার রানী হয়ে আপনার প্রাসাদেই থাকবো আজীবন। প্রথমত, আমার কিছু পোষা ছাগল আছে। আপনি আমাকে কথা দিন যে আপনি তাদের দেখে-শুনে রাখবেন। তাদের ভালো মন্দ দেখার ভার আপনার, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বও আপনার। আর দ্বিতীয়ত, আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি যেন কখনো আপনাকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে না পারে সেটার নিশ্চয়তাও আমাকে আপনার দিতে হবে।" উর্বশীকে হতবাক করে দিয়ে রাজা এই দুই শর্তেই রাজি হয়ে গেলেন। কাজেই, উর্বশীও তার প্রতিশ্রুতি মতন রাজা পুরুরবাকে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে থাকতে শুরু করলো।

স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীর জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল, এবং এই নতুন জীবনে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছিল সে। রাজা পুরুরবা আর উর্বশীর অনেক সন্তান-সন্ততি হয়।

কথায় আছে, একজন মানুষের সমস্ত জীবনের ব্যাপ্তি নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের এক পলক ফেলার সময়ের সমান। কিন্তু, সেই ইন্দ্রই তার প্রিয় অপ্সরা উর্বশী থেকে দূরে থাকার বিরহ সহ্য করতে পারছিলেন না। কাজেই তিনি তার সভার গন্ধর্বদের আদেশ করলেন, উর্বশীকে অমরাবতীতে ফিরিয়ে আনার জন্য।

পুরুরবা আর উর্বশী যখন রমণে ব্যস্ত ছিলেন, সেই মোক্ষম অসতর্ক মুহূর্তে গন্ধর্বরা উর্বশীর পোষা ছাগলগুলোকে চুরি করে পালিয়ে যেতে থাকলো। উর্বশী ঐ অবস্থাতেও লক্ষ্য করলেন যে গন্ধর্বরা তার প্রিয় ছাগলগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি শশব্যস্ত হয়ে পুরুরবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "স্বামী, তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো। ফিরিয়ে আনো ঐ দুষ্ট গন্ধর্বদের কাছ থেকে আমার ছাগলগুলোকে।"

পুরুরবা সাথে সাথেই বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে গন্ধর্বদের পিছু নিলেন ছাগলগুলোকে উদ্ধার করে আনার জন্য। এত ডামাডোলের মধ্যে তার এটাই মনে থাকলো না যে, তিনি একটা সুতাও গায়ে না জড়িয়েই বের হয়ে যাচ্ছেন। এদিকে পুরুরবা প্রাসাদ থেকে বের হয়ে চোরদের পিছু পিছু ছুটছেন। বাইরে তখন অন্ধকার রাত, কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র প্রস্তুত ছিলেন। তার হাত থেকে ছুটে আসা বজ্র রাতের আকাশকে দিনের মতন উজ্জ্বল করে তুলল। আর সকলেই সেই আলোতে রাজা পুরুরবাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেখতে পেল। কাজেই, ইন্দ্র সুনিপুণ চতুরতায় পুরুরবার করা দুইটা অঙ্গীকারই ভেঙ্গে ফেললেন। উর্বশীও তার দেয়া শর্তভঙ্গের কারণে বাধ্য হল মর্ত্যধাম থেকে দেব-সভায় ফিরে যেতে।

উর্বশী বিহনে পুরুরবা পাগলপ্রায় হয়ে পরলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, তিনি স্থির চিত্তে রাজ্য পরিচালনা করতে পারছেন না। তার প্রেম এমনই গভীর ছিল যে উর্বশীকে হারিয়ে তিনি একজন রাজা নন, বিরহকাতর প্রেমিকে রূপান্তরিত হলেন। অবস্থা দেখে, ঋষিরা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন। তারা পুরুরবাকে সরিয়ে তার একজন যোগ্য পুত্রের নিকট রাজ্যের শাসনভার প্রদান করলেন।

কেউ কেউ বলে, পুরুরবা এখনও বনে জঙ্গলে কেঁদে কেঁদে উর্বশীকে খুঁজে বেড়ান। আবার অনেকে বলে, উর্বশী পুরুরবাকে একজন গন্ধর্বে রূপান্তরিত করে নিজের সাথে দেবলোকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যখন দেব-সভায় উর্বশী গান গাইতে থাকেন, কিংবা নৃত্য প্রদর্শন করেন - তখন পুরুরবাও সেখানে থাকেন, উর্বশীর চির-সঙ্গী হয়ে।

পুরুরবার মতন এমন গভীর প্রেম, সুতীব্র আবেগ, প্রেমিকা-বিহনে চিত্তবিকলন অনেক বছর পর চন্দ্রবংশের আরেক রাজা শান্তনুর মধ্যেও দেখা যাবে। তাও সেটা একবার নয়, দুই দুইবার। শান্তনু প্রথমে গঙ্গার প্রেমে পরবেন, আবার পরবর্তীকালে পরবেন সত্যবতীর প্রেমে। আর এই দুই রমণীকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছার প্রভাবে ভাগ্য-রথের চাকা এমনভাবে ঘুরবে যার ফলে ভারতবর্ষের ইতিহাস পালটে যাবে চিরকালের জন্য। মানুষের স্মৃতি এক অদ্ভুত জিনিস। সে ইতিহাস পড়ে, কিন্তু মনে রাখে না। ভুলে যায়, ইতিহাস যে বার বার ফিরে আসে।

(চলিতেছে...)

শুরুর কথা পড়ে আসুন এখান থেকেঃ মহাভারত - পূর্বকথাঃ সর্পযজ্ঞ

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৩৭

রাজীব নুর বলেছেন: খুব বেশি প্যাচালো কাহিনি।

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪২

অজ্ঞ বালক বলেছেন: শুরুতেই এই কথা কইলে শেষে কি কইবেন আল্লাহ মালুম!!!

২| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪৯

ঘুটুরি বলেছেন: অনবদ্য। মনে হোলো লেখাটা এখানে কেন শেষ হয়ে গেল। ধন্যবাদ দারুন একটা লেখা উপহার দেবার জন্য।

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৫৬

অজ্ঞ বালক বলেছেন: শেষ হয় নাই আসলে। প্রথম অমগশ একসাথে বিশাল। ব্লগে একবারে দেয়ার মানে হয় না। তাই ভাইঙ্গা দিলাম। ধন্যবাদ।

৩| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:০৪

ঘুটুরি বলেছেন: না ভাই, আমি আসলে শুধু এই পর্বটার কথা বিবেচনা করে বলেছিলাম যে কেন এত দ্রুত শেষ হয়ে গেল। (আসলে চাই, আরো পর্ব চাই), ভালো লাগা থেকেই বলেছি। গরম গরম লেখা পড়ে এখন লোভ লেগে গেছে। যদিও কথায় আছে “ লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু” তবে লেখাপড়ায় কোনো পাপ নাই

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:০৮

অজ্ঞ বালক বলেছেন: হা হা হা। আসলেই পাপ নাই। আমার লেখার অপেক্ষা না করে আলাদাভাবে অনেকের লেখাই পড়োতে পারেন। গজেন্দ্রকুমারের 'পাঞ্চজন্য' বা নৃসিংহ ভাদুরি এই বিষয়ে তুখোড় লেখতেন। আর আমি তো চালাইতাছিই ঠেলাগাড়ি। চলবে।

৪| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: বেশ, ভালো লাগলো ।

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:১৮

অজ্ঞ বালক বলেছেন: ধন্যবাদ। ভালো লাগাটাই আসল ব্যাপার।

৫| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৪৮

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: শুরুতেই এই কথা কইলে শেষে কি কইবেন আল্লাহ মালুম!!!

মহাভারত আমি বুঝি না।

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:২০

অজ্ঞ বালক বলেছেন: এইডা কোনো কথা কইলেন। ধর্মগ্রন্থ না হোক, একটা সাহিত্যকর্ম হিসাবেও কইলাম এই বইটা টপ কোয়ালিটির। থ্রিল আছে, রোমান্স আছে, একশন আছে, টুইস্ট আছে, এডভেঞ্চার আছে - কঠিন জিনিস।

৬| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:১৬

রাশিয়া বলেছেন: মহাভারতের কাহিনী সম্পর্কে অবগত হবার জন্য প্রথমে সুকুমার রায়ের 'ছেলেদের মহাভারত' পড়ে ফেলা ভাল। সব ধরণের অশ্লীল আর ব্যাভিচার বাদ দিয়ে কেবল কাহিনীটাকে সেই বইয়ে তুলে আনা হয়েছে। ইন্ডিয়াতে খুব রিসেন্টলি জি বাংলায় মহাভারত নিয়ে একটি সিরিয়াল প্রচারিত হয়েছে। সেটিও মহাভারত সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা দেয়।

তবে একটা জিনিস ক্লিয়ার করুন। কুরুক্ষেত্রের ধর্ম যুদ্ধে পরাজিত কৌরবরা কেন স্বর্গবাসী হল আর ধর্মের পক্ষে থাকা পান্ডবেরা কেন নরকে গেল, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:৪৬

অজ্ঞ বালক বলেছেন: অশ্লীলতা আর ব্যভিচার বাদ দিছে দেইখাই সেইটা গ্রহণযোগ্য না। কিছুর থেইকা ভালোটাই নিব, খারাপটা ছুমু না এইডা হয় না। আর সুকুমার না, লিখসেন উপেন্দ্রকিশোর। তার বাবা। সিরিয়াল দেখি না, কাজেই জানি না তবে রামানন্দ সাগরের আদি সিরিয়ালের তো প্রচুর সুনাম শুনছিলাম।
যেইটা একটা প্রধানতম টুইস্ট সেইটা এখানে কইলে চলবো নাতো রাশিয়া সাহেব।

৭| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৩২

নীল আকাশ বলেছেন: আমি আগেই বলেছি আপনার এই বিষয়ে লেখার হাত ভালো। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেছি।
পোস্টে লাইকড। পুরো মহাভারত শেষ না করে পোস্ট দেয়া বন্ধ করবেন না।
তারা'র পরকীয়ার কাহিনী আরেকটু বড় করে দিতে পারতেন। উবর্শী কে ছিল সেটা আসাদ ভাইইয়ের পোস্ট বর্ননা আছে। অহল্যা বই উনি এটার কনসেপ্টের উপরেরই লিখেছেন।

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৪১

অজ্ঞ বালক বলেছেন: তাই নাকি। পোস্টের লিংকটা পারলে দিয়েন তো। আর বইটাও পড়তে হবে, লিস্টে তুললাম। আমি ভাই মহাভারত রিলেটেড কোনো বই ছাড়ি না। এই বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহে একজন এক্সপার্ট। যাই হোক, ধন্যবাদ ভাই। আপনার কমেন্ট পড়ে অনেক উৎসাহ পাইলাম।

৮| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৪৫

নীল আকাশ বলেছেন: ঠিক বই না। উনার বইয়ের এ্যাডে দিয়েছেন।
https://www.somewhereinblog.net/blog/agnisarothi/30110195
https://www.somewhereinblog.net/blog/agnisarothi/30290310

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৪৯

অজ্ঞ বালক বলেছেন: অবশ্যই পইড়া দেখবো। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইজান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.