![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অর্থ নয় কীর্তি নয় সফলতা নয় আরো এক বিপন্ন বিস্ময় অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে।
নওশের আলী মানুষটি সাধারণ কোন মানুষ না। সুপারম্যান লেভেল এর । মানুষটির একটি অদ্ভূত প্রতিভা আছে। টানা ৭২ ঘন্টা পানিতে ডুবে থাকতে পারে। এখন পর্যন্ত এটাই তার সর্বোচ্চ রেকর্ড। ব্যাপারটা ইজি না।
আমরা তখন হাই স্কুলে পড়ি। নওশের আলীর কথা শুনে হেটে পুরাতন বাজারের উদয়ন সংঘের অফিসে চলে গেলাম। নওশের আলী ক্লাব ঘরে এসে পৌছালেন একটা ভ্যান গাড়িতে চড়ে। নবাবগঞ্জ উপজেলার “স্বপ্নপুরী’তে প্রদর্শনী ছিল, শেষ করে এসেছেন। আগামীকাল বিরামপুর পুরাতন বাজারের মিজানুরের ১ নং রাইস মিলে একটি বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। 'বিরল মানুষ', 'জল মানব' নওশের আলীর দিন ব্যাপী ডুব প্রদর্শনী।
আমরা উঁকি ঝুঁকি মেরে নওশের আলীকে দেখি। প্রদর্শনীর আগেই একনজর দেখে নেওয়া। বিশেষ কিছু কর্মকান্ডের কারণে আমি এলাকার লিটিল সেলিব্রেটি। উদয়ন সংঘের বড় ভাইদের বলে নওশের আলীর কাছে চলে গেলাম। বেগ পেতে হলনা।
-আংকেল আসসালামু আলাইকুম
-ওয়ালাইকুমসালাম।
-আপনি ৭২ ঘন্টা পানিতে ডুবে থাকেন, খিদা লাগেনা?
-না, আমি তো খাই।
-কিভাবে?
কাল দেখো। প্রদর্শনীতেই দেখবে।
-ঠান্ডা লাগেনা?
তা তো একটু লাগেই।
আংকেল আপনার বাড়ি কোথায়?
খুলনা।
ছেলে মেয়ে নাই?
আছে, বড় ছেলেটা তোমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। আর একটা মেয়ে, ক্লাস ওয়ানে।
নওশের আলীর মন যেন একটু তরল হল। দুরবর্তী দৃষ্টি ক্লাব ঘরের দরজা পেরিয়ে বাইরে নিবদ্ধ হয়। তিনি আমার মাথায় হাত বুলান। “সুইট বয়। কিসে পড় তুমি”?
এভাবেই কথা আগায়। জানতে পারলাম নওশের আলী মানুষটি গত তিনমাস বাড়ির বাইরে। টানা প্রদর্শনী করে চলেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের সুইমিং পুলে টানা ৭২ ঘন্টা পানিতে ডুবে থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। ক্যান্টনমেন্টের জিওসি তাকে একটা মেডেল দিয়েছেন।
নওশের আলী ব্যাগ থেকে মেডেল বের করে দেখালেন।
সেই মেডেলে লিখা “বিশ্বরেকর্ডধারী বিরল প্রতিভা জল মানব নওশের আলী”।
নওশের আলী জানালেন বিশ্বে এরকম ৭২ ঘন্টা পানিতে ডুবে থাকার রেকর্ড আর কারো নেই। সেই হিসাবে এটা বিশ্ব রেকর্ড্। তবে যোগযোগের অভাবে তিনি গিনেস বুকে নাম লেখাতে পারছেননা। “বুঝলে বাবু, সব কিছুতেই কানেকশন লাগে। তবে আমি ট্রাই করে যাচ্ছি।”
আস্তে আস্তে মানুষ জন জড়ো হতে লাগলো। নওশের আলী সবার সাথেই হাত মেলাচ্ছেন। জননেতাদের মত হাসিমুখে কথা বলছেন সবার সাথে। আমরা আরো জানতে পেলাম নওশের আলী ডুব দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চান। এটাই তার জীবনের স্বপ্ন।
পরদিন নওশের আলীর আশ্চয প্রদর্শনী। আগের দিন থেকেই পুরো এলাকায় মাইকে ব্যাপক প্রচার করা হলো…. “সুখবর সুখবর সুখবর। খবর জানেন কি, খবর রাখেন কি…….আশ্চয মানব, জল মানব …..নওশের আলী……আসেছেন আপনার এলাকায়”। এলাকায় লিফলেট বিলানো হয় সেখানে নওশের আলীর জীবন বৃত্তান্ত আর কৃতিত্বের ইতিহাসের সাথে লেখা থাকে তিনি পানিতে ডুবে কি কি করবেন? যেমন
-হাত ও পায়ের বিচিত্র খেলা।
-গানের সাথে সাথে তুড়ি বাজানো
-পানির ভেতরেই মিষ্টি খাওয়া
-পানির ভেতরে সিগারেট খাওয়া…….. ইত্যাদি।
খুবই কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার। মফস্বলের গতানুগতিক নিস্তরঙ্গ জীবনে এক বিরাট ঢেউয়ের মত এইখবর সবার কাছে পৌছায়। থানার ওসি,উপজেলা কমপ্লেক্সের অফিসার, এসি ল্যান্ড ইউএনও সাহেবের ফ্যামিলিরাও আসেন। ভিআইপি গ্যালারি ২৫ টাকা টিকেট। আমরা দশ টাকার পাবলিক। পাচিল ঘেরা মিজানুরের ১ নং রাইস মিলের ছোট একটা ডোবার চার পাশে আমরা সুবিধামত বসে পড়ি। ডোবাটি মিলের চাতালের পাশে। পানি গুলো খুব সুবিধার না। বয়লারের ময়লা পানিও এসে পড়ে মনে হয়। প্রথমে ব্লিচিং পাউডার জাতীয় কিছু একটা ছিটানো হলো পানিতে। তারপর নওশের আলী এলেন। নৌকায় করে এক পাক ঘুরলেন। খালি গা, কেবল একটা ফুটবল খেলোয়াড়দের রঙ্গিন সিল্কের হাফপ্যান্ট পরা। গলায় টাকার মালা আর সেই মেডেল। হাত তুলে সমবেত জনতাকে অভিবাদন জানালেন। তারপর পানিতে ডুব দিলেন।
এরপর এক বিশাল শূন্যতা। নওশের আলীর বারো ঘন্টার কনট্রাক্ট। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত তিনি পানিতে ডুবে থাকবেন। এই সময়টা কিভাবে কাটবে আমাদের, আমরা যারা টিকেট কেটে ঢুকেছি। বের হলে আবার নতুন টিকেট, আবার দশটাকা। সম্ভব না। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গল্প করি, দুষ্টুমি করি। আগত কিশোরীদের দিকে আড় চোখে দেখি। বন্ধুদের সাথে হেসে গড়িয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে তাও ভাল লাগেনা। নওশের আলী সেই সময়টিকেও আনন্দময় করেন। মাইকে গান বাজে “ইশকুল খুইলাছে মওলা ভান্ডারী…..” নওশের আলী তুড়ি বাজিয়ে গানের সাথে তাল মেলান। আমেরা তালি দেই। একজন এসে নওশের আলীকে মিষ্টি দেন। মাইকে ঘোষণা করা হয়, নওশের আলী পানিতে থেকেই মিষ্টি খাবেন। নওশের আলী, ডুবন্ত মানব, হাত উচিয়ে মিষ্টি নেন। তারপর খালি হাত উচিয়ে দেখান, তিনি মিষ্টি খেয়েছেন। আমরা তালি দেই।
পুরো সময়টিকে বিনোদন মুখর করার প্রানান্ত চেষ্টা করে যান নওশের আলী।
সন্ধ্যা বেলা ঘোষণা হয় নওশের আলী পানি থেকে উঠে আসবেন। উঠে আসেন তিনি। মানুষটাকে বিদ্ধস্ত দেখায়। থোপসা লেগে থাকা চামড়ায় তাকে আরো বয়স্ক দেখায়। ফেব্রুয়ারীর ইষত শীতের সন্ধ্যায় খালি গায়ে কুকড়ে থাকে মানুষটি। শেষ মুহুর্তে ইউএনও সাহেব স্বয়ং এসে পৌঁছান। অনুষ্ঠান সমাপ্ত ঘোষণা করেন। তিনি নওশের আলীকে ৫০০ টাকা উপহার দেন নিজের পক্ষ থেকে। নওশের আলী মাইকে এসে কথা বলেন ইষৎ কাপা গলায়।
“ আমার স্বপ্ন ডুব দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেব। আমি এটা করবই আপনারা দোয়া করবেন।”
সারাদিন শেষে বাড়ি ফিরছি। সবার মুখে কথা একটাই "কিভাবে সম্ভব? হাউ? ” কেউ কেউ ভাব ধরে, যেন টেকনিকটা ধরে ফেলেছে। কাল থেকেই ডুবতে শুরু করে দেবে।
হঠাত মানুষটির জন্য আমার ভীষণ মায়া হয়। মনে পড়ে যায় তিনি তিন মাস বাড়ি ছাড়া। তার মানে নভেম্বর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় “ডুবের প্রদর্শনী” করছে!!
ওমাই গড! ডিসেম্বর! জানুয়ারি! শীত লাগেনা লোকটার! খুলনায় তার স্ত্রী সন্তানেরা মানুষটির পথ চেয়ে আছে। আহারে ছেলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বাবাকে মিস করে! লোকটিও নিশ্চয়ই করে।
মনে হয় লোকটির আর কিছু করার নেই। এটাই তার জীবিকা।হয়তো চেষ্টা করেছে কিন্তু আর কোন কাজ সে পারেনা। হয়তো জীবনে আর কিছু সে এত গুরূত্ব দিয়ে করেইনি।
আজ কয়জন মানুষইবা হয়েছে। টিকেটের টাকাটাই কি তার আজকের রোজগার? নওশের আলী মানুষটার আসলে অনেক কষ্ট।
তার পানি থেকে ওঠার পরের মুখটি মনে পড়ে। বিদ্ধস্ত, ক্লান্ত, থোপসানো,ফ্যাকাশে একটা মানুষ। কেবল চোখে একটা প্রত্যয় “আমি ডুব দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হব। বিশ্ব রেকর্ড করবো। এটাই আমার স্বপ্ন।” মনটা খারাপ হয়ে যায়। মানুষ কখনো কখনো এরকম অহেতুক স্বপ্নও দেখে! কেন দেখে?
পুনশ্চ: কদিন ধরে বাংলাদেশ নানান রকম অদ্ভুত রেকর্ড গড়ছে।সেগুলো আবার ভাঙছেও কেউ কেউ। এরকম নিত্য নতুন রেকর্ড গড়ার উদগ্র বাসনা দেখে নওশের আলীর কথা মনে পড়লো। সামনে লাখো কন্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড করবে। এই নিয়ে বিদঘুটে সব কান্ডকীর্তিও শুরু হয়েছে। অবশ্য এখনো এই দেশের অনেক স্কুলে, মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়াই হয়না। দরিদ্র নওশের আলীর বিপন্ন জীবনের ব্যর্থতা ঘোচানোর মতই কি এ এক দরিদ্র প্রচেষ্টা ? জানিনা, নাকি আমার বোঝার ভুল?
২| ২১ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:৪৮
তিক্তভাষী বলেছেন: ভালো লিখেছেন। ছাত্রজীবনে এই নওশের আলীর কথা আমিও শুনেছি।
আমি বুঝিনা হাস্যকর এইসব বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী হওয়াতে বা না হওয়াতে কী আসে যায? অথচ শীর্ষ দুর্নীতিবাজ দেশের তালিকা বা বাসের অযোগ্য রাজধানীর তালিকা হতে বের হওয়ার জন্য কোন প্রচেষ্টা নজরে পড়ে না। টাকাগুলো দিয়ে অন্তত হাতিরঝিল পরিস্কার করার চেষ্টা করলেও একটা কাজ হতো।
৩| ২১ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:৫৯
shahinur70 বলেছেন: আমার মনে আছে আমি তাঁর এই প্রদর্শনী ১৯৮৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসের কোন এক সময় চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ে দেখেছিলাম সরাসরি,তখন থেকে তাঁকে চিনতাম।
৪| ২১ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ২:৪৪
ঢাকাবাসী বলেছেন: দুনিয়ার সবচাইতে দুর্ণীতিবাজ দেশের সব অদ্ভুত কারবার!
৫| ২১ শে মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৩:১৩
কাকভেজা বলেছেন: তার পানি থেকে ওঠার পরের মুখটি মনে পড়ে। বিদ্ধস্ত, ক্লান্ত, থোপসানো,ফ্যাকাশে একটা মানুষ। কেবল চোখে একটা প্রত্যয় “আমি ডুব দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হব। বিশ্ব রেকর্ড করবো। এটাই আমার স্বপ্ন।” মনটা খারাপ হয়ে যায়। মানুষ কখনো কখনো এরকম অহেতুক স্বপ্নও দেখে! কেন দেখে?
স্বপ্ন তো নওশের আলী দেখেই ফেলেছে, কাজও এগিয়েছে এবং বিশ্ব রেকর্ডও করেছে। বাংলাদেশ সরকার তো তার এ প্রচেষ্টাকে গ্রিনিজ বুকে তুলতে পারে। কিন্তু কে করে, নওশের আলী তো একটা ভোট, কোন নেতাও নয়, টাকা পয়সাও নেই বেচারার তাই ওর নাম তুলে লাভ কি।
অন্য কোন দেশ হলে হয়তবা এমন প্রদর্শনী দিয়ে দেশ বিদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় রোজগারের প্লান করতো কিন্তু সরকারী ভাবে কোন উদ্যোগ নওশের কে নিয়ে হয় নেয়া হয় ন।
যদি দেশে ফিরে কোনদিন সৌভাগ্য হয় লোকটা দেখতে যাবো একবার। তবে পানির উপরে....
৬| ২৩ শে মার্চ, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৪
অমিয় উজ্জ্বল বলেছেন: সবাই কে অসংখ্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:৩৯
অগ্নি সারথি বলেছেন: চমৎকার ভাবনা আপনার। আমার বাড়িও দিনাজপুরে। আমিও দেখেছিলাম এই নওশের আলীকে।