![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কতোটা পথ পেরুলে তবে পথিক বলা যায় ......
‘নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়’ নির্ভীক কবি,বিপ্লবী নাজিম হিকমত কে শুধু এইএক লাইনেই বর্ণনা করা যায় । বিপ্লবী এই কবির কবিতা আমি প্রথম শুনি শিমুল মুস্তাফার আবৃত্তির ক্যাসেট এ ।কবিতার নাম ছিল জেলখানার চিঠি । মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ! বিংশ শতাব্দী তে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর ১ বছর ! জেলখানায় বসে প্রিয়তমা স্ত্রী কে লেখা এই কবিতার প্রতিটি লাইন জ্বলজ্বলে সূর্যের মতো প্রদীপ্ত ! এতো শুধু কবিতা নয়,এক বিপ্লবীর আত্মপোলব্ধি !
নাজিম হিকমত এর পুরো নাম নাজিম হিকমত র্যান । ১৯০২ সালের ১৫ ই জানুয়ারী বর্তমানে গ্রীসে অবস্থিত সালনিকা শহরে জন্মগ্রহন করেন ।তাঁর বাবার নাম হিকমত বে । তিনি ছিলেন সরকারী চাকুরীজীবী । সেলোনিকা গ্রীসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে বিখ্যাত। তৎকালীন সময়ে ওই অঞ্চল তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। ১৯১৮ সালে তিনি ইস্তাম্বুলে অবস্থিত তুর্কিশ নেভাল একাডেমি থেকে স্নাতক অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার শর্ত অনুযায়ী তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ওই সময়কার পটভূমিতে দেখা যায়, গোটা বিশ্ব অস্থিরতার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছিল। তা থেকে তুরস্কও মুক্ত ছিল না। ১৯১৯ সালে হিকমত স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। ফলে শারীরিক কারণে তিনি ১৯২০ সালে নেভাল সার্ভিস থেকে অব্যাহতি পান। হিকমত সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন ১৯২১ সালে। ওই সময় তার বন্ধু ভালা নুরেদ্দিন, ইউসুফ জিয়া অরর্থাক এবং ফারুক নাফিজসহ আনাতোলিয়া অঞ্চলের ইনেবুলু এলাকায় যান। মূলত, ওই অঞ্চল তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তুরস্কের জাতীয় আন্দোলনের মূল কেন্দ্রভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ আন্দোলন ১৯১৯-এর ১৯ মে থেকে ১৯২৩-এর ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে, হিকমত এবং তার বন্ধুরা তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় তৎকালীন কিংবদন্তি মুস্তাফা কামাল পাশার (আতাতুর্ক) সাথে সাক্ষাত করেন। কামাল পাশা জাতীয় আন্দোলনে যুক্ত কর্মীদের অনুপ্রেরণা দিতে তাদের কবিতা লিখতে অনুরোধ করেন। তাদের সৃষ্ঠ ওইসব কবিতা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। এরপর নাজিম হিকমত এবং তার আরেক বন্ধু মিলে জর্জিয়ার বাটোমি এলাকায় যান। তৎকালীন সময়ে এ দেশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। নাজিম হিকমত আগে থেকে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অপার আগ্রহে এ দেশে আসেন।
১৯২২ সালের জুলাইয়ে তিনি মস্কো যান। এখানে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করেন। ‘কমিউনিস্ট ইউনির্ভাসিটি অব দ্যা টইলার্স অব দ্যা ইস্ট’-এ অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। উল্লেখ্য, এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ২১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে বিভিন্ন উপনিবেশিক দেশের কমিউনিস্ট কর্মীদের পড়াশুনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এখানে হিকমতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত কবি ভ্লদিমির মায়াকোভস্কি এবং থিয়েটার বিশারদ ভেসেভুলুড মেয়েরহোল্ডে সাথে পরিচয় হয়। যা পরবর্তীতে তার শিল্প চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির ইলিচ লেনিনের মতাদর্শ হিকমতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে বেশ সমৃদ্ধ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি তার সমস্ত জীবনে প্রয়োগ হতে দেখা যায়। কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তার কবিতা আরো জোরালো হয়ে উঠে। ১৯২৪ সালে তুরস্ক স্বাধীনতা অর্জন করে। এরপর মুক্ত তুরস্কে হিকমত ফিরে আসেন। ওই সময় তিনি একটি বামপন্থি পত্রিকায় কাজ করেন। সেখানে বাম মতাদর্শে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু, হিকমত তুরস্ক থেকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ওই সময় তিনি বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কবিতা এবং গান রচনা করেন। ১৯২৮ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেয়া হলে তিনি আবার তুরস্কে ফিরে আসেন। কিন্তু, ততদিনে তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ওই সময় গোয়েন্দা ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে সবসময় নজরবন্দি করে রাখত। কিন্তু, এতকিছুর পরও হিকমতকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শোষিত মানুষ এবং নিপীড়িত জনতার কণ্ঠস্বর তার কবিতায় দেখা যায়। ফলে তুরস্কের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের কাছে তিনি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান। ১৯২৮ সাল পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তাকে পাঁচ বছর কারাগারে বন্দি থাকতে হয়। এত বিপত্তির পরও হিকমত ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যান। এ সময় তিনি নয়টি কবিতার বই প্রকাশ করেন। কাব্য চর্চায় তার অনুভব তুরস্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী স্পর্শ করে। প্রতিক্রিয়াশীলরা তাকে জেলে বন্দি রেখেও স্বস্থি পায়নি।
১৯৩৮ সালে হিকমতকে দীর্ঘমেয়াদে গ্রেফতার করা হয়। এবারের অভিযোগ গুরুতর। শাসক শ্রেণীর মতে, তার কবিতা সামরিক বাহিনীতি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে, তার কবিতা মিলিটারি ক্যাডেটরা পড়ছে এবং বিপ্লবের চেতনা জন্ম দিয়েছে। বিচারে তার ২৮ বছর সাজা হয়। ১৯৪৯ সালে চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা, গণসঙ্গীত শিল্পী পল রবসন এবং দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্রে তার মুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুক্তির দাবিতে তারা আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন। ১৯৫০ এর ২২ ডিসেম্বর হিকমত পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার জিতে নেন। এ বছর তিনি আঠারো দিনের আমরণ অনশনে যান। তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে তিনি মুক্তি অর্জন করেন। কিন্তু, প্রতিক্রিয়াশীলরা তার পিছু ছাড়ছিল না। তাকে দু’বার হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরবর্তীতে তিনি আবার কৃষ্ণ সাগর হয়ে রাশিয়ায় পালিয়ে আসেন। ওই সময় তুরস্কের সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। ১৯৬৩ সালের ৩ জুন সকালে দরজা থেকে সংবাদপত্র নেবার সময় হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে এ মহান কবি মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মস্কোর নভদেভিসি গোরস্থানে দাফন করা হয় । অপূর্ব সেই সমাধী প্রস্তর আজো তুরস্ক ও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান । নাজিম এর অন্তিম ইচ্ছা ছিল আনাতোলিয়া গ্রামের যে কোন গোরস্থানে একটা প্লেন গাছের নীচে যেন তাঁর সমাধী হয়।এই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি ।
নাজিমের নিজের লেখা আত্মজীবনী
আমার জন্ম ১৯০২ সালে
আমি কখনো একবারের জন্যও
আমার জন্মভূমিতে ফিরে যাইনি
আমার ফিরে যেতে ভালো লাগে না
তিন বছর বয়সে আলেপ্পোতে আমি পাশার দৌহিত্রের ভূমিকায়
উনিশে মস্কো কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে
ঊনপঞ্চাশে তেহেকা পার্টির অতিথি হয়ে ফিরে আসি মস্কোতে
চৌদ্দ যখন বয়স আমি কবি তখন থেকেই
কোনো কোনো মানুষ চারাগাছ সম্পর্কে সবকিছু জানে, মাছ সম্পর্কে কেউ কেউ
আমি জানি বিচ্ছেদ
কোনো কোনো মানুষ তারাদের নাম মুখস্থ বলতে পারে
আমি অনুপস্থিতির আবৃত্তি করি
আমি কারাগারে ঘুমিয়েছি, আর বিশাল হোটেলে
আমি জানি ক্ষুধা কেমন—এমনকি অনশনও আর কোনো খাবার
বলতে গেলে ছিলই না, আমি স্বাদ নিতে পারিনি
তিরিশ যখন আমার বয়স ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে
যখন আমি আটচল্লিশ তখন শান্তিপদক
পদক দিয়েছেও
ছত্রিশে আমি বছরের অর্ধেকটা সময় কেবল চার বর্গমিটার জায়গায়
অবস্থান করেছি
ঊনষাটে আঠারো ঘণ্টায় আমি প্রাগ থেকে হাভানা উড়ে এসেছি
আমি কখনো লেনিনকে দেখিনি ১৯২৪-এ তাঁর কফিন দেখতে দাঁড়িয়েছি
১৯৬১-তে তাঁর যে সমাধি দেখেছি তা কেবলই তাঁর রচনাবলি
ওরা আমাকে আমার পার্টি থেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে
তাতে কাজ হয়নি
পতিত নেতাদের তলদেশে আমাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি
১৯৫১-তে এক তরুণ বন্ধুকে নিয়ে পাল তুলে দিই মৃত্যুর চোয়ালের দিকে
১৯৫২-তে ভগ্নহূদয় মৃত্যুর দিন গুনে গুনে চার মাস শুয়ে থাকি চিৎ হয়ে
আমার ভালোবাসার নারীদের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হই
চার্লি চ্যাপলিনকে একটুও ঈর্ষা করিনি
আমি আমাদের নারীদের প্রতারণা করেছি
আমি কখনো বন্ধুদের কথার জবাব দিইনি
আমি পান করেছি কিন্তু প্রতিদিনই নয়
আমার রুটির পয়সা একই সঙ্গে কামাই করে নিয়েছি
যাদের আমি মিথ্যা বলেছি তাদের বিব্রতকর অবস্থায় কী মজা
কাউকে আঘাত করতে আমি মিথ্যা বলিনি
তবে আমি অকারণেও মিথ্যা বলেছি
আমি ট্রেন, উড়োজাহাজ আর গাড়ি চড়েছি
অধিকাংশ মানুষেরই এ সুযোগ হয় না
আমি অপেরায় গিয়েছি
অধিকাংশ মানুষ অপেরার নাম শোনেনি
আর ১৯২১ থেকে আমি যেসব জায়গায় যাইনি অধিকাংশ মানুষ যেখানে যায়
মসজিদ, গির্জা, মন্দির, সিনাগগ, জাদুকরের তামাশা
তবে আমি আমার কফির জমিন পাঠ করেছি
তিরিশ কি চল্লিশটি ভাষায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে
কিন্তু আমার তুরস্কে আমার তুর্কি ভাষায় তা নিষিদ্ধ।
ক্যানসার আমাকে এখনো পেয়ে বসেনি
পেয়ে বসবে এমনও কেউ বলেনি
আমি কখনো প্রধানমন্ত্রী কিংবা ও-রকম কিছু হতো না
আর সে জীবন আমি চাইও না
আমি যুদ্ধেও যাইনি
কিংবা রাত্রিশেষে বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে বিবরে ঢুকিনি
বোমারু জাহাজের ঊষর রাস্তা কখনো বেছে নিইনি
কিন্তু প্রায় ষাট বছর বয়সে প্রেমে পড়েছি
সংক্ষেপে কমরেড
এমনকি আজও বার্লিনে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি কঁকাচ্ছি
আমি বলতে পারি আমি মানুষের জীবনযাপন করেছি
আর কে জানে
আমি আর কত দীর্ঘকাল বাঁচব
আর আমার কী ঘটবে
[img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/117188/small/?token_id=5a7a59cf10f8d289bfe79cb6fa4e5a2d
[১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬১ নাজিম হিকমত পূর্ব বার্লিনে তাঁর এই ‘আত্মজীবনী’ রচনা করেন। তিনি এরপর আরও এক বছর নয় মাস বেঁচেছিলেন। র্যাডি ব্লাসিং ও মুতলু কোনুকের ইংরেজি অনুবাদ থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে।]
কখনো বলা হয়েছে তিনি "রোমান্টিক কমিউনিস্ট"; কখনো বলা হয়েছে তিনি তিনি "রোমান্টিক বিপ্লবী"।
তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে অসংখ্য ভাষায় । গত শতাব্দীতে তিনি শুধু তুরস্কেরই নয়,সারা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য কবিদের একজন তিনি।
পাবলো নেরুদা লিখেছেন
“ সদ্য মুক্তি পাওয়া
বন্দীদের একজন নাজিম হিকমত
তার কবিতার মতো
লাল রং সোনার সুতায়
বোনা জামা উপহার দিয়েছে আমায়।
মানুষের প্রেম,আশা,আকাঙ্খা,বিপ্লব ও মুক্তির মধ্যে নাজিমের কবিতা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল
জেলখানার চিঠি / নাজিম হিকমত
...
প্রিয়তমা আমার,
তোমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছো:
মাথা আমার ব্যথায় টনটন করছে,
দিশেহারা আমার হৃদয়।
তুমি লিখেছো:
যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়
তোমাকে যদি হারাই,
আমি বাঁচবো না।
তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধূ আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে,
মানুষের শোকের আয়ু
বড়জোর এক বছর।
মৃত্যু ...
দড়ির একপ্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয়, সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাঁসির দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়।
অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব, আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব।
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।
বধূ আমার,
তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চায়
বিচার সবেমাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
যে ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।
ও নিয়ে ভেব না
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সব সময় স্ফুর্তি থাকে
বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরীর একই ডাল একই ঝড়ে
দু’বার দোলে না।
গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।
আমি তোমাকে চাই:
তোমার মত রমণীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তমার মত।...
আমি জানি, দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।
নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জ্বল নীল শাখার মঞ্জুরিতে ফুলের দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে।
মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি, প্রিয়তমা।
রাত্রির অন্ধকারে, গ্রাম দেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নীচে জ্বালা অগ্নিকুণ্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, আমি তোমাকে স্পর্শ করছি।
আমি আছি মানুষের মাঝখানে, ভালোবাসি আমি মানুষকে
ভালোবাসি আন্দোলন,
ভালোবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালোবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
রাত এখন ন'টা
ঘণ্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলে দরোজা তালাবন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশী দিন কাটল
আটটা বছর।
বেঁচে থাকার অনেক আশা, প্রিয়তমা
তোমাকে ভালোবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর, কী আশায় রঙিন তোমার স্মৃতি।...
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আর আমি শুনতে চাইনা গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইবো।
আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের উপর এলানো
আমি আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচাগ্রে দাঁড়িয়ে।
দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সূচাগ্রে দাঁড়িয়ে !
যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখি নি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠেনি।
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
সে কথা আজও আমি বলিনি।
কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধূসর চোখ মেলে তুমি আবছা আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মতো ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি
লাঙ্গল চষা ভূঁইতে
মাটির বুকফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
আশাভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাইনি ?
...
(অনুবাদ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
তথ্যসূত্র প্রথম আলো ,উইকি,ব্লগ ।
২| ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:০৭
অপরাজিতা মুন্নি বলেছেন: আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো । আপনার পাঁচটি ভিন্ন শিরোনামের কবিতা পড়লাম ।ভালো লেগেছে । আমার ৭ দিনের ওয়াচ পিরিয়ড এখনো শেষ হয়নি
তাই আপনার পোস্টে কিছু বলতে পারলামনা !
৩| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৪৯
আহমেদ জী এস বলেছেন: অপরাজিতা মুন্নি,
হোক দেরীতেই না হয় দেখেছি, তবু ও সুন্দর একটি বিষয়ের দেখা মিললো ।
প্রশংসনীয় লেখা । ধন্যবাদ এজন্যেই ।
শুভেচ্ছান্তে ।
৩১ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ২:৫৫
অপরাজিতা মুন্নি বলেছেন: উৎসাহ পেলাম । আপনাকেও ধন্যবাদ ।
৪| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৭:৫৫
খেয়া ঘাট বলেছেন: মানুষের প্রেম,আশা,আকাঙ্খা,বিপ্লব ও মুক্তির মধ্যে নাজিমের কবিতা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
+++++++++++++++++++++++++++++++
১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:০২
অপরাজিতা মুন্নি বলেছেন: নাজিমের কবিতা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:৩৩
আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
জেলখানার চিঠি'র মাধ্যমেই নাজিম হিকমত কে জানা।
আপনার দূর্দান্ত পোস্টে আরো অনেক কিছু জানলাম।
ভালোলাগলো পোস্ট, প্লাসায়িত করে গেলাম।
শুভকামনা।।