নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

www.oputanvir.com

অপু তানভীর

আমার চোখে ঠোঁটে মুখে তুমি লেগে আছো

অপু তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্লগার\'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার জুল ভার্ন

১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৩৯



প্রিয় এবং অপ্রিয় ব্লগারগন, কেমন আছেন ? প্রতিমাসের মত এই মাসেও হাজির হয়ে গেলাম আরেকটি ব্লগার’স ইন্টারভিউ নিয়ে। এবার আমাদের অতিথি হয়েছে ব্লগার সর্বজন পরিচিত ব্লগার জুল ভার্ন ভাই। আজকের ইন্টারভিউ পড়ার আগে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া ভাল নয়তো ইন্টারভিউ পড়ার সময়ে কিছুটা অন্য রকম মনে হতে পারে। এই ইন্টারভিউটি সেই শুরুর দিকেই আমি নিয়ে রেখেছিলাম । আসলে এক সাথে বেশ কয়েকজনকে নক দিয়েছিলাম প্রথম ধাপে । আমি ভাবতেও পারি নি যে সবাই দ্রুতই সাড়া দিয়ে। বলা যায় যতগুলো ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম তা সবগুলোই একেবারে প্রথম মাসেই আমার কাছে এসে হাজির হয়েছিল। সেই সময়ে দেশের প্রেক্ষাপট অন্য রকম ছিল । তাই কিছু কথা হয়তো এখন অন্য রকম মনে হতে পারে । পরে অবশ্য সম্প্রতি সময়েও কিছু প্রশ্ন যোগ এবং কিছু বাতিল করেছি । আশা করি সামুর বুদ্ধিমান পাঠকগন সেই ব্যাপারগুলো সহজেই বুঝে নিতে পারবেন। তাহলে আর দেরি না করে ইন্টারভিউ শুরু করা যাক।

অপুঃ কেমন আছেন ভাইয়া?
জুল ভার্নঃ আলহামদুলিল্লাহ। বেঁচে আছি, তাই ভালো আছি। যদি হিসাব করি তাহলে সব মিলিয়ে সামুর বয়সের তিন ভাগের একভাগ সময় আমি লেখালেখি করেছি। তারপরও আমাকে মনে রাখার জন্য ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।

অপুঃ আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন কিছু? কোথায় জন্ম, কোথায় বেড়ে ওঠা এই সব আর কি! তবে যতটা অনলাইনে বড় নিরাপদ সেইটা অবশ্যই মাথায় রাখবেন।
জুল ভার্নঃ 'আমার পরিবার' বলতে- 'আমি' থেকে শুরু হলেও যতসামান্য পেছনে ফিরে যেতে হচ্ছে- আমাদের দাদা, চাচা, বাবা ১৯৩৪ সালে বরিশাল জেলা থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় যৌথ পরিবারে আমাদের আদি বাড়ি- র‍্যাংকিং স্ট্রিট, ওয়ারী। ওখানেই আমার জন্ম। ১৯৬৪ সালে ডি আই টি 'ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা' গঠন করলে আমরা 'ভুমি ক্ষতিগ্রস্ত' হিসাবে এখানে আবাসিক প্লট পাই। বৃহত্তর পরিবার ভেংগে পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারায় আব্বা এবং ছোট চাচা ধানমণ্ডিতে চলে আসেন। বড়ো এবং মেঝ চাচা ওয়ারীতেই থেকে যান এবং এখনো ওখানেই উত্তরাধিকারগণ কেউ কেউ আছেন।

আমি পড়ালেখা করেছি- সেন্ট গ্রেগরি, সেন্ট জোসেফ স্কুল এবং ক্যাডেট কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছি পাব্লিক এডমিনিস্ট্রেশনে। MBA করেছি একই বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে। MIBA কারার জন্য ইংল্যান্ডের একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েও শেষ করতে পারিনি। পেশা- ব্যবসা হলেও এখন ক্ষয়িষ্ণু ব্যবসায়ী, অর্থাৎ নামেই ব্যবসায়ী!

আমার স্ত্রী শিক্ষকতা পেশা থেকে অকালে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণের পর বর্তমানে হাউজমেকার। আমাদের দুই ছেলে এবং ছেলেদের স্ত্রী সবাই সুশিক্ষিত এবং পেশায় ভালো অবস্থানে আছে। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

অপুঃ আপনার অনেক লেখা থেকে জেনেছি যে ছোট বেলা থেকে পড়ার অভ্যাস ছিল আপনার। পড়ার পাশাপাশি লেখালেখির অভ্যাসও গড়ে উঠেছিল সেই ছোট বেলা থেকে?
জুল ভার্নঃ বাড়িতে পড়াশোনা করার চমৎকার পরিবেশ ছিলো আমাদের ভাই-বোনের জন্মের অনেক আগে থেকেই। যৌথ পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে একটা পারিবারিক লাইব্রেরী পেয়েছি।

যৌথ পরিবারে আমরা অনেক ভাইবোন ছাড়াও প্রতিবেশী এবং স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে আমাদের বই পড়ার প্রতিযোগিতা ছিল। সেই জন্যই স্কুল কলেজ জীবনে প্রচুর বই পড়ার এবং সংগ্রহ করার নেশা হয়ে যায়। আমার ছোট চাচা আর বুবুও ছিলেন বই পড়ার নেশায় বুঁদ। উনারা ছেলে বেলা থেকেই বৃটিশ কাউন্সিল মেম্বার ছিলেন। তারাও ওখান থেকে আমার জন্য শিশুতোষ বই এনে দিতেন। আমি ইংরেজি রপ্ত করার আগে পর্যন্ত তাঁরা দুজনেই বই পড়ে আমাকে বলতেন, যাতে আমার বুঝতে সুবিধা হবে।

অপুঃ ব্লগের আগে অন্য কোন মাধ্যমে কি লেখালেখি করেছেন? বলতে চাচ্ছি, কোন পত্রপত্রিকাতে কি লেখা পাঠাতেন এবং সেগুলো কি ছাপা হত?
জুল ভার্নঃ লেখালেখির চেষ্টাও সেই ছেলেবেলা থেকে। আমাদের ছেলেবেলা সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে খুব ভালো সংশ্লিষ্টতা ছিলো। বিশেষ উপলক্ষে (একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ঈদ এবং পুজোর সময়) পাড়ায়, স্কুলে দেয়ালপত্রিকা এবং ম্যাগাজিন বের করতো। মোটা আর্ট পেপারে বিভিন্ন রঙের কালিতে হাতে লেখা গল্প, কবিতা, কৌতুক লেখা হতো, যা ঝুলিয়ে দেয়া হত সুবিধা জনক দর্শনীয় স্থানে। যাতে সবাই দেখতে পায়। সেইসব দেয়ালপত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে লেখা দিতাম। লেখার মান খারাপ হলেও পাড়ার বড় ভাইরা এবং স্কুল শিক্ষকগণ সেই লেখা প্রকাশ করে লিখতে উৎসাহিত করতেন।

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার আগেই রবি ঠাকুর, লুতফর রহমান, ফররুখ আহমদ, সুকুমার সমগ্র, উপেন্দ্রকিশোর এর শিশুতোষ বইগুলো পড়া শেষ করেছি। ক্যাডেট কলেজে ক্লাসের পড়ার অনেক চাপ থাকলেও আমি শরৎচন্দ্র, নীহার রঞ্জন, মাইকেল, জীবনানন্দ, সত্যজিৎ, জরাসন্ধ, নিমাই ভট্টাচার্য, বঙ্কিম চন্দ্রের অনেক বই পড়েছি। ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদ বরাবরই আমাকে আকর্ষণ করতো। শুরু করেছিলাম- সেবা প্রকাশনীর বিশ্বখ্যাত ক্লাসিক বইগুলোর অনুবাদ পড়ে। বাদ যায়নি মন্টো, ইকবাল, রুমী, মপাসা, দ্যুমা, ওয়াইল্ড, চেখভ, ক্রিষ্টি, শেক্সপীয়ারও। হানিয়া ইয়ানাগিহারার 'আ লিটল লাইফ', জর্জ এলিয়টের 'মিডলমার্চ', চার্লস ডিকেন্সের 'ব্লিক হাউস', মিগুয়েল ডি সার্ভান্তেসের 'ডন কিয়োটে', হারম্যান মেলভিলের 'মোবি-ডিক (দ্য হোয়েল)', ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের 'ইনফিনিট জেস্ট', লিও টলস্টয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', স্টিফেন কিং এর 'দ্য স্ট্যান্ড' এর মতো বিশ্ববিখ্যাত বইগুলো পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। অনুবাদ বই সংগ্রহের অন্যতম সোর্স ছিলো নিউমার্কেটের জিনাত লাইব্রেরী।

স্বাধীন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিলো আমার প্রিয় ম্যাগাজিন। সাহিত্যের জন্য সাপ্তাহিক সন্ধানী। টুকটাক লিখতাম সিনে পত্রিকা- সাপ্তাহিক সিনেমা, পূর্বানী, বিচিত্রা, যায়যায়দিন এবং রিডার ডাইজেস্ট পত্রিকাতে। মাঝেমধ্যে লেখা ছাপা হত। যদিও নিজের লেখা নিয়ে কখনো উৎফুল্ল ছিলাম না বরং অনেক সময়ই প্রকাশিত লেখা পরিবার স্বজনদের থেকে লুকিয়ে রাখতাম। তবে পাঠক এবং কিঞ্চিৎ লেখালেখির সূত্রেই অনেক সমবয়সী, সিনিয়র, জুনিয়র বন্ধু পেয়েছি, যাদের মধ্যে এখন অনেকেই দেশের সেরা লেখক, সাংবাদিক, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।

সামু ব্লগের আগেও আমি দুটি ব্লগে লেখালেখি করতাম- যদিও সেই দুটি সাইটই ছিলো প্রচলিত ব্লগের চাইতে ভিন্ন ধারার। যার একটা ইয়াহু পরিচালিত ইয়াহু গ্রুপ। অন্যটা সমুদ্র গ্রুপ- চট্টগ্রামের কয়েকজন প্রবাসী গড়ে তুলেছিলেন। দুটোরই লেখার মাধ্যম ছিলো ইংরেজী।

অপুঃ সেই সময়ের লেখালেখি দিয়ে কোন মেয়ে পটিয়েছেন কি? ভাবী আপনার লেখালেখি পড়ে কী বলতেন?
জুল ভার্নঃ আমি কাউকে পটাইনি।
আমার স্ত্রী আমার লেখালেখির ভক্ত ছিলেন। আমার লেখার নিরপেক্ষ সমালোচক এবং প্রেরণা ছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে লেখালেখির জন্যই রাষ্ট্রীয় ভাবে হেনস্তা হবার পর আমার লেখালেখির কঠোর প্রতিবন্ধক হয়ে যান। তিনি এবং ছেলেরা কেউই চায়না- আমি সোস্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করি।

অপুঃ আপনি পুরানো ব্লগারদের একজন। ব্লগের কথা ঠিক কোথা থেকে কিংবা কার মাধ্যমে জানতে পারলেন?
জুল ভার্নঃ যেহেতু সর্বগ্রাসী পাঠক এবং টুকটাক লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলাম তাই এই লাইনে অনেক বন্ধু ছিল। এদের মধ্যে আমার দুই তরুণ বন্ধু একজন আহমেদ সজীব (আইটি স্পেশালিষ্ট) এবং রাজীব (রাজীব সালাউদ্দীন, একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জিএম) আমার অফিসে আসতেন। ওরাই সামহোয়্যারইন ব্লগের কথা জানায়। ওরা দুজনেই সামুতে একেবারেই প্রথম দিকে অর্থাৎ প্রথম ১০০ জন ব্লগারদের মধ্যে রেজিষ্ট্রেশন করিয়েছে। ওদের কাছে জেনেই আমি নিয়মিত সামু ব্লগ পড়তে থাকি। কিন্তু বাংলা টাইপ করতে পারতাম না তাই সাথে সাথেই রেজিষ্ট্রেশন করিনি।

ইতোমধ্যেই তখনকার জনপ্রিয় বেশ কয়েকজন ব্লগারদের সাথে পরিচয়/ যোগাযোগ হয়, যাদের মধ্যে অন্যতম- কৌশিক, মিল্টন, মেজবাহ আযাদ সহ আরও অনেকজন। কয়েক মাস পর নিক রেজিষ্ট্রেশন করি। প্রথম দিকে ইংরেজি হরফে বাংলা বক্তব্যে লিখতাম, যাকে সবাই বাংলিশ বলতো। সামু ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা --- এবং প্রবাসী ব্লগার মানবীর উৎসাহ এবং সহযোগিতায় খুব দ্রুতই বাংলা টাইপ করতে শিখেছিলাম।

অপুঃ জুলভার্নের আগে বাবুয়া নামে সম্ভবত আপনার একটা নিক ছিল। এই দুই নিক বাদে অন্য কোন নিকে কি লেখালেখি করেছেন? কেবল হ্যা না তেই উত্তর দিতে পারেন। আবার চাইলে সেই নিকের কথা বলতেও পারেন।

জুল ভার্নঃ রাইট, বাবুয়া নামে আমার আইডি ছিলো। সেই আইডি তে প্রায় দুই বছরে ২৬০ টা লেখা পোস্ট করেছিলাম, যার বেশীরভাগই ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং সার্ক দেশে ভ্রমণ কাহিনী। সেই লেখাগুলো খুব পাঠক প্রিয়তা পেয়েছিল। বাবুয়া নামে সাথে একটা যৌথ ইতিহাস আছে....- যাকে নিয়ে আমি ব্লগে প্রথম গল্প লিখেছিলাম- "শুন্যতাই তুমি" নামে। সেই তিনিই আমাকে 'বাবুয়া' নামে ডাকতেন, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র....

বাবুয়া আইডি ব্যান হবার পাঁচ মাস পর জুলভার্ন আইডি করে দিয়েছিল- ব্লগার মামুন (সত্য কথায় যত দোষ), নামটাও ওর পছন্দে- যেহেতু আমি ভ্রমণ পোস্ট বেশী লিখতাম- সেজন্যই জুলভার্ন আইডি। মজার ব্যাপার হচ্ছে- আমি যে নামেই লিখি, আমি এনোনিমাস নই, বেশীরভাগ পুরনো ব্লগার বন্ধুদের কাছেই আসল নামে আমি সুপরিচিত, তারপরও এখনো আমি সবার কাছে- বাবুয়া এবং জুলভার্ন ভাই!

অন্যকোনো নিকে লেখালেখি করেছি কি না? উত্তরে বলবো, একদা সামু ব্লগে 'এ- টীম' নামক একটা মারকুটে গ্রুপের নোংরা, অশ্লীল আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাই- আমার সমমনা ব্লগারগন। তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করতেই আমাদের সমমনা কয়েকজন জোটবদ্ধ হয়ে একাধিক ফেক/মাল্টি আইডি করে। সেই আইডি গুলোর পাসওয়ার্ড সমমনা সবাই জানতো। যে যখন সময় সুযোগ পেতো সেই মাল্টি/ফেক আইডি থেকে প্রতিপক্ষকে সমুচিত জবাব দিতে বাধ্য হয়। ফলত, এ- টীমের নোংরামী বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

অপুঃ কেন নিজের আসল নাম বাদ দিয়ে ছদ্মনামে নিক খোলার কথা মনে হল? যখন আপনারা ব্লগিং শুরু করেছিলেন তখন কিন্তু চাইলেই অনেক কিছু খোলাখুলি ভাবে বলা যেত অনলাইনে যা এখন যায় না। তখনো ব্লগার ধরার আইন তৈরি হয় নি। তাহলে ছদ্মনাম কেন?
জুল ভার্নঃ শুরু থেকেই লক্ষ্য করছিলাম- ব্লগে একটা দলীয় মতবাদের ব্লগারদের একক প্রধান্য ছিলো এবং তাদের লেখায় সৌজন্যতার চাইতে 'লেখায় পেশীশক্তির প্রয়োগ' ছিলো ভয়ংকর রকমের। তখন সেনা তত্বাবধায়ক সরকারের কাছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দলটির সংশ্লিষ্ট সবার উপরই আক্রোশ ছিলো ওদের। সত্যি বলতে- আমরা যখন ব্লগিং শুরু করেছিলাম তখনও কিন্তু চাইলেই অনেক কিছু খোলাখুলি ভাবে লেখা যেত না- মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ পেশীশক্তিধর ব্লগারদের কারণে।
বিভিন্ন দিক থেকে আমার একটা সামাজিক পরিচিতি ছিলো- যা আমি আসল নামে লিখে নিজেকে ব্লগে প্রকাশ করতে চাইনি, তাই বাবুয়া নামটাকেই বেছে নেই ......

অপুঃ ব্লগিং আপনার জীবনের উপরে কী রকম প্রভাব ফেলেছিল? কিংবা এখন কী রকম প্রভাব ফেলছে? ব্লগিংয়ের কারণে বিপদে পড়তে হয়েছে কখনো? যদি হ্যা হয় তাহলে যদি সংক্ষেপে তা বলেন।
জুল ভার্নঃ ব্লগ তথা সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাব আমাদের সবারই জীবনে পারিভাষিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে প্রভাবিত করে। আমি এখানে ভালোটুকুই বলবো- ব্লগারদের অনেক লেখায় বিভিন্ন সংবাদ, তথ্য, ও বিশ্লেষণ প্রদান করতো যা আমাকেও সচেতন করতো। কিছু লেখায় বিনোদন এবং মনোরমতা দিয়ে জীবনের মানসিক চাপ কমিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করতে সহায়ক হতো। ব্যক্তি সামাজিক পরিবর্তন গুলোতে সচেতন বাড়াতো। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব উন্নত করেছে এবং জীবনে প্রতিস্পর্ধা ও উন্নত করতে উৎসাহ তৈরি করেছে। পরিবেশ, সামাজিক সংস্কৃতি, সার্বজনীন নীতি এবং রাজনীতি উন্নতিতে প্রভাব ফেলতে সহায়ক হয়েছে। ব্যক্তিগত সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করেছে নিঃসন্দেহে।

ভিন্নতাঃ "ধর্মবিদ্বেস, স্পেশালী ইসলাম ধর্ম/কোরআন অবমাননা, সমকামীতা ব্লগারদের কাজ"- খারাপ অর্থে এমন একটা অপপ্রচারণা এবং ভালো অর্থে যতসামান্য প্রচার সুযোগ সন্ধানীরা লুফে নিয়ে সমাজ ও জনমনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। ফলশ্রুতিতে ব্লগারদের উপর একটা বাজে ধারণা স্টাব্লিস্টড হয়ে গিয়েছিলো। তেমন খারাপ পরিস্থিতি আমাকেও ফেস করতে হয়েছে......।

অপুঃ প্রেমিকা বা বউয়ের সাথে ভাব নেওয়ার জন্য সামুর কথা বলেছেন কখনও? এই যেমন জানো আমি সামুর ব্লগার এই টাইপের কথা বলেছেন কখনো?
জুল ভার্নঃ না, কখনওই না।

অপুঃ বর্তমান সময়ের ব্লগিং আর আপনারা যখন প্রথম সময়ের ব্লগিং এর ভেতরে কোন ধরনের পার্থক্য আপনার চোখে পড়ে?
জুল ভার্নঃ দৃশ্যত, সব থেকে বড়ো পার্থক্য- পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব। শ্রদ্ধা- সম্মান-স্নেহবোধের অভাব। আগেও ব্লগারদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধীতা ছিলো, মতভেদ ছিলো- আবার পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহমর্মীতারও কমতি ছিলোনা- ভালো লেখার অকুণ্ঠ প্রশংসা ছিলো সবার মধ্যে। এখন হাতে গোনা কয়েকজন ব্লগার অনলাইনে থাকে। মানসম্মত লেখা অত্যন্ত কম- এ ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্য নাই।

অপুঃ আপনার এই কথার সাথে দ্বিমত করার কোন উপায় নেই । এখন এই ব্যাপারটা সামুতে খুব প্রকট ভাবে দেখা যাচ্ছে। যাইহোক, সামুর বর্তমান ব্লগারদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? এই ব্লগারদের দিয়ে কি দেশের কোন উপকার কিংবা কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে কি আপনার মনে হয়? প্রশ্নটা যদি ঘুরিয়ে করি বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশে ব্লগিং এর কি কোন প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?
জুল ভার্নঃ প্রথমেই বলবো- ব্লগিং এর খুব বেশীই প্রয়োজন আছে। কারণ- শিক্ষিত, সৎ সাহসী ব্লগাররা কারোর 'পেইড' বা 'পেট' নয়। এরাই পারে- নির্মোহ ভাবে সত্যকে তুলে ধরতে। ব্লগ এবং ব্লগারগণই হতে পারে- নাগরিক সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত।

কিন্তু নানাবিধ কারণেই মনখুলে সত্যকথা বলা, লেখা বিপদজনক- অন্তত দেশে থেকে। প্রধানতম বাঁধা- সরকারের পছন্দের বাইরে, সরকার সমর্থক না হলে সত্য হলেও বলা এবং লেখা বিপদজনক। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ/ নিয়ন্ত্রিত। যারা সরকার সমর্থক নয়- তাদের বিরুদ্ধে যা খুশী লেখা/বলা গেলেও সরকারের বিরুদ্ধে যায়- তেমন সত্যও প্রকাশ করা যাবে না। বর্তমানে যারা ব্লগিং করেন- তাদের বেশীরভাগই আত্মকেন্দ্রীক...... এদের কাছে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালোকিছু আশা করা যায়না।

অপুঃ ব্যক্তিগত প্রশ্ন, প্রেম করেছে কতগুলো ?
জুল ভার্নঃ বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত অধ্যাপক সফিউদ্দীন আহমেদ স্যার বলেছিলেন- "এই দেশে ক্লাস ফাইভ- সেভেন পড়ুয়া এমন কোনো মেয়ে নাই- যে অনেকগুলো প্রেমপত্র পায়নি এবং লিখেনি......!" একই কথা বলেছিলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম/দ্বিতীয় বর্ষে পড়া কালীন আমাদের ডিপার্টমেন্টে সব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটা নির্মোহ সত্য প্রকাশের অপ্রকাশিতব্য জরিপ করে এর সত্যতা পেয়েছিলাম। অর্থাৎ সমান সমান!

অপুঃ আমরা সবাই জানি আপনি কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। সেই উত্তাল সময়ের কথা যদি চিন্তা করেন তাহলে এই বর্তমান সময়ে কী মনে হয়?
জুল ভার্নঃ সত্যি বলতে ছেলে বেলা থেকেই আমি ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। বাড়িতে কঠোর নিয়ম শৃংখলার মধ্যে বড়ো হলেও শৃংখলা ভেংগে সব কিছুতেই উতসাহী ছিলাম। উনসত্তুরের গণ আন্দোলনের সময় আমি খুবই পিচ্চি, তবুও সমবয়সীদের জড়ো করে মিছিলে অংশ নিয়েছি মূলত আনন্দ-ফুর্তির আমেজে, এমনকি কখনও বড়দের সাথে একাই শ্লোগান দিয়েছি- তা যে দলেরই হোক, মিছিল আমাকে টানতো! সাইকেল চালানো এবং ফুটবল খেলতে পছন্দ করতাম। কিন্তু আমাকে কোনো দল/গ্রুপই খেলতে নিতে চাইতো না। কারণ, আমি গোল দিতে পছন্দ করতাম- তা আমার নিজ দল কিম্বা প্রতিপক্ষ যে দলেরই হোক। গোল পোস্টের সামনে বল পেলেই পায়ে কিম্বা হাতে ধরে গোল দিতাম! তবুও আমাকে খেলতে নিতে হতো। কারণ, বলটা ছিলো আমার!

১৯৭১ সনে আমরা তিন ভাই (বড়ো ভাই মির্জা শামস টুয়েলভ ক্লাস, চাচাতো ভাই মির্জা সাবুর টুয়েলভ ক্লাস এবং আমি ক্লাস নাইন) ঝিনাইদা ক্যাডেট কলেজের ছাত্র।

ক্যাডেট কলেজের ৪র্থ শ্রেণীর কতিপয় স্টাফ ছাড়া সবাই ক্যাম্পাসে আবাসিক ছিলেন। আমাদের কলেজ এডজুট্যান্ট এবং মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন পাঞ্জাবী। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাসনের পর থেকেই আমরা কলেজ ক্যাম্পাসেরর বাইরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারতাম না। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ৪র্থ কর্মচারীদের মাধ্যমেই ২৫ মার্চের ম্যাসাকারের বিষয়টা আমরা খুবই হালকা ভাবে জানতে পারি ৩ দিন পর। হয়তো কলেজ প্রিন্সিপাল কর্ণেল রহমান, অন্যান্য শিক্ষক এবং সিনিয়র ক্যাডেটদের কেউ কেউ জানতে পারলেও প্রকাশ করতে পারেননি, আর আমাদেরমতো জুনিয়র ক্যাডেটদের পক্ষে জানার সুযোগ ছিলো না।
২৭/২৮ মার্চ কলেজের নিরাপত্তায় আনসার/সিভিল গার্ড বাহিনীর স্থানে মিলিটারী পুলিশ (এমপি) এবং পাক মিলিশিয়া সদস্যরা যৌথ দায়িত্ব নেয়।

২৮ মার্চ ক্যাডেট মির্জা শামস (কলেজ প্রিফেক্ট) সহ অন্য চার প্রিফেক্ট ক্যাডেটদের নিরাপত্তার কারণে কলেজ ছুটির ব্যাপারে কলেজ এডজুটেন্ট এর সাথে কথা বলতে গেলে তিনি কঠোর ভাবে দ্বিমত করেন। ওই দিনই গেম ফিল্ডে সিনিয়র সমমনা ক্যাডেটরা কলেজ থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়...
৩০ মার্চ ফজরের নামাজ শেষে আমার বড়ো দুই ভাই ক্যাডেট মির্জা সাবুর এবং ক্যাডেট মির্জা শামস এর নেতৃত্বে ১৪ জন জেষ্ঠ ক্যাডেটের সাথে আমিও কলেজ ক্যাম্পাস থেকে পালাই। যারযার সুবিধামতো কেউ যশোর/খুলনা/বাগেরহাট চলে যায়। আমার চাচাতো ভাই মির্জা সাবুর খুলনার টুটপাড়ায় ওদের বাড়িতে চলে যায়। অনেক বৈরী পরিস্থিতে ঝিনেদাহ থেকে যশোর> খুলনা> বাগেরহাট>গোপালগঞ্জ>মাদারীপুর হয়ে আমরা পায়ে হেটে, কখনো নৌকা/ছোট লঞ্চ যোগে ১২ দিনে আমরা দুই ভাই শারীরিক মানসিক বিদ্ধস্ত হয়ে বরিশাল পৌঁছি। বরিশাল পৌঁছে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি- আমার ছোট চাচা ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ঈমাম, (ফ্রেব্রুয়ারীতে ছুটিতে এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে) দেশের পরিস্থিতি আচ করতে পেরে তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাননি। বরং স্থানীয় ছাত্র, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ, ইপিআর এবং সেনা সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের বৃহত্তর পরিবারের লাইসেন্স করা শর্ট গান, পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল, পিস্তল ছাড়াও এলাকার অন্য যাদের লাইসেন্স করা পার্সনাল আর্মস ছিলো সেগুলো সংগ্রহ করে ট্রেইনিং শুরু করেন।

ক্যাডেট কলেজ থেকে আমাদের পালানোর খবর ছোট চাচা জেনে তখন থেকেই আমাদের যাওয়ার সম্ভাব্য যায়গায় নিকট আত্মীয় এবং বিশ্বস্ত লোকের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন। নির্দেশনা মোতাবেক আমরা বরিশাল থেকে পিরোজপুর পৌঁছানোর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা সেনা সদস্য খলিলুর রহমান আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে নৌকায় ভান্ডারিয়া, রাজাপুর হয়ে ২২ এপ্রিল বুকাবুনিয়া ক্যাম্পে পৌঁছেন।

আমরা দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করি। বড় ভাই মির্জা শামস পরবর্তীতে বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং উর্ধতন সেনা কর্মকর্তা হয়ে অবসর নিয়েছেন। আমি অনেক অস্র চালাতে পারতাম কিন্তু বয়স বিবেচনায় আমাকে কখনো অস্রহাতে যুদ্ধ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পাক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার আবদুল মজিদ(পরবর্তীতে স্থানীয় শিক্ষকতায় যোগ দেন) স্যারের সাথে আমি বিভিন্ন যায়গা থেকে আসা রিক্রুট মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকা ভুক্ত করতাম। বিভিন্ন ক্যাম্পে বার্তা এবং অস্র পৌঁছে দেওয়ার আগে মুক্তি যোদ্ধা রুস্তম মাঝির সাথে পথঘাট এবং যায়গাটা রেকি করে আসতাম। বিশ্বস্ত এবং দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম মাঝির সাথে আমি পার্শ্ববর্তী মঠবাড়িয়া, কাঠালিয়া, রাজাপুর, বেতাগী, সরুপকাঠী, বাকেরগঞ্জ থানার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে অনেক বার অস্র পৌঁছে দিয়েছি।

ক্যাপ্টেন মেহেদী এবং ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর এর নেতৃত্বে প্রথম দিকে সিভিল গান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেইনিং শুরু হলেও ২৭ মার্চ পিরোজপুর মহকুমা অস্ত্রাগার এবং ট্রেজারি লুট করে বিপুল পরিমাণ অস্র গোলাবারুদ এবং টাকা সংগ্রহ করা হয়। যার নেতৃত্ব দেন অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র আবদুস সাত্তার এর নেতৃত্বে বরগুনা মহকুমা অস্রাগার লুট করে। দুই মহাকুমার সব অস্র নিয়ে আসা হয় ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর এবং ক্যাপ্টেন মেহেদীর নেতৃত্বে সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বামনা থানাধীন বুকাবুনিয়ায়।

ছোট চাচা ক্যাপ্টেন(পরবর্তীতে মেজর) মেহেদী আলী ঈমাম মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। একই সেক্টরের সিনিয়র সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন পরবর্তীতে মেজর শাজাহান ওমর বীর উত্তম।
(এই বিষয়ে ২০০৮ সালে ব্লগে এবং ২০১২ সালে ফেসবুকে- "মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইদা ক্যাডেট কলেজ" শিরোনামে লিখেছিলাম)।

অপুঃ মুক্তিযোদ্ধারা তখন যেই আশা আকাঙ্খা নিয়ে নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, এখন সেই সবের কী প্রতিফলন হয়েছে?
জুল ভার্নঃ মনে রাখতে হবে, একাত্তরে এদেশের গ্রাম-বাঙলার হাজারও স্বল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত যুবক যারা লুঙ্গি পরে কোমর-মাথায় গামছা বেঁধে খালি পায়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল- যাদের বেশীরভাগই ছিল ছাত্র, স্কুল শিক্ষক, চাষী, মাঝি, মজুর, বেকার তরুণ যুবক। তাদের সহযোগীতা করেছেন কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, যারা দেশের ভেতরে থেকে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও আশ্রয় যুগিয়েছিল। শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধির খবর দিয়ে সাহায্য করেছিল, তাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ কোনো কোটা প্রাপ্তি কিম্বা চেতণা ফেরি করা নয়। কোনো কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে বা ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসাব করে তারা যুদ্ধে যাননি। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই- নিখাদ দেশপ্রেম, অন্যায়-অত্যাচারের বিরদ্ধে মরণপণ প্রতিরোধ। অথচ এখন টেলিভিশন, সুস্বজ্জিত মঞ্চে মুক্তিযোদ্ধা নামে যারা বক্তৃতায় মঞ্চ কাঁপায়, এদের প্রায় সবাই শিল্পপতি, বড়ো ব্যবসায়ী! তারা সবাই কেতাদুরস্ত সুটেট-বুটেট শতশত কোটি টাকার মালিক!

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও জাতীয় ঐকমত্য দেখি না কোনো কিছুতেই। জাতিসত্তার ও জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায়, ইতিহাসের গুরত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর বর্ণনায়, বরেণ্য নেতাদের তালিকায়, বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুর মধ্যে, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সর্বত্রই বিভাজন। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বে সৎ ও নিঃস্বার্থ নেতার সংখ্যা কমে এসেছে। পুঁজিবাদী ও পেশীশক্তিই এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান যোগ্যতা। সৎ, যোগ্য, শিক্ষিত, ত্যাগী, নিবেদিত প্রাণ, নিঃস্বার্থ সমাজসেবক অথচ টাকা পয়সা নেই এমন ব্যক্তিরা এখন সর্বত্রই অপাংতেয়! দলীয় তোষামোদি করায় এদের কেউ কেউ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই পেয়েছে।

স্বাধীনতা পূর্বে আমরা ‘বাইশ পরিবারে’র শোষণের বিরদ্ধে কথা বলতাম। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে অবাঙালি বাইশ পরিবারের স্থান নিয়েছে বাইশ হাজার বাঙালি পরিবার। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সমাজিক শ্রেণী শোষণ কি কমেছে? মানুষে মানুষে বৈষম্য কি সামান্যতম হ্রাস পেয়েছে, নাকি অজস্র অজস্র গুণ বেড়েছে? এমন কি আঞ্চলিক বৈষম্যও কি এদেশে ক্রমবর্ধমান নয়? এটাকেই কি স্বাধীনতার আকাঙ্খার বাস্তবায়ন বলবো?

অনেক কথা বলে/লিখে ফেললাম। তারপরেও তোমার প্রশ্নের সারসংক্ষেপ উত্তরঃ দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে- আমাদের নতুন প্রজন্মের সিংহভাগই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানে না। যা জানে তা ফ্যাক্টরী মেড, ফরমায়েশী লেখা- "মুক্তিযুদ্ধের গল্প"! অথচ মুক্তিযুদ্ধ কোনো গল্প নয়, কঠিন বাস্তবতা। আজ যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছেন তারা নিজেরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির ধারে কাছেও নেই।

অপুঃ সামুতে এখন আর আগের মত মান সম্মত পোস্ট আসে না বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। সামুর অবস্থাও আগের মত আর নেই। আপনার এই ব্যাপারে মত কী?
জুল ভার্নঃ এখানেও পারস্পরিক বিভাজন! যেখানে রাষ্ট্রীয়/ সরকারী ভাবে বিভাজনকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়- সেখানে ব্লগ/ সোস্যাল মিডিয়া বাদ যাবে কেনো! কেউ রাজনীতি নিয়ে, জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখলে তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে আক্রমণ করে। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লিখলে তাকে মৌলবাদী/রাজাকার ট্যাগ দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে লিখলে তাকে নাস্তিক/ধর্মবিদ্বেসী ট্যাগ দেওয়া হয়। নাস্তিকতার নামে শুধুমাত্র ইসলাম বিদ্বেস/কোরআন বিদ্বেস ছড়ানো হয়। সর্বপরি এখন সবাই লেখক, পাঠক নাই। সবাই আত্মপ্রচারে মগ্ন। কেউ শিখতে চায়না, সবাই শিখাতে ব্যস্ত।

ব্লগ আর ফেসবুক এর মধ্যে একটা বড়ো রকম পার্থক্য আছে। তুমি নিজেও ব্লগার এবং ফেসবুকেও সক্রিয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবে- যেসব ব্লগার বন্ধুরা ফেসবুক করে তাদের দুটো প্লাটফর্মের লেখা ভিন্ন ধরনের। ব্লগের লেখায় গভীরতা থাকতে হয়। ভালো লেখক হতে হলে আগে ভালো পাঠক হতে হবে। ব্লগে লিখতে হলে কিছুনা, অনেক বেশীই পড়ালেখা করতে হয়, জানতে হয়- সেটাই ব্লগে প্রথম দিকে ছিলো। ফেসবুকে চটুল লেখা বেশী জনপ্রিয়- যা লিখতে তেমন পড়াশুনার দরকার হয়না। এখন ব্লগারদের মধ্যেও সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যা ব্লগের জন্য ভালো নয়।

যারা লেখালেখি করেন- তাদের বেশীরভাগই নিরীহ গো-বেচারা প্রকৃতির। ভাল লেখকরা কারোর সাথে লাগতে যায়না। গালাগাল করেনা। এখন একশ্রেণীর ব্লগার লেখার সমালোচনা করেনা, লেখকের সমালোচনা করে। সমালোচনার নামে হুমকী ধামকী দেয়- "অমুক মন্ত্রীর ডান হাত, অমুক পার্টীর ক্যাডার- দেখাইয়া দিমু!"- এসব দেখে ভালো লেখকরা লেখালেখিতে উতসাহ হারিয়ে ফেলেছে।

২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সংস্থার ব্লগে নজরদারী শুরু হয়েছে- যা প্রকট আকার ধারণ করেছে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে হামলা এবং হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। লেখালেখির কারণেই অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে- তাই অনেকেই যা লিখতে চায় তা লিখতে পারেন না। নিতান্তই নিরুপায় হয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছে।

অপুঃ সামুকে আগের পর্যায়ে নিতে যেতে হলে কী করতে হবে বলে আপনার মনে হয়?
জুল ভার্নঃ এই প্রশ্নের জবাব তোমার আগের প্রশ্নের উত্তরের বিপরীত। কাজেই উত্তরের কলেবর আর বাড়াতে চাইনা। সাথে যোগ করতে চাই- সাইবার নিরাপত্তা আইন, দ্রুত বিচার আইন যা লেখকের প্রতিবন্ধকতা- এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যে যাই বিশ্বাস করি না কেন একে অন্যের প্রতি সহনশীল থাকতে হবে। লেখার সমালোচনা হোক, লেখকের নয়।

অপুঃ আমরা সবাই জানি আপনি খানিকটা অভিমান করেই সামু থেকে চলে গিয়েছিলেন। আপনার চলে যাওয়ার পেছনের কারণটাও আমরা জানি। আবার যে ফিরে এসেছেন এটা দেখকে ভাল লাগছে। আশা করি আবার চলে যাবেন না।
জুল ভার্নঃ হ্যা, সামুর প্রতি অভিমান আছে তাই বেশীর ভাগ লেখা ডিলিট এবং ড্রাফট করে দিয়েছি। কিন্তু কয়েকজন ব্লগার লেখকদের লেখা পড়ার জন্য মাঝেমধ্যে ব্লগে ঢুকি। কাজেই সামু বিমুখ হইনি এবং হতে পারবো না।

স্বাধীনতাত্তর পড়ায় দেশীয় মাধ্যমে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিলো আমাদের ক্রেজ। তারপর যায়যায়দিন এবং সাপ্তাহিক সন্ধানী ছিলো আমার অন্যতম পছন্দের পত্রিকা। প্রকৃতপক্ষে লেখালেখির জন্য আমি প্রথম স্বীকৃতি পাই যায়যায়দিন থেকেই। আবার লেখালেখি করে জনপ্রিয়তা পেয়েছি সামুতে। এখনও লেখালেখির প্লাটফর্মে সামু আমার সব চাইতে স্পর্শকাতর কিন্তু স্বাচ্ছন্দের যায়গা। আমি সামুর সাথেই ছিলাম, আছি এবং থাকবো।

অপুঃ সামুর মডারেশন প্যানেল নিয়ে অনেকেই খুশি না। অনেকের অনেক রকম অভিযোগ রয়েছে? আপনার সামুর মডারেশন প্যানেল নিয়ে কি কোন অভিযোগ রয়েছে? এছাড়া মডারেশন প্যানেল নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
জুল ভার্নঃ 'সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি'/ দীর্ঘসূত্রিতা ছাড়া মডারেশন নিয়ে আমার তেমন কোনো অভিযোগ নাই। আমি মনে করি- মডারেশন প্যানেলের সবাই সুশিক্ষিত এবং অনেক জ্ঞানী ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন। যদি বলি- বর্তমান মডারেটর কাল্পনিক_ভালোবাসা শুধু একজন গুণী ব্লগারই নন, সেই সাথে অনেক বেশী ব্লগার বান্ধব, অনেক বেশী উদার (এই উদারতাই তাকে দ্রুত সিদ্ধান্তহীনতা কিম্বা দ্বিধান্বীত মনে হয়) তাহলে তা অতিরঞ্জিত হবে না।

অপুঃ আপনাকে যদি একদিনের জন্য মডু বানিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী করবেন? কাকে একবারে সুলাইমানি ব্যান করবেন?
জুল ভার্নঃ সরল স্বীকারোক্তি- মডু হবার যোগ্যতা আমার নাই। পরিস্থিতিগত কারণে একদিনের জন্য মডু হলে কিছুই করার থাকবেনা। তারপরও সুযোগ থাকলে ব্লগের নিয়মানুযায়ী দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।

অপুঃ ৫ই আগস্টের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান এবং এর পরে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আপনার বক্তব্য এবং আশা কী?
জুল ভার্নঃ উত্তরঃ অপু, যতদূর মনে পড়ে, সামহোয়্যারইন ব্লগের জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলে- মে-জুন মাসে.... তখনকার প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেক ভিন্ন। তখনকার সময়ে প্রশ্ন এবং উত্তর বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুটা বৈসাদৃশ্য থাকা স্বাভাবিক। তাই এই প্রশ্নের জবাবে জুলাই আগস্ট আন্দোলন সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করবো। এই প্রশ্নের জবাবে-

প্রথমেই বলবো- আশা আর প্রত্যাশার ব্যবধান আসমুদ্রহিমাচল! তারপরও এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে একটা রাজনৈতিক উপখ্যান হয়ে যাবে। ৫ই আগস্টের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পেছনে আছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের লুটপাট, নির্যাতন নিপীড়ন আর আমজনতার বঞ্চনার ইতিহাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে গেল, তা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না বলা যাবেনা। বরং গত পনেরো বছরে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে নিবর্তন মূলক শোষণ উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের, সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যোগ হয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। কাজেই শুধু জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দিয়েও এটাকে সীমিত করা যাবে না। তবে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত রাজনৈতিক নেতৃত্বে হয়নি। গণঅভ্যুত্থান তো আগেও দেখেছি। ১৯৬৯, ১৯৯০ এ গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। '৬৯ এ রাজনৈতিক দলগুলো যেমন- আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ সামনে ছিল। সেই আন্দোলনের ফসল মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন দেশে আবার গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৯০ সালে ৯ বছরের আন্দোলনের ফসল এরশাদের পতন। তখন বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও বামদলের নেতৃত্বে সম্মিলিত আন্দোলন হয়। এবারের জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ ভাবে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, কোনো নির্দিষ্ট নেতাও ছিল না। কিন্তু যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া সবাই ছিলো একাট্টা। ছাত্র আন্দোলন দমাতে গিয়ে শেখ হাসিনা যাকিছু করেছে, তার সবই একদফা শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছে।

গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় বসে নির্বাচন কিংবা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে পুলিশী নির্যাতন, গুম-খুন, দমন-পীড়নসহ সবকিছু করেছে। তারা মিডিয়াকে ভয়াবহভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আদালত অকার্যকর করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ছিলো আজ্ঞাবহ। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেরুদণ্ডহীন মাস্তানদের ভিসি, শিক্ষক নামের গুন্ডাদের সমাবেশ ঘটিয়েছে। দুর্নীতির কারণে একদিকে যেমন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে, অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ইন্ডিয়ার সাথে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের গোপন চুক্তি করেছে, মেগাপ্রকল্পের নামে মেগাদুর্নীতি স্বীকৃতি পেয়েছিল। সব মিলিয়ে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ক্ষমতাসীন এবং তাদের দোসর গং ছাড়া আপামর মানুষের মধ্যে হতাশা তথা জাতিগত ডিপ্রেশন তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব তৈরি করেছিল।

কোটা বাতিলের পরিপত্র আদালত বাতিল করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আনোলকারীদের অনেকেই ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলন আবার শুরু হলে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হওয়ায় জনগণের সমর্থন পায়। বিপরীতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিল- সমাবেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আক্রমণ করে। মেয়েদের ওপর আক্রমণ করলো, আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে শেখ হাসিনা বক্তব্য দিলে পুলিশ, র‍্যাব শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক হামলা করে, যা আপামর মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ সাতজন যখন নিহত হলো, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া ভয়ংকর আকার ধারণ করে। আবু সাঈদের ওপর যেভাবে গুলি হয়েছে যার কোনোই যৌক্তিকতা নেই। এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ সমর্থন দিলো আন্দোলনে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সাথে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী, কলেজের শিক্ষার্থী, স্কুলের শিক্ষার্থীরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়। রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, নারী-পুরুষ শিশু নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে এলো- পুরো দেশে ছড়িয়ে গেল হাসিনা বিরোধী আন্দোলন।

শেখ হাসিনা আদালতের দোহাই দিয়ে সময় ক্ষেপণ করার চেষ্টা করলে আন্দোলন আরও তীব্র হলে আদালতের তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসলে বোঝা গেল পুরো বিষয়টি আসলে ভাঁওতাবাজি। ততদিনে শতশত মানুষের জীবন চলে গেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। গুলিতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ মানুষ নিহত হলো। এরপর শেখ হাসিনা আলোচনায় বসার কথা বলল, আর অন্যদিকে সমন্বয়কদের আটক করে আন্দোলন প্রত্যাহারের চেষ্টা করল।

ততক্ষণে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইনজীবী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ডাক্তার, শ্রমজীবী মানুষ, রিকশাচালক সর্বস্তরের হাজারো মানুষ অংশ নেন। সম্মিলিতভাবেই তখন দাবি এলো পদত্যাগের, সারাদেশের মানুষ পদত্যাগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। তখনো চারিদিকে পুলিশি অভিযান, চারিদিকে গুলি, ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব। পাঁচ শতাধিকমানুষ হত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। তবুও শেখ হাসিনা হত্যা বন্ধ করেনি। বরং আরও নির্মম হয়ে ওঠে। নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানো হয় দেশজুড়ে। এত মানুষকে গুলি করেও যখন আন্দোলন দমানো যাচ্ছে না। কিন্তু স্বৈরাচারের ট্রাজেডি হলো তারা বুঝতে পারে না তাদের পতন। সবশেষ সেনাবাহিনী যখন গুলির বিরুদ্ধে অবস্থান নিল, তখন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে পালাতে হলো।

ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনের ফসল নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে দুই মাস পার হয়ে গিয়েছে। ১৫ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে দুই মাস মোটেই বেশী সময় নয়। তারপরও আমজনতার প্রাথমিক প্রত্যাশা- নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানো, আইনশৃংখলা পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণ এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান সহযোগীদের পাকড়াও করা- যা মোটেই আশানুরূপ নয়।

এছাড়াও, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে না পারা, আহতদের চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব সরকার যথাযথ ভাবে নিতে না পারা জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এখনো আহত-গুলিবিদ্ধদের অনেকে মারা যাচ্ছে। আহতদের মধ্যে যারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছে তাদের এবং নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলা হলেও অদ্যাবধি জান-মালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের দুই একজন ছাড়া কাউকে কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মোটা দাগের ব্যার্থতাঃ
(১) নিত্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। (২) সিদ্ধান্তহীনতা। (৩) শেখ হাসিনার লুটেরা, সন্ত্রাসী সহযোগীদের আটকাতে না পারা এবং পালানোর পর নিষেধাজ্ঞা। (৪) দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির টাকা সরিয়ে নেওয়ার পর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা- সবই সুশাসনের প্রতিবন্ধক।

এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটসহ যেসব চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলো বাতিলের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অসম বাণিজ্য, সীমান্ত হত্যা এগুলো নিয়েও এই সরকার এখনো কার্যকর কিছু করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ভারতসহ সব দেশের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি প্রকাশ করা।

আন্তর্জাতিক বলয়ের কথা বলতে সবার আগে আসবে ভারত। ব্যক্তিগত ভাবে আমি বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকারের বিরোধিতা করি। কারণ, ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের সাথে নয়, আওয়ামী লীগের সাথে বন্ধুত্ব করে কায়েমি স্বার্থ উদ্ধার করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থ বঞ্চিত হচ্ছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- বাংলাদেশে বা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রকট প্রভাব আছে। ভারত বড় দেশ হিসেবে আশেপাশের দেশের ওপর দাপট দেখানোর চেষ্টা করে। অন্যান্য দেশের ওপর অতটা না পারলেও বাংলাদেশের ওপর বেশি প্রভাব রেখেছে আওয়ামী লীগের নতজানু নীতি এবং জনগণ ধিকৃতির কারণে। আওয়ামী লীগ সরকারের ৮০% জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে ভারতের হাত ছিল। গত দেড় দশকে তাই ভারতের আধিপত্য আমাদের দেশে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা তো বলতোই, 'ভারতকে আমি যা দিয়েছি তারা সেটা সারাজীবন মনে রাখবে।'- সেই মনে রাখার মতো অপকর্মই শেখ হাসিনার পতন তরান্বিত করেছে।

তবে বাংলাদেশের উপর ভারতের আধিপত্য থাকবে না, এটাও বলা যাবে না। কারণ বিএনপি, জামায়াত সবাই বলছে ভারতের সঙ্গে তারা ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। এতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য নিয়ে একটা বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে।

অস্বীকার করার সুযোগ নাই, বর্তমান সরকারের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও সরকারের চ্যালেঞ্জ হবে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গ্রুপ, ইন্টারন্যাশনাল লবি, সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির স্বার্থ রক্ষা করা। এই তিন শক্তিই চাইবে তাদের স্বার্থ রক্ষা হোক। এটা সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে সততা, সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা দিয়ে।

এই সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জনগণ। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গা তৈরি করতে পারলে মানুষ এই সরকারের পাশে থাকবে। বলছি না রাতারাতি সব করে ফেলতে হবে। কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলোর সূচনাটা তো এখনই করতে হবে। পরে পর্যায়ক্রমে সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হবে।

গণঅভ্যুত্থানের যে স্পিরিট বা শক্তি, তার ওপর ভিত্তি করেই অনেক কাজ করা যায়। সরকার যদি শিথিল থাকে বা দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নেয়, তাহলে অনেকগুলো কাজ পরে আর করতে পারবে না। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু কাজ করতে হবে। মানে পরিবর্তনের সূচনাটা এখনই করতে হবে- এটাই আমার প্রত্যাশা।

সব শেষে তোমার মাধ্যমে সামু ব্লগে লেখক পাঠক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার সালাম জানাই। সকলের জন্য শুভ কামনা।

অপুঃ সামুর অন্যান্য ব্লগাররা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারে । আশা করি সময় নিয়ে সেই প্রশ্ন গুলোর জবা দিবেন । আজকের মত ইন্টারভিউ এখানেই শেষ । এই ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য আপনাকে কয়েকবার নক দিয়ে জ্বলাতন করেছি । সময় নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ !!
জুল ভার্নঃ তোমাকেও ধন্যবাদ । আর যারা এতো সময়ে এই ইন্টারভিউ পড়েছেন তাদেরকেউ ধন্যবাদ।

ব্লগারগন আপনারা চাইলে জুলভার্ন ভাইকে প্রশ্ন করতে পারেন কমেন্ট সেকশনে। সময় সুযোগ মত জুলভার্ন ভাই সেই প্রশ্নের উত্তর দিবে আশা করি । আজকের আয়োজন এই পর্যন্তই । আবার সামনের মাসে দেখা হবে আশা করি।


আগের পর্বগুলো
সাড়ে চুয়াত্তর
কাল্পনিক_ভালোবাসা
ভুয়া মফিজ
শায়মা




Pic source

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:০৯

কামাল১৮ বলেছেন: ১৯৩৪ সালে পুরো পরিবার বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার কারণ কি ছিলো।নদিভাঙ্গন নাকি অন্য কোন কারন।আমরা বিক্রমপুর ছেড়ে যশোর চলেযায় নদিভাঙ্গনের কারণে।তখন আমি ছোট।

২| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২৪

জুল ভার্ন বলেছেন: কামাল ভাইজান, আমার দাদারা ছিলেন দুই ভাই, দুজনেই ছিলেন ঢাকার আদালতের আইনজীবী, বড়ো চাচা ছিলেন চাকুরিজীবী পোস্টিং ছিলো ঢাকা। পরিকল্পিত ভাবেই ঢাকায় বাড়ি কিনেছিলেন।

৩| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২৫

জুল ভার্ন বলেছেন: আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২৮

অপু তানভীর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ সময় নিয়ে উত্তর দেওয়ার জন্য

৪| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১১:৫৭

আজব লিংকন বলেছেন: পুরো ইন্টারভিউটা দারুণ হয়েছে। অনেক অজানা কথা জানা হলো।

৫| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১১:৫৮

আজব লিংকন বলেছেন: জুল ভার্ন আপনি একটা পোস্টে আমাকে আপনার নামে হওয়া মিথ্যে মামলাগুলোর কথা বলেছিলে। থানা ভাংচুর মামলাও ছিল মনে হয়। লেখালেখি জন্যই কি সেই মামলাগুলো হয়েছিল? তারপর থেকেই কি লেখালেখির হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন?

এই ইন্টারভিউ সেই মিথ্যা মামলাগুলোর বিষয়ে কেন আলোচনা করলেন না? অনেকে জানা উচিত আপনার উপর দিয়ে কি অমানবিক নির্যাতন গিয়েছে।

৬| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১২:১২

ডার্ক ম্যান বলেছেন: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ কিংবা রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লেখা বই কি আগামী বইমেলায় আসবে?

অদূর ভবিষ্যতে দেশে কি আবার সামরিক শাসন আসবে?

৭| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৬:৩৭

জুল ভার্ন বলেছেন: @আজব লিংকন, আমার ঠিক মনে পড়ছে না, কোন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেছিলাম। তবে হ্য আমার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হয়েছিল শুধু লেখালেখির কারণেই। গুম, গ্রেফতার, রিমান্ড, জেল বাস নিয়ে শুধু আমাকেই নয়, আমার পরিবারের সবাইকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে.... তারপর থেকে আমার স্ত্রী সন্তানদের প্রবল আপত্তি আমার লেখালেখির জন্য। সবার কথা চিন্তা করেই লেখালেখি থেকে দূরে থাকা। আজ বাংলা আউট লুকে আমার গুম নিয়ে একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, পড়ে দেখতে পারেন। https://banglaoutlook.org/investigation/238094

৮| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৬:৩৯

জুল ভার্ন বলেছেন: @ডার্ক ম্যান, জ্বি আশা করি।
আমার গুম নির্যাতন নিয়ে আজ একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। পড়তে পারেন- https://banglaoutlook.org/investigation/238094

৯| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:০৯

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:

উনি সরকারী চাকরি কবে ছেড়েছেন?

১০| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: বিশাল পোস্ট।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.