![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভূমিকাঃ
…এবং (হে মুহম্মাদ) আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে রয়েছে প্রত্যেক বস্তুর সুস্পস্ট বর্ণনা, এবং হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের (অনুগত) জন্য সুসংবাদ।” [নাহলঃ ৮৯]
…And We have sent down to you the Book as clarification for all things and as guidance and mercy and good tidings for the Muslims.
কোরআন ঘোষণা করেছে যে তার প্রাথমিক কাজ হলো সবকিছুর ব্যাখ্যা করা এবং উপ্রোক্ত আয়াতের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে মানবকূলের ইতিহাসে এযাবৎকালের ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার সবচে আজব, সবচে রহস্যময়, এবং সবচে ব্যাখ্যাতীত ঘটনাটিও কোরআন বুঝিয়ে দিতে সক্ষম। বিশেষত সেই ঘটনাটি যার প্রকৃত রূপ এখনো অনাবৃত, কিন্তু ঐ ঘটনার ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া আমরা পুরো বিংশ শতাব্দী ধরে প্রত্যক্ষ করে আসছিঃ
১৯১৭-১৮ সালে সেকুলার বা ধর্ম-বিমুখ ইউরোপ মুসলিমদের আরেকটি হলিল্যান্ড বা পবিত্রভুমি জেরুজালেমকে মুক্ত করার সাফল্য অর্জন করে। প্রায় ১০০০ বছর পূর্বে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত ক্রুসেডের মাধ্যমে যে প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছিলো, এই সাফল্য মুলত সেই সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই ফল।
[মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো, খ্রিস্টান ইউরোপের “পবিত্রভূমিকে” মুক্ত করার মোহ ১০০০ বছর পুরানো, কিন্ত বর্তমান ইউরোপ পুরোপুরিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ তথা অবশ্যই ধর্ম-বিমুখ। তাহলে যাদের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই, যারা ধর্মের ধার ধারে না তারা কেনো “পবিত্রভূমিকে” মুক্ত করতে চাইবে? আর ১০০০ বছরের বেশি আগে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা একমাত্র ইউরোপীয় খ্রিস্টানরাই বা কেনো “পবিত্রভূমিকে” মুক্ত করার মোহে অন্ধ?]
২০০০ বছর আগে, মহান আল্লাহ্ যেই ভূমিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সেই আদি ইজরায়েল রাস্ট্রের পুনরুদ্ধার কাজে ইউরোপীয় ইহুদীদের সাফল্য— এই সাফল্যও সম্ভব হয়েছে ঐ একই ধর্মনিরপেক্ষ, মূলত ধর্ম-বিমুখ ইউরোপের সক্রিয় সহায়তায়!
[দাঊদ (আ) এবং সুলাইমান (আ) কর্তৃক ২০০০ বছরেরও আগে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় রাষ্ট্রটি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে, ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপ কেনো ইউরোপীয় ইহুদীদের সাহায্য করার জন্য এমন মোহাচ্ছন্ন হবে? আর কেনই বা (গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদীদের মধ্যে) কেবল ইউরোপীয় ইহুদীরাই ইজরায়েল রাস্ট্র পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ হবে? আই মিন, প্যাগান রোমান সাম্রাজ্য খ্রিস্টান রোমে রুপান্তরিত হবার পর নতুন সৃষ্ট এই খ্রিস্টান চার্চ বা কর্তৃপক্ষ ইউরোপের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করার সাথে সাথেই “পবিত্রভূমির” প্রতি এক অদ্ভূত মোহাচ্ছন্নতা প্রদর্শন করে, যা (ইউরোপের বাইরে) অন্য কোনো খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মাঝে দেখা যায় নি। আর তাই ক্রুসেডসমূহ কেবল খ্রিস্টানদের আক্রমণ ছিলো না, বরং বলা যায় সেগুলো ছিলো ইউরো-খ্রিস্টানদের আক্রমণ। “পবিত্রভূমির” নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেবার লক্ষ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর রক্তক্ষয়ী ক্রুসেড পরিচালনা করা হয়। এই ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের যদিও বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের আবাসভূমি মাড়িয়ে যেতে হয়, তবুও অ-ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা ইউরোপীয়দের সাথে (ক্রুসেড অভিযানে) যোগ দেয়নি। ক্রুসেডসমূহে এদের কোনো ভূনিকা ছিলো না। তাই পবিত্রভূমি ও জেরুজালেম সংক্রান্ত মোহাচ্ছন্নতা খ্রিস্টান বৈশিষ্টের চেয়ে বরং ইউরোপীয় বৈশিষ্ট বললেই সঠিক বলা হবে।]
আল্লাহ্ কর্তৃক পবিত্রভূমি থেকে বহিষ্কৃত হবার পর এবং ২০০০ বছর বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার পর ইজরায়েলী ঈহুদীদের পবিত্রভূমিতে প্রত্যাবর্তন (অর্থাৎ ইউরোপীয় ইহুদীদের প্রত্যাবর্তন)। ইউরোপীয় ইহুদীরা, ইজরায়েলী ইহুদীদেরকে পবিত্রভূমিতে ফিরিয়ে আনলেও, তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে “ফিরে এসেছে” কথাটি প্রযোজ্য নয়, কারণ তারা তো আগে কোনো সময়েই সেখানকার বাসিন্দা ছিলো না- তারা কেমনে সোজা পবিত্রভূমিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলো?
[ইউরোপীয় মানুষজন কেনো ইহুদীধর্মে ধর্মান্তরিত হলো, এবং কেনই বা তারা পবিত্রভূমি মুক্ত করার ও ইজরেয়েলী ইহুদীদেরকে সেখানে ফিরিয়ে আনার মিশনকে যে করেই হোক সম্পন্ন করার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করলো?]
এই রহস্যময় ঘটনাগুলোর সবকিছুই, বাকি পৃথিবীর কাছে আজব ও নৈরাশ্যজনক মনে হলেও, ইহুদীদের কাছে তাদের দাবীকৃত সত্যাসত্যের প্রমাণস্বরুপ মনে হয়। উপরের ঘটনাগুলো থেকে মনে হতে পারে যে, মহান আল্লাহ্ ইহুদীদেরকে যে কথা দিয়েছিলেন, অর্থাৎ তাদের মাঝে একজন নবী পাঠানো হবে, যাকে সবাই “মসীহ্” বলে জানবে, এবং যিনি তাদের জন্য সুলাইমান (আ) এর “Golden Age” এনে দেবেন- সেই সকল প্রতিশ্রুতি বাস্তব রূপ লাভ করলো বুঝি!
“কোরআন ও বাইবেলে ইয়াজুজ মাজুজ” নোটে দেখানো হবে যে, কোরআন শুধুমাত্র যে এসকল আজব ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দিয়েছে তাইই নয়, বরং জেরুজালেমের শেষ পরিণতি কি হবে তাও বলে দিয়েছে। কোরআন এমন এক পরিণতির কথা জানিয়ে দিয়েছে, যা ইহুদীদের বাইবেলীয় সতাসত্যের দাবীর ভিতরে যে মিথ্যাচার রয়েছে তাকে উন্মোচিত করে দেয় এবং রাসুলুল্লাহ্ (স) এর কাছে যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছিলো সেটাকে নিশ্চিত করে।
ইয়াজুজ ও মাজুজ পরিচিতি ও অতীত অবস্থানঃ
একদা নবী (স) তাঁর কিছু সাহাবীর সাথে দেখা করলেন যারা বসে ছিলো এবং একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন ছিলো। তিনি তাদের আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তখন তাঁকে বলা হলো আলোচনাটি ছিলো সা’আর আলামত নিয়ে। আল্লাহ্র একজন সত্য নবী হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেনঃ
“লা তাকুমুস সা’আ হাত্তা……”
অর্থাৎ শেষ সময় আসবে না যতক্ষণ না দশটি আলামত প্রকাশিত হচ্ছে। সেই দশটি আলামতের একটি হলো ইয়াজুজ মাজুজের প্রাদুর্ভাব।
কোরআনে দু’জায়গায় ইয়াজুজ মাজুজের বর্ণনা আছে। একবার সূরা আম্বিয়ার ৯৫-৯৬ আয়াতে ইয়াজুজ মাজুজের মূল ভূমিকাটি বর্ণিত হয়েছে, আরেকবার সূরা কাহাফে তাদের অবস্থান, কৃষ্টি-কালচার, চরিত্রের বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমাদের কর্মপন্থা হলো প্রথমে কোরআন থেকে ইয়াজুজ মাজুজের জীবনচিত্র বা জীবনআলেখ্য বের করবো। তারপর হাদীসের সহায়তা গ্রহণ করবো, এরই ফাঁকে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিকৃত বাইবেলের ইয়াজুজ মাজুজ সংক্রান্ত দাবীর ন্যায্যতাকে কোরআনের কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করবো।
সূরা কাহাফের ৮৩-১০১ আয়াতে ইয়াজুজ মাজুজের বিস্তর বর্ণনা আছে।
“তারা আপনাকে (হে মুহম্মদ!) যুলক্বারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, “আমি তোমাদের কাছে তাঁর কিছু কিছু অবস্থা বর্ণনা করবো।” [কাহাফ ১৮:৮৩]
And they ask you, [O Muhammad], about Dhul-Qarnayn. Say, “I will recite to you about him a report.”
আভিধানিকভাবে যুলক্বারনাইন বলতে “দুই শিং” এর অধিকারীকে বুঝায়। আরবি “ক্বারন” বলতে শিং বুঝায়, তবে এর আরেক অর্থ হচ্ছে, কাল বা যুগ। কিন্ত কোরআনে যতবার “ক্বারন” শব্দটি এসেছে এটি শেষোক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হলো, সূরা কাহাফ এমন একটি বর্ণনা পেশ করেছে যা দুটি যুগকে প্রভাবিত করে। এই দুটি যুগের একটি যুগ ছিলো অতীতে এবং আরেকটি যুগ হবে শেষযুগ (End time)। যুগ দুটি এতই ভিন্ন হবে যে তারা একে অপরের সম্পূর্ণ উল্টো হবে।
শেষ নবীর আগমনের পর তিনি আসলেই নবী কি না তা যাচাই করার জন্য মদীনার মুরুব্বি সম্প্রদায় ইহুদীদের কাছে ধর্না দিলো। কারণ ইহুদীরা এমন একটি জাতি যে জাতির কাছে সবচে বেশি নবী পাঠানো হয়েছিলো এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সবচে বেশি নবী খুন করার রেকর্ডও তাদের দখলে। তাই মদীনার লোকজন এই মতৈক্যে পৌঁছালো যে মুহম্মদ আল্লাহ্র সত্য নবী কি না তা একমাত্র ইহুদীরাই পরীক্ষা করতে পারে। দায়িত্ব পেয়ে মদীনার ইহুদী রাবাইরা নবী (স) কে সেই বিখ্যাত ভ্রমণকারী সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলো, যে পৃথিবীর দুই প্রান্ত ভ্রমণ করেছিলো। তাদের ধারণা ছিলো যে, যদি তিনি এই (সেই সাথে আরো দুটি প্রশ্ন) প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন তবে এটি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করবে যে, তিনি আসলেই আল্লাহ্র সত্য নবী। কোরআন এখানে সেই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেছে।
“আমি তাঁকে পৃথিবীতে (রাস্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে) প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং তাঁকে ক্ষমতা দান করেছিলাম যেনো তিনি যেখানে ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারেন…” [কাহাফ ১৮:৮৪]
Indeed We established him upon the earth, and We gave him to everything a way.
যুলক্বারনাইন ঈমানদার বান্দা ছিলেন, তাঁর বিশ্ব-ব্যাবস্থার (Pax Quarnain) রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা ছিলো ঐশ্বরিক মদদপুষ্ট। ঐ বিশ্ব-ব্যাবস্থার ভিত্তি ছিলো ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতি ও নৈতিকতার মাঝে কোন্ ধরণের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা উচিত? ঐশ্বরিক মদদপুষ্ট বিশ্ব-ব্যাবস্থা যখন ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তখন এটি কোন্ ধরণের বিশ্ব-ব্যাবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং টিকিয়ে রাখে? সূরা কাহাফ আমাদেরকে সেই শিক্ষা দিচ্ছে এবং আমাদেরকে সহায়তা করছে দ্বিতীয় “ক্বারন” টিকে (দুই যুগের দ্বিতীয়টি) চিহ্নিত করতে, যা উপরে বর্ণিত বিশ্ব-ব্যাবস্থার একেবারে উল্টো হবে। সিদ্ধান্ত হলো, এই দুই যুগের দ্বিতীয়টি আমাদের আজকের বিশ্ব-ব্যাবস্থা, যাকে তৈরি করেছে আধুনিক ইউরোপীয় ইহুদী এবং খ্রিস্টান সভ্যতা তথা জুলকারনাঈনের প্রিজন থেকে মুক্তি পাওয়া ইয়াজুজ মাজুজ গং!
“তিনি ভ্রমণ করলেন যতক্ষণ বা তিনি সূর্যের অস্তাচলে পৌঁছলেন (যেহেতু সেখানে এরপর কোনো ভূমি ছিলো না তাই মনে হচ্ছিলো এটিই পৃথিবীর শেষপ্রান্ত)। তখন তিনি সূর্যকে ঘোলা জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখলেন এবং সেখানে তিনি এক সম্প্রদায়কে পেলেন। আমি বললাম, “হে যুলক্বারনাঈন! (তোমার অধিকার রয়েছে) চাইলে তুমি এদের শাস্তি দিতে পারো অথবা তাদের প্রতি দয়াময় হতে পারো। [কাহাফ ১৮:৮৬]
Until, when he reached the setting of the sun, he found it [as if] setting in a spring of dark mud, and he found near it a people. Allah said, “O Dhul-Qarnayn, either you punish [them] or else adopt among them [a way of] goodness.”
নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার উপরে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সভ্যাতাকে তৈরি করা ও তা টিকিয়ে রাখার জন্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহৃত হতে পারে। সেই ব্যবস্থার ভিত্তি ঈমানের উপর হতে হবে। মূল্যবোধকে সহায়তা এবং উৎসাহিত করতে তা ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু ঈমান বা বিশ্বাস না থাকলে ক্ষমতা অন্যায় ও নিপীড়নের কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। এই ঘটনাটির উদ্দেশ্য হলো, ক্ষমতা যখন ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে তখন তা কিভাবে ব্যবহৃত হয়, তা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেওয়া!
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ের অনেক পন্ডিতেরা এই আয়াতে বর্ণিত ঘন কালো সাগরকে কৃষ্ণসাগর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তিনি (উত্তরে) বললেন, “আমরা আমাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করবো) সেই সকল ব্যাক্তিকে শাস্তি দেবার জন্যে, যারা সীমালঙ্ঘন করে, নিপীড়ন ও অন্যায় জাতীয় অপরাধে দোষী হবে। এরপর সেই ব্যাক্তি যখন তাঁর পালনকর্তার কাছে ফিরে যাবে, তখন তিনি তাকে কঠোর শাস্তি দিবেন।” [কাহাফ ১৮:৮৭]
He said, “As for one who wrongs, we will punish him. Then he will be returned to his Lord, and He will punish him with a terrible punishment.
ক্ষমতা যখন ঈমানের উপরে নির্ভর করে তখন সেটা অত্যাচারীকে ন্যায়সংগতভাবে শাস্তি দিতে ব্যবহৃত হয়। অপরাধ ও দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রে কখনো শান্তি ও সুখ থাকে না। ন্যায়কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুলক্বারনাঈনের বিশ্বব্যবস্থা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সুখ ও শান্তি স্থাপন করেছিলো। আজকের বিশ্বেও তা হতে পারতো যদি মানবজাতি নবী (স) এর দেখানো পথ থেকে সরে গিয়ে গোমরাহী না করতো!
বর্তমান দুনিয়া ফিতনায় পরিপূর্ণ। সূরা কাহাফে বর্ণিত “দুই যুগ” (ক্বারনাঈন) এর দ্বিতীয়টিকে শেষযুগ বা ফিতনার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় যুগটিতে মানবজাতি নবী (স) কে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তাঁর দেখানো পথে জীবন যাপন করবে না, এর ফলে তারা ঠিক যুলক্বারনাঈনের যুগের বিপরীত যুগের মুখোমুখী হবে, যেখানে ক্ষমতা ঈশ্বরহীনতার (সেকুলার) উপরে প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে অত্যাচারীকে শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে এটি অন্যায়ভাবে নিরপরাধকে নির্যাতন করার কাজে ব্যবহৃত হবে। এরকম যুলুমের বিশ্বব্যবস্থা থেকে শান্তি ও সুখ উধাও হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক!
“যে ঈমান আনে ও ভালো কাজ করে তাঁর বিনিময় হচ্ছে কল্যান (পরবর্তী জীবনে) এবং আমরা আমাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এটি নিশ্চিত করবো যেনো তাঁর পার্থিব জীবন সহজ হয়ে যায়।” [কাহাফ ১৮:৮৮]
But as for one who believes and does righteousness, he will have a reward of Paradise, and we will speak to him from our command with ease.”
যুলক্বারনাঈন অন্যায়কারী ও সীমালঙ্ঘনকারীকে শাস্তি দিতে তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করতেন, কিন্তু যারা ঈমানের সাথে বসবাস করতো এবং যাদের আচার আচরন ভালো তাদেরকে সহায়তা ও পুরস্কৃত করতেন। এটাই যুলক্বারনাঈনের বিশ্বব্যবস্থা যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। সূরা কাহাফ একটি মূল্যবান সতর্কবাণী পেশ করেছে। যে দ্বিতীয় বিশ্বব্যবস্থা সামনে আসবে তাঁর ভিত্তি হবে সেকুলার বা ঈশ্বরহীনতা আর তা হবে নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তি-শূন্য। সুযোগ সন্ধান, সুবিধাবাদ, অত্যাচার, ঈশ্বরের প্রতি ঈমানকে অবজ্ঞা, ভালো আচার আচরনকে উপহাস ইত্যাদি হবে এই বিশ্বব্যবস্থার বৈশিষ্ট। যারা নিষ্ঠার সাথে ধর্মীয় জীবন যাপন করে এই বিশ্বব্যবস্থায় তাদেরকে টার্গেট করে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হবে। প্রকৃতপক্ষে এই ব্যাবস্থা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। আর এটাই সেই বিশ্বব্যবস্থা যার মাঝে আমরা বর্তমানে বসবাস করছি!
“এরপর তিনি সঠিক পন্থার মাধ্যমে উপায় অবলম্বন করলেন…” [কাহাফ ১৮:৮৯]
Then he followed a way
যুলক্বারনাঈন কিভাবে তাঁর ক্ষমতাকে ব্যাবহার করতেন এখানে তাঁর আরেকটি উদাহরণ রয়েছে।
“যতক্ষণ না তিনি সূর্যের উদয়াচলে পৌঁছলেন (অর্থাৎ তিনি পুবের একেবারে দূরপ্রান্তে চলে গেলেন; যেহেতু এরপর কোনো ভূমি ছিলো না তাই মনে হচ্ছিলো এটিই পৃথিবীর শেষপ্রান্ত এবং এখান থেকেই সূর্য উদিত হয়)। তখন তিনি একে এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদিত হতে দেখলেন, যাদের জন্যে (সূর্য, কিরণ, আবহাওয়া, পরিবেশ ইত্যাদি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে) আমরা প্রাকৃতিক আড়াল ছাড়া কিছুই তৈরি করিনি। [কাহাফ ১৮:৯০]
Until, when he came to the rising of the sun, he found it rising on a people for whom We had not made against it any shield.
এর মানে পূর্বদিকে ভ্রমণের সময় তিনি আরেকটি বড় সমুদ্রের মুখোমুখি হলেন যেমনটি তিনি পশ্চিমে হয়েছিলেন। আর এটি সেই সমুদ্র থেকে অনেক দূরে যেখান থেকে তিনি সূর্যকে উদিত হতে দেখেছেন। পশ্চিমের সেই সমুদ্রটি যদি কৃষ্ণসাগর হয় তবে পূর্বেরটি ক্যাস্পিয়ান সাগর।
সূরা কাহাফ আমাদের ক্ষমতার দ্বিতীয় ব্যাবহার সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করছে। যেমন, বিশাল পরিমাণ তেল-সম্পদ আহরণের পথে যদি আদিম জনগোষ্ঠী বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো, তাহলে যুলক্বারনাঈন কিভাবে তাঁর ক্ষমতাকে ব্যবহার করতেন? যেহেতু তাদের দেশে (ক্যাস্পিয়ান অঞ্চলে) বিপুল পরিমাণ তেল সম্পদ মজুদ রয়েছে, তিনি কোনটিকে প্রাধান্য দিতেন, তেলের বস্তুগত মূল্যকে না কি মানবাধিকারকে, যদিও তারা গরীব আদিম জনগোষ্ঠী ছিলো? তিনি কি ক্যাস্পিয়ানের তেল দখলের জন্য যুদ্ধ লাগিয়েছিলেন, ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছিলেন, না কি তিনি মানবাধিকারকে তেলের লোভের উপরে প্রাধান্য দিয়েছিলেন?
এই আয়ত আরো দেখিয়ে দিচ্ছে, এই সমস্ত অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকৃতি যা দিয়েছে তা ব্যাতীত অন্যান্য জিনিস থেকেও সুরক্ষার প্রয়োজন ছিলো।
“এভাবেই (তিনি তাদের সাথে দেখা করলেন আর বুদ্ধিমত্তা ও দয়ার সাথে তিনি তাদেরকে ছেড়ে দিলেন এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে কোনো বিঘ্নতা সৃষ্টি করলেন না); এবং আমরা আমদের জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁর অবস্থা (ও প্রতিক্রিয়া) সম্পর্কে জ্ঞাত রয়েছি।” [কাহাফ ১৮:৯১]
Thus. And We had encompassed [all] that he had in knowledge.
ক্ষমতার ভিত্তি যখন ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তখন সেখানে ন্যায়নীতি, প্রজ্ঞা, সহমর্মিতা এবং সজীব বিবেককে লালন করা হয়। যারা স্বেচ্ছায় আদিম অথবা যাযাবর জীবনযাপন করে (যেমনটি ইউরোপীয় সভ্যতা আসার আগে উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের অধিবাসীরা করতো), তাদের জীবনযাত্রাকে যুলক্বারনাঈনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা আধুনিকায়ন, শিল্পায়ন, সম্পদ আহরণ ইত্যাদির নামে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে না। দুই ক্বারনের (দুই যুগ) দ্বিতীয় ক্বারন (দ্বিতীয় যুগ) সম্পর্কে সূরা কাহাফ একটি কঠোর সতর্কবাণী পেশ করেছে। সে সময় যারা ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে তারা হবে বাস্তবিকপক্ষে সেকুলার তথা ঈশ্বরবিমুখ। তারা এমনভাবে কাজ করবে যা হবে যুলক্বারনাঈনের ঠিক উল্টো!
তারা নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত (এটি যখন তাদের সুবিধার সাথে খাপ খাবে) ন্যায়নীতি, প্রজ্ঞা, সহমর্মিতা এবং সজীব বিবেককে লালন করবে না। তারা নিষ্ঠুরভাবে অন্যান্য জাতির সম্পদকে গ্রাস করবে যদিও এর চেয়ে মূল্যবান সম্পদ তাদের অধিকারে রয়েছে। তারা তাদের জীবনযাত্রাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিবে। তারা নির্দয়ভাবে আদিম জনগোষ্ঠিকে ও তাদের জীবনযাত্রাকে আক্রমণ করবে।
তারা মানবাধিকারের নামে ঈশ্বরবিমুখ আধুনিকতা, বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক প্রয়োজন ইত্যাদিকে চাপাতে থাকবে। উপ্রোন্তু, স্বেচ্ছায় যারা যাযাবর অর্থনৈতিক জীবনযাপন করে, তাদেরকে আক্রমণ ও ধ্বংস করবে, এবং অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকারে পরিণত করবে। উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও বাকি পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থানে সহজ সরল জনগোষ্ঠী এই নির্মম ভাগ্যকে বরণ করেছে। ক্যাস্পিয়ান অববাহিকার তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল সেই একই ভাগ্যের জন্য এখন অপেক্ষা করছে।
“তিনি (ভ্রমণ করতে থাকলেন) যতক্ষণ না তিনি দুই পর্বত প্রাচীরের মাঝে পৌঁছালেন। তিনি সেখানে এমন এক জাতিকে পেলেন যারা তাঁর কথা (অর্থাৎ তাদের ভাষা) খুব কমই বুঝতে পারছিলো।” [কাহাফ ১৮:৯৩]
Until, when he reached [a pass] between two mountains, he found beside them a people who could hardly understand [his] speech.
এর মানে এরা এমন একটা জনগোষ্ঠী যারা বিশ্বের শাসক যে ভাষায় কথা বলতো সেই ভাষা বুঝতো না। হয় তাদের একটি অনন্য ভাষা ছিলো, বিশ্বে প্রচলিত অন্য ভাষার সাথে যার মিল ছিলো না, আর না হয় তারা সমগ্র পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করতো!
“(যখন তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলো) তখন তারা বললো, ‘হে যুলক্বারনাঈন! ইয়াজুজ ও মাজুজ (আমাদের বসবাসের) এই স্থানে ফ্যাসাদ (এবং ধ্বংস) চালাচ্ছে। আমরা কি আপনাকে কর দেবো এই শর্তে যে, আপনি (আমাদেরকে তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য) আমাদের ও তাদের মাঝে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিবেন?” [কাহাফ ১৮:৯৪]
They said, “O Dhul-Qarnayn, indeed Gog and Magog are [great] corrupters in the land. So may we assign for you an expenditure that you might make between us and them a barrier?”
কারা এই ইয়াজুজ মাজুজ? তারা কি আদম (আ) থেকে আগত দু’টি বংশ? তারা যেই হোক, যুলক্বারনাঈনের মতো ইয়াজুজ মাজুজও অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলো। যারা ইয়াজুজ মাজুজের আক্রমণের শিকার ছিলো তারা যুলক্বারনাঈনকে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিতে অনুরোধ করে। এই ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ইয়াজুজ মাজুজরা এক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। তারা যে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী তা ঈমাম মুসলিমের সংকলিত সহীহতে বর্ণিত একটি হাদীসে কুদসী দ্বারা আরো দৃঢ় হয়ঃ
“…আমি আমার এক সৃষ্টিকে এতটা ক্ষমতাবান করেছি যে, আমি ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ করতে পারবে না।” [সহীহ মুসলিম]
সূরা কাহাফ সেই সাথে আরো বিশেষ তথ্য দিচ্ছে, ইয়াজুজ মাজুজ তাদের ক্ষমতাকে যুলক্বারনাঈনের ঠিক উল্টো পথে ব্যবহার করতো। তারা জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতো (ফাসাদ ফিল-আরদ্ব), অর্থাৎ যা কিছুকে টার্গেট করতো তাকেই তারা তাদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা দ্বারা বিনষ্ট করে ছাড়তো। নির্বিচারে হত্যা, পরিকল্পিত হত্যা, ভীতি প্রদর্শন, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, নির্যাতন ইত্যাদি সবই “ফাসাদ ফিল-আরদ্ব” হিসেবে বিবেচিত। যারা ফাসাদ ফিল-আরদ্ব এর অপরাধে অপরাধী হবে, তাদেরকে আল্লাহ্র আঈন অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে।
“হয় তাদেরকে হত্যা করতে হবে, ক্রুশবিদ্ধ করতে হবে, বিপরীত দিক থেকে হাত পা কেটে দিতে হবে অথবা সমাজ থেকে বহিষ্কার করতে হবে।” [মায়িদাহ্ ৫:৩৬]
Indeed, the penalty for those who wage war against Allah and His Messenger and strive upon earth [to cause] corruption is none but that they be killed or crucified or that their hands and feet be cut off from opposite sides or that they be exiled from the land. That is for them a disgrace in this world; and for them in the Hereafter is a great punishment,
এই শাস্তি ফ্যাসাদের মাত্রা অনুসারে প্রদান করা হবে। কোরআনে বর্ণিত ঐশ্বরিক শাস্তির মধ্যে সবচে কঠিন শাস্তি এটাই।
উপরের আলোচনার আসল তাৎপর্য হলো, ইয়াজুজ ও মাজুজকে যখন বিশ্বে ছেড়ে দেওয়া হবে, মানবজাতি তখন এমন একটা বিশ্ব-ব্যবস্থার মুখোমুখি হবে যা যুলক্বারনাঈনের বিশ্ব-ব্যবস্থার (Pax Quarnain) সম্পূর্ণ বিপরীত! দুই ক্বারনের (দুই যুগ) দ্বিতীয় ক্বারনটি (দ্বিতীয় যুগ) এমন হবে যে, ইয়াজুজ মাজুজরা মানবজাতির উপর বিশ্বব্যাপী ফ্যাসাদ চাপিয়ে দিবে। সূরা কাহাফের এই আয়াতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সূরাটি আধুনিক যুগকে ব্যাখ্যা করেছে!
উত্তরে তিনি বললেন, “আমার প্রতিপালক আমাকে যা কিছু দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা (তোমরা আমাকে যে কর দিতে চাইছ তা থেকেও) উত্তম, তবে তোমরা আমাকে (তোমাদের) লোকবল দ্বারা সাহায্য করো (এবং) আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিবো।” [কাহাফ ১৮:৯৫]
He said, “That in which my Lord has established me is better [than what you offer], but assist me with strength; I will make between you and them a dam.
যুলক্বারনাঈন একটি অবকাঠামো নির্মাণে রাজি হলেন, যাকে রাদ্মান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এরপর তিনি কি প্রকৃতির প্রাচীর নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তাঁর বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে।
“আমাকে লোহার খন্ড এনে দাও”! এরপর তিনি (লোহাকে স্তুপাকার করে) দুই পাহাড়ের মধ্যকার ফাঁকা স্থানকে ভরাট করে দিলেন, তিনি বললেন, “তোমরা (আগুন জ্বালাও এবং) এর নিচে ফুঁ দিতে থাকো!” যখন এক (তপ্ত) আগুন তৈরি হয়ে গেলো, তখন তিনি আদেশ করলেন, “(তামাকে আগুনে গলাও এবং তারপর) গলিত তামাকে আমার কাছে নিয়ে আসো যেনো আমি তা (লোহার উপর) ঢালতে পারি।” [কাহাফ ১৮:৯৬]
Bring me sheets of iron” – until, when he had leveled [them] between the two mountain walls, he said, “Blow [with bellows],” until when he had made it [like] fire, he said, “Bring me, that I may pour over it molten copper.”
সর্বোচ্চ শক্তিশালী ধাতু দ্বারা তৈরি প্রাচীরই ইয়াজুজ ও মাজুজকে আটকে রাখতে পারে। সূরা হাদীদে [৫৭:২৫] কোরআন নিশ্চিত করেছে যে, লোহা এমনই এক ধাতু যার ভেতরে এরূপ ক্ষমতা রয়েছে। এজন্য তাকে লোহার উপর লোহা স্থাপন করতে হয়েছে যতক্ষণ তা পাহাড়ের চূড়াতে পৌঁছে যাচ্ছে এবং সেই সাথে চওড়া ও উঁচু ফাঁকা স্থানকে ভরাট করে দিচ্ছে। এই প্রাচীরটি ইয়াজুজ মাজুজকে আটকে রাখবে যেনো লোকেরা তাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে পারে। যুলকারনাঈন লোহার প্রাচীর নির্মাণ করার পর তাঁর উপর তামার দ্বারা গ্যালভানাইজিং করলেন সম্ভবত তাতে যেনো মরিচা না পড়ে! তিনি আরো নিশ্চিত করলেন যে, ইয়াজুজ মাজুজ অনন্য ক্ষমতার অধিকারী, অতএব তিনি তাদেরকে কেবল আটকে রাখতে পারেন, কিন্তু তাদেরকে ধ্বংস করতে অক্ষম! (আল্লাহ্ ভালো জানেন)
দ্বিতীয় ক্বারণে বা যুগে যখন ইয়াজুজ মাজুজকে এই পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া হবে তখন তারা তাদের ফিতনাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবে যা মানবজাতিকে ভীতসন্ত্রস্থ করে রাখবে। সে সময় মু’মিন বা বিশ্বাসীদেরকে এক শক্তিশালী প্রাচীরের আশ্রয় নিতে হবে যেনো তারা নিজেকে ইয়াজুজ মাজুজের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। মু’মিনেরা লোহা ও তামার মতো দু’টি জিনিস দ্বারা অদৃশ্য প্রাচীর নির্মাণ করে নিবে। সেখানে কোরআনের আয়াতসমূহ হবে লোহার খন্ড এবং সুন্নাহ্ হবে গলিত তামা যা সেই লৌহখণ্ডের উপরে প্রবাহিত হবে আর এভাবেই নির্মিত হবে দুর্ভেদ্য বা অজেয় এক প্রাচীর!
“আর এভাবেই (প্রাচীরটি নির্মিত হলে ইয়াজুজ মাজুজরা) না পারবে তা আরোহন করতে আর না পারবে তা ধ্বসিয়ে ফেলতে (যথা খননের মাধ্যমে, আর এভাবেই মানবজাতি তাদের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকবে)।” [কাহাফ ১৮:৯৭]
So Gog and Magog were unable to pass over it, nor were they able [to effect] in it any penetration.
যুলক্বারনাঈনের প্রাচীর যতদিন টিকে থাকবে মানবজাতি ততদিন ইয়াজুজ মাজুজের অনাচার থেকে নিরাপদে থাকবে। যুলক্বারনাঈন নামটি যে দু’টি যুগের প্রতিনিধিত্ব করে এটা এখন পরিষ্কার! প্রথম যুগটি ইয়াজুজ মাজুজের অনাচার থেকে নিরাপদে ছিলো, প্রাচীরটি যতদিন টিকে ছিলো এই অবস্থা ততদিন বিরাজ করেছিলো।
দ্বিতীয় যুগটি হবে ফিতনা আর ফাসাদে ভরপুর তাতে সমগ্র মানবজাতি আক্রান্ত হবে কেননা তখন মহান আল্লাহ্ এই প্রাচীরটি ধ্বংস বা বিদ্ধস্ত করে দিবেন বা সমান করে দিবেন এবং ইয়াজুজ মাজুজকে মানবজাতির উপর মুক্ত করে দেবেন বা ছেড়ে দেবেন।
আর এই দ্বিতীয় ক্বারণটিতে (যুগ) শেষ সময়ের আলামত গুলি একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকবে। ইয়াজুজ মাজুজের ফ্যাসাদ (বিশবব্যাপী ধ্বংসলীলা এবং অনাচার) থেকে নিরাপদে থাকার জন্যে বিশ্বাসীদেরকে কোরআন ও সুন্নাহ্র অদৃশ্য প্রাচীরে আশ্রয় নিতে হবে।
“(যুলক্বারনাঈন) বললোঃ “(প্রাচীর নির্মাণে সফলতা) আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রহমত! যখন আমার প্রতিপালকের নির্ধারিত দিন (অর্থাৎ শেষ যুগ) আসবে তিনি এই প্রাচীরটি ধ্বংস/বিধ্বস্ত/সমান করে দিবেন (অর্থাৎ এর স্বাভাবিক পরিণতি হলো তিনি এটাকে ধ্বংস করে দিবেন) আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই আসবে!” [কাহাফ ১৮:৯৮]
[Dhul-Qarnayn] said, “This is a mercy from my Lord; but when the promise of my Lord comes, He will make it level, and ever is the promise of my Lord true.”
সূরা কাহাফে আল্লাহ্ তা’য়ালা এক কঠিন সতর্কবাণী পেশ করেছেন, তিনিই এক সময় প্রাচীরটিকে ধ্বংস করে দিবেন এবং এই পৃথিবীতে ইয়াজুজ মাজুজকে ছেড়ে দিবেন। আল্লাহ্ তা’য়ালা যখন এই কাজটি করবেন (ঠিক) সে সময় বিশ্বের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে সেকুলার বা ঈশ্বরবিমুখ ভিত্তির উপর। সেই ক্ষমতাকে জুলুম, নির্যাতন, ধ্বংস ইত্যাদি কাজে, আর বিশেষ করে ইসলামের (শান্তি) বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।।
“…একদিন আমরা তাদের এক অংশকে তরঙ্গের মতো সক্রিয় করবো এবং তাদের তাদের অপর অংশের সাথে একীভূত করবো (বা তার সাথে সংঘর্ষ বাধাবো); তারপর (বিচারের) শিঙ্গা যখন বাজানো হবে, তখন তাদের সকলকে একসাথে নিয়ে আসবো।” [কাহাফ ১৮:৯৯]
And We will leave them that day surging over each other, and [then] the Horn will be blown, and We will assemble them in [one] assembly.
কোরআন আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, বিভিন্ন সময়ে শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে (১৮:৯৯, ২৩:১০১, ৩৬:৫১, ৩৯:৬৮ দুবার, ৫০:২০, ৬৯:১৩)। উপরের আয়াতে বর্ণিত শিঙ্গায় ফুঁৎকার , ফিতনার সময় যে ঘনিয়ে আসছে তার দিকে ঈঙ্গিত করছে । ভালোভাবে বলতে গেলে এটি সা’আর (কিয়ামত) আবির্ভাবের দিকে নির্দেশ, অর্থাৎ যে সময় পৃথিবী ধ্বংস হবে এবং এরপর থেকে কবর থেকে সবাই পুনরুত্থিত হবে সে সময়কে এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে, এও সম্ভব যে, এই রহস্যপূর্ণ আয়াতে ইয়াজুজ ও মাজুজের পৃষ্ঠপোষকতায় পৃথিবীব্যাপী অশান্তি, অরাজকতা এবং পাপপূর্ণ নিয়মকানুনের বিশ্বায়নের দিকে ঈঙ্গিত করা হয়েছে। (আল্লাহ্ ভালো জানেন)
কোরআনের শদার্থতাত্বিক ড. তাম্মাম আদী সূক্ষ্মদর্শিতার সাথে মন্তব্য করেছেন যেঃ “ইয়াজুজ মাজুজকে ঢেউয়ের আকারে ছেড়ে দেওয়া হবে; তারা একে অপরকে শক্তি যোগাবে; একজন বিফল হলে, অপরজন জয়ী হবে। এপর্যন্ত ঠিক এটাই হয়ে আসছে। তারা প্রত্যেক জাতি ও ধর্মের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে সবাইকে একই চেহারায় রুপান্তরিত করেছে (আমি যেটাকে বলি “ফটোকপি” বানানো)। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হলো অ্যামেরিকার সমাজ, যেখানে খাযার গোত্রের বিভিন্ন শাখা এসে জড়ো হয়েছে, সেখানে তারা একজোট হয়ে অন্যান্য দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার কাজে এগিয়ে চলেছে।”
এই আয়াতে আগামী দিনের তারকা-যুদ্ধের (STAR-WAR) পূর্ভাবাসও থাকতে পারে, যা ইয়াজুজ মাজুজের মধ্যে সংগঠিত হবে, যার ফলে পৃথিবীর এক বিশাল অংশ ধুলায় পরিণত হবে, (সূরা কাহাফ ১৮:৮, সময় এলে আমরা এর বেশিরভাগকে ধুলায় পরিণত করে দেব)। তারপরই পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং কিয়ামত চলে আসবে। আসলে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে ইয়াজুজ মাজুজ ঢেউয়ের মতন একে অপরের সাথে বাড়ি খাবে, তারা দ্বৈত ক্ষমতায় সন্তুষ্ট হবে না, এবং একক আধিপত্যের জন্য যুদ্ধ করবে। পৃথিবীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মহা ধড়িবাজ ইবলিশ ঠিক এটাই চাইবে। তবে এই সংঘর্ষের পরই শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে।
“এবং সেদিন (যখন ইয়াজুজ বনাম মাজুজ সংঘর্ষের ভয়ংকর মুহূর্তটি আসবে এবং মাশরুমের মত পরমাণু মেঘের আকারে আকাশে দুখান বা ধোঁয়া দেখা দিবে তখন) সত্যকে অস্বীকারকারী সকলের চোখের সামনে আমরা জাহান্নামকে নিয়ে আসবো…”। [কাহাফ ১৮:১০০]
And We will present Hell that Day to the Disbelievers, on display
সেসব ভয়াবহ যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ লোক ধ্বংস হবে এবং পৃথিবীর জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ হ্রাস পাবে, এই আয়াত সেদিকে পরিস্কার ঈঙ্গিত দিচ্ছে। এই যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ লোক ধ্বংস হবে এবং তাদের অধিকাংশের ভয়ার্ত চোখের সামনে জাহান্নামকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। মুসলিমরা এখন ঠিক এইরকম দুনিয়ায় বসবাস করছে। সময় এসেছে মুসলিমদের এই ক্রমবর্ধমান সেকুলার ও ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার মুলধারা থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করবার। ইয়াজুজ বনাম মাজুজ (আরমাগেডন) যুদ্ধ যখন আরম্ভ হয়ে যাবে এই সমাজ ব্যবস্থা তখন ধ্বংসের ডোমঘর বা খোঁয়াড়ে পরিণত হবে…।
Armageddon
“তারা হলো (সে সকল লোক) যাদের চোখে আমার স্মরণ থেকে পর্দা লেগে রয়েছে, কারণ তারা (সত্য কথা) শুনতে সক্ষম ছিলো না।” [কাহাফ ১৮:১০১]
Those whose eyes had been within a cover [removed] from My remembrance, and they were not able to hear.
এই আয়াত বলে দিচ্ছে, যাদের চোখ রয়েছে তারপরেও তারা দেখতে পায় না, কান রয়েছে তারপরও শুনতে পায় না, অন্তর রয়েছে তারপরও উপলব্ধি করতে পারে না, এরা হচ্ছে ইয়াজুজ মাজুজ (ও তাদের ফটোকপি)। এরা সেই সমস্ত লোক যারা দ্বিতীয় ক্বার্ণকে চিহ্নিত করতে পারে না। পারে না চিহ্নিত করতে চরমভাবে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ তথা ঈশ্বরহীন ও ক্ষয়িষ্ণু আজকের বিশ্বের বাস্তবতাকে যেখানে আমরা বসবাস করছি (যা খুবই হতাশাজনক ও আধ্যাত্মিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু আমাদের দ্বীন ইসলামকেও তথাকথিত সহীহ্ ইসলামের নামে এরূপ বস্তুবাদী করার হীন প্রচেষ্টা চলছে)। দুই ক্বার্ণের দ্বিতীয় ক্বার্ণটি (যুগ) যে নিজেই একটি শেষ দিনের আলামত এই সত্যটি তাদের মত ব্যাক্তিরা চিহ্নিত করতে পারে না।
কোরআনের উপরের অনুচ্ছেদ হতে এবং সেই সাথে হাদীস, এবং ইহুদী-খ্রিস্টান অপর দুই আব্রাহামিক ধর্মের ধর্মগ্রন্থ থেকে বিশুদ্ধ দলীলের ভিত্তিতে ইয়াজুজ মাজুজের হালচাল বা জীবনচিত্র খুবই যত্ন সহকারে বর্ণনা করা হবে। তারা অবশ্যই মনুষ্যজাতি, তবে দু’মুখো (দুই মুখো সাপ প্রবাদটির মতো) এবং ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। তারা মুখে বলে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি, সকল ধর্মের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করি, আদতে তারা ইব্রাহিম (আ) এর স্রষ্টার উপাসনাকারীদের ঘোরতর শত্রু। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার ভান ধরে বিশ্বাসীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে পটু!
©somewhere in net ltd.