নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অামি অতি সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই ।

পার্থ তালুকদার

আমি ভাই সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই।

পার্থ তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিকড়ের টানে গাই ধামাইল গান

১৪ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১২:২৫



ফাগুনের রাত। কনকনে শীত কদিন আগে বিদায় নিয়েছে মাত্র। চারদিকে পিনপতন নিরবতা। বাড়ীর উঠানে অস্থায়ীভাবে নির্মিত টিনশেডের মধ্যখানে জ্বলছে চোখ ঝাঁজালো হ্যাজাক লাইট। তার চারদিকে সামাজিক মর্যাদা ভিত্তিক আসন বিন্যাস । চেয়ার-টেবিল,লম্বা-চিকন বেঞ্চ, পিড়ি, পাটের বস্তা, আরও কত কী! চেয়ারে বসা মুরব্বী একটু রাগ¦ত স্বরে বললেন- কইগো তোরা, তাড়াতাড়ি শুরু কর। দুষ্টু ছেলেগুলোও যেন শান্ত ছেলেতে রূপ নিয়েছে। তাদের নিস্পাপ চোখ দুটি অপেক্ষায় কাতর। তিক্ত অপেক্ষার পালা একসময় শেষ হয়। শুরু হয় নারীদের সুমধুর কন্ঠে ও সুনিপুন নৃত্যে এক মনোরম পরিবেশনা। আর তা চলতে থাকে ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত।

বলছিলাম ভাটিবাংলা তথা বাংলা লোকসাহিত্যের অতিপরিচিত এবং জনপ্রিয় ধামাইল গানের আসর নিয়ে। সাধারনত মাঙ্গলীক অনুষ্ঠানগুলোতে ধামাইল গানের প্রচলন থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে এই গানের আধিক্য বেশী। বিশেষ করে বিয়ের আগের রাত অর্থাৎ অধিবাসের রাতে ধামাইল গানের প্রচলন বেশ লক্ষণীয়। এই গানগুলো সাধারনত রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী নির্ভর হয়ে থাকে। প্রথমে ‘প্রার্থনা’ অথবা ‘গুরুবন্দনা’ দিয়ে গান শুরু হয়ে একে একে দেহতত্ত, বাঁশী,জলভরা,পাশাখেলা,অভিসার,কোকিল সংবাদ ইত্যাদি বিষয়ে একাদিক লেখকের গান রাতভর চলতে থাকে। বিভিন্ন লেখকের গান বিশ্লেষণে দেখা যায় তাঁরা এক একটি বিষয়ে অনেকগুলো গান রচনা করেছেন। যেমনঃ ‘গুরুবন্দনা’ অথবা ‘প্রার্থনা’। এ বিষয়ে ধামাইল গানের অগ্রদুত, ভাবুককবি রাধারমন লিখেছেন- আমি ডাকি কাতরে/উদয় হওরে দীনবন্ধু,হৃদয় মন্দিরে একইভাবে ভাটি বাংলার প্রিয়মুখ কাশীনাথ তালুকদার লিখেছেন- প্রথমে বন্দনা করি গুরুপদ স্মরি/গুরুতো মনুষ্য নয় গো প্রকাশ গোলক হরি একই বিষয়ে ধামাইল গানের আরেক প্রচার বিমূখ গীতিকার শ্রী সুনীল লিখেছেন- বন্দি অনাদি চরণ/ যাহার নামেতে কলির কলুষ নাশন সব লেখকেরই একই মিনতি। প্রতিটি গানেই গুরুর প্রতি অগাদ ভালবাসা,ভক্তি ও শ্রদ্ধা গভীর ভাবে ফুটে উঠেছে।

রাত যত গভীর হয়, পৃথিবী যত নীরব হয়, ধামাইল আসরের প্রতিটি গান ততই শ্রুতি মধুর হয়ে থাকে। রাতের নির্জ্বনতা আর গায়িকাদের সুমধুর কণ্ঠ যেন একাকার হয়ে যায়। গানের ফাঁকে ফাঁকে গরুর দুধের অসাধারন চা গায়িকা এবং শ্রোতাদের মনকে সতেজ করে তোলে। গভীর রাতের গানগুলো দর্শকের মনকে কল্পনার সাগরের উতাল পাতাল ঢেউয়ের সাথে নাচাতে বাধ্য করে। ধামাইল আসরের প্রতিটি গান স্পষ্ঠতই আপনার মনের কথারই বহিঃপ্রকাশ। জীবনে চলার পথে অনেক ঘটনার সাথে এই গানগুলোর কথার সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। কখনও ‘কোকিল সংবাদ’ শ্রোতার মনকে বিরহের আবহে আচ্ছন্ন করবে আবার ‘মিলন’ সেই ভাঙ্গা হৃদয়ে আনন্দের শীতল বাতাস বইয়ে দিবে। বিশেষ করে বিচ্ছেদ গানগুলো পরিবেশনের সময় শ্রোতাদের চোখ-মুখে আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি ফুঁঠে উঠে। প্রিয়জনকে না পাওয়া অথবা পেয়ে হারানোর ব্যাথা এই বিচ্ছেদ গানগুলোর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। বিচ্ছেদ পর্বে কাশীনাথ তালুকদার যেমন লিখেছেন- বধূয়া বিহনে আমার অঙ্গ যায়গো পুড়ে, ঠিক তেমনি রাধারমন লিখেছেন- আমি রব না রব না গৃহে/বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচেনা। অন্যদিকে ধামাইলপ্রেমিক প্রতাপরঞ্জন প্রেমিক হৃদয়ের মনের কথা বলেছেন এভাবে- যারে খুঁজিয়া বেড়াই/কত মানুষ পাইলাম, আমার মনের মানুষ নাই।

ধামাইল গানের আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘বাঁশি’। প্রিয়তমাকে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা মেটানোর জন্য প্রেমিক পুরুষ এই বাঁশির সাহায্য নিতেন। বাঁশির ইশারায় তিনি প্রেমিকাকে নির্দিষ্ট জায়গায় আসার আহ্বান জানাতেন। প্রিয়তমা তার শ্যামকালার বাঁশির সুর শোনে পাগলবেশে ছুটে আসতেন। সময় না মেনে বাঁশি বাজানোর দোষে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিমানও কিন্তু কম নয়। শ্রী প্রতাপরঞ্জন এ বিষয়টি চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন- জলে যখন করি গমন,সঙ্গে নিয়ে সব সখিগণ/বাঁশি বাজাও তুমি তখন, তাই কি তোমার উচিত হয়। অন্যপক্ষে কালার বাঁশি শুনে গৃহে থাকা কী যে কষ্টের, বেদনার,তার চিত্র ফুঁটে উঠেছে শ্রী আশুতোষের এই গানে-ওগো সখি গৃহে থাকা হলো দায়/ এত সুন্দর বাঁশের বাঁশি কে বাজায়। একইভাবে শিখা রানী দাস লিখেছেন- সখি বলগো বাঁচি কেমনে/ কালার বাঁশি ডাকে গো রাত্র দিনে/সখি অন্য নাম তার নাহি মনে তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, ধামাইল সাধারণত মহিলাদের গীত হলেও গান লেখকদের মধ্যে তাদের সংখ্যা অতি নগন্য। এক্ষেত্রে শিখা রানী দাস পিঁছিয়ে নেই। ধামাইল গানের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা, মেধা ও প্রবল ইচ্ছা শক্তির সমন্বয়ে তিনি আমাদের অসংখ্য গান উপহার দিয়েছেন।

এরকম হাজার হাজার গান বাংলার পল্লীতে মানুষের মনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, অধিকাংশ গীতিকারের প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ কোন ডিগ্রী না থাকলেও শুধু মনের টানে ও সাধনার মাধ্যমে পল্লীতে বসেই আমাদের প্রাণপ্রিয় এই ধামাইল গানগুলো সযতনে রচনা করেছেন। যা গ্রামের কাঁদামাখা দুষ্টু ছেলে কিংবা সাধু জনেরাও তাদের মনের অজান্তেই গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেন। সহজ সরল শব্দে ও ছন্দে ধামাইল গান সত্যিই মানুষের মনকে আলোড়িত করে। এই ধামাইল গান মানুষের মনকে একবার হাসায় তো একবার কাঁদায়। গ্রামের মানুষ যেখানে আধুনিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন তখন এই ধামাইল গানের আসর তাদের জীবনে অন্তত একটি দিনকে ভিন্নতর স্বাদের সুযোগ করে দেয়। এজন্য ধামাইল গানের লেখক ও শিল্পীদের কাছে আমরা বিশেষভাবে ঋণী।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫১

গেম চেঞ্জার বলেছেন: আপনার ১ম পোস্টটিই এতো চমৎকার!! এই বিষয়টা নিয়ে আরেকবার লিখতে পারেন। আমাদের লোকজ সংষ্কৃতি দিনদিন ক্ষয়েই যাচ্ছে।

নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে ১ম প্লাস দিতে পারায়। :)

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২২

পার্থ তালুকদার বলেছেন: !!!!!!!!!

অনেক ধন্যবাদ।

এ বিষয় নিয়ে আমার একটা বই আছে। পত্রিকায় ৩ পর্বের সিরিজ প্রকাশিত হয়েছিল এই ধামাইল গান নিয়ে। এবং তা দিয়েই আমার ব্লগিং শুরু। :)

ভাল থাকবেন ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.