নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অামি অতি সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই ।

পার্থ তালুকদার

আমি ভাই সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই।

পার্থ তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ বাঁধ ভাঙার আওয়াজ

০৪ ঠা জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১২



আকশের নীল যতই কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে সূরুজ মিয়ার মনটা ততই অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। দু’চালা খড়ের ঘরটার বারান্দায় পড়ন্ত বিকালে চুপচাপ বসে আছে সুরুজ মিয়া।

ছোট একটা পিঁড়িতে বসে পা দু’টা সামনের দিকে ছড়িয়ে বাঁশের এক খুটিতে হেলান দিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে সে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে কিভাবে নীল আকাশটা আস্তে আস্তে মেঘের ভয়ঙ্কর কালোর কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। সুরুজ মিয়া হঠাৎ ঘরের ভিতরের দিকে তাকিয়ে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

- কই গো সোনাইর মা ? ভিতরে কী এমন করতাছো, বাইর হইয়া দেইখা যাও আসমান আজ কী রাগ করছে। একটু পরে তো মনে অয় তুফান আইব।

- তুফান আইলে তো ভালা, জানটা একটু ঠান্ডা অইবো, যে গরম পড়ছে।

ঘরের ভিতর থেকে একটানে উত্তর দেন সোনাই এর মা।

- তুমি তো আসল খবর জানো না। এইডা জানলে এই রকম কথা কইতা না।

- কী অইছে ? আসল খবর কি ?

- কুশিয়ারা নদী ভইরা আমাগো হাওয়রে সব পানি ঢুইকা যাইতাছে। এখন বুঝ কী অবস্থা অইবো। হাওরের সব ধান পাইখা হলুদ হইয়া রইছে। এখন যদি কুশিয়ারার পানি বাঁধ ভাইঙ্গা হাওয়রে ঢুকে, তয় সব ধান পানির তলে ডুইবা যাইবো। মানুষ তখন না খাইয়া মরবো। ছোট বেলায় বাবার কাছ থেইক্কা হুনছিলাম একবার নাকি বাঁধ ভাইঙ্গা সব ধান পানির তলে ডুইবা গেছিল, তখন নাকি মানুষ খালি কচুর মোড়া খাইয়া বাইচা ছিল। এখন যদি পানি আয় তা অইলে আমাগো কী অইবো, আমার সোনাই এর কী অইবো !

কথা গুলো শেষ করতে গলায় কাঁপন ধরে সুরুজ মিয়ার।

- আমাদের আর কী অইবো, আমাদের আছেই কী, হারাবোই কী ?

ভিতর থেকে বলে উঠে সুরুজ মিয়ার স্ত্রী লাইলি বেগম।



আসলেই তো ঠিক। কী আছে সুরুজ মিয়ার ? দু’চালা এক খড়ের ঘর, দুইটা মাটির কলসি, রান্না করে খাওয়ার মতন দু’একটা হাঁড়ি-বাসন, তিনটা ছাগল, আদরের এক ছেলে সোনাই এবং ভালবাসার সোনাই’র মা, লাইলি বেগম। পাড়ার সবাই স্ত্রী’দের নাম ধরে ডাকলেও সুরুজ মিয়া তার স্ত্রীকে আদর করে সোনাই’র মা বলেই ডাকে। তাতে লাইলি বেগমের আনন্দের শেষ নেই। গ্রামের মহিলারা এ নিয়ে তাচ্ছিল্য করলেও তাতে কান দেয়না সুরুজ মিয়া।



তবে সুরুজ মিয়ার সম্পদ না থাকলেও বুকে আছে অসীম সাহস। প্রাণে আছে প্রবল ইচ্ছা আর দেহে আছে বল। এলাকায় তার সুঠাম দেহের জন্য আলাদা এক নাম-ডাক রয়েছে। তাছাড়া মানুষের জন্য কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা তাঁর মনের মধ্যে অটুট থাকে। কারো বাড়ীতে কঠিন কোন কাজের জন্য লোকের প্রয়োজন পড়লেই ডাক পড়ে সুরুজ মিয়ার। শুকনা থেকে পানিতে নতুন নৌকা টেনে নামাতে অথবা বড় বড় গাছের ডাল ছাটাই করতে দরকার পড়লেই খুঁজতে হয় সুরুজ মিয়াকে। এ নিয়ে সুুরুজ মিয়ার গর্বের কমতি নেই।

- কইগো সোনাইর মা, তাড়াতাড়ি ভাত দিয়া দাও। হুনছি বাঁধের অবস্থা ভালা না। কখন যে কী অয়। রাতে সবাই মিলে বাঁধ পাহাড়া দিত অইবো। একবার বাঁধ ভাঙ্গলে সারা বছর না খাইয়া থাকতো অইবো।

টাকি মাছের ভর্তা দিয়ে খেতে বসে সুরুজ মিয়া। পাশে তার স্ত্রী চুপ মেরে বসে আছে। একমাত্র পুত্র চার বছরের সোনাই বাবার কুলে নিরিবিলি বসে আছে। সবাই নিরব, নিশ্চুপ। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে লাইলি বেগম বলে উঠল,

- তুমি একটু সাবধানে থাইকো ।

- হুম, থাকুম নে।

- বাঁধ যদি ভাঙ্গে তখন তো অনেক স্রোত অইবো, তুমি কিন্তুু তখন পানিতে নাইমো না।

- হুম, ঠিক আছে।

- আমার কথা হুনবা তো ?

- হুম, হুনবো।

রাতের খাবার শেষে সুরুজ মিয়াকে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় লাইলি বেগম। বিছানায় যাওয়ার পরও তাঁর চোখে ঘুম আসছে না। পাশে সোনাই চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। লাইলি বেগমের মাথায় শুধু চিন্তা; যদি সত্যি সত্যি বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তাহলে তাদের কী হবে। ফুটফুটে ছেলে সোনাইকে তাঁরা কী খাওয়াবে। জমিতে যে কয়টা ধান আছে এইতো তাদের সারা বছরের সম্বল। যেখানে এক বস্তা ধান কম হলে তাদের অভাব লাগার সম্ভাবনা থেকে যায় সেখানে তো পুরো জমির ধান ! না না এ হবার নয়। যেভাবেই হোক বাঁধ ভাঙ্গা ঠেকাতে হবে।



হঠাৎ চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে লাইলি বেগমের। ভাঙ্গা দরজার ফাঁক দিয়ে কিঞ্চিত আলো দেখে সে বুঝতে পারলো রাত পোহালো বুঝি। দুঃশ্চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে বুঝতেই পারেনি। চিৎকার শুনে বিছানা থেকে উঠে দরজাটা একটানে খুলে দেয় সে। সে দেখতে পেল কিছু পুরুষ আর মহিলা যে যার মত বাধেঁর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। সে একটানে সোনাইকে কাধে নিয়ে বাঁধের দিকে দৌড়াতে লাগল। গিয়ে দেখে হাজার হাজার মানুষ বাঁধ ঠেকানোর জন্য মরনপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ টুকরি দিয়ে, কেউ বস্তা দিয়ে বাঁধের উপর মাটি ঢালছে। গ্রামের বাঁশ ঝাড় থেকে শত শত বাঁশ কাটা হচ্ছে বাঁধে লাগানো জন্য।



কেউ একজন আবিস্কার করলো বাঁধের নিচ দিয়ে বড় একটা সুরঙ্গ তৈরি হয়েছে। এবং এই সুরঙ্গ দিয়ে প্রবল বেগে পানি হাওয়রের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, যে কেউ ডুব দিয়ে এই সুরঙ্গের মুখ মাটির বস্তা আর খড়ের ঢেলা দিয়ে বন্ধ করে আসবে। তবে কে যাবে ? এত ভয়ংকর কাজটি করার সাহস কারই বা আছে।



সবার মধ্যে থেকে গম্ভীর ভাবে সুরুজ মিয়া বলে উঠল- আমি যাব, তোমারা বস্তা তৈরি করো।

সবার চোখে মুখে একটা আলোর ঝিলিক ছোঁয়ে গেল। সবাই জানে এই কাজটা সুরুজ মিয়াকে দিয়েই হবে । কারণ সুরুজ মিয়াই পারে ভয়ংকর সব কাজ করতে।

লাইলি বেগম কথাটা শুনে দৌড়ে এসে সুরুজ মিয়ার হাতটা ধরে বলল- ‘না, না, তুমি যাইবা না। এত ডরের কাম তোমার করার দরকার নাই। তোমার কিছু অইলে আমরা বাচুম কেমনে।’ সুরুজ মিয়া একটানে তাঁর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দৃঢ়কন্ঠে বলল- না, আমার যাইতে অইবো, বাঁধ ভাঙ্গতে দিমু না। পাশে দাড়ানো বয়স্ক এক লোক সুরুজ মিয়াকে বলল- যাও বাবা, তোমার গায়ে আল্লা শক্তি দিছে, এই শক্তি আমাগো লাগি কাজে লাগাও। সুরুজ মিয়া তখন চোঁয়াল শক্ত করে বলল- যাইতাছি চাচা, আমার লাগি দোয়া কইরেন।



ছেলে সোনাই এর মাথায় আদর করে সুরুজ মিয়া এক লাফে পানিতে নেমে গেল। বাঁধের নিচে সুরঙ্গ দিয়ে শাঁ শাঁ করে হাওয়ের মধ্যে পানি উপছে পড়ছে। বাঁধের উপরে কয়েকটা বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। এই বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে পাশের গ্রাম থেকে শত শত মানুষ বাঁধের পাশে জড়ো হয়েছে। আকশে উড়ছে নানা ধরনের পাখি। তারা তাদের খাবার পোকা-মাকড় ধরতে ব্যস্ত।

সুরুজ মিয়া মাটির বস্তা আর খড়ের ঢেলা দিয়ে সুরঙ্গের মুখ বন্ধের জন্য ডুব দিল। বাঁধের পাশে বসা লাইলি বেগম আর সোনাই অপলক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে সুরুজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সুরুজ মিয়া একবার ডুব দিয়ে কিছু সময় পর আবার উঠে আসে। হঠাৎ একজন চিৎকার করে বলে উঠল -‘পানি যাওয়া বন্ধ অইছে’। এই কথা শুনে সবাই আনন্দে এক সাথে উল্লাস করতে লাগলো।

অন্যদিকে একজন খেয়াল করলো সুরুজ মিয়াকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে আর পানির নিচ থেকে উঠছে না। এবার শুরু হলো তাকে খোঁজার পালা। এক যুবক ডুব দিয়ে সুরঙ্গের মুখে যা দেখে আসলো তা হলো- সুরুজ মিয়ার মাথা সুরঙ্গের ভিতর ঢুকে আছে। সে অনেক চেষ্টার পরও তাঁর নিথর দেহ টেনে আনতে পারেনি।



তারপর, মাটির বাঁধ টিকে গিয়েছে ঠিকই কিন্তুু সুরুজ মিয়ার প্রাণ দেহের বাঁধ ভেঙ্গে উড়ে গিয়েছে। তা আর ফিরে আসেনি। আর তখন বাঁধ ভাঙ্গা আওয়াজের সাথে বিলীন হয়ে গেছে লাইলি বেগম ও তাঁর ছেলে সোনাই এর কান্নার আওয়াজ। যে আওয়াজে লুকিয়ে আছে প্রিয় হারানোর করুন বেদনা।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫১

মামুন রশিদ বলেছেন: চমৎকার গল্পে মুগ্ধতা । খুব চমৎকার ভাবে হাওড় পাড়ের অসীম সাহসী মানুষদের বাঁধ ভাঙা পানির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ছবি এঁকেছেন । বানের পানিতে হঠাৎ হাওড় পাড়ের মানুষের সোনালী স্বপ্ন ধইল হয়ে যাওয়া আমিও দেখেছি । আমিও ঐ অঞ্চলের মানুষ ।

০৫ ই জুন, ২০১৪ রাত ১১:৩৫

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ মামুন ভাই। ছোটবেলা হাওর পাড়ে সময় কাটিয়েছিতো তাই মনের মাঝে অজান্তেই স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে ।
ভালো থাকবেন।

২| ০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:২০

এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত বলেছেন: খুবই চমৎকার!গল্পটা পড়ে খুবই ভাল লাগল।

০৫ ই জুন, ২০১৪ রাত ১১:৩৮

পার্থ তালুকদার বলেছেন: অনেক ভালোলাগা আপনার জন্য । সাথে ধন্যবাদও।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.