নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অামি অতি সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই ।

পার্থ তালুকদার

আমি ভাই সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই।

পার্থ তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

সূফীবাদ ও আমাদের তালপীর।

১২ ই জুন, ২০১৪ রাত ১২:১০





নদীর পাড়ে লম্বা এক তাল গাছের নিচে দু’চালা টিনের ঘর। লাল সালুক পড়া, মাথায় লম্বা চুল, হাতে লোহার চূড়ি, গলায় তামার মালা, সুঠাম দেহের একজন লোক গ্রামের আঁকাবাকা পথ ধরে নিরবে আপনমনে হেঁটে যাচ্ছেন। কারো কাছ থেকে গ্রহণ করছেন আদাব, কারো কাছ থেকে সালাম। অবার কারো কথা বলার ইচ্ছে হলে দু’চারটা কথাও বলছেন। তবে অদ্ভুত পোষাকী এই লোকটিকে আমি প্রচন্ড ভয় পেতাম। আমাদের বাড়ীতে আসলে আমি দূর থেকে লোকটিকে তাকিয়ে দেখতাম। তিনি বাস করতেন নদীর পাড়ে তালগাছটার নিচে ঐ দু’চালা টিনের ঘরটাতেই। সবার কাছে তিনি পীর সাহেব নামে পরিচিত। তাল গাছের নিচে আবাস থাকায় এলাকায় তিনি ‘তালপীর’ নামেই পরিচিত।



কিছু মানুষ জন্মগত ভাবেই ভাবুক প্রকৃতির। অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার, অচেনাকে চেনার অগ্রহ জীবনভরই তারা মন-মানসে লালন করে থাকেন। মানুষ এক টুকরো শান্তির জন্য ছেড়েছে ঘর, বেছে নিয়েছে চাল-চুলোহীন অনিশ্চিত জীবন। ধর্মকে আশ্রয় করে মানবজাতি দুঃখ কষ্টের স্মৃতি ভুলতে চেয়েছে বারংবার। মানুষ যখন তাঁর জীবন যুদ্ধে পরাজিত অথবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে জর্জরিত তখন দু’হাত তোলে প্রার্থনা করেছে সৃষ্টিকর্তার নিকট। আর এভাবে মানুষের মনে বাসা বেঁধেছে বৈষ্ণববাদ, সুফিবাদ, চৈতন্যবাদ, এমনকি বাউল মতবাদ।



স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাতিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সূফী দর্শন বা সূফীবাদ বলা হয়। সূফীরা স্রষ্টা এবং সৃষ্টিকে স্বীকার করে স্রষ্টার সাথে তারা প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। এ প্রণয় জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার প্রণয়। তারা বিশ্বাস করেন একমাত্র প্রণয়ের মাধ্যমেই স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়া যায়। সূফীবাদের সাথে বাউল মতবাদের সাদৃশ্য থাকলেও কিছুটা বৈসাদৃশ্য রয়েছে। বাউলতত্ত্বে বলা হয়েছে আগে আত্মাকে জানুন। নিজের আত্মার মাঝেই রয়েছেন ‘মনের মানুষ’, ‘অচিন পাখি’ আর ‘মন পাখি’। আত্মাকে জানা মানেই ঈশ্বরকে জানা, আল্লাহকে জানা। তাইতো লালন সহজেই বলেছেন-‘.... আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে,দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে।’ বাউলদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের সাধকের সন্ধান পেলেও সুফিবাদ পুরোটাই ইসলাম নির্ভর। সুফিরা ‘আল্লা’ ছাড়া কারো অস্তিত্ত্ব স্বীকার করেন না। আল্লার প্রতি অপার প্রেম-ভক্তি-সাধনার মাধ্যমে সুফি সাধকরা সেই ‘পরমাত্মা’ কে পেতে চান।



তবে সূফীমতের সাথে বৈষ্ণবাদর্শনের কিছুটা সাদৃশ্য ও আচারিক মিল রয়েছে। বৈষ্ণব ধর্মে যেমন জীবাত্মা ও পরমাত্মার প্রেম স্বীকৃত ঠিক তেমনি আছে সূফী মতেও। বৈষ্ণব মতবাদে যেমন রয়েছে নামকীর্তন, জীবে দয়া, বিনয়, নামে রুচি, সখীভাব ঠিক তেমনি সূফীদের আছে যিকর, খিদমত সামা, তরিকত, হরিকত এবং মারফত। সূফীমতের ফানাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) কিংবা বাকাবিল্লাহ (আল্লাহতে বিলীন হওয়া) যেন বৈষ্ণব মতবাদের যুগরূপ বা অভেদরুপেরই উৎসস্বরূপ। সূফীর গজল এবং বৈষ্ণপদসাহিত্য যেন, না পাওয়ার বেদনা ও পেয়ে হারানোর শঙ্কা- এই দুই এর সমন্বয়েই রচিত।



ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন- ‘সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী, কিন্তুু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগন ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিনামে অদ্বৈতসত্তার প্রয়াসে। সূফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সূফী-বৈষ্ণবের প্রধান কাজ।’ তাইতো সূফী বলেছেন, ‘ আত্মবিস্মৃত হয়ে সবাইকে প্রীতি দান করো আর পরের কল্যাণ কর্মে আত্মনিয়োগ কর। মানুষের মন জয় করাই সবচেয়ে বড় হজ। একটি হৃদয় সহস্র কাবার চেয়েও বেশী; কেননা কাবা আজর পুত্র ইব্রাহীমের তৈরী একটি ঘর মাত্র, আর মানুষ হচ্ছে আল্লাহর আবাস।’



সূফীমতের উদ্ভব সম্বন্ধে বিজ্ঞজনেরা বিভিন্ন মত পোষন করেন। Von Kremer ও Dozy-এর মতে বেদান্ত প্রভাবেই ইরানে সূফী মতের উদ্ভব হয়। তবে কুফার আবু হাশিম (মৃত্যুঃ ১৬২ হিঃ) প্রথম সূফী হিসাবে পরিচিত। তিনি হুজুইরীর সংজ্ঞানুগ সূফী। অর্থাৎ ত্যাগ, অনুগত্য, ধৈর্য, বাকসংযম, আত্মপীড়ন, ভোগ বিমুখতা, ভেক, দারিদ্র- এ অষ্টগুন সম্পন্ন সূফী। সূফী মতের প্রথম প্রবক্তা হচ্ছেন মিসরীয় কিংবা নুবীয় (Nubian) লেখক জুননুন (মৃত্যু ২৪৫-৪৬ হিঃ)। তবে এদেশের মানুষের সূফীতত্ত্বের সাথে পরিচয় গড়ে উঠে বিখ্যাত সূফী সহিত্যিক মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর ‘মসনবীর’ মাধ্যমে। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই ভারতে প্রথম সূফীমত প্রবেশ করে।



বাংলায় অনেক সূফীশাস্ত্র গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ’ এ প্রাপ্ত লেখক হলায়ূধ মিশ্র রচিত ‘শেকশুভোদয়া’ গ্রন্থে সূফী শেখ জামাল উদ্দীন তাবরেজীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে ফয়জুল্লাহ রচিত গোরক্ষবিজয়, মীর সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ-জ্ঞান চৌতিশা, শেখ চান্দের হর-গৌরী সম্বাদ, বালক ফকিরের জ্ঞান চৌতিশা, শেখ মনসুরের সির্নামা উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রন্থে যোগচর্যানির্ভর আধ্যাত্ম তত্ত্বের ও সাধনার, সূফীর ফানা-বাকা, সৃষ্টিতত্ত্ব, স্রষ্টাতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। মীর সৈয়দ সুলতানের নিবাস ছিল চট্টগ্রামের চক্রশালায়। তিনি তাঁর ‘জ্ঞান-প্রদীপ’ এ শন্যতত্ত্ব বর্ণনা করেছেন এভাবে-

দেখিতে না পারি যারে তারে বলি শূন্য

তাহারে চিন্তিলে দেখি পূরুষ হএ ধন্য।

নাম শূন্য কাম শূন্য শূন্যে যার স্থিতি

সে শূন্যের সঙ্গে করে ফকির পিরিতি।



সূফীরা সৃষ্টিকে স্রষ্টার অংশ হিসাবে স্বীকার করেন। তাদের মতে, স্রষ্টা তাঁর খেয়াল খুশীমতই সৃষ্টি করছেন। এ তাঁর অপার লীলা। কবি হাজী মুহম্মদ সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন-

বীজ হোন্তে বৃক্ষ যেন বৃক্ষ হোন্তে ফল,

(.....)

বীজ বৃক্ষ ফল হোন্তে কেহো ভিন্ন নহে।



সাম্প্রতিক সময়ের আব্দুল করিমের গানেও পীর সাধকদের গুনগান লক্ষ্য করা যায়। যদিও তিনি বাউল ধারার অসংখ্য গান লিখে গেছেন। তিনি বলেছেন-

পীরের চরণ অমূল্য ধন, সুসময়ে কর যতন,

হলে পীরের মনের মতন, প্রানে প্রানে মিশে যায় ।



তবে সূফীবাদ, বৈষ্ণববাদ কিংবা বাউলমতবাদ; এই তিন মতবাদেই রয়েছে প্রেম, জীবে দয়া, ত্যাগ, ভোগ বিমুখতা ইত্যাদি অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য। বর্তমান আধুনিক এই জীবনযাত্রায় আমরা তা স্বাভাবিক ভাবে অনুসরণ করলেই আমাদের জীবনকে আরো সহজ এবং সাধারণভাবে যাপন করতে পারি। ইদানিং সুফি সাধকদের জীবনী পড়তে গিয়ে আমাদের এই সুঠামদেহী ‘তালপীর’ সাহেবের মুখচ্ছবিটা আমার চোখে ফিরে ফিরে ভেঁসে উঠছে। যদিও জানিনা এখন তিনি কি করছেন আর কোথায়ই বা আছেন।



সহায়ক গ্রন্থ :

বাউল ও সুফি সাহিত্য; ড. আহমদ শরীফ

বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য (১ম ও ২য় খন্ড); ড. আহমদ শরীফ।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০১৪ রাত ৩:০৮

পাউডার বলেছেন:
ধর্মএর সুবিধা ভোগ করবে কিন্তু ধর্ম পালনের কষ্ট না করার আরেক নাম সূফীবাদ।
নামাজ-রোজা-যাকাত-দান-হজ্জ এগুলা বাদ দিয়া গানবাজনা-গাঞ্জা-নাচানাচি-ব্যাভিচার করতে ভালত লাগবেই।

১৩ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৫

পার্থ তালুকদার বলেছেন: কারো চোখে ব্যাভিচার তো কারো চোখে ধর্মাচার -- এটাতো ধর্মের গায়ে লেগেই আছে !!
তবুও তো আমাদের বাচঁতে হবে, কিছু বিশ্বাস আর অবিশ্বাস কে সঙ্গী করেই ।

২| ১৩ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:৩০

মামুন রশিদ বলেছেন: সুফীবাদ নিয়ে চমৎকার পোস্ট । আরো লিখুন ।

১৩ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:১৯

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ মামুন ভাই।
সূফীবাদ বা সূফীদর্শনে এতটাই গভীরতা যে, এক জীবনে তার কুল-কিনার পাওয়া সম্ভব নয় যা হয়তো আপনিও জানেন।
আমিতো এক ফোঁটা জল নিয়ে এর শীতলতা অনুভব করেছি মাত্র !!!
আবারো ধন্যবাদ আপনাকে, আমার ব্লগিং এর সঙ্গী হওয়ার জন্য।

৩| ১৩ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৯

নজের সনি বলেছেন: সুফিবাদের আরো গভীরের কথা শুনতে চায়। জানা থাকলে লিখুন ভাই। লালন, পাগলাকানাই, সিরাজ সাই, দুদ্দু শাহ, পানজু শাহের কথা জানা থাকলেও লিখুন।

১৩ ই জুন, ২০১৪ রাত ১০:৫৭

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ মি. সনি।

'বাউল' নিয়ে আমার ছোট্ট এই লেখাটি পড়তে পারেন।

Click This Link

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.