![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজেকে নিয়ে গবেষণা চলছে । জানলে জানাব ।
ব্যাস্ত নগরী । হুহু করে ছুটে চলা গাড়ি আর নানা রঙের মানুষ গুলোর বিচিত্র কথায় মুখরিত রাজ পথ । সোডিয়ামের আলোয় জ্যোৎস্না আসে আমার ঘরে । মাঝে মাঝে বাতাস এসে উঁকি দেয় আমার চুন খসে পড়া দেয়ালের ঘরে । রঙচটা শার্টের পকেটে ঠাই পায় না স্বপ্ন গুলো । ঘামের গন্ধে পালায় বিলাসিতার অনুভূতি ।
আমার শূন্য জগতের সবটা জুড়ে যে আছে, সে আমার একমাত্র ছেলে আবির । নাম রেখেছিলাম ঘটা করে । দারিদ্রতায় মোড়া মানুষ গুলো যেমন করে বাঁচে আর কি । কিছুটা স্বপ্ন নামের মাঝেই পূরণ করে । কিন্তু ছেলের জীবনে একটুও রঙের ছোঁয়া আমি লাগাতে পারিনি । আমি বাবা, তবে অসহায় বাবা । যে বাবা প্রতিনিয়ত অভাবের সাথে লড়াই করে বাঁচে । শরীর শ্রান্ত হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলে । নাভিশ্বাসে সে লড়াই ক্ষান্ত হয় ।
সকাল হয়, নতুন সূর্য উঠে । রণাঙ্গনের ডাক দেয় শূন্য পেট । বিদ্রোহ ঘোষণা করি রাতের স্বপ্ন গুলোর সাথে । আমি যে বাবা । আবিরের স্বপ্ন গুলোর সাথেই নাহয় বাঁচুক আমার স্বপ্ন গুলো ।
তবে আজকের রাতটা একটু অন্য রকম । কেমন যেনো গোমট বাঁধা । একটা পুড়া গন্ধ মাতাল করে রেখেছে পরিবেশকে । হৃদপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে উঠলো । বাবাদের যেমন হয় সন্তানের আশু বিপদে । অভাবের সাথে লড়াই করা আমার ছেলের চোখেমুখে উত্তাপের ছাপ । আমি অবাক নেত্রে ঠায় দাড়িয়ে আছি ।
আজও সোডিয়ামের আলোয় জ্যোৎস্না নেমেছে ঘরে । তবে আজকের জ্যোৎস্নারা কিছুটা অবাক; আমার মতোই । কিন্তু আজ আর গাড়ি ছুটার হুহু শব্দ নেই, থেমে গেছে বাহারি রঙের মানুষ গুলোর বিচিত্র কথা গুলোও । আমি মাতাল নই । নেশা আমার বরফ চাপা অনুভুতি গুলোর কাছে খুবই নগণ্য । দারিদ্রতার কপাটে আমার বলিষ্ঠ মন হিম হয়ে যাচ্ছে । আমি কি তবে পাথর হয়ে যাচ্ছি ?!
বিকারগ্রহস্ত মৃদু ডাকে চেতনা ফিরে আমার । দৌড়ে আবিরের কাছে যাই । কোলে মাথা রাখি তার । আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো তার জ্বরের উত্তাপে । সে বাবা বলে ডাকল । আমি উত্তর দিলাম । সে শুনলো কিনা বুঝতে পারলাম না । মুখের দিকে অপলকে চেয়ে রইলো । আমি দেখলাম আমার মা মরা ছেলের চোখে আগ্নেয়গিরি; দেখলাম কিভাবে পুড়ছে তার স্বপ্ন গুলো সেখানে । আমি এই চাহনি চিনেছিলাম সেবার তার মায়ের চোখে । যে বার সে ফাঁকি দিল । বুক টা মোচড় দিল ।
স্বপ্ন পুড়া চোখে ধোঁয়া উঠে না; কিন্তু বুকের পাঁজরে সেই স্বপ্ন পুড়া ধোঁয়ার আস্তরণ ঠিকই পরে । আমি তাকে ডাকলাম, '' বাবা আবির, কেমন লাগে তোমার ? '' সে উত্তর দিল না । আমার ডাকটা যে মৌন ছিল । আমি যে বাবা, আমি জানি তার কেমন লাগছে । তাই ডাকার সাহস আমার উবে গিয়েছে । অনেক্ষন পর সে বলল, '' হুম, বলো । '' আমি অবাক হলাম না । এ সময় মানুষ অন্যের অন্তরাত্মা দেখতে পায় । খুউব সহজেই পড়তে পারে চোখের ভাষা ।
আমি উঠতে চাইলাম । সে হাত চেপে ধরে রইল । বলল, '' লাভ নেই বাবা, আরো কিছুটা সময় নাহয় কোলে মাথা রাখি । '' আমি তার হাত ধরে বসে রইলাম । দুজনেই নির্বাক । যেখানে মনের সেতু বন্ধনটি খুউব বেশি প্রবল, সেখানে দুজনের অনুভূতি গুলো বাতাস হয়ে চারপাশে ভাসে । প্রতিটা শিরা-উপশিরায় বহে সেই অনুভূতি । মনের খাঁজে খাঁজে প্রতিফলিত হয় কথোপকথন ।
হুঁইসেল বাজিয়ে স্টেশনে ট্রেন আসে । তখনো পরিবেশ গোমট বাঁধা । তখনো ধাঁধাঁর আঁধারে মস্তিষ্ক হাবুডুবু খাচ্ছে । যুদ্ধ চলছে বুঝা না বুঝার মাঝে । যুক্তিরা বারবার হার মানছে আবেগের কাছে । জ্বরে আবিরের গা পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু অবিরত ঘেমে যাচ্ছি আমি । ট্রেন যাচ্ছে; নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে আমি । অপলক দৃষ্টি । বাবা ডাকটা বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তার প্রতিধ্বনি টা ফুরচ্ছে না ।
আমি এখনো আবিরের হাত ধরে আছি । বারবার 'বাবা' ডাকটা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরেফিরে আসছে কানে । হিসেব মিলছে না । কেনো কিছুকিছু মানুষের জীবনের গল্প গুলো অধরাই থেকে যায় ?
রাত ভারি হচ্ছে । আবির আমার হাত ধরেই শুয়ে আছে । শুধু শ্বাস যন্ত্রটা বিকল । হাতের উপর হাত আছে, কিন্তু আমার আবির সোনা আর নেই ।
শূন্য ঘর, শূন্য আমার ভুবন ।
এভাবেই শিরোনামহীন হয়ে ঝরে পরে কিছু জীবনের গল্প । স্মৃতির ছাঁয়া পথে শুধু রয়ে যায় তাদের প্রতিচ্ছবি। চিরচেনা হাসি গুলো অথবা মায়া মাখা ডাক গুলো । যেখানেই থাক, ভালো থাকুক এই দরিদ্র বাবা'দের হারিয়ে যাওয়া আবির গুলো ।
[ FictiOn in rOad ]
©somewhere in net ltd.