![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের বন্ধুদের আড্ডার প্রধান বিষয় ভ্রমন নিয়ে আলোচনা করা, এই জায়গায় যাব, ওই খানে যাব। বেশির ভাগ প্ল্যান মাঠেই মারা যায়। শিলং থেকে ঘুরে আসার পর থেকেই আমাদের দার্জিলিং যাওয়ার রব উঠেছিল। কিন্তু হাতে-মুখে না মেলায় গলাধঃকরন হচ্ছিল না। সাভারের ৩ জামাই খোকন ভাই, অতুল আর পলাশ (সবার ভাইস্তা) সাভার বাজারের কালাচান মিষ্টান্ন ভান্ডারের জাফরান মিষ্টি (এই অমৃতসম মিষ্টি নিয়ে এক দিন লিখব ভাবছি) খেতে খেতে দার্জিলিং ট্যুর করার একটা পরিকল্পনা করে ফেলল। আমাদের বন্ধুদের ঘুরাঘুরির একটা গ্রুপ আছে, নাম "মুসাফির"। মুসাফিরের সব সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে সাকুল্যে ৪ জন পাওয়া গেল যারা যেতে রাজি। আর সবার এই সমস্যা, অই সমস্যা। যেহেতু আমার পায়ে তিল, তাই ভ্রমনের অনুরোধ আমার কাছে লক্ষ্মীর মতো, "সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই ।"
শুরু হল সবার ভারতীয় ভিসা লাগানোর পালা। সে আরেক এলাহী ব্যাপার। ভারতীয় ভিসা লাগানোর যত তরিকা আছে, তার মধ্যে সহজ পথ খুজে বের করার চেষ্টা। অন্তর্জালের ভান্ডার থেকে জ্ঞান নিয়ে অবেশেষে হাজির হলাম শ্যামলী ভিসা সেন্টারে। এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা হাতে চলে এল। ভিসা পাওয়া এখন জলবৎ তরলং, ভাবছি কোন এক দিন ভারতীয় ভিসা ফ্লেক্সিলোডের দোকানেও পাওয়া যাবে । ভিসার সিল লাগানো পাসপোর্ট দেখার আনন্দই আলাদা।
যাত্রার দিন তারিখ আগে থেকে ঠিক করাই ছিল। দিন কাছে আসার পর এক মুসাফির ভ্রমন থেকে ডিগবাজি দিল, মানে খোকন ভাই যাবে না, উনি বিজনেস কনফারেন্সে ভিয়েতনাম, চায়না যাবে! কি আর করা। বাকি রইল ৩ মুসাফির অতুল, পলাশ আর আমি। যাত্রা শুরু হবে ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ রাতে। শ্যামলী বাসের টিকেট কাটা হল। নন-এসি বাস ৬৫০ টাকা। আগেই বলে রাখি, "মুসাফির" গ্রুপের উদ্দেশ্য কৃচ্ছতাসাধন করে ভ্রমন করা। আমরা হোটেল এবং পরিবহন খাতে সব সময় সস্তা খুজি। ভ্রমনে জ্ঞান বাড়ায়, জীবনকে নতুন ভাবে উপলব্ধি করায়, এটাই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। অযথা খরচ পরিহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ! আরেকটা কারন আছে, গোপন কথা, এক ট্যুরে বেশি খরচ হয়ে গেলে পরের ট্যুর নিয়া পরিবার থেকে ভেটো আসতে পারে ।
আমরা ভিসা নিয়েছিলাম বাংলাবান্ধা বর্ডার দিয়ে যাওয়ার। সবাই বুড়িমারী বন্দর দিয়ে যায়। কিন্তু আমার কাছে অই বন্দর একটা ঝামেলাপূর্ণ ব্যস্ত বন্দর মনে হয়েছে, তথ্যগুলো দেশের ভ্রমনকারীদের কাছে থেকে নেয়া। আর পঞ্চগড় জেলাটা আমার খুব প্রিয়, কারন হিমালয় রেঞ্জের এত কাছে আর কোন জেলা নেই। এছাড়া বাংলাবান্ধা বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি শহর মাত্র ১০ কিমি। আর বুড়িমারী থেকে ২/৩ ঘন্টা লাগে শিলিগুড়ী আসতে।
৭ ডিসেম্বর ২০১৭ঃ
বাস ছাড়বে রাত ১০টায় কল্যানপুর থেকে, আমি আর অতুল ১ ঘন্টা বসেই রইলাম, সেই বাস গাবতলী ব্রিজ ছাড়ল ১১টায়। সাভার থেকে পলাশ উঠল। গাড়ির অবস্থা বিশেষ সুবিধার না। কানে ধরছি, কোথাও ঘুরতে গেলে শ্যামলীতে আর নয়। ওদের তেল বেড়ে গেছে, যাত্রী সেবার কথা চিন্তাও করে না। নবীনগর থেকে ৪/৫ জন যুবক উঠল, কথা বলে জানা গেল ওরা মানিকগঞ্জ শহরের ছেলে, ওরাও যাচ্ছে দার্জিলিং। মানিকগঞ্জের ছেলেরা এত ঘুরে জানতাম না।
টাঙ্গাইল রোডে যতটা জ্যাম হবে ভেবেছিলাম, সেটা হয়নি। ড্রাইভার খুব ভাল মানুষ, গাজা-টাজা খায় না। গাড়ির ধীরে চলা দেখে তাই মনে হয়েছে। কারন জোরে গাড়ি চালাতে হলে নাকি গাড়ীতে ডিজেল, আর ড্রাইভারের গঞ্জিকা সেবন যমজ ভাইয়ের মতো। ৬০কিমি/ঘ এর বেশি টানতেই পারেন না ভদ্রলোক। আমার মোবাইলের Speedometer অ্যাপ তাই ঘোষনা দিচ্ছিল বারে বারে।
উত্তরবঙ্গের রাস্তায় আমি সিরাজগঞ্জ মোড়ের বেশি যাই নাই, নাটোর গিয়েছি এক বার, সেটা অন্য রাস্তায়। তবে বগুড়া রোডের সুনাম শুনেছিলাম যতটা, ততটাই খারাপ মনে হয়েছে আমার কাছে। রোলার কোস্টার রোডে একটু ঘুমানোর উপায় নাই। ভাবছিলাম মুসাফিরের আরেক সদস্য লাবলু ভাই থাকলে গাড়ী থেকে নেমে বাড়ি ফেরত যেত । রাত ৩ টার দিকে ফুড ভিলেজে সাময়িক বিরতি পেলাম। ডিসেম্বরের শুরু, উত্তরবঙ্গে যতটা ঠান্ডা পড়বে ভেবেছিলাম, তেমন মনে হল না। কুয়াশা ছিল না এক দমই। যদিও বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের খবর শুনে এসেছিলাম, তারি প্রভাবে হয়তোবা এমন।
৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ঃ
ভোরের আলো ফুটতেই মসৃন রাস্তায় উঠে গেলাম। Google map এ দেখলাম অংপুরের (রংপুর) মাটি। এত সুন্দর রাস্তা আশা করি নাই, ভাবছিলাম বাংলাবান্ধা পর্যন্ত রাস্তা অনুন্নয়নের মহাসড়ক হবে, কিন্তু রংপুর জেলায় ঢুকে উন্নয়নের মহাসড়ক দেখলাম। এরশাদ কাকার অবদান কি না কে জানে! সাত সকালে রংপুর বাইপাস হয়ে সৈয়দপুর দিয়ে নীলফামারী, ঠাকুরগাও পেরিয়ে পঞ্চগড় সদরে পৌছালাম সাড়ে নয়টায়। ঠাকুরগাও থেকে রাস্তার দুই পাশে এত আলুর ক্ষেত যা আগে কখনো দেখিনি। আলু ক্ষেতের সারি সারি নকশা করা আইল গুলো দেখার মত। কোথাও দেখলাম বিস্তীর্ন জমিতে ধান কাটা শেষ, কিন্তু সোনা রঙের ধানের গোড়া সকালের আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল।
বাস যদিও তেতুলিয়া পর্যন্ত যাবে, কিন্তু আমাদের প্ল্যান ছিল পঞ্চগড় শহরেই নামার। কারন এখানে ছোটভাইসম/বন্ধুসম প্রাক্তন সহকর্মী সৈকত সরকার সপরিবারে থাকে। ওর মত 'স্পারক্লিং' চরিত্র আমি কম দেখেছি। কুয়েট মেইড মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, আমার প্রাক্তন অফিসে চাকুরীরত অবস্থায় পরিচয়। খুলনার ছেলে বউ এর চাকুরীর কারনে পঞ্চগড়ের বাসিন্দা এখন। ওর আথিতেয়তা নেয়ার জন্যেই করতোয়া নদী পার হয়ে নেমে পড়লাম পঞ্চগড় জিরো পয়েন্টে। করতোয়া নদী
বাস থেকে নেমেই ঠান্ডা টের পেলাম। বুঝলাম হিমালয়ের অনেক কাছে আমরা এখন। চিলিং ঠান্ডা যাকে বলে, সাথে হাল্কা ঊত্তরে বাতাস, আকাশ ঝকঝকে। মনটা ভাল লাগায় ভরে গেল। তখন থেকেই আমি উত্তরের দিকে তাকাচ্ছিলাম, যদি কাঞ্চনজঙ্ঘার সুবর্নরেখা দেখা যায় কোথাও। আসলে পঞ্চগড় বাংলাবান্ধা বর্ডার থেকেও ৫৩কিমি দূরে, তবুও কেন যেন মনে মনে হচ্ছে কাছেই। প্রফুল্ল চিত্তে দূরও কাছেই মনে হয়। ভাল কথা, পর্যটকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি এখনও। ছবির বা দিক থেকে অতুল নাগ, পলাশ দাস, এবং ডানের অধম লেখক(!) স্বয়ং।
৫ মিনিটের মধ্যেই বিশাল এক রিকশা ভ্যান গাড়িতে হাজির সৈকত। ওর বাসায় পৌছে দেখি ও আমাদের জন্যে এলাহী আয়োজন করে রেখেছে। আমাদের মত বাজেট ট্রাভেলারদের জন্যে এমন আপ্যায়ন আমাদের কাছে অনাকাংখিত বিস্ময়। মুগ্ধ হলাম ওর স্ত্রী দেবদ্যুতির আথিতেয়তায় যিনি তেতুলিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্টার পদে কর্মরত। সকালের নাস্তার আগে স্পেশাল নাস্তা (গোপন রাখলাম!), পরে ভারী খাবারের তালিকা বিশাল, সরিষা ইলিশ, মাংস, (আরো কয়েক পদের নাম মনে নেই ) ইত্যাদি, সব খেয়েছি গোগ্রাসে। জানতাম পাহাড়ে ওঠার আগে এটাই হবে আগামী ৩/৪ দিনের জন্যে শেষ খাঁটি বাংগালী খাবার। সৈকত কিছু দিন আগে দার্জিলিং থেকে আনা ওর চায়ের সংগ্রহ দেখাল। টং দোকানের চায়ের বাইরে তুলসী চা, গ্রীন টি'র স্বাদ নিয়েছি, কিন্তু রোজ টি, জেসমিন টি, ওয়াইন টি সহ আরও বিচিত্র কিছু চার ঘ্রান নিলাম। চা যে এত প্রকারে হয় জানা ছিল না।
সৈকতের স্ত্রীকে আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাংলাবান্ধা সীমান্তের দিকে। সৈকতের গাড়ী থাকায় বিশেষ সুবিধা হল। ফাঁকা রাস্তায় ড্রাইভার দ্রুত টেনে বাংলাবান্ধা সীমান্তে নিয়ে আসলেন। যাওয়ার পথে পড়ল চাওয়াই নদী, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চাওয়াই সেতু মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়, বেজন্মা পাকিবাহিনী তাই আর নদীর ওপারে যেতে পারেনি বিধায় পুরো তেতুলিয়া ছিল মুক্তাঞ্চল। দুই পাশ শস্য ক্ষেতে ভরা, কোথাওবা অপরুপ চা বাগান, এসব উপভোগ করতে করতেই দুপুর ১ টায় পৌঁছে গেলাম বাংলাবান্ধা সীমান্তে। হিমালয় কন্যা পঞ্চগড় যে অসম্ভব সুন্দর তার কিয়দংশ দেখেই বুঝলাম। আশা রাখলাম কোন একদিন আবার আসব শুধু হিমালয় কন্যাকে দেখতেই।ছবিতে সৈকত আর আমরা, পিছনে কে?
সীমান্তে কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, ট্রাভেল ট্যাক্স ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতে করতে আরো ১ ঘন্টা লেগে গেল। তবে একটা জিনিস বুঝলাম, সীমান্তে যারা চাকুরী করেন, তাদের ভাতের ক্ষুধা কম, তাই অন্য ক্ষুধা বেশি। টাকা ছাড়া কেউ কথা বলেন না। পুরো প্রসেসের জন্যে আমাদের মাথা পিছু ৩৫০ টাকার মত ঘুষ দিতে হল। ঘুরতে গেলে মন খারাপ করতে নেই, তাই আসা যাওয়ার পথে এই সরকারী ভিক্ষুকদের কিছু দান খয়রাতি দিতে খারাপ লাগে না।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জিরো পয়েন্টে গিয়ে স্বভাবসুলভ গ্রুপফী করে সৈকতকে বিদায় জানালাম। নিজের দেশ ছাড়ার আগে কেমন জানি ফিলিং আসে, মোবাইল সিগন্যাল তখনো জিন্দা, সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল যার যার পরিবারে "সীমান্ত-রিপোর্ট" পেশ করতে।
নোম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপফী গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ । এরপরে ঢুকে গেলাম পরদেশ, ভারতে।
©somewhere in net ltd.