![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাবা বাড়িতে। রাত সোয়া
১০টা বাজে। মেয়ে ফেরেনি।
তিনি মেয়েকে খুঁজতে
বেরোলেন। বাবার হাতে
টর্চলাইট। বাড়ির অদূরেই
কালভার্টের কাছে পড়ে আছে
একপাটি জুতা। তাঁরই মেয়ের।
টর্চ মেরে দেখলেন একটু দূরে
তার মোবাইল পড়ে আছে।
কালভার্টের আরেক পাশে
পাওয়া গেল তনুকে। বাবার
চিৎকারে তনুর ছোট ভাই
রুবেলও ততক্ষণে ছুটে এসেছে।
এই পর্যন্ত পড়েই বুকটা চেপে
ধরে। শরীর হিম হয়ে আসে।
আহা, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট
বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার
হোসেন সাহেব। আপনার মনের
ভেতর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে
তখন, তনুর মায়ের মনের ওপর
দিয়ে, আপনাদের সমস্ত
অস্তিত্বজুড়ে কী অসহ্য অমেয়
বেদনার পাহাড় চেপে বসে
আছে! আমি কল্পনা করতে
পারছি না। আমি এই চাপ নিতে
পারছি না।
কী প্রাণবন্ত একটা মেয়ে ছিল
তনু। সোহাগী জাহান তনু।
আপনাদের আদরের সোহাগী।
সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যমে ওর ছবি ছড়িয়ে
পড়েছে, একাধিক, মাথায়
স্কার্ফ, মুখে হাসি, চোখে
বুদ্ধির ঝলক। কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজের
ইতিহাসের ছাত্রী। নাটক করে।
সংস্কৃতি চর্চা করে। প্রাণহীন
বিক্ষত দেহ পড়ে রইল
কালভার্টের পাশে, জঙ্গলের
ভেতরে। বাড়ির খুব কাছে।
আমিও তো বাবা। আমার
বুকের মধ্যে সন্তানহারানো
বাবার সমস্ত বেদনা এসে
চেপে ধরে। আমিও একজন মানুষ!
আরেকটা মানুষের এই অপরিসীম
উত্তরহীন শোক, বেদনা,
যন্ত্রণা আমাকেও খানিকটা
স্পর্শ করে।
হয়তো তনুর এই খবর আমি অগ্রাহ্য
করে নিস্তরঙ্গ হয়েই থাকতাম।
রোজ তো তাই করি। এত
দুঃসংবাদ, এত মৃত্যু, এত নারী
নির্যাতন, আত্মহত্যা, সড়ক
দুর্ঘটনা, রেল-নৌ দুর্ঘটনার
খবরের চাপে পলায়নবাদী হয়ে
গেছি। ওই সব খবর পাশ কাটিয়ে
চলে যাই। নিরাপদ তন্দ্রায় আশ্রয়
নিতে চাই। পড়লে সহ্য করতে
পারব না। কান্নাকাটি করব।
বাকি সব কাজ তুচ্ছ মনে হবে।
বুঝি, এ হলো বার্ধক্যের লক্ষণ।
উটপাখির মতো বালিতে মুখ
গুঁজে বহমান ঝড়কে ভুলে থাকার
চেষ্টা।
কিন্তু তরুণেরা তা হতে দিল
না। আমার মতো আধমরাদের
ঘা মেরে বাঁচানোর জন্য
সারা বাংলাদেশের
অপরাজেয় তারুণ্য জেগে
উঠেছে। হাজার হাজার
ছেলেমেয়ে দখল করেছে
কুমিল্লার সড়ক-মহাসড়ক।
প্রতিবাদে রুখে উঠেছে
দেশের নানা জায়গার
তরুণসমাবেশ। তারুণ্য তো তাই।
প্রতিবাদ করাই তো তারুণ্যের
ধর্ম। হেলাল হাফিজ তো সেই
কবেই লিখে রেখেছেন, এখন
যৌবন যার মিছিলে যাবার
তার শ্রেষ্ঠ সময়।
ওইখানেই আশার আলো
দেখছি। প্রতিবাদের আগুনে
আমাদের কালিমা পুড়ে যাক।
আমরা খাঁটি সোনা হয়ে
উঠি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লিখেছিলেন, এই হাত ছুঁয়েছে
নীরার মুখ, এই হাতে আমি কি
আর কোনো পাপ করতে
পারি? স্মৃতি থেকে লিখছি,
এদিক-ওদিক হতে পারে, সুনীল
লিখেছিলেন, পুরুষ পাঞ্জার
দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো।
যে হাতগুলো মিছিলে
যাবে, মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আকাশের
দিকে উঠবে, তারা সবাই যেন
শুদ্ধ হয়ে ওঠে, এই পুরুষ হাতগুলো
যেন তনুদের পাশে থাকবার,
সঙ্গে চলবার জন্য চিরদিনের
জন্য যোগ্য হয়ে ওঠে।
‘দেখি, কালভার্টের পাশে
মেয়ের একটি জুতা’
তনুকে যারা হত্যা করেছে,
তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি
দেওয়া হোক। দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি। যেন আর কেউ
কোনো তনুর দিকে তাদের
হিংস্র হাত বাড়ানোর সাহস
না পায়। এটা সম্ভব।
সেই যে দিনাজপুরের ইয়াসমিন
হত্যার বিরুদ্ধে সমবেত
প্রতিবাদে কাজ হয়েছিল।
বিচার হয়েছে, শাস্তি
পেয়েছে অপরাধীরা। এবারও
তাই হতে হবে। দোষীদের
খুঁজে বের করতে পারতেই হবে।
অপরাধীর/অপরাধীদের
আইনানুগ ন্যায্য ও দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি হতেই হবে।
পাশাপাশি নারীর প্রতি
সহিংসতা সর্বস্তরে বন্ধ করার
আন্দোলনও সূচিত হোক
আজকের দিনটি থেকেই।
আমাদের তিনজন নারীর দুজনই
নির্যাতিত হন নিজ ঘরে।
আমাদের নারীরা সম্মানিত নন,
সমমর্যাদা পান না কোথাও।
আজকে যে তরুণেরা
প্রতিবাদী হয়ে নেমেছেন
রাজপথে, যে তরুণেরা সর্বস্ব পণ
করে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে
দিচ্ছেন সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমে,
তাঁদের বলি, এই নৃশংস অপরাধের
ন্যায়বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি নিশ্চিত করার এই
আন্দোলন বিজয় অর্জিত না
হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যান।
হাস্তালা ভিক্তোরিয়া
সিয়েম্পে্র—চে গুয়েভারার
উক্তি—মাহমুদুজ্জামান বাবুর
গানে যা আমরা শুনতে পাই—
বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত
লড়াই চালিয়ে যাও... এখনই অন্ধ
বন্ধ কোরো না পাখা, তা
হোক এই আন্দোলনের ব্রত।
পাশাপাশি, ঘরে-বাইরে,
মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে,
যানবাহনে-স্টেশনে, কর্মস্থলে-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পাহাড়ে-
সমতলে, নির্জন স্থানে আর
জনতার ভিড়ে—সর্বত্র আমরা
যেন নারীর নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে পারি। আমি
আমার স্ত্রীকে নিয়ে, নারী
সহকর্মী নিয়ে স্টেডিয়ামের
গ্যালারি থেকে বেরোতে
ভয় পাই, ভিড়ের কারণে,
বইমেলার গেটে নারীসঙ্গী
থাকলে তটস্থ হয়ে থাকি।
ভিড়ের মধ্যে নারী নিরাপদ
নন। নারী নিরাপদ নন তাঁর
নিজের ঘরে। নারী নিরাপদ নন
নির্জন স্থানে। নারী নিরাপদ
নন কাস্টোডিতে। নারী
নিরাপদ নন অফিসে। এবং শিশু
থেকে শুরু করে বয়স্ক পর্যন্ত কে এই
সমাজে নিজেকে নিরাপদ
ভাবেন? কোন নারী?
এসব ব্যাপারে করণীয় আছে
অনেক। তবে সবকিছুর শুরু হবে নিজ
থেকে, নিজের পরিবার
থেকে। আমার নিজের হাতের
দিকে তাকিয়ে যেমন বলতে
হবে, যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে
ওঠো, তেমনি আমার ছেলে
সন্তানটিকে উপযুক্ত মূল্যবোধ
দিতে হবে, আমি যদি নারীকে
সম্মান না করি, আমার সন্তান
শিখবেটা কী।
তনু হত্যার প্রতিবাদের মিছিল
বড় হোক। ওই প্রতিবাদের আগুন
আমাদের পুড়িয়ে পুড়িয়ে
খাঁটি করে তুলুক। রাষ্ট্র তার
দায়িত্ব পালনে যেন
বিন্দুমাত্র গড়িমসি না করে।
ব্যক্তিও যেন নিজেকে শুদ্ধ
করতে ব্রতী হয়। সমাজ যেন
পুরুষবাদী মানসিকতা থেকে
বেরিয়ে মানববাদী হয়ে ওঠে।
m.prothom-alo.com/opinion/article/809635/তনুর-বাবা-আমি-আমরা
©somewhere in net ltd.