![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পার্থসারথি , লেখক
ধারাবাহিক উপন্যাস : রঙমহল, পর্ব-১
= পার্থসারথি
পর্ব-১
স্ত্রী যুগবালা ইহধাম ত্যাগ করার পর থেকেই সবকিছু কেমন যেন ছন্দ ছাড়া হয়ে পড়ে নারায়ণ বাবুর কাছে। কাজের ভেতর ডুবে থেকে ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু স্মৃতির পাতা বারবার উল্টে ভেসে ওটে যুগবালার প্রতিচ্ছবি। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো বারবার হানা দেয় মনের ছোট আকাশের চিলেকোঠায়। দীর্ঘশ্বাসের ধোয়ায় ধোয়ায় স্মৃতির কষ্টগুলো ঘনীভূত হয়। কোনভাবেই নিজেকে প্রবোধ মানাতে পারছেন না। জীবনটা বৃন্তচ্যুত ঝরা পাতা। অথবা মহাকাশ থেকে খসে পড়া উল্কাপিন্ড। সবই বুঝেন শুধু যুগবালার অকস্মাৎ চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না। যখনই একটু নীরবতা তখনই শুরু হয় যুগবালার স্মৃতি রোমন্থন।
শালিক জোড়ার সোহাগী কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেলে তাকান নারায়ণ বাবু। ইজি চেয়ার থেকে শরীরটা তোলেন। গভীরভাবে তাকিয়ে দেখেন শালিক জোড়ার প্রেম। মনটা প্রচন্ড রকমের ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চোখ মেলে দেন অসীম নীল আকাশের বুকে। আর ভাবেন ঐ নীলের কোথাও হয়ত মিশে আছে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমা যুগবালার ফেলে যাওয়া নি:শ্বাসের প্রতিধ্বনি।
শালিক জোড়া প্রেম প্রেম খেলা শেষে ফুরুৎ করে ঊড়ে চলে যায়। নিমেষেই চোখের আড়াল হয়। মন-কাড়া দৃশ্যটুকু ভাবতে ভাবতে নারায়ণ বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হাত দু’টো মাথার পেছনে ফেলে আবার শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিলেন। চোখ জোড়া বন্ধ। গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। কপালের ভ াঁজগুলো দেখলেই কষ্টের সীমানা পরিমাপ করা যায়।
সুবিমল হুকা হাতে অনেকণ দ াঁড়িয়ে আছেন। কর্তাবাবুর ঘুমটা ভাঙাতে মন চাচ্ছিল না। এদিকে হুকার আগুন পুড়ে অর্ধেক শেষ। কর্তাবাবু সাজানো তাজা হুকা টানতে পছন্দ করেন। আগুনটা ঠিক রাখতে বেশ জোরে জোরে ফু ঁ দিচ্ছেন সুবিমল বাবু। শব্দ পেয়ে কর্তাবাবু ডান হাতটা বাড়িয়ে দেন। সুবিমল খুব যতœ সহকারে হুকার নলটা কর্তাবাবুর হাতে তুলে দেন। না তাকিয়েই কর্তাবাবু হুকাতে দম বসান। ধোয়ার কুন্ডলী ছাড়তে ছাড়তে কর্তাবাবু বলেন - কী রে সুবিমল কোন কথা বলছিস না কেন?
সুবিমলের সংপ্তি জবাব - আজ্ঞে কর্তাবাবু।
কর্তাবাবু - আচ্ছা তুই তো আমার সাথে আছিস অনেক কাল , তাই না?
সুবিমল বলেন - আজ্ঞে কর্তাবাবু , তা প্রায় তিন যুগ হবে । জীবনের প্রায় পুরোটাই আপনার এখানে। আমার এখনও মনে পড়ে যখন এসেছিলাম তখন ধুতিটাও ঠিক মতন পরতে পারতাম না।
কর্তাবাবু - আচ্ছা বল তো আমি লোক হিসেবে কেমন।
সুবিমল কোন কথা বলেন না। অবশ্য কথা বলবেনই কী! কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। কর্তাবাবুকে দেখলেই সুবিমলের মনটা বিমর্ষ হয়ে যায়। সুবিমল তার চার যুগের বয়সে এমন বিশুদ্ধ আর প্রাণখোলা লোক দেখেন নি। কর্তাবাবুর কী নেই ; বিশাল সম্পত্তির মালিক। একদিকে রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য আর অন্য দিকে বিশাল পরিমাণের জমি-জিরাত ; শুধু নামাংকিত জমিদারিটা নেই। কিন্তু একজন জমিদারের চেয়ে কোন অংশে কমতি নেই। বাড়ীতে দাস-দাসীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। উনার বাড়ীতে খেয়ে-পরে কত পরিবারই
উৎরে যাচ্ছে। কর্তাবাবুর দয়ার শরীর। বিপদে-আপদে সবার পাশে থাকেন। রুচির দিক থেকেও বেশ সরস। বাড়ীতে নতুন কেউ ঢুকলেই কর্তাবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন। এই যে হাতের কাছে রুপাতে
ব াঁধানো হুকাটা যে কেউ দেখুক হাতে স্পর্শ করে না-দেখে থাকতে পারবেন না। আর যে কাঠের -দোতলা বাড়ীর বারান্দায় বসে হুকা টানছেন সেটা দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে শুধু এক পলক দেখার জন্য ছুটে আসে লোকজন।
কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে কর্তাবাবু চোখ মেলে তাকালেন। সুবিমলের দু’চোখ বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছে।
কর্তাবাবু নিষ্পলক, বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন - তুই ক াঁদছিস?
সুবিমল ক াঁপা ক াঁপা কন্ঠে বলেন - কর্তাবাবু আপনি এমন এক প্রশ্ন করলেন যার উত্তর দেবার মত ভাষা ভগবান আমাকে দেন নি।
কর্তাবাবু বেশ আপে করেই বলেন- ভগবান তাহলে আমার প্রতি এমন অবিচার করলেন কেন? আমি তো এমন কোন পাপ করি নি যে,তোর গিন্নীমা আমাকে ছেড়ে আগেই বিদায় নেবেন। আমি একন ে ঁবচে থেকে কী করব?
সুবিমল- কর্তাবাবু , আপনি এভাবে ভেংে পড়লে চলবে না। ছোটবাবু তাহলে কোথায় ভরসা পাবেন। আপনি মনটাকে শক্ত করেন। ভগবানের খেলা আমাদের মেনে চলতেহবে। গিন্নীমা যেন স্বর্গবাসী হন।
আমি যে তোর গিন্নীমাকে মন থেকে কোন ভাবেই মুছে ফেলতে পারছি না। আজ এক বৎসর গত হল একটি দিনের জন্যও ভুলতে পারি নি। তোর গিন্নীমা আমার রক্তের প্রতিটি কণায় মিশে আছেন।
সুবিমল এবার প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করে বলেন- কর্তাবাবু যদি বেয়াদপি না নেন তবে একটা কথা বলব। - এই বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
কর্তাবাবু মুখে কিছুই বলেন নি। কিন্তু দৃষ্টি পড়ে আ্েযছ শোনার প্রতীায়। সুবিমল আমতা আমতা করে বলেন- আসলে কথাটা আমি অনেক দিন ধরেই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি কিন্তু বলার সাহস পা”্ছি না।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে কর্তাবাবু তাকান। সুবিমল বাবু যেন অভয় পেলেন ; বলতে শুরু করেন- কর্তাবাবু যদি বেয়াদপি না নেন ; অনেকদিন আগেই আমার কাছে একটা ভাল প্রস্তাব ছিল। যদি...।
কথা শেষ করতে না দিয়েই কর্তাবাবু বলেন- এমন অশোভন কাজ করলে মানুষজন হাসাহাসি করবে। তাছাড়া ছেলে-পুলেরাই উপযুক্ত হয়েছে। এখন আর এসব চিন্তা মানায় না। বরং আমার প্রিয়নাথের জন্য কনে দেখ।
আপনি একি বলছেন! ছোটকর্তার বয়স বারও হয় নি।
গেল মাসেই বার পূর্ণ হয়ে তেরতে পড়েছে। আমার প্রিয়নাথের জন্যই পাত্রী দেখ।
আজ্ঞে কর্তা। তবে আমি যে পাত্রীর কথা বলছি রূপে-গুণে লী-স্বরস্বতীর যুগল মূর্তি। আপনি ভাল করে ভেবে দেখুন, খুবই ভাল হবে। আমরা নতুন করে গিন্নীমাকে ফিরে পাব।
না সুবিমল এ আর হয় না। আমার যুগমায়া আমা প্রতি রুষ্ট হবে। তাছাড়া আমার আর বয়স আছে নাকি? আমার প্রিয়নাথের কনে দেখ। যথাশীঘ্রই বিয়ের ব্যবস্থা কর। আর আজ থেকে প্রিয়নাথ সবসময় আমার সঙ্গে থাকবে। ব্যবসা-বাণিজ্য দেখা-শুনা করবে।
সুবিমল বেশ ঊদগ্রীব হয়ে বলেন- ছোটকর্তার লেখা-পড়ার কী হবে?
আর লেখা-পড়া হবে না ; তাছাড়া প্রিয় লেখাপড়ার প্রতি বেশ অমনোযোী। আমার এই বিশাল সম্পত্তির দেখাশুনার উপযুক্ত একজন তো লাগবেই।
তা’ অবশ্য ঠিকই বলেছেন। ঠিক আছে কর্তাবাবু, আপনি এখন বিশ্রাম নিন।
***
বহুদিন পর বাবু-বাড়ীতে উৎসব উৎসব আমেজ। এত এত নানান রকমের লোক থাকা সত্ত্বেও বাড়ীটা ছিল প্রাণহীন। তা’ হবেই বা না কেন। গিন্নীমাতার চিরবিদায়ে সবাই যেন মূহ্যমান হয়ে পড়েছিল। এবার ছোটকর্তার বিয়ে পাকাপাকি হবার সংবাদে সবাই যেন একটু নড়েচড়ে বসল। যত সহজে এ সংবাদটা লিখলাম তত সহজে াবশ্য এ বিয়ে ঠিক হয় নি। এর জন্য বাবু নারায়ণ সরকারকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র প্রিয়নাথ এখনও অতি ভালক স্বভাবের।একটু গা-ছাড়া ভাব নিয়ে চলাফেরাতেই অভ্যস্ত। পিতার সাথে বৈষয়িক ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট হয়েছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ব্যবসা,ব্যবসা আর ব্যবসা; এমন বেড়াজালে ঢুকতে আয় নি প্রিয়নাত। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পথে আনা হয়েছে। এখন অবশ্য সারাণ পিতার ছায়ায় ছায়ায় থাকেন। বিয়েতে ছোট কর্তা প্রিয়নাথের তেমন জোড়ালো আপত্তি না থাকলেও সমস্যা কনে নির্বাচনে ছিল। একবারতো এক কনে দেখতে গিয়ে এক লংকাকান্ড। সবকিছু ঠিকঠাক এবার কনে দেখার পালা। কনেরে ডাক পড়ল ; কনের পাত্ত্ নেই। রীতিমতদ নি ঁখোজ। ঘরে নেই। উঠানে নেই। পেছন বাগানে নেই। পাশের কোন বাড়ীতেও নেই। নেই...নেই...নেই..। পুরো বাদলা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খে াঁজা হল কনের খে াঁজ মিলছে না। শেষ-মেস কি আর করা! নারায়ণ বাবু কনে-পিতাকে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে বিদায় নিচ্ছেন অমনি ঝন্ঝনিয়ে কয়েকটা চুড়ি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেল। সবার দৃষ্টি চলে গেল ওপরে। উঠানে আম গাছের সবচেয়ে উচু ডালে পা ছড়িয়ে বসে মিটিমিটি হাসছে। অনেক কসরত করে কনেকে গাছের মগআল থেকে নামাতে হয়েছে। কনের বক্তব্য সবকিছুই ঠিক আছে ; কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। নারায়ণ বাবু বুঝতে পেরেছেন এ মেয়েকে নিয়ে রাখতে পারবেন না। নদী স াঁতরে হলেও বাপের বাড়ি চলে আসবে। তাই হাল ছেড়ে দিলেন। অবশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করেন নি। শেষমেস সুবিমলের চেষ্টায় পূব-গ াঁও- এ কনে পাওয়া গেল। দূর-দূরান্ত ঘুরে শেষে পাশের গ্রামে কনে মিলল। কনের বয়স সবে দশ পূর্ণ হয়েছে। এ বিয়ে ঠিক হয়েছে কনের একটি শর্তে ; বিয়ের পর সব খেলনা, হাড়ি-পাতিল সাথে করে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে আসবে। নারায়ণ বাবু তা’ সানন্দে মেনে নিলেন। আরও মেনে নিলেন কনের পিতা বিখ্যাত মামলাবাজ হওয়া সত্বেও। কারণ মেয়েটা দেখতে -শুনতে, রূপে-গুণে পরিপূর্ণ। ওকে গড়ে তুলতে বেশিদিন লাগবে না। তাছাড়া ছেলে তো বউ নিয়ে সবসময় শ্বশুরবাড়ী পড়ে থাকবে না।
বজরা সাজিয়ে বড় কর্তা নিজে রওনা হলেন মহকুমা সদর কিশোরগঞ্জ। বিশেষ কাজ ছাড়া কর্তাবাবুৃ মহকুমা সদরে যান না। ছেলের বিয়ের কেনাকাটা নিজে করবেন তাই গেলেন। ইটনা থেকে মহকুমা সদর দু’দিনের পথ। তা’হোক শত হলেও ছেলের বিয়ে।
বজরা বোঝাই করে প াঁচ দিনের মাথায় বড় কর্তা ফিরলেন। আর এদিকে সুবিমল বাবু ছোটকর্তাকে নিয়েই এ ক’দিনে পুরো একটা জলমহালের দেখাশুনা করলেন। বৈশাখেই চলে জলমহালের মাছ তোলা আর বেচা। আবার পাশাপাশি ধান তোলার মাস। তাছাড়া এ মাসেই বিয়ে, হাতে সময় এ কদম কম। ছেলের ব্যবসায়িক বদ্ধির বেশ তারিফ করলেন সুবিমল। শুনে নারায়ণ বাবু বেশ স্বস্তি ফিরে পেলেন।
পরের সপ্তাহে বেশ ধুমধামের সাথেই বিয়ে হল। পুরো ইটনা গ্রামের সবাই এ বিয়ের নিমন্ত্রণী ছিল। সবাই নারায়ণ বাবুর রুচির প্রসংশায় পঞ্চমুখ।
***
বিয়ের পর ফিরাগমন সেরে প্রিয়নাথ পিতার সাথে ব্যবসায়িক কাজে নিজেকে পুরোদমে স’পে দিলেন। আর এ দিকে বাল্যবধূ রাসময়ী দেবী তার খেলার অনেক সাথী পেয়ে মহাখুশী। মিছিমিছি রান্না খেলা, কানামাছি অথবা পুতুল খেলা নিয়ে মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বাড়ির যত ছোট ছেলে-মেয়েরা আছে সবাই ছোটগিন্নী রাসময়ী দেবীর খেলার সঙ্গী। এমন কি দুই দেবর ও ননদ ওর প্রিয় খেলার সাথী। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে অবিরাম খেলা। ছোট সঙ্গীরা রাসময়ী দেবীকে পেয়ে যেন আকাশের চ াঁদ হাতে পেল। কারণ এখন খেলার কোন সামগ্রী অথবা সময়ের অভাব হয় না। ঘুম থেকে উঠে কোথায় যাচ্ছেন অথবা কী করছেন সেদিকে কোন খেযালই রাখেন না রাসময়ী দেবী। অথবা এটাও বলতে পারি ওই বোধটুকু এখনও জন্মায় নি রাসময়ী দেবীর চিন্তার জগতে। ওকে দোষ দেবারও কোন ফ াঁক-ফোকর নেই। কারণ এই বয়সটা তো লেখাপড়া আর খেলা করার।
দেখতে দেখতে বিয়ের বয়স এক বৎসর পূর্ণ হল। এ এক বৎসরে প্রিয়নাথের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পুরোদস্তুর সাংসারিক মানুষ। বৈষয়িক ব্যাপারে জ্ঞান একেবারে ঠনঠনে। বাবু নারায়ণ সরকার ইচ্ছে করেই সংসারের লাগামটাপুত্র প্রিয়নাথের হাতে ছেড়ে দেন। এবং কাছ থেকে ল্য রাখেন।প্রিয়নাথ সবই ঠিকঠাক নির্বিঘেœ চালিয়ে নেয়। নারায়ণ বাবু খুবই প্রীত বোধ করেন পুত্র প্িরয়নাথের গুণ ল্য। তবে মাঝে মধ্যে পুত্রকে চিন্তিত দেখতে পেয়ে দু:শ্চিন্তায় পড়ে যান নারায়ণ বাবু। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না এর কারণ কী থাকতে পারে। তাই কর্তাবাবু সুবিমলকে ডেকে পাঠালেন। এবং বলে রাখলেন যেভাবেই হোক এর কারণ অনুসন্ধান করে বের করার জন্য্
সারাদিন কাজ শেষে যখন প্রিয়নাথ বাড়ি ফেরে তখন পর্যন্ত রাসময়ী দেবী থাকে ওর নিজস্ব জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সন্ধ্যার পরের সঙ্গী মূলত: দেবর শম্ভূনাথ ও প্রহল্বাদ াার ননদিনী সুনয়না। ওরা প্রত্যেকেই খুব কাছাকছি বয়সের। ননদিনী সুনয়না তো বউ’দিমনির সাথে সারাদিন আঠার মত লেগে থাকে। প্রিনাথের কাছে লেও সঙ্গে থাকে লুডুর বক্সটা। প্রিয়নাথের বেশ বিরক্তি লাগে কিন্তু প্রকাশ করেন না। আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু স্ত্রী রাসময়ী দেবীকে দেখেন। এবং ইদানীং প্রিয়নাথ বুঝতে পারেন যে, রাসময়ী দেবীকে দেখলে একটা অন্যরকম ভাললাগা সে ভর করে। হাত বাড়িয়ে কাছে টানার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাসময়ী দেবী চোখ গরম করে বলে- সাবধান আমার গায়ে হাত দিবা না, আমার রাগ ওঠে; কথাগুলো বেশ জোরে-সোরে বলে ওঠে। আশেপাশে কেউ থাকলে তা স্পষ্ট শুনতে পাবে তাই লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নেয় প্রিয়নাথ।
রাতে এক বিছানায় শোয় ঠিকই কিন্তু বিস্তর একটা ফারাক থাকে। তা’ সযতনে রাসময়ী দেবী তৈরি করে রাখেন। বিয়ের পর থেকে প্রিয়নাথ বন্ধুর মতই মিশেছে। কিন্তু আজকাল বিছানায় লেই শরীর গরম হয়ে ওঠে। কান দু’টো কেমন যেন ঝা ঝা করে। কেউ দূর থেকে কথা বললে তা কাছে সে অস্পটষ্ট হয়ে আসে। স্ত্রী রাসময়ী দেবীকে জাপটে ধরার বাসনা তীব্র হয়। কিন্তু রাসময়ী দেবী বিশাল এক দেয়াল তৈরি করে রেখেছেন।
এ দেয়ালটা ভাঙারচেষ্টা করেন রাসময়ী দেবী কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেন না। দাসী লী অবশ্য তা নিয়ে রাসময়ী দেবীকে অনেক রকম পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি কীভাবে ক্যী করতে হবে তা সবই অভিনয় করে দেখিয়েছেন। এবং প্রথম রাতে যে নিজে যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সে কথাও রাসময়ী দেবীকে শুনিয়ে দিলেন। শোনেন ছোটগিন্নী স্বামী হল মেয়েদের ভগবান। স্বামীকে সবসময় তুষ্ট রাখবেন। স্বামী সেবাই মেয়েদের একমাত্র সেবা। যেসব পেলে স্বামী খুশী হন অথবা করে শান্তি পান তাতে স্ত্রীকে সহযোগিতা করথে হয়। স্বামী অখুশী থাকলে এ সংসার কোনদিন সুখের হয় না। স্বামীর ঘর ¯ত্রীর কাছে পরম আরাধ্য হওয়া দরকার। - এভাবেই দাসী-লী রাসময়ী দেবীকে বুঝিয়ে বলেন। রাসময়ী দেবী কথায় কথায় সায় দেন কিন্তু কার্যত বিন্দুমাত্রও পালন করতে পারেন না।
প্রিয়নাথ বাবু আজ মনস্থির করেন ; যেভাবেই হোক আজ রাতে রাসময়ীকে বাগে আনতে হবে। এবং কীভাবে কী করতে হবে তা মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন।
প্রিয়নাথ বাবু বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। াানমনে ভাবছেন অনেক কিছু। রাসময়ী দেবী ঘরে প্রবেশ করতেই তাকালেন এবং হেসে বললেন- এতণে আমার কথা মনে পড়ল?
রাসময়ী দেবী তেমন গুরুত্ব না দিয়েই বলেন- আমরা লুডু খেলছিলাম।
প্রিয়নাথ বাবু প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।
রাসময়ী দেবী অভিমান ভরা কন্ঠে বলেন- তোমার ভাই শম্বুনাথ ভীষণ চুরি করে তাই হারাতে পারি না।
প্রিয়নাথ বাবু মুচকি মুচকি হাসেন। তারপর সোহাগ ভরা কন্ঠে বলেন- ও ছোট মানুষ একটু-আধটু চুরি করতেই পারে, খেলার মধ্যে ওসব চলে।প্লিজ লীটি দরজাটা একটু চাপিয়ে এস!
রাসময়ী দেবী বেশ ঝাঝালো কন্ঠে বলেন- দরজা চাপাতে হবে কেন?
প্রিয়নাথ বাবু একটু গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে বলেন- তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
কী কথা তাড়াতাড়ি বল, দরজা চাপাতে হবে না।
প্রিয়নাথ বাবু অনুনয়ের সুরে বলেন- আগে দরজাটা চাপিয়ে এস, পরে বলছি।
রাসময়ী দেবী আর কথা বাড়ান না। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে আসেন। তারপর একটু দূরত্ব রেখেই বিছানায় বসেন এবং বলেন- এবার বল কী বলবে?
প্রিয়নাথ বাবু ইচ্ছে করেই একটু কালপেণ করে বলল- ভাবছি তোমাকে নিয়ে আগামীকাল তোমাদের বাড়ীতে যাব।
রাসময়ী দেবী খুশিতে লাফিয়ে ওঠেন। নড়েচড়ে একটু কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেন। চোখে চোখ রেখে বলেন- সত্যি বলছো তো?
হ ্যাঁ, সত্যি ... সত্যি ... সত্যি ... তিন সত্যি বললাম।
রাসময়ী দেবীর চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল। এই সুযোগে প্রিয়নাথ আরও ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেন , বলেন- আমার মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। চুলগুলো একটু টেনে দাও না? – বলতে বলতে প্রিয়নাথ রাসময়ী দেবীর একটা হাতে চেপে ধরেন।
রাসময়ী দেবী স্বামীর কাছাকাছি এসে মাথায় হাত রাখেন। তারপর চুলের ভেতর আঙুলে বিনুনি কাটতে থাকেন। সুযোগে প্রিয়নাথ বাবু হাত চালাতে থাকেন। খুবই সন্তপর্ণে চলে এ হাত। কারণ রাসময়ী দেবীর সারা শরীর জুড়ে ক াঁতুকু ঁতু ভরা। এখনও এ হাতের উত্তাপ শুষে নেবার অনুভূতিগুলো জেগে ওঠেনি। তবে আজই প্রথম স্বামীর এলোমেলো হাতের উত্তাপ কেমন যেন শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। রাসময়ী দেবী স্বামীর মাথায় বিনুনি কেটেই চলছেন। এদিকে প্রিয়নাথের নি:শ্বাসের চলাফেরা দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। হাতটা হঠাৎ থমকে যায় সবে উন্নত বুকে এসে। রাসময়ী দেবী স্বামীর চোখে চোখ রাখেন। দৃষ্টিতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। প্রিয়নাথ ক াঁপা ক াঁপা কন্ঠে বলেন- সত্যি বলছি তোমাকে নিয়ে আগামীকাল তোমাদের বাড়ীতে যাব। প্রিয়নাথের হাতের উত্তাপে, নি:শ্বাসের উত্তাপে সর্বোপরি দেহের উত্তাপে মাখনের মত গলে নেতিয়ে পড়ল রাসময়ী দেবী। প্রিয়নাথ দু’হাতে জড়িয়ে ধরে দু’চোখ বন্ধ করে মিশে যায় মহাকালের অন্তহীন গহ্বরে।
চলবে...
©somewhere in net ltd.