![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভূমিকাঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার। তার দীর্ঘদিনের নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে আমাদের স্বদেশভূমিকে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আদর্শে জাতীয়তাবাদী ও বিশ্বাসে গণতন্ত্রমনা। তাইতো তিনি কর্মী থেকে হয়েছেন নেতা আর নেতা থেকে হয়েছেন জননেতা। দেশনেতা থেকে হয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে একটি দলের নেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই বাঙালির দীর্ঘদিনের আত্মানুসন্ধান,আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। তিনি আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়া হঠাৎ করে হয়নি। আজ এ কথা ভেবে বিস্মিত হই যে, এই ভূখণ্ডে যেটি পাকিস্তান সৃষ্টির পর 'পূর্ব বাংলা' এবং 'পূর্ব পাকিস্তান' নামে পরিচিত ছিল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জাঁদরেল পাকিস্তানি সমরনায়কদের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে সেটিকে 'বাংলাদেশ' বলে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করার পেছনেও শেখ মুজিবের অবদান অনন্য।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে যারা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি, তারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের অনুচর ও ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু সরকার যখন এক স্থিতিশীল, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং শোষণমুক্ত ও প্রগতিশীল আর্থসামাজিক কাঠামো গড়ে তোলার কাজে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে এবং কিছু সাফল্যও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। বলা যেতে পারে, ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা ।
শুধু দেশের উন্নয়নই নয়, আন্তর্জাতিক মহলে কিভাবে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, এটিই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবনা। তিনি সবসময়ই একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে কোনো যুদ্ধ, সংঘাত ও ধ্বংস থাকবে না। একই সঙ্গে মানবতার কল্যাণ ও শান্তির জন্য বিশ্বের সবগুলো রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ছিলেন। এই প্রত্যয় থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। আমাদের উপমহাদেশের বর্তমান অনিশ্চিত ও অশান্তিকর পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত অন্যান্যরাও যে ন্যামের গুরুত্ব এখনও অনুভব করছেন এবং তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এটা বড় ধরনের আশার কথা। দেশের অস্তিত্বের জন্য এবং যথাসম্ভব দানবতন্ত্রের থাবামুক্ত থাকার লক্ষ্যে বিশ্বের দুর্বল এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যে লৌহদৃঢ় ঐক্য প্রয়োজন, এই সত্যটা বঙ্গবন্ধুর মতো সবাই উপলব্ধি করছেন এবং দেশের মাটিতে অসংখ্য জরুরি কাজ থাকা সত্ত্বেও তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যাম সম্মেলনে ছুটে গেছেন।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যাম হচ্ছে কোনো শক্তির সঙ্গে জোট না বেঁধে প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া—এই মূলনীতির ভিত্তিতে ১৯৬১ সালে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জন্ম হয় একটি সংগঠনের, যা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) নামে পরিচিত। এ আন্দোলন গড়ার মূল নায়ক ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, ঘানার প্রেসিডেন্ট কোয়ামি ইনকোমো এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ। একে বলা হতো ‘পঞ্চ-উদ্যোগ’।
১০টি নীতির ভিত্তিতে ন্যাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: জাতিসংঘ সনদের আলোকে মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো; সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন; ছোট-বড় সব দেশ ও গোত্রের মধ্যে সমতার স্বীকৃতি; অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা; জাতিসংঘ সনদের আলোকে এককভাবে বা সমষ্টিগতভাবে কোনো দেশের অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রদান; কোনো বড় শক্তির স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে যেকোনো প্রচেষ্টা ও অন্য দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা; কোনো দেশের অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ বা হুমকি প্রদান থেকে বিরত থাকা; সব ধরনের আন্তর্জাতিক বিরোধ জাতিসংঘ সনদের আলোকে আলোচনা, সমঝোতা, সালিস বা আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা; পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতাকে এগিয়ে নেওয়া এবং ন্যায় ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
তৎকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ন্যামের প্রতিষ্ঠাঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। ১৯৪৫ সালে চালু হয় বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ। ১৯৪৫ সালেই সৃষ্টি হয় জাতিসংঘ। শুল্ক হ্রাস ও বাণিজ্য-বাধা কমিয়ে আনার মাধ্যমে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে শুরু হয় শুল্ক ও বাণিজ্যবিষয়ক সাধারণ চুক্তি (গ্যাট) আলোচনা। সামরিক জোট গঠনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয় নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সহযোগিতার মোড়কে ঢাকা হলেও একই উদ্দেশ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে ১৯৫৪ সালে সৃষ্টি হয় সাউথ-ইস্ট এশিয়ান ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিয়াটো) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ১৯৫৫ সালে ‘ওয়ারশো প্যাক্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শত্রু-মিত্র নতুন করে জোট বাঁধে। বিশ্ব দুই শক্তিধর গ্রুপের অর্থনৈতিক ও সামরিক সামর্থ্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয়া ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)’ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ১৯৫৫ সালে ‘ওয়ারশো প্যাক্ট’ গঠিত হবার পর থেকেই বিশ্ব দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলো তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান বৈশ্বিক দরবারে তুলে ধরার তাগিদে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করে। কোনো পক্ষের সঙ্গে মৈত্রী না করে প্রতিটি রাষ্ট্রকে সম্মান প্রদর্শন করে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তোলাই ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) এর একমাত্র উদ্দেশ্য।
ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুঃ
আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে আমেরিকার প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও যোগ দিয়েছিল ৭৩টি দেশ। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত, সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল (পরবর্তীকালে মার্কিন-চক্রান্তে নিহত), লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট আর্চবিশপ ম্যাকারিওস, গিনির প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুক প্রমুখ তৎকালীন বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় অনেক নেতা। সারাবিশ্বের দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ছিল এই ন্যাম সম্মেলনের দিকে। তখনকার দুই সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত দুই জোট এবং তাদের কোল্ড ওয়ারের মাঝখানে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছিল দুর্বল ও উন্নয়নশীল দেশ এবং সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জন্য শেষ আশা ও ভরসাস্থল। ভারতের নেহরু, মিসরের নাসের এবং যুগোস্লাভিয়ার টিটোর নেতৃত্বে এই জোটনিরপেক্ষতার আন্দোলনের জন্ম। এবং সারাবিশ্বে তা দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো প্রবল বিরোধিতা করেছে। নয়াচীন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে সমর্থন দেয়নি। প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করেনি, তবে তাতে ভাঙন ধরাতে চেয়েছে। কারণ, ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তখন চীনের শত্রুতা চলছিল।
আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র তখনকার ভারত ছিল ন্যামের নেতৃস্থানীয় তিনটি দেশের একটি। সুতরাং চীন দূরে ছিল এবং এখনও আছে। নেহরু এবং নাসেরের মৃত্যুর পর শক্ত হাতে এই আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন ইন্দিরা, টিটো এবং কাস্ত্রো। সম্ভবত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ন্যামের নেতৃস্থানীয় তিন নেতার সঙ্গে আরেকটি নাম যুক্ত হতো। সেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। কিন্তু আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মাত্র এক বছর পরেই (১৯৭৫) তার অকাল মৃত্যু বা মর্মান্তিক হত্যা সেই সম্ভাবনার বিনাশ ঘটায়। এরপর একে একে টিটো ও ইন্দিরার মৃত্যু আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি করে। ন্যামের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু শক্তি ও প্রভাব আগের মতো নেই। সত্তরের দশকের গোড়ায় ন্যাম যখন স্নায়ুযুদ্ধে পীড়িত বিশ্বে দুই সুপার পাওয়ারের প্রভাববলয়ের মাঝখানে একটি সত্যিকারের শান্তির মরূদ্যান এবং একটি প্রভাবশালী আন্দোলন, তখন এর প্রধান নেতা ইন্দিরা, টিটো ও কাস্ত্রোর সঙ্গে শেখ মুজিবের নামটিও অচিরেই যুক্ত হবে- এমন একটি আভাস ন্যামের ১৯৭৩-এর আলজিয়ার্স সম্মেলনেও পাওয়া গিয়েছিল। সম্মেলন শুরু হওয়ার পর ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সদলে আলজিয়ার্সে পৌঁছেছিলেন। তিনি পৌঁছাতেই সম্মেলন কক্ষের চেহারা পাল্টে গিয়েছিল। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের স্থপতি মুজিবকে সর্বাগ্রে দেখার জন্য অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়ক তার দিকে ছুটে এসেছিলেন। সম্মেলন কক্ষের দোরগোড়াতেই তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, আনোয়ার সাদত এবং ফিদেল কাস্ত্রো। কাস্ত্রো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তখনকার দুই পরাশক্তির আধিপত্যমূলক প্রভাববলয়ের বাইরে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে আগ্রহ ছিল, সেই আগ্রহ ও নিষ্ঠা যে তার কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যেও সমভাবে বিদ্যমান তার প্রমাণ তার প্রথম দফা প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ঢাকায় ন্যাম ভবন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যামের সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠানের জন্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীনের শত্রুতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সরকার চীনের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছিলেন, চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
বর্তমান প্রেক্ষিতে ন্যামের প্রয়োজনীয়তাঃ
ন্যাম এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মতাদর্শভিত্তিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রশমনে অবদান রেখেছে। বর্ণবাদ, শাসন-শোষণ ও জাতিগত বিরোধের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সমর্থন জুগিয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও ঔপনিবেশবাদের অবসানের পর ন্যামও তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিবর্তন এনেছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন করণীয় নির্ধারণ করেছে। ন্যায়ানুগ ও সমতাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়েছে। সমসাময়িক ইস্যুগুলোর ওপর ঐক্যবদ্ধ নীতি-কৌশল বাস্তবায়নে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে বহুজাতিক নীতি বাস্তবায়ন, সমতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় উন্নয়নশীল বিশ্বের কণ্ঠ বলিষ্ঠতর হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ন্যামের সদস্যদের দাবি সুসংহত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের হার বেড়েছে, যা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ন্যামের সদস্যরা টেকসই উন্নয়ন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটাও ঠিক যে উন্নয়নের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তেমন উদ্যোগ নিচ্ছে না। সার্বভৌম উন্নয়ন নিশ্চিত করার অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। বিশ্বায়নের অভিঘাতের পাশাপাশি ঋণের বোঝা, অন্যায্য বাণিজ্যচর্চা, বৈদেশিক সহায়তা হ্রাস, দাতাদের অযাচিত শর্তারোপ এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ার ফলে উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘে সব রাষ্ট্রের সমান অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শক্তিশালী দেশগুলো হরহামেশাই তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। এর ফলেও উন্নয়নশীল বিশ্ব তাদের সার্বভৌম অধিকার সংরক্ষণ করতে পারছে না। এসব প্রতিবন্ধকতা অপসারণে ন্যাম ৭৭-জাতি গ্রুপের সঙ্গে কয়েকটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর ফলে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্য ঘোচানোর দাবি আজ বিশ্বদাবিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি মানবাধিকার, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ধর্মীয় সহনশীলতা, কৃষ্টির বিশেষত্ব ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি সর্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়েছে।
ন্যামের বৃহদাকার, সদস্য দেশগুলোর বিভিন্নমুখী স্বার্থ এবং বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কারণে অনেক সময়ই সংস্থাটির মূল লক্ষ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সবার চাওয়া-পাওয়াকে সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। তার পরও সদস্যদের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের একগুঁয়েমির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকা ও সহযোগিতার মনোভাব টিকে আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানের পরিবর্তে মধ্য পন্থা অবলম্বন করেছে। স্বল্পোন্নত বিশ্বের বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘবে দ্রুত ও কার্যকর অবদান রাখতে উন্নত বিশ্বের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বায়নের কারণে বিশ্বে নতুন করে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তা ঘোচানোর জন্য দাবি জোরালো হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ন্যামের সদস্যরা মনে করে, অনুন্নয়ন, দারিদ্র্য এবং সামাজিক অবিচারই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। তাই এ তিনটি ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে আরও তৎপর হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
পর্যালোচনাঃ
ন্যাম যদি বিশ্ব-রাজনীতিতে গুরুত্বই হারাত, তাহলে মাত্র সাড়ে তিন দশকে তার সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা এত উন্নীত হতো না। ভারতের মতো বড় দেশ আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান অনেকটা ক্ষুণ্ন করার পরও এই সংস্থায় থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না। ওয়াশিংটন এখন বিশ্বের একক পরাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও এই সম্মেলনের দিকে বিরূপতা ও সংশয়ের দৃষ্টিতে তাকাত না। এ কথা সত্য, ন্যামের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শক্তি বৃদ্ধি পায়নি, বরং তা হ্রাস পেয়েছে। এটা পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির অনিবার্য ফল। দুটি সমান শক্তিশালী জোট থাকলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিয়ে মাঝখানে একটি নিরপেক্ষ জোট গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু একক পরাশক্তির যুগে এই নিরপেক্ষ আন্দোলনের অস্তিত্ব রক্ষা করাই দুরূহ। ন্যাম যে তার অস্তিত্ব এখনও রক্ষা করতে পেরেছে এবং সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে এটাই তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। দুই পরাশক্তির যুগে জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর যতটা প্রয়োজন ছিল, বর্তমান একক পরাশক্তি এবং তার আগ্রাসী ভূমিকার যুগে এই গোষ্ঠীর প্রয়োজন আরও বেশি। পুঁজিবাদ ও তার নয়া সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধনীতি এবং আগ্রাসনের মোকাবেলায় দুর্বল ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে আত্মরক্ষার কাজে নৈতিক শক্তি জোগাতে ও তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধিকে শঙ্কামুক্ত করতে পারে তাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও জোটবদ্ধতা। একা কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই আমেরিকার বিশ্বধ্বংসী মারণাস্ত্রের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আজ শক্তিমান আমেরিকার দাপটের সামনে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও সচেতন বিশ্বজনমতের কাছে সেই দাপট এখন পরাজয়ের মুখে। আর কিছু না হোক, বিশ্ব মানবতাকে রক্ষা, তার শান্তি ও সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করার জন্য ও বিশ্ব জনমতকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন রাখার কাজেও ন্যাম যদি ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাই হবে তার সবচেয়ে বড় অবদান।
উপসংহারঃ
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ন্যাম সম্মেলনে গিয়ে যতটা গুরুত্ব পেয়েছিলেন, ২০০৯ সালের ন্যাম সম্মেলনে গিয়ে শেখ হাসিনাও অনুরূপ গুরুত্ব পেয়েছেন। কারণ, শতাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা মিলে তাকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে ন্যামের ভাইস চেয়ারপারসন নির্বাচিত করেছেন। তার মধ্যে সাহসী নেতৃত্বগুণ রয়েছে বুঝতে পেরেই ন্যামের অন্যতম নেতৃপদে তাকে বসাতে তারা দ্বিধা করেননি। শেখ হাসিনার এই সম্মানে বাংলাদেশও সম্মানিত হলো- একথা বলা চলে। ন্যাম সম্মেলনে যোগদানের সুযোগে শেখ হাসিনা আরও দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পেরেছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে তার কাছ থেকে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পেরেছেন বলে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত গ্রহণ করবে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার বৈঠক হয়েছে মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী, ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট এবং একাধিক গালফ স্টেটের মন্ত্রীদের সঙ্গেও। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক গ্রহণ এবং সেসব দেশে শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা সুরাহার উদ্দেশ্যেও তিনি ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন।
বাঙালি জাতির চরম দুর্ভাগ্য, যে সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর মহান লক্ষ্য অর্জনের সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্যত হচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রের নির্মম শিকার হলেন তিনি। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুর চারজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান কেও জেলখানায় বন্দি অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হল।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৮
বিলুনী বলেছেন: ধন্যবাদ গুরুত্বপুর্ণ এ লিখাটির জন্য ।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছু রাজাকারের ধাপাধাপির যুগে এ ধরনের লিখার প্রয়োজন আছে ।