নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চেষ্টাই আছি........
পর্ব-২
---------
এমন তো তাদের জীবনে কতই হয়। কত মানুষ এর থেকেও খারাপ ভাবে বলে, গালি দেয়, যেন তারা খুব নিম্নকীট। তাদের ছোঁয়া লাগলেই শরীরে ঘা হবে, শরীর পঁচে যাবে। কী ভয়াবহ রোগ হয়ে জন্মেছে তারা। তাদের ছোয়া যায় না, তাদের সাথে রাখা যায় না, মুখের দুটো ভাল কথাও বলা যায় না। তবুও বিনাদোষে তারা সব অপবাদ, অপমান, লাঞ্চনা মেনে নিয়েছে। জন্মই যে তাদের অভিশাপ, তারা বুঝে গেছে। জন্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কীভাবে? কার কাছে বিচার দিবে এই অন্যায়ের? এই গঞ্জনা গুলোর প্রাপ্য কি সত্যিই তারা? জন্মের উপর তো তাদের হাত নেই। হাত থাকলে নিশ্চয় কোন ধনীর দুলালি অথবা রাজপুত্র হয়ে জন্ম নিতো। এমন নরক জন্ম কে চায়? জন্মদাতা-জন্মদাত্রীই যেখানে তাড়িয়ে দেয়। জন্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কীভাবে? যিনি সব কিছুর মালিক, যার হাতে জীবন-মৃত্যু, যিনি অপার শক্তির অধিকারী, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে কীভাবে? এমন স্বৈরাচারী রাজার শাসনে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কী'বা করার আছে? মৃত্যুর পরও যিনিই পালনকর্তা।
কিন্তু লোকটার কথার মধ্যে কী'জানি একটা ছিলো। যা তাচ্ছিল্য ছিলো না, আবার মিথ্যাও বলে মানতেও দ্বিধা হয়। কিন্তু সত্য তো বিন্দুমাত্র নেই, সেটাতো সত্যি। তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছু নয়। এমন তাচ্ছিল্য এ জীবনে বহু পেয়েছে, আর কত পেতে হবে কে জানে! কিন্তু লোকটার কথা ছায়াটা ভুলতে পারছে না। ওমন মায়া করা মুখটা কিছুতেই চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। ঐ মুখের কথা ভেবে ছায়াটা বারবার বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছে। লোকটার সেই তাচ্ছিল্য কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বারবার ভেতরে বেজেই চলেছে, টেপ রেকর্ডের মত। নিজেকে মুক্তি দিতেই ছায়াটা তাদের মাকে সব বললো, বেশ রসিয়ে চড়িয়ে বললো। ঘটনা তেমন কিছু না। এমন ঘটনা তাদের জীবনে বহু ঘটে, এটা ছায়াদের মাও জানে। কিন্তু ছায়ার মুখ থেকে শুনে বেশ অবাক হল। সামান্য কৌতুহল ও জাগলো, ছেলেটাকে দেখার। বললো- কাল আমাকে দেখিয়ে দিশ তো।
ছায়া বললো- তুমি যাবে?
: অবশ্যই যাব, কে তোর মনে দাগ ফেলেছে দেখতে হবে না! যার তার হাতে আমি মেয়েকে তুলে দিতে পারবো না।
ছায়া মিথ্যে অভিমানি স্বরে বললো- দাগ ফেলেছে তোমাকে কে বললো? তোমাকে বলাই ভুল হয়েছে। যাও।
আরেকটা ছায়া এসে শেষের কথা শুনে বললো- কী হয়েছে?
ছায়াদের মা, ছায়ার থুতনি টিপে ধরে বললো-মেয়ে প্রেমে পড়েছে।
দ্বিতীয় ছায়াটি অতিরিক্ত ঢং করে বললো- ওমা, তাই? ছেলেটা কেরে সখি?
ছায়াটা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো- যাও, তোমাদের খালি বেশী বেশী। বলেই সে বেড়িয়ে চলে গেল।
দ্বিতীয় ছায়াটা প্রায় চেঁচিয়ে বললো- পালিয়ে গেলি?
ছায়াদের মা হেসে বললো- লজ্জা পেয়েছে।
বলেই দুজনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসির দমক থামার পর দ্বিতীয় ছায়াটা বললো- তোমার এই মেয়েকে নিয়ে আমাদের অনেক দু:খ হবে, দেখি নিও।
ছায়াদের মাও উদাসী হয়ে গেল। ছায়াকে সে সত্যি নিজের মেয়ের মতই ভাবে। ভীষণ লাজুক, আর স্বভাব চোরা। বাকী সবার মত না। বাকী সবার মত হলে ভাবনা ছিলো না। চালিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু সে না থাকলে কীভাবে যে চলবে? সেটা ভেবে ছায়াদের মায়ের ভয় হয়।
পরদিন পৃথিবীর ঘূর্ণনের নিয়মে, দুপুর রোদ যখন খা খা করতে লাগলো, চারিদিকে যখন ঘামের দূর্গন্ধ, ছায়া, ছায়াদের মা সহ আরও কয়েকটি ছায়া হোটেলে এসে ভীর করলো। বেশ হইচই করছে। কে যেন ছায়াটাকে কী বলেছে। ছায়াদের মা তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে। একটা ছায়া, ছায়াটাকে বললো- আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে পারিস না! একা একা যাস কেন?
লোকটার কানে সেসব কিছুই ঢুকলো না। সেদিকে তাকালো না পর্যন্ত। সে এক পাশ দিয়ে হোটেলে ঢুকে টেবিলে গিয়ে বসলো। প্রতিদিনের কাস্টমার, তাই মেসিয়ার কে কিছুই বলতে হল না। সে ঠিক নিয়মে, ঠিক ঠিক খাবার এনে দিলো। প্রথমে এক বোতল ঠান্ডা পানি, তারপর ভাত, ভর্তা এবং ডালের বাটি। মেসিয়ারের হয়তো লোকটার জন্য মায়া আছে। ওর জন্য এক বোতল পানি ফ্রীজে রেখে দেয়। বাড়তি পাওনা এইটুকুই। অথচো ঠিকমত কথা হয় না। শুরুতে যদিও অর্ডার দেয়ার জন্য কথা হয়েছে। এখন আর বলতে হয় না। এসে বসলে অটোমেটিক খাবার সামনে চলে আসে। মাঝে মাঝে মাছ ভাজা বা মাংসের কয়েক টুকরা এনে দেয়। লোকটা মুখের দিকে তাকালে বলে- খান, দাম কম রাখমুনি। এজন্য অবশ্য তাকে মহাজনের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়। মহাজনও কিছু বলে না। জানে এ কৈফিত কেবল দেওয়ার জন্যই কৈফত। সত্যি কিছু নেই। তবুও কিছু বলে না। মুখে শুধু হালকা হাসি রাখে। হয়তো মহাজনের ও লোকটার জন্য হালকা মায়া আছে।
লোকটা খেতে শুরু করলো। ছায়াটা তাদের মাকে ডেকে লোকটাকে কে দেখিয়ে দিলো। ছায়াদের মা যখন লোকটার দিকে তাকালো, তখন লোকটা নিবিষ্ট মনে খাবারের সদ ব্যাবহার করছে। যেন ভীষণ ব্যাস্ত, কোথাও যাবার প্রচন্ড তারা আছে। যেন খাবার প্লেটে পড়ে থাকা সহ্য হচ্ছে না। পেটই যে তাদের আসল ঠিকানা তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। ছায়াদের মা এসে লোকটার টেবিলের সামনের চেয়ারে এক পা তুলে বসলো। সর্দারনিরা এভাবেই বসে। যেন কাউকে পরোয়া করে না। ক্ষমতা দেখাবার এটাই হয়তো সহজ কৌশল। বাকী ছায়ারা পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। ছায়াদের মা বললো- তুই কাল আমার মেয়েকে কী বলেছিস?
: কোন মেয়ে কে? কী বলেছি?
: তুই জাহান্নামে থাকিস? তোর নাম আযাযিল? শাস্তি ভোগ করছিস?
: হ্যা। লোকটার দৃঢ় উত্তর।
লোকটার কন্ঠ শুনে সরদারনিও এক মুহুর্তের জন্য টলে গেল। পর মুহুর্তে নিজেকে ঠিক করে নিলো। কন্ঠ ভাড়ি করে বললো- এসব উদ্ভট মিথ্যা কথা বলেছিস কী জন্য?
:মিথ্যা তো বলিনি। বলতে বলতে লোকটা খাবার থেকে মুখ তুললো। সামনে একজন ৫০/৫৫ বছর বয়সী হিজরা। তৃতীয় লিঙ্গ। মুখে অতিরিক্ত মেকাপের ছাপ, পরিপাটি- ঠোঁটে গাড় লিপিস্টিক, কপালে কালো টিপ। যেন ফালগুণের ভরা চাঁদের গায়ে একটা দাগ।
লোকটা সরদারনির চোখের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললো - আপনারা করছেন না? তারপর আবার নিচের দিকে মুখ নামিয়ে বললো- শুধু দুজনে দুই দোযখে আছি বলে দেখা হয়নি।
লোকটার কন্ঠ শুনে সরদারনি বেশ অবাক হল। লোকটাকে কে দেখে মনে হচ্ছে না যে, সে ফাজলামি করছে বা তাচ্ছিল্য করছে বা সে রকম পরিস্থিতিতে ও আছে। বরং সত্যি বলে মেনে নিতে ইচ্ছেকরে। সরদারনি মুখে ব্যাঙ্গের হাসি টেনে বললো- তাহলে তোর নাম আযাযিল।
লোকটা তেমনি দৃঢ় স্বরে বললো- হ্যা।
সরদারনি ছায়াকে টেনে এনে সামনে দাড় করিয়ে বললো- তবে এর সাথে পরিচয় হ, এর নাম লিলিথ। লোকটা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, এক নারী মুর্তি। অপূর্ব সুন্দর, দেখলে তৃপ্তিতে বুক হীম হয়ে যায়৷ কখনো হয়তো ঠোঁটে লিপিস্টিক দিয়েছিলো, সেটুকুও ঠোঁটের সাথে প্রায় মিশে গেছে। আর কোন মেকাপের চিহ্ন নেই। আশ্চর্য, গতকাল এই ছিলো? লোকটা তাকিয়েও দেখেনি। কন্ঠটা এখনো কানে লেগে আছে, কী মিহি আকুলতায় বলেছিলো- সত্যি করে বলো না। এই মেয়ে হিজরাদের সাথে কী করছে! লোকটা বললো- খুব সুন্দর নাম৷ বলেই মুখ নামিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
লোকটার চোখে কী একটা ছিলো। লিলিথ ঠিক বুঝতে পারেনি। কঠিন সে চোখের ভাষা। লিলিথ আর একটা হিজরার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছিলো। এখন লোকটার মুখ নামানোতে আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো।
সরদারনি বলল- তুই এমন সুদা ভাত খাচ্ছিস কেন?
লোকটা নির্বিগ্নে বললো- সুদা ভাত কই, ভর্তা আছে, ডাল আছে। "জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনো ক্ষুধার লাগি, জোটে যদি দুটো পুয়সা ফুল কিনো হে অনুরাগী। " আমার কাছে একটিই পয়সা আছে, ফুল কিনে ডালা সাজাবার বিলাসিতা নেই।
সরদারনি হেসে মেসিয়ার কে ডেকে বললো- এই এখানে মাংস দে।
লোকটা নির্লিপ্ত ভাবে বললো- তাহলে আর এক প্লেট ভাতের ও অর্ডার করে দিন। আজ তবে পেটের পূজা হোক।
সরদারনি তার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো- এই চল তো, এখানে থাকলে এই রাক্ষসটা আমাকে ফকির করে দিবে। আমরাই খাই ভিক্ষা করে, আর একজন আসছে আমাদের থেকে ভিক্ষা করতে।
লোকটা: ভিক্ষা তো চাইনি। আপনি খাওয়াতে চেয়েছেন তাই বলছি। যদি ভিক্ষাই হয় তাহলে মাংসের অর্ডারটাও ক্যান্সেল করে যান৷ মেসিয়ারের দিকে তাকিয়ে বললো- দরকার নেই।
লোকটার কন্ঠ শুনে মেসিয়ার বাটি হাতে ফেরত গেল। সরদারনিও অবাক হল, পর মুহুর্তে মুখ ঝামটা দিয়ে বললো- দেমাগ দেখো।
তারপর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো - এই চল তো, চল।
লিলিথের কী যে হয়েছিলো! নড়তে পারছিলো না। মুর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলো। সরদারনির কথা ঠিক ওর কানে গেল কিনা বুঝা গেল না। সে দাঁড়িয়েই রইলো। একটা হিজরা তাকে হাত ধরে টান দিয়ে বললো- চল সখি।
টানে লিলিথ ফিরে এলো। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো। কোন অজানা এক দূর দেশে। যেখানকার কিছুই সে চেনে না, জানে না। কেবল অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে। যেন এই দেখবার জন্য সে এতকাল অপেক্ষা করেছিলো৷ যেন এই সে, যাকে সে যুগ যুগ ধরে চিনে। কোথায় যেন তারা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো। জায়গাটা ঠিক চিনতে পারছে না লিলিথ। যেতে যেতে বারবার পিছনে ফিরে আযাযিল কে দেখতে লাগলো। যেন আর একবার দেখলেই সব মনে পড়ে যাবে। চোখ ফেরালেই যেন সব কিছু হারিয়ে যায়, অস্পষ্ট। বারবার লিলিথ ফিরে ফিরে দেখতে থাকে।
আযাযিল অবশ্য আর একবারও তাকায়নি। সেই যে মেসিয়ার কে মাংসের বাটি হাতে ফেরত পাঠালো আর মুখ তুলেনি।
২| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৫০
রাজীব নুর বলেছেন: একটি নিষিদ্ধ প্রেমের মানবিক গল্প।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৪২
রানার ব্লগ বলেছেন: ষিদ্ধ প্রেম কি আছে ?