নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের গতি প্রকৃতি

রাজনীতির ইনসাইড অফসাইড

পীর হাবিরূর রহমান

রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নির্বাহি সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

পীর হাবিরূর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না

১২ ই মে, ২০১২ বিকাল ৫:২৮





দলীয় সরকারের অধীনেই সামনের জাতীয় নির্বাচন হবে, নিউইয়র্কে বসে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের তিন দিনের মাথায় নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারের পদত্যাগ ও অবিলম্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তিন বিভাগে রোডমার্চ ও জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে পাল্টা জবাব দিয়েছেন। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি না দিলেও এই রোডমার্চ কর্মসূচি ঘিরে সরকারি ভূমিকা কি হবে তার ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের রাজনীতির পরিণতি। অনেকে বলছেন, রাজনীতি সামনে সংঘাতের পথে হাঁটতে যাচ্ছে। বিশেষ করে সরকারের দমননীতির নমুনা ও জামায়াত-শিবির খালেদা জিয়ার ওপর ভর করায় এই আশঙ্কা বেড়েছে। শাসকমহল এতদিন বিএনপির আন্দোলনকে জিয়া পরিবারের পারিবারিক ইস্যু বলে কটাক্ষ করে এলেও এই কর্মসূচি ঘোষণাকালে খালেদা জিয়ার এক ঘণ্টা ১০ মিনিটের ভাষণে কোথাও তার নিজের বা পুত্রদের বিষয় উঠে আসেনি। উঠে এসেছে রাজনৈতিক ইস্যু।



খালেদা জিয়ার ভাষণের পরদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একে সরকারবিরোধী মিথ্যাচার বলে যেমন সমালোচনা করেছেন তেমনি খালেদা জিয়ার 'এরশাদকে নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না'_ বক্তব্যের কড়া জবাবে বলে দিয়েছেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।' এদিকে বৃহস্পতিবার ক্ষমতার রাজনীতির কোনো এক ভিখারির যোগদান অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া আবার বলেছেন, 'তার ঘোষিত কর্মসূচি রোডমার্চের পর ফাইনাল রাউন্ডে সেপ্টেম্বরের আগেই সরকারকে বিদায় করা হবে।' এর আগেরদিন রাতে গুলশান কার্যালয়ে নেতাদের বলেছেন, সরকার বিএনপি ভাঙতে চায়। অন্যদিকে খালেদা জিয়া যখন ফাইনাল রাউন্ডের হুমকি দিচ্ছেন তখন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের তার শান্তির মডেল নিয়ে বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে বলেছেন, 'ক্ষমতা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে নয়, সেনা ছাউনিতেও থাকবে না_ সেই চিন্তা থেকেই তিনি এ প্রস্তাব দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় মার্শাল ল', সেমি মার্শাল ল', ব্যাক মার্শাল ল' দিয়ে জনগণের ক্ষমতা নিয়ে ছিনিমিনি করা হয়েছে। জনগণের কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি।'



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো ক্লান্তির বিশ্রাম শেষে বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণের প্রতিটি শব্দ শুনবেন, বিচার বিশ্লেষণ করে তার জবাব দেবেন। এতে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি মানুষের কাছে আরও উন্মোচিত হবে। পর্যবেক্ষকরাও তখন তাদের মতামত তুলে ধরবেন। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ওয়ান-ইলেভেন-উত্তর শেখ হাসিনার শাসনকালের দিকে তাকালে সরকারের বড় অর্জনের মধ্যে পাওয়া যায়_ বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা এবং সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জনের পথ হেঁটে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারত ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন অন্যতম। এর মধ্যে শেখ হাসিনা পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনকের হত্যার বিচার একেবারে সাধারণ আইনে করলেও '৭৫-উত্তর প্রতিটি সরকার যে এদের রক্ষা করেছে, সমাদর করেছে তা অপ্রিয় হলেও সত্য। কিন্তু সরকারের ৩৪ মাসে বড় বিতর্কের ইস্যু হচ্ছে শেয়ার কেলেঙ্কারি করেও নায়করা পারই পাননি, রীতিমত ইমামতিও করাচ্ছেন। ৩২ লাখ বিনিয়োগকারির বুকভরা কান্না থামাতে সরকার ব্যর্থ হলেও প্রভাবশালী মন্ত্রী ফটকাবাজ বলে গালি দিচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াত জমানার স্টাইলে বিরোধী দল দমনের পথ গ্রহণের চিত্র গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের নমুনা। বিরোধী দলের চিফ হুইপকে নির্যাতনের পর সরকার বিরোধী কর্মীর বুকে পুলিশের বুটের ছবি গণতন্ত্রের কান্না হলেও শাসক দলের নেতা যখন বলেন, এমন একটিমাত্র দৃশ্য সরকারের অর্জন ম্লান করে না তখন শয়তানও গণতন্ত্রের নমুনা দেখে দূর থেকে হাসে।



দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতির অবনতি, সড়ক দুর্ঘটনায় লাশের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে অদক্ষ চালকদের পক্ষে নৌপরিবহনমন্ত্রীর খলনায়কোচিত চেহারার বেফাঁস মন্তব্য মানুষকেই নয়, শাসকদলের বিবেকবান কর্মীদের অন্তরকেও কাঁদিয়েছে। প্রশ্ন এসেছে, তিনি মন্ত্রী নাকি পরিবহন সেক্টরের নেতা? মিডিয়ার আক্রমণের মুখে কিংবা তুমুল সমালোচনার মুখেও ভদ্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে হাসিমুখে জবাব দান যোগাযোগমন্ত্রীর বড় গুণ। সৌম্য-সুন্দর এই মন্ত্রীর দিকে আকাশের কোনো 'পরী'র নজর পড়েছিল কিনা জানা নেই। তবে তিনি শুনিয়েছিলেন, পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু, পাতাল রেলসহ নানা পরিকল্পনার কথা। সমালোচকরা বলছেন, ৩৩ মাসের মাথায় এসে তার পরিকল্পনার 'পরী' উড়ে গেছে। কল্পনা পড়ে আছে মাটিতে। তবুও তিনি পদ্মা ও উড়াল সেতুসহ প্রতিশ্রুতি পালনের অঙ্গীকার থেকে না সরে দেশের বেহাল রাস্তাঘাটের চেহারা বদলাতে এখন হামেশা ছুটছেন চারদিকে। এমনকি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তিনি টিআইবি ও দুদককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সাহসের সঙ্গে। দন্তহীন বাঘের মতো দুদক ও টিআইবি'র দিকে আমরা তাকিয়ে থাকতে পারি, কী প্রমাণ আসে তা দেখার জন্য। মানুষ পূর্ণ সত্য জানতে চায়। তবে মানুষ এখন যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে বড় বড় স্বপ্নের চেয়ে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও যানজট সংকটের কবল থেকে মুক্তি চায়। সরকার নিয়মিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করতে পারলেও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি এমনকি শিক্ষামন্ত্রী সাফসুতরো থাকলেও মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির সিন্ডিকেট বলয় ভাঙতে পারেননি। ভূমিমন্ত্রী, তার পুত্র ও এপিএস নিয়ে বাজার শুরু থেকেই রমরমা। তথ্যমন্ত্রীর কথা শোনা গেলেও বোঝা যায় না। মন্ত্রণালয়ের বাইরে ঢাকা ক্লাব ছাড়া কোথাও নাকি পাওয়া যায় না! ক্লাবের ভেতরে এত দীর্ঘ সময় তিনি কি মন্ত্রণালয়ের ফাইল দেখেন? এমন প্রশ্ন রশিকজনরাও করেন। তবে এই সত্য সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে যে, দেশের অতীতের বেশিরভাগ তথ্যমন্ত্রীদের মতো তাকে নিয়েও মুখরোচক কথাবার্তা হয়। সরকারের অনেক মন্ত্রীর এপিএসদের দুর্নীতির রমরমা খবর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে। অতীতে অনেক মন্ত্রীরা যা পারেননি, তা এবার অনেক এপিএসরা করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারলে তিনি কাউকে রেহাই দেবেন না। পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ডাকাতরা একে একে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। ডাকাতির মালামালসহ কে কখন ধরা পড়বে তা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কৃষিতে সাফল্য আসলেও তা প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দৃষ্টি থাকার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তবে কৃষিমন্ত্রী আর্থিকভাবে সৎ হলেও প্রধানমন্ত্রীর সামনে সত্য বলতে সাহস পান না এমন খবর ঘরে-বাইরে। এমনকি কারও কারও সর্বনাশে তিনি এগিয়ে! ন্যাপনেত্রী নাকি দলের কমিউনিস্ট মন্ত্রীদেরও সমালোচনা করেন! দলীয়করণ থেকেও এ সরকার বের হতে পারেনি। শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিরাও এলাকায় এলাকায় দুর্নীতির ডালপালা ছড়িয়ে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন খবরও এখন সর্বত্র। শাসকদলের প্রভাবশালীরাও বলছেন, শতাধিক এমপি'র আবার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া আশার গুড়ে বালি মাত্র।



প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সর্বক্ষণ তৎপর। তারা জানছেন এবং জানাচ্ছেন। কি সরকার, কি দল কোথাও পরিবর্তনের আভাস নেই! খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় নির্বাচনে অযোগ্য হন বা নাই হন, নির্বাচনে আসুন আর নাই আসুন, মওদুদ-নাজমুল হুদারা বিশাল বহর নিয়ে বিএনপি'র সাইনবোর্ডে নির্বাচনে অংশ নেবেন এমন স্বপ্নে বিভোর শাসকদলের অর্বাচীনরা কত কথাই বলছেন যা আওয়ামী লীগ কর্মীরাই বিশ্বাস করেন না। হাসিনা-খালেদা ছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি'র অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে এই হিসাবতো ওয়ান-ইলেভেনেই শেষ হয়ে গেছে। এমন এক সংবিধান সংশোধন হয়েছে যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন নয়, নির্বাচনকালীন সময়ে সংসদ অর্থাৎ সংসদ সদস্যরাও বহাল তবিয়তে থাকবেন! এই সংশোধনী নিয়ে যেমন আওয়ামী লীগের অনেকে খুশি নন, তেমনি মহাজোটের অন্যতম শরিক ১৪ দলও নাখোশ। দেনা-পাওনার হিসেবে সাবেক সেনাশাসক এরশাদের দল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলেও উপেক্ষিত। পেয়েছে অনাদর অবহেলা। এরশাদের ভাইকে নিধিরাম সরদারের মতো মন্ত্রী করে রাখলেও দুতিয়াল বলে পরিচিত ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়া উদ্দিন বাবলুকেও মন্ত্রী করা হয়নি। এরশাদকে দেওয়া হয়নি সম্মানজনক পদবি। হয়ত অস্থির চিত্তের এরশাদ শিকল পায়ে নীরবে নিভৃতে অভিমানি সুরে গুনগুন করে গাইছেন_ 'আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না।' কিন্তু বাতিল ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এরশাদকে ছয়মাসের রাষ্ট্রপতি করার লিখিত চুক্তি করেছিল আওয়ামী লীগ। এরশাদ কেন! এ গান চাঁদ কপালি দিলীপ বড়ুয়াকে দেখে রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গাইছেন না তার নিশ্চয়তাই বা দেবে কে? হয়তো যারা বিপুল প্রত্যাশায় নৌকায় ভোট দিয়েছেন, সেসব সাধারণ ভোটাররাও গাইছেন। আন্তর্জাতিক নীলনকশার ওয়ান-ইলেভেন মানুষকে বোকা ও বিভ্রান্ত করে অনেকের সর্বনাশই করেনি, জাতীয় ঐক্যের পথে দলে দলে ঘরে ঘরে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়ে গেছে। মাঝখানে ব্যক্তি এরশাদই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, দেশটাও আমাদের পিছিয়ে গেছে। এই বিপর্যয়ে পতিত বিএনপিকে নিয়ে জনগণের হৃদয়ে ঠাঁই না পাওয়া বিলুপ্ত ন্যাপত্যাগী মতিয়া আজ আওয়ামী লীগের নেত্রী ও মন্ত্রী হয়ে বলছেন, বিএনপি নাকি জোড়াতালির পার্টি! বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি হলেও বিএনপি'র ভোটের অংক শাসকরা বেমালুম ভুলে গেছে। অন্যদিকে ৩৩ মাসে বিএনপি দলীয় কোন্দল, মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত থাকলেও কতটা এগিয়েছে তা চোখে দেখছেন না। এমনকি শাসকদল আয়নায় তাকিয়ে নিজেদের চেহারা দেখার সময়ও পাচ্ছেন না। দলীয় কাউন্সিলের আড়াই বছরের মাথায় কোথাও হয়নি জেলা সম্মেলন, কোথায় নেই জনসভা, পল্টনে নেই মহাসমাবেশ, দলীয় কার্যালয় কর্মীশূন্য! ক্ষমতার মোহে একেকজন ফ্রি স্টাইলে কথা বলছেন অথচ দেখছেন না রক্তশূন্য আওয়ামী লীগের চেহারা। ৩৩ মাসে কতটা জনবিচ্ছিন্ন আর কতটা কোন্দলেই বা জর্জরিত? উপজেলা চেয়ারম্যানরা অপমানের যন্ত্রণা সয়ে কি বলছেন তাও জানছেন না। দলের নিবেদিতপ্রাণ মজিব সন্তানরা উপেক্ষিত, সুবিধাবাদী আর মোসাহেবরা তদবির বাণিজ্যে কামিয়ে নিচ্ছে। সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা কতটা তা বোঝা যায় যখন মিডিয়ার ওপর স্বৈরশাসকের মতো কালো সেন্সরশিপ চাপিয়ে দিতে চায়।



এখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, হ্যাঁ, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন। বিরোধীদলীয় নেতা বলছেন, না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন। এখানে দু'পক্ষ অনড় হয়ে সামনে শক্তির লড়াইয়ে মুখোমুখি হওয়ার পথে হাঁটছেন। খালেদা জিয়ার বিএনপিকে শেষ করে দেওয়ার হিসাবের অংক এরশাদ জমানায়ই শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে শাসকদল হিসাব করলে অংকের ফলাফল ভুল হবে_ এমনটি বলছেন পর্যবেক্ষকরা। প্রধানমন্ত্রী সংলাপের সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছেন। এতে দু'পক্ষের আপসহীন রাজনীতির ফর্মূলা নিয়ে গন্তব্যে পেঁৗছতে গেলে সংঘাতের পরিণতি কি হতে পারে তার গুজব-গুঞ্জন চায়ের টেবিলে জমে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর 'হ্যাঁ' জয়যুক্ত হবে নাকি বিরোধীদলীয় নেতার 'না' জয়যুক্ত হবে অথবা কেউ মধ্যস্থতা করে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফর্মূলা দিয়ে সংবিধানে আরেকটি সংশোধনী এনে দেবেন তা দেখার জন্য আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ দেশের মানুষ বার বার গণতন্ত্রের জন্য কান্নাকাটিই করেনি, নেতা-নেত্রীদের ডাকে বার বার রাজপথে নেমেছে, অকাতরে জীবন দিয়েছে। বহু রক্তে অর্জিত গণতন্ত্র মানুষ কতটা পেয়েছে তা প্রতিটি সরকারের চিত্র স্মরণ করলেই জানা যায়। জিয়া-এরশাদ যুগ ছিল সেনাশাসনের যুগ। শ্বৈরতন্ত্রের যুগ। কিন্তু '৯১-এর খালেদা থেকে আজকের শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের যুগ। '৯১ ও '৯৬ গণতন্ত্রের প্রশ্নে যতটা প্রশংসিত ছিল ততটা কি ২০০১ ও ২০০৮- উত্তর শাসনামলে হয়েছে বা হচ্ছে? যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, রগকাটা শিবির সন্ত্রাসীদের ছাড় দেওয়া যায় না, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলাদের ছাড় দেওয়া যায় না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পুলিশ প্রশাসনকে তদন্তে প্রভাবমুক্ত রেখে ন্যায় বিচারের স্বচ্ছতা হওয়া জরুরি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যদি স্বচ্ছ হয়ে থাকে বিএনপি নেতা-নেত্রীসহ যে কারও বিচারও হওয়া উচিত স্বচ্ছ। ন্যায়বিচার লাভ গণতান্ত্রিক সমাজের বড় অর্জন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আদালতে হাজিরার সময় পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় দেখিনি! অথচ তারা ছিল দুর্ধর্ষ খুনি। রাজনৈতিকভাবে আদর্শহীন। জামায়াতের আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে জামায়াত যখন কোনো নিষিদ্ধ দল নয়, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল তখন সে দলের প্রবীণ নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা কি সমর্থনযোগ্য?



প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেলকে সমর্থন জানাই, তার উদ্যোগ ও এ লড়াইকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু তার শাসনামলে দেশের মধ্যে যখন পুলিশ বিরোধী দলের চিফ হুইপকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে, পুলিশ বিরোধী দলের কর্মীর বুকে বুট নিয়ে দাঁড়ায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারীর ওপর পুলিশি কায়দায় বুকে পা দিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী দাঁড়ায় তখন শাসক দলের কাছে জানতে ইচ্ছা করে এই ছবি বা চিত্র গণতান্ত্রিক দুনিয়া দেখার পর কি বলবে এ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। '৭১-এর কারণে পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাদের কাছে নিন্দিত এক খলনায়ক। কিন্তু তার দেশের মানুষের কাছে তিনি এক নন্দিত রাজনীতিবিদ। উচ্চ শিক্ষিত কূটনৈতিক মেধাসম্পন্ন এই চৌকস রাজনীতিবিদ পাকিস্তানের সিভিলিয়ান সিএমএলএ ছিলেন। সংবিধান সংশোধন করে সেনাশাসনকারীর জন্য ফাঁসির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তার শাসনকাল ছিল সমালোচনায় ক্ষত-বিক্ষত। স্বৈরশাসকের মূর্তি নিয়ে দেশ শাসন করে তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন। সেনাশাসক জিয়াউল হক এসে তাকে ফাঁসিতে চড়িয়েছিলেন। পাকিস্তান এখনো গণতন্ত্রের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়া দূরে থাক, আইএসআই'র ছায়ায় বেড়ে ওঠা জঙ্গিবাদের আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত এক রাষ্ট্র। আমরা শুধু গণতন্ত্রই নয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জ্বল। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ কোটি কোটি হাত। জঙ্গিবাদ উৎখাতে রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি পায়ে পায়ে হাঁটছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, উগ্রতা, হঠকারিতা, সহিংসতা ও রক্তপাতের পথে দুই দুই বার জিয়া-এরশাদের সেনাশাসন জনপ্রিয় হয়েছিল। বিএনপির দাম্ভিকতা, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার উন্মত্ত নেশা, একগুয়েমি আর সেদিন মহাজোটের প্রতিরোধে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার পথে সরলপ্রাণ জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল। কিন্তু এ কথা ঠিক দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে '৯০ ও ২০০৮ সালে ভূমিকা রাখায় রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসে এবং দেশ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে। তাই সংবিধান সংশোধনের চেয়েও ওয়ান-ইলেভেনের অগি্নপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াই এখনো এদেশের গণতন্ত্রের শেষ কথা। তাদের সমঝোতা, জাতীয় ইস্যুতে ঐক্য কেবল সংঘাত ও অনিশ্চয়তার পথকে রুদ্ধ করতে পারে। জাতীয় নির্বাচনকে সফল করে দেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে পারে। সংসদকে কার্যকর করে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়িয়ে প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত রেখে দুই নেত্রী একটি গ্রহণযোগ্য সংশোধিত সংবিধান জনগণকে উপহার দিতে না পারলে পরিণতি কতটা সুখকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন দূর করার দায়ও তাদের।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.