![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সম্প্রতি লেখক শহরের কোলাহল ছেড়ে যতটুকু পারা যায় গ্রাম আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চান। বিকেলে মাঠে ঘুড়ি উড়িয়ে শৈশবে ফিরে যাওয়া, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁপোকার দল বুকে নিয়ে এক টুকরো নীরবতা খুঁজে পাওয়া — এ যেন তার নতুন জীবনের ছোট ছোট জয়। আজকের দুনিয়ার অস্থিরতা আর যুদ্ধের গন্ধের ভেতরেও তিনি স্বপ্ন দেখেন গ্রামের শান্ত আকাশ আর মাটির ঘ্রাণে ভিজে থাকার। শহরের ব্যস্ত দালান থেকে পালিয়ে মাটির কাছে ফেরার এ চেষ্টাই তার সবচেয়ে বড় আরাধ্য।
জাতীয়তাবাদের মূল উৎস মানবজাতির স্বাভাবিক গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা ও সংঘবদ্ধ হবার প্রবণতা। বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক ধরনের আত্মরক্ষামূলক কৌশল—গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে টিকে থাকার সংগ্রাম। রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদ এমন একটি আদর্শ যা জাতিকে সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে, যেখানে অন্যান্য নৈতিক, ধর্মীয় বা আন্তর্জাতিক চিন্তাধারা পেছনে পড়ে যায়।
স্বদেশপ্রেমও এই জাতীয়তাবাদের একটি প্রকাশ—যেখানে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক পরিচয়কে ঘিরে আত্মপরিচয়ের এক কেন্দ্রবিন্দু গড়ে ওঠে। এটি একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে, অন্যদিকে অন্ধ ও সংকীর্ণ স্বজাতিগর্বের জন্ম দেয়। এর ফলে জাতিগত বৈষম্য, উগ্রতা এবং গোঁড়ামির মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়, যা বিশ্ব মানবিকতা, সহমর্মিতা ও শান্তির আদর্শকে হুমকির মুখে ফেলে।
বিশ্বের বহু জাতি ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে—ভারত, ভিয়েতনাম বা আমাদের বাংলাদেশই তার উদাহরণ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ছিল মুক্তির এক মহান প্রেরণা। তবে সেই সংকট পেরিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হয়, তখন একই জাতীয়তাবাদ যদি অন্য জাতি, গোষ্ঠী বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা তৈরি করে—তবে তা আর আদর্শ থাকে না, বরং বিভাজনের অস্ত্রে পরিণত হয়।
আজকের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই, কিভাবে পুঁজিবাদী শ্রেণি ও বাণিজ্যিক মিডিয়া জাতীয়তাবাদকে পণ্য করে তুলেছে। ক্রিকেট কিংবা বিনোদনের অঙ্গনে জাতীয়তাবাদ এখন এক ধরনের বিপণন কৌশল। যেখানে খেলাকে খেলার জায়গায় না রেখে সেটাকে উগ্র দেশপ্রেমের প্রতীক বানিয়ে তাতে বাম্পার বিজ্ঞাপন লাগিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে। এই মিথ্যা উন্মাদনা দিনে দিনে জাতিগত ঘৃণা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়িয়ে তুলছে।
তবু, একটি সত্য অস্বীকার করা যায় না—রাষ্ট্রহীন পৃথিবী এখনো একটি অলীক কল্পনা। তবে সেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেও যদি আমরা সীমান্তের দেয়ালকে মননে ও মানসপটে ঝাপসা করে ফেলি, যদি আমরা সবাইকে শুধুই "আমার দেশের লোক" না ভেবে "আমার পৃথিবীর মানুষ" ভাবতে পারি—তবে জাতিগত বিভাজনের চেয়ে মানবিক ঐক্য অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
ভিয়েতনামের সংবিধান একটি বড় উদাহরণ—তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করলেও, আজ তাদের সংবিধানে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটির উপর জোর দেওয়া হয়নি; বরং দেশব্যাপী বহুজাতিক সম্প্রদায়ের স্বকীয়তাকে মর্যাদা দেওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং, আমাদের উচিত একদিকে যেমন স্বদেশপ্রেমের প্রকৃত মানবিক দিকগুলো রক্ষা করা, তেমনি জাতি বা ভূখণ্ডের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিজেকে বিশ্বমানব ভাবার অভ্যাস গড়ে তোলা। স্বদেশপ্রেম যেন অন্য জাতি বা গোষ্ঠীকে হেয় করার মাধ্যমে গর্ব নয়—বরং নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে অন্যের সংস্কৃতিকে সম্মান করার এক নৈতিক ভিত্তি হয়ে ওঠে।
একটি পরিণত ও দায়িত্বশীল সমাজের মানুষ হিসেবে আমাদের দরকার ঐক্যের রাজনীতি, বৈচিত্র্যের মধ্যে সম্প্রীতি এবং সর্বোপরি এমন একটি মননশীলতা, যা ‘জাতি’ নয়, ‘মানবতা’কে সভ্যতার শ্রেষ্ঠ পরিচয় মনে করে।
©somewhere in net ltd.