নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জ্ঞান হবার পর থেকে নিজের পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করি—আমি কে? আমি কী? কোথা থেকে এসেছি? কিছুই জানি না। কখনো নিজেকে শূন্য মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, এই জগৎ সংসার কেমন করে শূন্য থেকে শূন্যে মিলিয়ে যায়।

সাফায়েতুল ইসলাম

সম্প্রতি লেখক শহরের কোলাহল ছেড়ে যতটুকু পারা যায় গ্রাম আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চান। বিকেলে মাঠে ঘুড়ি উড়িয়ে শৈশবে ফিরে যাওয়া, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁপোকার দল বুকে নিয়ে এক টুকরো নীরবতা খুঁজে পাওয়া — এ যেন তার নতুন জীবনের ছোট ছোট জয়। আজকের দুনিয়ার অস্থিরতা আর যুদ্ধের গন্ধের ভেতরেও তিনি স্বপ্ন দেখেন গ্রামের শান্ত আকাশ আর মাটির ঘ্রাণে ভিজে থাকার। শহরের ব্যস্ত দালান থেকে পালিয়ে মাটির কাছে ফেরার এ চেষ্টাই তার সবচেয়ে বড় আরাধ্য।

সাফায়েতুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

৫ই আগস্ট আমার দেশ বিজয়ের ইতিহাস

০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:০২

১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার বিকেল।
অন্য দিনের তুলনায় শুক্রবার আমার জীবনে এক ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। সপ্তাহের এই দিনটি এলেই আমার মনে একধরনের অজানা আতঙ্ক নেমে আসে। কারণ, বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বলে —প্রতি শুক্রবার কিছু না কিছু অদ্ভুত, দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যা আমাকে তাড়িত করে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।

আমার বাসার সামনের রাস্তা জুড়ে ছিল মানুষের ঢল। শিশু, বৃদ্ধ, তরুণ, ছাত্রছাত্রী—প্রতিটি শ্রেণির মানুষ যেন আজ রাজপথে নেমে এসেছে। কারণ একটাই: আওয়ামী সন্ত্রাসীদের লাগাতার হামলা, হত্যা আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। কেউ প্রতিবাদ করছে, কেউ কাঁদছে, কেউ শুধু দাঁড়িয়ে দেখছে—কিন্তু ভয় সবার চোখে স্পষ্ট।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে ভয়ংকর এক দমননীতি চালু আছে। প্রতিবাদ করলেই গুলি, প্রশ্ন তুললেই গুম, এবং কণ্ঠস্বর উঁচু করলেই খুন। শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্র আজ গণতন্ত্রের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তার শাসনব্যবস্থা চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তার অধীনে মানুষ অতিষ্ঠ, ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ। সবার এখন এক দফা এক দাবি: হাসিনার পতন চাই। স্বৈরতন্ত্রের অবসান চাই। আমার নিজস্ব অবস্থা আরও শ্বাসরুদ্ধকর।

বাসায় থাকতে আর মন চায় না। ইলেকট্রিক মিটারে টাকা নেই —লাল আলো জ্বলে নিভছে, কারেন্ট যেকোনো সময় চলে যাবে। কিন্তু বাইরের দৃশ্য যেন বিদ্যুতের অভাবেও চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছুঁড়ে ছুঁড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছে পুলিশ। এই দৃশ্য এতটাই বাস্তব যে মনে হচ্ছিল, আমি যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে বসে আছি। গুলশান, রামপুরা, বাড্ডা থানা ঘিরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হায়েনাসদৃশ আচরণে যেন অন্ধকার ছেয়ে গেছে। তারা যেন মানবতার সর্বশেষ আলোটুকু নিভিয়ে ফেলতে চায়।

আমার ভাই, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন —কেউ নিরাপদ নয়। কেউ অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত, কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বিচারহীনতা, আর প্রশাসনের বেপরোয়া দম্ভ আমাদের প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে। মন্ত্রীদের বেফাঁস মন্তব্যগুলো যেন বিদ্রুপের মতো আঘাত হানে এই বিপর্যস্ত জাতির বুকে। প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছেন। ইন্টারনেট নেই, মোবাইল ডেটা অচল। কারো সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না, কোনো অফিসিয়াল ইমেইল পাঠানো যাচ্ছে না। আমার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট রেসপন্সের অপেক্ষায় ছিল —আর এখন এই পরিস্থিতিতে আর্থিকভাবে বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়ছি। সবকিছু গুমোট লাগছে। দমবন্ধ অনুভব করছি।

হুট করেই রাস্তায় নেমে গেলাম। আর কিছু বুঝতে চাইলাম না —শুধু প্রতিবাদের মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে দিলাম। ন্যায্য অধিকারের দাবিতে, জীবনের সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়ালাম রাজপথে। পুলিশের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম — অবচেতনে এক মুহূর্তের জন্যও গুলি খাওয়ার ভয় কাজ করছিল না। যেন আমি অন্য কেউ। এত দুঃসাহস কোথা থেকে এলো? মনে হচ্ছিল আমি আবু সাঈদের মতো কেউ —যার বুকে স্বাধীনতার ঝড় বইছে। আমি কুণ্ঠিত নই, বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পেছনে হঠাৎ দুটো টিয়ার শেল পড়লো। চোখ জ্বালাপোড়া শুরু করলো, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেলো সবকিছু। আমি যেন পথ হারিয়ে ফেললাম। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখতে পেলাম —একটি অচেনা দল আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কেউ ছাত্র নয়, কেউ সাধারণ পথচারী নয়, বরং তারা ছিল সেই চিহ্নিত দল যারা পুলিশের ছত্রছায়ায় নৈরাজ্য চালাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন খাটো গড়নের ছেলে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো —
ধর ধর!
আমি প্রাণপণ চিৎকার করে বললাম, “ভাই, আমি সাধারণ মানুষ! আমি আন্দোলনকারী না!”
কিন্তু তারা কিছু শুনল না। তারা এমন আচরণ করতে লাগলো, যেন আমি কোনো সংগঠিত ছাত্রদলের সদস্য —তাদের ভাষায় “শত্রু”।
আমি বুঝলাম, আমি ফেঁসে গেছি। ছাত্রলীগের একদল ছেলে আমাকে ঘিরে মারধর শুরু করলো। আর আমার দিকে পাল্টা ধাওয়া দিয়ে এগিয়ে এলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু সদস্য, যারা আমাকে বাঁচাতে চাইলেন।

তারা আমাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন। এই পুরো ঘটনা যেন স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের এক মিশ্র জগত —ঘোরের মধ্যে আমি বুঝতে পারছিলাম, কেউ আমাকে টার্গেট করেছিল। তারা মারধরের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াতে চেয়েছিল —আমাকে শেষ করে দেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। মানুষের ভীড় ঠেলে ছুটে চলেছিলাম। কিন্তু বারবার ছিটকে পড়েছি রাস্তায়। তারা আমার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে। চারপাশে মানুষ জড় হচ্ছিল, কেউ বুঝতেই পারছিল না—কাকে কেন মারা হচ্ছে।আসলে যারা দাঙ্গা করছিল, তারা ইতিমধ্যেই নিজেরা নিরাপদে সরে পড়েছে। আমার সমস্ত কিছু হাইজ্যাক করে পালিয়ে গেছে। তখনই আমি নিশ্চিত হই —এরা সরকারপন্থী ছাত্রলীগ

আমার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল, পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে রক্তাক্ত করে তুলেছিল। মনে হচ্ছিল আমি আর বাঁচবো না। জনতা অবশেষে ধীরে ধীরে হুঁশে এলো। তারা নিজেরাই জানতে চাইল —
“আমাকে কেন মারা হচ্ছে?”
কারও মুখে উত্তর ছিল না। দলের একজন লিডার আমার গলা চেপে ধরলো, চোখে আগুন —
"তোরে কে পাঠাইছে? তুই এখানে কেন? তুই কি ছাত্রলীগ?"

আমি তখন আর কথা বলার মতো শক্তি রাখতাম না। আমার গলার স্বর জুড়ে গিয়েছিল, তবুও ফিসফিস করে বললাম, "ভাই... আমি সাধারণ মানুষ... আমি ছাত্রলীগের কেউ না..." আমার গেঞ্জি আর প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে অনেকখানে, রক্তে আমার শরীর ভিজে উঠেছে।চোখে অন্ধকার, মনে হচ্ছিল আমি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছি। এইসব প্রশ্নের মাঝেই হঠাৎ করে কোত্থেকে এক ছেলে এসে আমার বুকে জোরে লাথি মারলো। তবুও আমি অজ্ঞান হইনি। আমার মনে হচ্ছিল —এটা নিশ্চয় দুঃস্বপ্ন। বাস্তব হতে পারে না। আমি বুঝে গেলাম —আমি ছাত্রলীগের একটি পরিকল্পিত ফাঁদে পড়েছি। তারা শুধু আমাকে আঘাত করেনি, তারা আমাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। আমার রক্তভেজা প্যান্টের পকেট থেকে হঠাৎই বের হয়ে আসে আমার কোম্পানির আইডি কার্ড। ওরা সেটি হাতে নিয়েই বললো, “এই তো সাংবাদিক!”

কেউ ভালোভাবে কার্ড না পড়ে শুধুই দেখে ফেললো যে আমার গলায় একটা ট্যাগ ঝুলছে —সাংবাদিক ট্যাগ দেওয়া হলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আইডি কার্ড হাতবদল হলে বোঝা গেল আমি একজন জাপানের একটি গ্লোবাল কোম্পানির কর্মকর্তা। তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় —আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। ঘটনার গভীরতা বুঝে এবং একরকম অনুশোচনায় আক্রান্ত হয়ে দুইজন ছেলে আমাকে দ্রুত ‘ঢাকা হেলথকেয়ার সিস্টেম’ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার মাথার রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে তৎক্ষণাৎ সেলাই করা হয়। যদিও আমার শরীরের আরও অনেক জায়গায় ক্ষত ছিল, যেগুলোর কোনোটাই তখনকার মতো অবহেলা করার মতো নয়। হাসপাতালের বাইরে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। তারা জানতে চাইছিল —“আমি বেঁচে আছি, নাকি মারা গেছি?” তখনও আমি হুঁশে ছিলাম, কিন্তু অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছিল। আমি বারবার বমি করছিলাম, অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হয়। শরীর ক্রমাগত অবশ হয়ে আসছিল। একজন চিকিৎসক আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “রোগীর অবস্থা ভালো না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। সিটি স্ক্যান না করা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।”

আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও, হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা ছিল না। এর মধ্যেই দুইজন অপরিচিত ছেলে আবার সামনে এলো, বললো —“ভাই, আপনাকে দ্রুত এম জেড হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।” তবে সমস্যা হলো —এই মুহূর্তে কোনো এম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। একটি সিএনজি চালক নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রাজি হলো। আমি গাড়িতে উঠতেই দুইজন ছেলে আমার দু’পাশে বসে পড়লো। হাজারো মানুষের জনস্রোত ভেঙে সিএনজি ছুটে চলছে হাসপাতালের দিকে। যাত্রাপথে অসংখ্য আক্রমণের মুখে পড়ি। রাস্তাজুড়ে সেই দুইজন ছেলে প্রাণপণে চিৎকার করছিলো, “ভাই রুগী! ভাই সাইড দেন! ইমারজেন্সি রুগী! সাইড প্লিজ!

শেষমেশ আমি “এম জেড হাসপাতালের” সামনে পৌঁছাই, কিন্তু সেখানে ভেতরে কোনো জায়গা ছিল না। আহতদের ভিড় উপচে পড়ছে। রাস্তায় আমাকে শুইয়ে রাখা হয়, কারণ হাসপাতালের ভেতরে ভর্তি নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। প্রতি কিছুক্ষণ পরপর আন্দোলনে আহত কেউ মারা যাচ্ছেন। একজন তরুণী চিকিৎসক এগিয়ে এলেন, আমার পেশি পরীক্ষা করলেন, হালকা গুঁতোগুঁতি করলেন শরীরে। যেসব জায়গায় সেলাই দরকার ছিল সেগুলো দ্রুত খুঁজে বের করলেন। আমার ঠোঁটে সেলাই দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল —এইবার হয়তো আমি সেন্সলেস হয়ে যাবো। সামনের দাঁত ভেঙে গেছে, শরীর নিথর। আমার বারবার মনে হচ্ছিল —এই হাসপাতালে থেকে গেলে আরও খারাপ কিছু হতে পারে। তাই আমি অনুনয় করে বললাম, “ভাই, দয়া করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন।”

বাসার পথে আরো বিপদ। একদল উগ্র আন্দোলনকারী আমার সিএনজি উল্টে দিতে চাচ্ছিল, এমনকি আগুনও দিতে চাইছিল। তবুও সকল বাধা পেরিয়ে শেষমেশ বাসায় পৌঁছে গেলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম —“আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।” তবে সেই রাতে এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারিনি। এতক্ষণ যে চিকিৎসাসেবা পেয়েছি — তা সবই ছিল বিনামূল্যে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা চিরকাল অটুট থাকবে। সকালের দিকে আমি বারবার অনুভব করছিলাম —আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। নিজে থেকেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি এবং গিয়ে পৌঁছাই ফরাজী হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। তবে সমস্যা হলো —আমার সঙ্গে ব্যাংকের চেকবই থাকলেও, তারা সেই চেক গ্রহণ করতে চাইছিল না। আমাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন বাধ্য হয়ে হাত-পা ধরে অনুরোধ করি, অনেক কাকুতি-মিনতির পর অবশেষে আমাকে ভর্তি নেয়।

দুই ঘণ্টা পর আমার কাজিন এসে হাজির হন। তাকে দেখে আমি এক অনন্য সাহস পেলাম। পুলিশের কঠোর নজরদারির মাঝেও সে আমার এলাকায় প্রবেশ করতে পেরেছে, এটা ভেবেই আমার বুক গর্বে ভরে গেলো। কারণ সেদিন কড়া কারফিউ জারি ছিল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাইরের ঠান্ডা বাতাস যেন শরীরের ব্যথাকে আরও তীব্র করে তুলছে। আমি যা খাচ্ছি, তাই বমি হয়ে যাচ্ছে —এমনকি স্বাভাবিক পানি খেলেও! ফাহিম, যিনি আমার পাশে ছিলেন, উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, "ভাই, তোমাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। শরীরের অবস্থা ভালো ঠেকছে না। "আমিও বললাম, "আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমি মনে হয় প্রচণ্ড ব্যথায় মারা যাচ্ছি।"

দেশের পরিস্থিতি তখনও ছিল থমথমে, গুমোট। বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও আমরা বসুন্ধরা এভারকেয়ার হাসপাতালের দিকে যাই। সেখানে ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করি। তারা সরাসরি পরিষ্কার জানিয়ে দিল, "আন্দোলনকারী কাউকে ভর্তি নেওয়া যাবে না।" তাদের দাবি, সরকারের ‘উপরমহল’ থেকে কড়া নির্দেশ আছে —কোনো আন্দোলনকারী যেন চিকিৎসা না পায়। আমাদের কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই, কোনো স্পর্শ না করে, তারা চালাকি ও অপমানজনক ভঙ্গিতে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। বড় চাচার ফোন আসে। তিনি বললেন —"ইবনে সিনা হাসপাতালে যাও। সম্ভবত ওখানে কেউ একজন সাহায্য করতে পারবে।"

তবে বাস্তবতা ছিল আরও ভয়াবহ। প্রতিটি হাসপাতালকে গোপনে জানানো হয়েছে: কোনো প্রটেস্টার বা সরকারবিরোধী ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক মামলা দেওয়া হবে। এই ভয়ে কেউই এগিয়ে আসছে না। ফলে নিরীহ বহু ছাত্র আন্দোলনকারী চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। আমি আমার কাজিনকে সঙ্গে নিয়ে ইবনে সিনা হসপিটালের দিকে রওনা দিই। সেই মুহূর্তে মহাখালী শহরকে দেখে মনে হচ্ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকা। জ্বলন্ত টায়ার, ধোঁয়ার কুণ্ডলি, মানুষের চিৎকারে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য। ইবনে সিনায় ডাক্তার রাহাত ভাই এবং তাঁর স্ত্রী কলি ভাবির অনুরোধে আমাকে এক প্রকার বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি নেয়। রাতে মাথার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে মাথা কামানো হয়। গোসল করি, সেলাই গোনা যায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে। আমার প্রাণপ্রিয় আত্মীয় হামজা চাচ্চু ফলমূল নিয়ে দেখতে এলেন। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দুঃসময়েও পাশে ছিলেন। আমি অনুভব করছিলা-এই কঠিন সময়ে যেসব মানুষ পাশে এসেছে, তারা যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো ফেরেশতা।

তবুও আমার শরীরের অবস্থা অবনতি হচ্ছিল। কিডনির সমস্যা দ্রুত ড্যামেজ স্টেইজে চলে যাচ্ছিল। ইবনে সিনার চিকিৎসা-পরিসেবা অপর্যাপ্ত ছিল। পরদিন রাতে, আমার বাবা এবং রাহাত ভাই স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিয়ে যান। বাবা ডাক্তারের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অনুরোধ করেন —"আমার ছেলেটাকে বাঁচান।" সেই ডাক্তারদের একটাই উত্তর ছিল —"সরকারবিরোধী আন্দোলনকারী হলে কোনো চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।" আমার বাবা যেন একপ্রকার প্রাণ ভিক্ষা করে আমাকে ভর্তি করান। এই দৃশ্য আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আমার পরিবারের সদস্যরা, আমার আত্মীয়রা, আমার সহযোদ্ধা ছাত্ররা —তাদের প্রার্থনা, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগে আমি এক অসম্ভব যুদ্ধ থেকে ফিরেছি।

দীর্ঘদিন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, আমি শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরি। এই সময়েই, জাতির ইতিহাস বদলে যেতে শুরু করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন হয়। এই ফ্যাসিবাদী শাসনের পরিসমাপ্তিতে আমি যেমন নতুন জীবন ফিরে পেলাম, তেমনই বাংলাদেশ ফিরে পেল মুক্তির আলো। একটি নতুন স্বাধীনতা অর্জিত হলো। আমি বুক ভরে বলি —আমার বাংলাদেশ চিরঞ্জীব হোক। এই দেশের মাতৃভূমিকে আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি। তেমনি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানাই হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তিনি এমন এক সময় দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন জাতি কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি —ছাত্রলীগ এই আন্দোলনে বারবার সন্ত্রাস চালিয়েছে। তারা এতদিন পুলিশের ছত্রছায়ায় টিকে ছিল। তবে বাংলাদেশ পুলিশও খুব নিরীহ নয় —সুযোগ পেলেই তারা সাধারণ মানুষকে হেনস্তা ও অপমান করতে দ্বিধা করে না।

এই দেশের বিবেক, মূল্যবোধ ও মানবিকতা আজ চরমভাবে বিপন্ন। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো —এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু মানুষ আওয়ামী লীগের জন্য মায়াকান্না করে মিছিল করছে। একজন খুনি, স্বৈরাচারী নেত্রীকে আবার ক্ষমতায় আনার কথা বলছে।এমন বিকৃত মানসিকতার মানুষদের চিকিৎসা দরকার। পুলিশের প্রতি এখন যে ক্ষোভ জমে আছে —তা কখনো সহজে মুছে যাবে না।একবার সুযোগ পেলেই মানুষ রাস্তার মোড়ে ইতিহাসের জবাব দিবে। সমাধান একটাই —পুলিশকে পোশাক পরিবর্তন করতে হবে, গণমানুষের মাঝে ভালো কাজ করে পুনরায় বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তারপরই তারা আবার দায়িত্ব পালনে ফিরতে পারবে। আমি আজ বুঝি —বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করা হয়েছিল। আমরা আর ভুল করবো না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

সুশীল সমাজ, তোমাদের হাতে ছাত্র-শিশুদের রক্ত লেগে আছে। তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুনি। একটি যুগ শেষ হলো। শেখ হাসিনার রেজিম পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেল নতুন সূর্যোদয়। আমাদের রক্তের বিনিময়ে এবার আবার গড়ে উঠবে একটি নতুন বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে। নতুন স্বপ্নে ভর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যাত্রা শুরু হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে, আমরা ফিরে পাবো প্রকৃত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আর নিঃশ্বাস নেওয়ার মুক্ত আকাশ।

আমি কখনো রাজনীতিতে আসতে চাইনি। স্বয়ং রাজনীতি আমাকে মেরে, রক্তাক্ত করে শিখিয়েছে —এই রাষ্ট্রে বেঁচে থাকার জন্য রাজনৈতিক অংশগ্রহণ শুধু প্রয়োজন নয়, বাধ্যতামূলক। আমি ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিলাম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। আমার পরিবার সবসময় চাইতো —আমি যেন শুধু মানুষ হই, নেতা না হই। তবু কপাল টেনে নিয়ে আসে রাজপথে। বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাকে বিশ্বজিতের মতো হত্যার চেষ্টা করে। আমি চুপ করে গিয়েছিলাম, কাউকে কিছু বলিনি, কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম —আমার পরিবারের কেউ যেন কোনোভাবে জুলুম আর স্বৈরাচারের শিকার না হয়।
হাসপাতালে সবাই যখন জানতে চাইলো —
"আপনার শরীরে এত জখম হলো কিভাবে? কে আপনাকে মারলো?"
তখন আমি বলে দিই —
"টোকাই বা ছিনতাইকারী মেরেছে।"

আমি জানতাম সত্য বললে আমার পরিবার আরও বিপদে পড়বে। কিন্তু ইতিহাস তো থেমে থাকে না। আমি যখন আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি, একদল যুবলীগপন্থী ডাক্তার আমাকে টেকনিক্যালি মার্ডার করতে চেয়েছিল। মা-বাবার দোয়া আর আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরি। এই দীর্ঘ পথচলার প্রতিটি ধাপে আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত, আর মনের ক্ষত – কোনো শব্দেই প্রকাশযোগ্য নয়। আজ যখন দেশ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুনভাবে পথ খুঁজছে, আমি বিশ্বাস করি —আর কোন দুর্নীতিবাজ, লোভী, দুঃশাসক যেন এই ভূমিকে কলুষিত করতে না পারে। এই রাষ্ট্র আর কারো হাতে জিম্মি হতে পারে না। আমার অবস্থান পরিষ্কার —আমি আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামাতের কেউ না। আমি বাংলাদেশের মানুষ। আমার দেশ ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি। আমার প্রিয় বাংলাদেশ মুক্ত থাকলেই আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আজ আমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছি। এই রাজনৈতিক নির্যাতনে আমার আর্থিক সঞ্চয় ধ্বংস হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত।

আমি এখনও জুলাই ফাউন্ডেশন বা সরকারি কোনও সহযোগিতা পাইনি। আমি লড়েছি আমার দেশের জন্য, তবু আজ আমি সাহায্যের জন্য হাত পাতছি —যেন অন্তত বেঁচে থাকতে পারি। যদি কোনও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা নীতিনির্ধারক এই লেখা পড়েন, আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ —আমাকে সাহায্য করুন। আমি ভিক্ষা চাইছি না, আমি আমার ন্যায্য মর্যাদা চাই। আমি যে দেশকে ভালোবেসে জীবন দিয়েছি, সেই দেশ যেন আমাকে ভুলে না যায়। আমার হারানো স্বাস্থ্য, আমার ভেঙে পড়া ভবিষ্যৎ, আমার গলিত অর্থনীতি —এই দেশ অন্তত একটি সুযোগ দিক, যাতে আমি পুনরায় দাঁড়াতে পারি। আমি জানি, আমি একা নই। আমার মতো আরও অনেকে আছে —যারা লড়েছে, হারিয়েছে, আজ নিঃস্ব। এই লেখাটি শুধুই কাগজে আঁকা কিছু শব্দ নয়, এটি একটি রক্তাক্ত হৃদয়ের প্রতিবেদন।

আমার জীবনের সবটুকু ব্যথা ও আশা দিয়ে বলছি —বাংলাদেশ যেন এমন আর কাউকে নিঃস্ব না করে। শেষ শব্দ নয়, এটি একটি নতুন শুরুর আহ্বান। যদি কেউ এই যন্ত্রণাকে সত্য মনে করেন —আমার পাশে দাঁড়ান। আপনার একটুকরো সাহায্য, আমার নতুন জীবন হয়ে উঠতে পারে।
জয় হোক মানুষের।
জয় হোক বিবেকের।
জয় হোক সত্যের।
— একজন সত্যিকারের ভুক্তভোগী।

MD. Shafayetul Islam
Bkash: 01684510574
Email: [email protected]

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৫

ওমর খাইয়াম বলেছেন:




বেশ বড় ধরণের গার্বেজ ছেড়েছেন?

২| ০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:৫২

সাফায়েতুল ইসলাম বলেছেন: আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
তবে, যদি আপনি সত্যিই মনে করেন যে পোস্টে ভুল কিছু রয়েছে, তাহলে অনুগ্রহ করে যুক্তিসহ ও ভদ্রভাবে তা তুলে ধরুন। গঠনমূলক সমালোচনা সবাইকে শেখার সুযোগ দেয়। কেবল নেতিবাচক কথা বললে আপনার মানসিকতার পরিচয়ই শুধু স্পষ্ট হয়।

ভালো কিছু বলার মতো যদি থাকে, তাহলে সেটাই বলুন—তাতে আপনার মূল্যই বাড়বে।

৩| ০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:১২

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আপনি এখন কী ধরনের সমস্যায় আছেন? শারীরিক, মানসিক, নাকি আর্থিক? ডিটেলস বলেন ।

০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:১৯

সাফায়েতুল ইসলাম বলেছেন: হ্যাঁ ভাই, আমি বর্তমানে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক—সব ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। আপনার এই খোঁজখবর নেওয়া ও সহানুভূতি প্রকাশ সত্যিই অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং আমার জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক।
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

যদি সম্ভব হয়, দয়া করে আমাদের জুলাই ফাউন্ডেশন-এর মাধ্যমে বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন—হয়তো তারা আমার জন্য কিছু করতে পারে।

৪| ০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:২৫

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: জুলাই ফাউন্ডেশনে হেলপ করলে আপনার কিভাবে হেলপ হবে ? বিকাশ কার নামবার এটা ? আপনার পারসোনাল হেলপ লাগবে না ? জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তো আপনি সহায়তা নেন না বলে ?

০১ লা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৪

সাফায়েতুল ইসলাম বলেছেন: জি ভাই, বিকাশ নাম্বারটি আমার নিজের। তবে যদি জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা করা সম্ভব হয়, সেটাও gratefully গ্রহণ করব। আমি এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারি কোনো সুবিধাও পাইনি।

আমি নিজের উন্নয়নের জন্য এবং আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হতে এই সহায়তা চাইছি, কারণ আমি অনেক কিছু হারিয়েছি এবং সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাচ্ছি।

এটা মোটেও এমন নয় যে আমি নিতে চাই না—বরং আমি সত্যিই সাহায্যের অপেক্ষায় আছি। আপনার সদয় আগ্রহ ও প্রশ্নের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.