![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সারাবিশ্বের সকল গুরু, গোঁসাই, পির, মুর্শিদ, ভক্ত আসেকান ও তরিকাপন্থী সকলের পবিত্র চরণে প্রেমভক্তি রইল। এই আইডির ও গুরু গৃহ পেইজের সকল পোস্ট বিষয় ভিত্তিক ও গবেষেণাধর্মী। এখানে সাধারণ কোনো পোষ্ট দেওয়া হয় না। তাই; সবাইকে বিশেষভাবে জানানো যাচ্ছে যে; কোনো জাতি, ধর্ম ও শাস্ত্রীয় মতবাদকে ছোট করা বা কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা আমাদের লেখার উদ্দেশ্য নয়। তথাপিও; যদি; অজানতে আমাদের লেখার বিষয়বস্তু বা কোনো বাক্য কারো মতের বিপক্ষে যায়; সেক্ষেত্রে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মনে রাখতে হবে; যেহেতু; আমাদের পোস্টগুলো বিষয় ভিত্তিক ও গবেষণাধর্মী। লেখকের লেখার উদ্দেশ্য সমাজ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ও ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা; কাউকে হেওপ্রতিপন্ন করা নয়। তাই; সকলের প্রতি আবারও বিনীত নিবেদন; প্রতিটি পোস্টে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের করে লেখককে উৎসাহিত করবেন। যেহেতু; প্রতিটি পোস্ট তৈরিতে লেখকের প্রচুর মেধা ও শ্রম ব্যয় হয়। আর যদি তা না পারেন; তবে; খারাপ মন্তব্য করা হতে বিরত থাকবেন। লেখাতে তথ্যগত ভুল, অসংগতি ও ইতিহাস বিভ্রাট দেখা গেলে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করবেন। গুরু গৃহ কর্তৃপক্ষ ও পরম কাঁইজি
০১.
প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয়–নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতন লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতেই জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি।
অবশ্য মহাকাল কারো কারো প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন, মানিক বন্দ্যো, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।
আর, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। কালের স্থূল হস্তাবলেপ তাঁর গায়ে লাগেনি। প্রতিভার নবনবোম্মেষে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রতিভাত, উদ্ভাসিত। নিত্য নব ভাষাভঙ্গি, নব নব ভাবের উদ্ভাবনায় বিভিন্ন শৈলীর শৈলশিখরে স্বচ্ছন্দ বিচরণে বাঁকে বাঁকে অবাক করা, নিতুই নব তিনি। হিমালয়ের মতই চিরন্তনরূপে সর্বকালীন বলে যেন মনে হয় তাঁকে। চিরদিনের অপরূপের।
কিন্তু ওই মনে হওয়াটাই। যথার্থ বললে হিমালয়ও কিছু চিরকালের নয়। কালস্রোতে সেও ক্ষয় পায়। ভেসে যায়।
তাহলেও এই মনে হওয়াটাই অনেক। ক্ষণস্থায়ীদের ঝরতি পড়তির ভিড়ে এই দীর্ঘক্ষণ স্থায়িত্বটুকু বিস্তর। অমরত্বের ভ্রম জন্মায়। তাই কি কম?
তবে সত্যিকার সর্বকালীন লেখা কি নেই? আছে। সেটা বিধাতার নিজের রচনার। যদিও তা মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে বদলে যায়, তবু তাঁর হাতের স্বাক্ষরে এক চিরকালের আদল বজায় থাকে।
আর আছে তাঁর উচ্চারণায়–যা চারিধারে তিনি চারিয়ে দেন তাঁর প্রতিভূদের প্রতিধ্বনিতে। বেদ উপনিষদ গীতা চণ্ডী বাইবেল কোরআন্ কথামৃত–সেই জাতীয়। তা-ই কেবলমাত্র কালজয়ী। সর্বদাই আনকোরা, সর্বকালের মানুষ তার মধ্যে চিরদিনের জিনিষ খুঁজে পায়–চিরকালের প্রেরণা।
তা বাদে আর সব লেখাই কালক্ষয়ী, কালক্ষয় করার জন্য লেখা এবং পড়া। কালের সাথে সাথে ক্ষয় পাবার।
সত্যিকারের হচ্ছে এই কালস্রোত। নদীর জলধারার মতই চিরন্তন, নিত্য নূতন।
বহতা নদীর ধারে আমার কালজয়ী তাজমহল গড়ে তুললাম, অভ্রংলিহ সেই কীর্তিস্তম্ভ দাঁড়ালো বটে সগৌরবে, কিন্তু নদীর পথ পালটালো, নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেও অন্য ধারা ধরলো সে, সঙ্গে সঙ্গে সেই জলপথে যাতায়াতকারী যাত্রীদলেরও মতিগতি পালটে গেল, ভাব-ভাবনা হয়ে গেল আরেক ধারায়। বহতা নদীর তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুদূরপরাহত বহুকীর্তিত সেই কীর্তিমন্দির কারো কারো কাছে তখনো হয়ত পরিক্রমণীয় তীর্থ হলেও, নিজের দুর্বহতার বোঝা নিয়ে আর সবার কাছেই তখন তা যত্নসাপেক্ষ প্রত্ন গবেষণার; একদার মিউজমহল কৌতূহলী সকলের কাছে তখন মিউজিয়ম হল্ ছাড়া কিছু নয়।
আমার ধারণায়, আমাদের কারো কোনো লেখাই কখনই কালজয়ী হয় না। হতে পারে না। সব লেখকই ক্ষণকালজয়ী–যদি বা হয়। রূপের মতন সেই মুহূর্তের চোখ আর মন ভোলাতে পারলেই ঢের। তাহলেই সে সার্থক। পরমুহূর্তেই আবার নতুন রুপোদ্দামে নব বসন্তের নতুন মধুপদের আসর জমজমাট। পুরানো রূপসীর দিকে তাকাবার কারো ফুরসৎ কোথায়?
আমার নিজের কথা বলতে পারি, আমি কখনই কালজয়ী হতে চাইনি, এমনকি বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠাতেও নয়। সেই বৃথা চেষ্টার অক্লান্ত সাধনায় কালক্ষয় না করে সকলের জীবনের সকালটা, না, জয় করতে নয়, তার সঙ্গী হতেই চেয়েছিলাম আমি। ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় আমার লেখা পড়বে, একটু বেলা হলে, বড় হলেই অক্লেশে ভুলে যাবে আমায়। সেই একটুক্ষণ তাদের একটুখানি হাসি-হাসি করতে পারলেই আমার খুশি।
কিন্তু গোড়াতেই যেকথা বলেছি, ক্ষণজীবীই হোন আর দীর্ঘজীবীই হোন, খোদা কাউকে কখনো পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেন না, স্বেচ্ছায় না সরলে সরিয়ে নেন–শেষ খোদকারি সেই তাঁরই।
পথচারীদের জন্যে সর্বদাই পথ সাফ রাখতে হয়, ট্রাফিক যেন জামতলায় না জমে।
এক জায়গায় এসে দাঁড়ি টানতেই হয়। আর সবার পক্ষে দেহরক্ষার পর হলেও লেখকের বেলায় তার ঢের আগেই। বলবার কথা ফুরিয়ে গেলেই তাঁর কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না আর। আমার নিজের কথা যদি বলি, আমার কী বলার কথা ছিল আমি নিজেই জানি না। এতদিন ধরে কত কথাই বলেছি, বেশির ভাগই তার আজেবাজে আর হাসির কথাই, নিতান্তই টাকার জন্য, বাঁচার তাগাদায় লেখা–কিন্তু আর না। কিছু বলতে পেরে থাকি বা না থাকি, কিছু বলতে পারি আর নাই পারি–এই লেখাটার পরেই আমার দাড়ি। এইটাই আমার শেষ লেখা আমি আশা করি।
এর পরেও যদি প্রাণে প্রাণে থাকি, প্রাণের দায়ে যদি ফের আমায় কলম ধরতে বাধ্য করে, এই দাঁড়ির পরেও কথা বাড়িয়ে আবার আমায় Comma-য় আসতে হয়, তবে সেই সব বাক্য অবশ্যই আমার মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করবে, আমি জানি, সে হবে আমার আপন স্বাক্ষরে নিজের ডেথ সেনটেনস।
.
রূপোর ঝিনুক মুখে নিয়ে জন্মাইনি ঠিকই; আর, যদি জন্মাতুমও, তাহলেও ঝিনুকের থেকে মুক্ত হতে আমার দেরি হত না। অল্প বয়সেই আমি বুঝেছিলুম মুখ মোটেই ঝিনুকের জন্যে নয়; আর রূপো না, মুখের সম্মুখে যদি কিছু রাখতেই হয় তো সে হচ্ছে রূপ। ঝিনুকের থেকে মুক্তি পাবার পরেই সে মুক্ত!
সেই নব নব রূপে অপরূপ মুক্তি।
আর এই রূপই হল আমার অভিশাপ। এই রূপের জন্যেই জীবনে আমার কিছু হল না এবং যা কিছু হল তা হয়ত ওর জন্যেই হল। এই অনির্বচনীয়ের স্বাদ বাল্যকালেই আমি পেয়েছিলাম আর তার টানে সেই অতি কৈশোরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির থেকে স্বাধীনতার সাথে শুধু কেবল বহুবিচিত্র রূপের আস্বাদে।
মুক্তির রূপ আর রূপের মুক্তি এক হয়ে মিশে গেছে আমার জীবনে।
এই কারণেই আয়াসসাধ্য কোনো সাধনা আমার দ্বারা হল না, সাধনালব্ধ কোনো সিদ্ধিও নয়। এমন কি, লিখে লিখে জীবনটা কাটলেও লেখকের মত লেখক আমি হতে পারলাম না কোনোদিনই। লেখক হতে হলে যে উদয়াস্ত পরিশ্রম বা নিদারুণ পড়াশোনা বা যে দুর্নিবার দুঃখ ভোগ করতে হয় তা আমার কুন্ঠিতে কই?
লেখক হতে চাইওনি বোধ হয় আমি। লিখতে ভাল লাগে না আমার। প্রেরণার বশে নয়, প্রাণের দায়েই, আর কিছু না হতে পেরেই অগত্যা আমার এই লেখক হওয়া–সাংবাদিক হতে গিয়েই লেখক। ঘরকুনো হয়ে ঘাড় গুঁজে কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে লেখক হবার কোনোদিনই আমার সাধ ছিল না, পাঠক হতেই চেয়েছিলাম বরং। বিধাতা সে বর্ণপরিচয়ের কেতাব আমাদের চোখের সামনে চারিধারে মেলে রেখেছেন সর্বদাই, যার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে মুক্তোর ছাঁদে সোনার আখরে আপন স্বাক্ষরে তাঁর অপরূপ কাহিনী লেখা, নতুন নতুন হরফে নব নব মুদ্রণে মুহূর্তে মুহূর্তেই যে–বইয়ের নিত্য নবীন সংস্করণ, সেই-বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের পড়াই আমার শেষ হয়ে উঠল না জীবনে। লিখিয়ে হব কি, পড়ুয়া হয়েই থাকতে হল আমায় চিরটা কাল। কি সেই ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারলুম কি?
.
যে তিনটি কথা মাথায় করে আমার এই আত্মকাহিনীর শুরু, সে-তিনটির সঙ্গেই, যাকে বলে কমফ্রন্টেশন, সেই বাল্যকালেই আমার হয়েছিল।
সত্যি বলতে, সে সময়টা ছিল কেমন ঈশ্বরপীড়িত। আমাদের বাড়িতে বাবা ছিলেন পরম বৈষ্ণব, বিষ্ণুভক্ত; মা ছিলেন শাক্ত, শক্তির উপাসিকা; আর আমার মামা ছিলেন নাম-সাধক, হরিগুণ গানে বিভোর।
বাবাকে আমার মনে হত মহাদেবের মতন। শিবের মতই ছিল তার চেহারা আর ধরনধারণ। রক্তাভ গৌরকর্ণ চেহারা, সদাপ্রসন্ন, প্রশান্ত, আত্মনিমগ্ন। সংসার-উদাসীন আত্মভোলা। ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম ভাঙত তাঁর। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি গোটা গীতাটা আওড়াতেন। তাঁর মুখে শুনে শুনেই গীতা আর উপনিষদের আদ্ধেক শ্লোক আমার মনে গাঁথা হয়ে গেছল– মানে তার বুঝি আর নাই বুঝি। সেই পুঁজিই আমার সারা জীবন ভাঙিয়ে খাওয়া।
মার কাছে প্রায়ই আসত লাল চেলীপরা ত্রিশূলধরা ভৈরবীরা–তিব্বতের কোন মঠ না কামিখ্যে থেকে কে জানে! মার সঙ্গে নিভৃতে আলাপ হত তাঁদের। দিনকতক থেকে ফের কোথায় তাঁরা চলে যেতে যেন।
এক ভৈরবী আমায় ভালোবাসতেন ভারী। পেড়া-টেড়া খেতে দিতেন তার বোলার থেকে। দেবী কামাখ্যার মহাপ্রসাদ। তিনি একবার আমায় বলেছিলেন-তোমার মাকে সামান্য মনে কোরো না বাবা। জগন্মাতার অংশ আছে তার মধ্যে। মাকে কখনো অমান্য কোরো না।
মাকে আমি ভালোবাসি তে।
মা সাক্ষাৎ ভগবতী। মা-ও যা–মা দুর্গাও তাই। তিনি বলতেন।
জানি আমি। জবাবে আমি বলতাম–সবার মা-ই তো তাই। মা দুর্গাই। তাই না?
শুনে শুনেই এসব কথা জানা। আমিও শুনিয়ে দিতে ছাড়তাম না।
তাই বটে। তবে তোমার মা আরও বিশেষ।
কিন্তু কী যে সেই বিশেষ তা তিনিও কোনো দিন খুলে বলেননি, আমিও তা জানতে চাইনি কখনো। মার সেই বিশেষত্ব সারা জীবন ধরে আমায় জানতে হয়েছে। জীবন ভরে জেনেছি। আর, পৃথিবীর সঙ্গে আমার মুখোমুখি হয়েছিল সেই বয়সেই। মাথার মধ্যে কী পোকা ছিল কে জানে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোতো, আর মাঝে মাঝেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম বিবাগী হয়ে। পকেটে একটিও পয়সা না নিয়ে পাব কোথায় পয়সা?) বিনাটিকিটে রেল গাড়ির লম্বা লম্বা পাড়ি জমাতাম-চলে যেতাম বৈদ্যনাথধাম। দেওঘরের দেবতা কি প্যাড়া কিসের টানে তা আমি বলতে পারি না।
চলে এসেছি কলকাতায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, খবরকাগজ ফিরি করেছি, জেল খেটেছি মাঝে মধ্যে, ফুটপাথে পার্কে শুয়ে রাত কেটেছে। কষ্টের মধ্যেও কতো সুখ। স্বাধীনতার স্বাদ।
আর, ভালবাসা? তার পরিচয় কাউকে বোধ হয় চেষ্টা করে পেতে হয় না, সে নিজেই আগ বাড়িয়ে জানান দিয়ে থাকে। ই একটি বস্তু, যা কারোর দ্বারা কিছুতেই লভ্য নয়, (পাওয়াও যায় না বোধ হয়) নিজগুণে আপনার থেকে অযাচিত এসে ধরা দেয়।
চলার পথের মোড়ে মোড়েই তার দেখা মেলে। দেখতে না দেখতেই বেঁচে উঠি, বেঁচে বেঁচে যাই। নতুন করে বাঁচি, নতুনতরো আঁচ পাই জীবনের। কি করে যে একজনকে আরেকজনের এমন ভালো লেগে যায়, আর কী আশ্চর্য, তাকেও ভালো লাগানো যায় তেমনি আবার–কত সহজেই না! আমার কাছে সে এক পরম বিস্ময়-পরামাশ্চর্য রহস্য:
ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা–প্রত্যেকের জীবনেই ওতপ্রোত। কেউ বঞ্চিত নয়। প্রত্যেককেই টের পেতে হয় কখনো না কখনো, না টে: পেয়ে উপায় নেই, যিনি এই নাটের গুরু তিনিই টের পাওয়ান।
আর, বাল্যকালেই এসবের টের পেয়ে যাওয়া এক রকমের ভালোই বোধ করি। কেননা, ব্যাধি হিসেবে এই তিনটিই মারাত্মক–এই ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা। তেমন করে ধরতে পারলে এ বস্তু কাউকে ছাড়ে না, রেহাই দেয় না সহজে, আজীবন ভোগায়, আপাদমস্তক গ্রাস করে বসে। সংসার, সারাৎসার আর…আর ভালোবাসার কী আখ্যা দেব? অন্তঃসার? নেহাৎ অন্তঃস্রাব ছাড়া কী আর ও? এর একটিই যদি কাউকে ধরে তো তার হয়ে গেল। জীবনের মতন ছাড়ান নেই। ঘোর সংসারী, যোরালো প্রেমিক কিংবা ঘোরতর ঈশ্বরসাধক হয়ে গেল সে। হতেই হবে। পরিত্রাণ নেই আর।
তাই কৈশোরেই কারো যদি এসবের টিকা নেয়া হয়ে যায়-খানিক খানিক স্বাদ পায় সেতো জন্মের মতই বেঁচে গেল বেচারা!
সটীক হয়ে থাকলে সঠিকভাবে বাঁচা যায় জীবনভোর। বাল্যে বসন্তের টিকা নিয়ে রাখলে তা যেমন কখনো প্রাণান্তকর হয়ে দেখা দিতে পারে না, দিলেও হামের মতই হামেশার সামান্য ব্যাপার হয় মাত্র, তেমনি প্রাথমিক এই ত্রিবিধ টিকায়–এই ট্রি অ্যানটিজে নেয়া থাকলে সারা জীবন ধরে পৃথিবী, ঈশ্বর আর ভালোবাসার পার্থিব আর অপার্থিব সেই বসন্তকালকে অল্পে অল্পে একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে চেখে চেখে যাওয়া যায়-খাওয়া যায়।
তাকেই খাই, তাঁর খাদ্য হতে হয় না।
পরাৎপর হলেও সেই মহাকাল যেন পরাস্ত হয়ে থাকে।
বিবেকানন্দের ভাষায় অমৃত ভাণ্ডের কিনারে বসে তার কিনারা করা। তার ভেতরে ডুব দিয়ে মজে ভূত হয়ে যাওয়া নয়, তাকে কিনারায় রেখে বহালতবিয়তে থেকে দেখেশুনে চেখে যাওয়া।
ভবানীর ভাঁড়ে হারিয়ে না গিয়ে, মিলেমিশে তাঁর সাথে একাকারে নিজেও ভাঁড়ে ভবানী না হয়ে, নিজের ভাঁড়কেও ভবানী না বানিয়ে ভবানীর ভাড়ার লুঠ করা আর কি!
একদিন বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি মা আমার বিরাট দরদালানে কেমন যেন অভিভূতের মতন দাঁড়িয়ে।
আমাকে দেখে বললেন, জানিস কে এসেছিল আজ?
কে?
মা এসেছিলেন।
দিদিমা? তাই নাকি? কই কই? কোথায় দিদিমা? আমি লাফিয়ে উঠেছি।
না, তোর দিদিমা নয়। তোরও মা। তোর মা, আমার মা, সবার মা। তিনিই একটু আগে এসেছিলেন।
শুনে আমি হতবাক হই। বুঝতে পারি না ঠিক।
মা কালী আমায় দর্শন দিয়ে গেলেন একটু আগে। এই সামনে, ওইখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন–যেখানে তুই দাঁড়িয়েছিস। ওই জবাফুলটা দিয়ে গেলেন আমায়। আমার হাতে তুলে দিতে এসেছিলেন। ভয়ে আমি হাতবাড়িয়ে নিতে পারিনি। হতচ্ছাড়ী আমি!
সামনেই একটা জবাফুল পড়েছিল আমি দেখলাম। দেখেশুনে আমি শিউরে উঠেছি কেমন।
কাছেই একটা গোরু বসে জাবর কাটছিল, কিন্তু জাবর কাটা সে ভুলে গেছে কখন রোমাঞ্চিত হচ্ছে তখনো। মনে হয় সেও বুঝি মা কালীকে দেখেছে।
আর, সত্যি বলতে, দিব্যদর্শনের গোরুত্ব তখনই আমার মালুম হয়েছিল। সেই দণ্ডেই।
.
©somewhere in net ltd.