নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
এপ্রিলের শুরুতেই রংপুর শহরে খান সেনারা হত্যা যজ্ঞ চালায়। হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঠিক চার পাঁচ দিন পরেই সন্ধ্যার সময় দুইজন লোক এসে থাকার জায়গা চেয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। দেশে তখন যুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থা, বর্বর খান সেনাদের হাতে প্রতিদিনই মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মরছে, নিজেদেরই জানমালের নিরাপত্তা নাই এ অবস্থায় অচেনা অজানা লোককে জায়গা দিয়ে কোন বিপদ হয় এই আশঙ্কায় বাবা তাদেরকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার মতো ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল। লোকটি মাটিতে বসেই দুই পা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে আল্লাগো আল্লাগো বলে কাঁদতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এ অবস্থা দেখার পরে বাবা আর নিষেধ করতে পারলেন না। তাদেরকে থাকতে বললেন।
সন্ধার অন্ধকার হয়েছিল, বাবা বাড়ির ভিতর থেকে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে আনতে বললেন, আমি বাড়ির ভিতর থেকে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে এনে দেখি লোকটি তখনও পা দু’টি লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছে। ছড়ানো দুই পায়ের অবস্থা দেখে চমকে উঠলাম। দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের এই অবস্থা বুঝতে পারি নাই। দুই পায়ের হাঁটু এবং পায়ের গিটসহ গোরালি ফুলে ঢোল হয়েছে। বাত ব্যাথার রুগিদের যেমন পায়ের গিটগুলো ফুলে যায়, তেমন অবস্থা। বাবা লোকটির এই অবস্থা দেখে মর্মাহত হলেন। পায়ের গিটগুলো ফুলল কি করে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই লোকটি কোকাতে কোকাতে বলল, চাচা গো- আজ তিনদিন হলো শুধু হাঁটার উপর আছি, জীবনে কোনদিন দশ মাইল হাঁটি নাই সেখানে এই তিন দিনে নাহলে একশ’ মাইল হেঁটেছি, হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে। পায়ের ব্যাথায় গায়ে জ¦র এসেছে। এখন আর হাঁটতে পারতেছি না, পা টেনে তুলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। রংপুর থেকে জান বাঁচিয়ে এই পর্যন্ত আসালেও জীবন্ত বাড়ি যেতে পারবো কি না বুঝতে পারতেছি না। মানুষ কতটা বিপদে পড়লে এইরকম ফুলে যাওয়া পা এবং পায়ের ব্যাথা নিয়ে শতশত মাইল হাঁটতে বাধ্য হয় তা এই মানুষগুলোর মাধ্যমে নিজ চোখে দেখেছি। এতো বছর পরেও দৃশ্যগুলি ভুলতে পারি নাই। আজো সেই দৃশ্যগুলি প্রায়ই চোখের সামনে ভেসে উঠে।
অতিথ মুসাফির থাকার জন্য আমাদের আগে থেকেই একটা কাচারি ঘর ছিল। দাদার আমলেও অনেক অতিথকে থাকতে দেখেছি। দাদা ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে হজ্ব করেছিলেন। তার ভিতর আল্লাহভিতি সবসময় কাজ করতো। কোন পথিক থাকার জায়গা চাইলে দাদা কখনই না করতেন না। যতটা পারতেন সমাদর করতেন। নিজে না খেয়েও মুসাফিরকে খাওয়াতেন। সেই অভ্যেসটা আমার বাবার মাঝেও ছিল। তার ধারণা মুসাফিরদের তাড়িয়ে দিলে আল্লাহ বেজাড় হয়। এমন ধারনা আমার মায়ের মাঝেও ছিল, যতো কষ্টই হোক না কেন মুসাফিরকে কখনই না খেয়ে রাখতেন না। মা সবসময় বলতেন মুসাফিররা আল্লাহর মেহমান, তারা তাদের রিজিক সাথে করে নিয়ে আসে, তাদেরকে না খেয়ে রাখতে নাই, মুসাফিরকে না খেয়ে রাখলে আল্লাহ বেজাড় হয়, সংসারের বরকত কমে যায়। দেশের এই অবস্থার মাঝেও তাদের সেই বিশ^াসের ঘাটতি ছিল না। বাবা বিপদগ্রস্ত এই অতিথিদের থাকাসহ খাওয়ার পরিপূর্ণ ব্যাবস্থা করলেন।
লোকগুলির গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের কোন এক অঞ্চলে। রংপুর শহরে চাকরি করার করেন রংপুর শহরে থাকেন। স্ত্রী সন্তান কিছুদিন আগে বাড়ি রেখে এসেছেন। তাদের বর্ননা অনুযায়ী ৩এপ্রিল খান সেনাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে তারা বাসাতেই ছিলেন। আর্মির গাড়ি নিয়ে খান সেনাদের মেইন রাস্তায় টহল দেয়া এবং এলোপাথারি গুলি করার দৃশ্য দেখে ভয়ে বাসার পিছনে জঙ্গলে লুকিয়েছিলেন। লুকানো অবস্থায় রাস্তায় মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে দেখে ভয়ে সারা দিন আর জঙ্গল থেকে বের হন নাই। দিন শেষে সন্ধার পর রাতের অন্ধকার হলে তারা জঙ্গল থেকে বের হয়ে সোজা পূর্ব দিকে রওনা দেন।
চাকরি জীবনে ময়মনসিংহ থেকে রংপুর শহরে তারা সবসময় ট্রেনে যাতায়াত করেছে। ট্রেন লাইনের বিকল্প রাস্তা তাদের জানা নাই। তাদের ধারনা ফুলছড়ি ঘাটে যেতে পারলে নদী পার হয়ে বাড়ি যেতে পারবে। কিন্তু খান সেনাদের বর্বরতার ভয়ে শুধু শহর নয় গ্রামগুলোও জনশুন্য হয়ে পড়েছে। পথের সন্ধান দেয়ার মতো কোন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এরপরও অনেক কষ্টে তারা হাঁটতে হাঁটতে এই পর্যন্ত এসেছে।
রংপুর থেকে আসার সময় কিছুই আনতে পারে নাই, পরনের জামা কাপড় ছাড়া বাড়তি কোন কাপড় ছিল না। দুইজনের মধ্যে একজনের কাছে একটা গামছা ছিল, সেটাতেই তারা গ্রামের কোন এক মুদির দোকান থেকে কিছু চিড়া কিনে বেঁধে এনেছিল।
তাদের পায়ের অবস্থা দেখে বাবা বাড়ির ভিতর গিয়ে মাকে গরম পানি করতে বললেন। গরম পানি বালতি ভরে এনে তাদেরকে দিয়ে বললেন, গরম পানি দিয়ে হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত ধুয়ে ফেলেন অনেক আরাম পাবেন। লোকগুলো বাবার কথা মতো গরম পানি দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত পা ধুয়ে একটু আরামবোধ করতে লাগল। গরম পানি দিয়ে হাত পা ধোয়া হলে বাবা তাদেরকে কাচারি ঘরে বসতে দিয়ে খাবার খেতে দিলেন। খাওয়া শেষ হলে ঐ ঘরেই শোয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। লোকগুলা খাওয়ার পরে আর একমিনিটও দেরি করলেন না চৌকিতে গা এলিয়ে দিয়েই সটান শুয়ে পড়লেন।
সকাল বেলা লোকদুটি না খেয়েই চলে যাচ্ছিল, বাবা তাদেরকে না খেয়ে বের হতে দিলেন না। ভাত খাওয়ার পরে বাবা নিজে সাথে নিয়ে ওয়াপদা বাঁধে এগিয়ে দিয়ে আসলেন। শুধু এগিয়ে দিয়ে আসলেন না যমুনা নদী পার হওয়ার জন্য ফুলছড়ি ঘাটে কিভাবে কোন রাস্তায় সহজেই যাওয়া যায় সব দেখিয়ে দিয়ে আসলেন। ফুলছড়িতে তখনও হানাদার বাহিনী আসে নাই। ফুলছড়ি হানাদার মুক্ত থাকায় ফুলছড়ি এবং জামালপুরের ইসলামপুর থানার গুঠাইল পর্যন্ত নৌকা চলাচল ছিল এবং এই রাস্তাটি নিরাপদ ছিল। যাওয়ার সময় কান্না জড়িত টলমল চোখে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছিল আর বাবাকে বার বার বলছিল চাচা দোয়া করবেন আমরা যেন জান নিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পারি।
যদিও ঘটনাটি গল্পের মতো মনে হচ্ছে আসলে এটি কোন গল্প নয় একাত্তুরে শহর থেকে পালিয়ে আসা অসহায় লোকদের বাস্তব ঘটনা থেকেই বলছি।
(ছবি ইন্টারনেট)
০৬ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৫
প্রামানিক বলেছেন: যুদ্ধের সময় অনেক মানুষই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াতো সাহায্য না করতো তাহলে অর্ধেক মানুষ খান সেনাদের হাতেই শেষ হয়ে যেত। ধন্যবাদ আপনাকে মূল্যবান মন্তব্য করার জন্য।
২| ০৬ ই জুন, ২০২৪ সকাল ৮:৩১
শ্রাবণধারা বলেছেন: জীবন বাঁচাতে রংপুর শহর থেকে পায়ে হেটে আসা এই মানুষগুলোর দুর্দশা এবং আপনার পিতার তাদেরকে সাহায্যের গল্প মন ছুঁয়ে গেল প্রামাণিক ভাই।
ভালো থাকবেন আর আমাদের জন্য একাত্তরের গল্প আরো লিখবেন।
কামাল ভাইয়ের মন্তব্যটিও ভালো লাগলো। এইসব ছোট ছোট ঘটনা, গল্পগুলোর ভিতরে আমি বাংলাদেশ নামক এক দুখিনী মায়ের জন্ম-বৃত্তান্ত দেখতে পাই।
০৬ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৭
প্রামানিক বলেছেন: সেই সময় অনেক মানুষের জীবনে নিদারুণ কষ্ট গেছে। তারপরেও বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যে যেভাবে পেরেছে চেষ্টা করেছে। ধন্যবাদ মূল্যবান মন্তব্য করার জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই জুন, ২০২৪ রাত ৮:৩১
কামাল১৮ বলেছেন: ২৫ শে মার্চ রাতে গোলাগুলির শব্দশুনি।আমি তখন মুন্সি গঞ্জের পাশে কমলা ঘাট এলাকায় থাকি।সকালে দেখি হাজার হাজার লোক ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে চর দিয়ে হেটে কমলা ঘাটের দিকে আসছে।অবস্থা বেশি খারাপ ছিলো মহিলাদের।২০/২৫ মাইল পথ খালি পায়ে বালির উপর দিয়ে হেটে তার আসছে ।সে যে কি এক অবস্থা ভাষায় বর্ননা করা যায় না।তাদের কে ল্কুলে থাকার ব্যবস্থা করে খাবারের খোজে লেগে গেলাম দলবেধে।চিড়া মুড়ি গুড় কলা যা বাজারে পাওয়া গেলো তাই তাদের খেতে দেওয়া হলো।