নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রফেসর আলতাফ সরকার

প্রফেসর আলতাফ হোসেন সরকার, একজন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিক্ষক, ব্যাকপেইন বিশেষজ্ঞ, সমাজকর্মী, স্বাস্থ বিষয়ক কলাম লেখক, বাংলাদেশ ফিজিেথেরাপি এসোসিয়েশন এর প্রতিষ্ঠাতা উপদ্রেষ্টা, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠাতার প্রধান সম্পাদক, ব্যাকপেইন চিকিৎসায় উন্মোচন করেছেন এক নতুন দিগন্ত, সরবপরি আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

প্রফেসর আলতাফ সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে

১৪ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:৪৬



বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের নভেম্বরে হলো ঈদ। কিভাবে যে ঈদ করলাম তা এখন ভাবতেই অবাক লাগে। তখন থাকতাম বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) – ভারতের বর্ডারে একটা ক্যাম্পে। চাচা তাহেজ উদ্দিন সরকার আমাদের কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। তাঁর চিঠি নিয়ে এসেছে ইসহাক কাকা, যিনি এখন বেড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। চিঠি পেয়ে আমরা ২০-২৫ জনের একটা দল রওনা দিলাম ভারতে। হুরা সাগর নদী আমার বাড়ী সংলগ্ন। সেখান থেকে রাতে নৌকায় উঠলাম। সাথে আছে গতকাল হাটে ধানবিক্রি করা ১৭ টাকা। পরনে লুঙ্গী ও পাঞ্জাবী পায়ে পঞ্জের সেন্ডেল। পরের দিন যমুনা নদীর পাশে একটা জায়গায় আমরা যাত্রা বিরতি করলাম। উদ্দেশ্য কিছু খাবার সংগ্রহ করা। আমি, দুলু ও মঈন (ডাঃ মঈন এখন আমেরিকায় থাকে)। এক-দুই বাড়ী ঘুরার পরে যথেষ্ঠ চাল-ডাল এবং আন্তরিকতা পেলাম। জীর্ণ একটা ঘরের কোণ থেকে ৪০ বছর বয়সের একজন লোক এসে আমাদেরকে বললেন, আপনারা নৌকায় ফিরে যান। প্রশ্নের দৃষ্টির নিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। অন্যদিকে ক্ষুধায় শরীরটা বিষণœ হয়ে আসছে। ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনারা জানেন না যে, এই এলাকায় রাজাকার, আলবদর আছে। যারা আপনাদেরকে পাক-বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিতেও পারে অথবা আপনাদেরকে মেরেও ফেলতে পারে”। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম সত্যি আমাদের এভাবে এখানে আসাটা ভুল হয়ে গেছে। নৌকায় এসে যখন পৌঁছোলাম, তখন পশ্চিম গগণে সূর্যের দেখা পেলাম না। রাতে যখন খাবার খেতে বসলাম, প্লেটে পেলাম কয়েক রকম চালের উষ্ণ ভাত। সাথে আগুনে পোড়ানো দুটো শুকনো মরিচ। রাতের বেলায় যে জায়গায় আমাদের নৌকাকে আটক করা হল, তা ছিল একটা চর অঞ্চল। জানতে পারলাম যারা আমাদেরকে আটক করেছে, তারা কাদেরিয়া বাহিনীর সৈনিক, অর্থাৎ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি বাহিনীর সদস্য, ওরা আমাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারল, আমরা যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দিলেন যে, এক ঘন্টা নৌকা চালালে আপনারা বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন। পৌঁছে ওখানেই অবস্থান করবেন। সূর্য উঠার সাথে সাথে আপনারা দ্রুত নদী পার হবেন। মনে রাখবেন, যত তাড়াতাড়ি ওপারে যাবেন, তত তাড়াতাড়ি আপনারা মুক্ত এলাকায় পৌঁছে যাবেন। গতকালও সকাল ১০ টার দিকে দুটি নৌকায় মুক্তিযোদ্ধারা নদী পাড় হয়ে ভারত যাচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলেছে ও নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। আমরা কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধার উপদেশ অনুযায়ী, আল্লাহর নাম নিয়ে প্রাণপণে নৌকা চালিয়ে নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে গেলাম। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি ক্যাম্পে কয়েকদিন অবস্থান করার পর উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা হবার প্রাক্কালে দুলু, শাহাদত ও এসকানকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে জানতে পারলাম ওরা মা-বাবার টানে বাড়ি ফিরে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় যেতে যেতে ওদের কথাই বেশি মনে পড়ছিলো। যদি কোনো ভাবে বা কোন কারনে ওরা রাজাকার, আলবদর বা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, তাহলেতো নিশ্চিত মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ নেই। পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পে সাউদ মামা আমাদের স্বাগত জানিয়ে ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সাউদ মামা ১৯৬৭ সালে “র‌্যাক্সু” এর ভিপি ছিলেন। ১৯৭০ সালে এমএনএ, ১৯৭৩ সালে এম.পি, ১৯৯৬ সালে এম.পি. নির্বাচিত হন পাবনা-১ থেকে। আবু সাউদ সাহেবের ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে জলিল(মরহুম আব্দুল জলিল প্রাক্তন এমপিও সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ) ভাইয়ের সাথে তার ক্যাম্পে কয়েকবার দেখা হয়েছিল। জলিল ভাই খুব আদর করতেন আমাকে। ছোটবেলার বন্ধু আনোয়ারুল করিম মিন্টু উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজাম ভাইয়ের নেতৃত্বে (নিজাম ভাই তৎকালীন সময়ে শাহজাদপুর কলেজের ভি.পি. ছিলেন, বর্তমানে পাবনা জেলার সাথিয়া থানার উপজেলা চেয়ারম্যান) দেশের ভিতরে যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে জানতে পারি, সম্মুখ যুদ্ধে মিন্টু শহীদ হয়েছে। নভেম্বরের ২৬-২৭ তারিখের দিকে দুপুরে ইন্দ্ররা থেকে পানি তুলে গায়ে ঢালছিলাম আমিও তাহেজ চাচা এমন সময়ে শুনতে পেলাম আমাদের ক্যাম্পে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হামলা করেছে। আমি এবং ছোট চাচা তাহেজ মুক্তি ঐ অবস্থায় এসএলআর ও এসএমজি নিয়ে দৌড় শুরু করলাম ক্যাম্পের দিকে। ঘরে থাকলো তাঁর স্ত্রী, ছোট মেয়ে মিতু ও চার ছেলে -ঝন্টু, পিন্টু, মিন্টু, মিলন। চাচা আর আমি, খানিকক্ষণ পর যুদ্ধের খাতির আলাদা হয়ে গেলাম। রাত ৯টার দিকে আমি যখন ঘরে ফিরলাম, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার তাহেজ চাচার এখনও কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। আল্লাহর অশেষ রহমতে, ঘন্টাখানেক পরে চাচা ফিরলেন, চোখে অশ্রু আর মুখে প্রচন্ড কান্তি, বললেন, “তোমাকে অনেক খুঁজেছি, না পেয়ে ভাবলাম, পাঁচ বিবির মফিজের মত তোমাকেও হয়তো ওরা ধরে নিয়ে গেছে।” এরপরই শুরু হলো যুদ্ধের পূর্ণ দামামা, আমরা ২রা ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের বগুরা জেলার পাঁচবিবি থানায় পৌঁছে গেলাম, আসার পথে পাক হানাদার বাহিনীর পোঁতা মাইনে পা ওড়ে গেল হাদীর। পরে জানতে পেরেছি তাঁকে বিদেশ পাঠিয়ে যাবতীয় চিকিৎসা করে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেশে নিয়ে আসা হয়েছে।



লেখক: প্রফেসর আলতাফ হোসেন সরকার, মুক্তিযোদ্ধা।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:৫৬

জলপুরুষ বলেছেন: মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য কাহিনী। পরে বেশ ভালো লাগলো।

২| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:১৬

চাঁদগাজী বলেছেন:



ব্লগে আছেন, জেনে খুবই উৎসাহিত হলাম।

জলিল সাহেবের সাথে পরিচিত ছিলাম।

৩| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৩৬

প্রামানিক বলেছেন: আপনার যুদ্ধের কাহিনী পড়লাম। আপনার প্রতি রইল আমার আন্তরিক শুভ্চেছা।

৪| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৪৩

তৃণ বলেছেন: একজন মুক্তিযোদ্ধার ব্লগে এসে তার বিরোচিত যুদ্ধের গল্প জেনে খুবই অভিভূত হলাম! বিনম্র শ্রদ্ধা!

৫| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৩:৫৫

স্পাইক্র্যাফট বলেছেন: সম্মুখ যুদ্ধের আরো কিছু স্মৃতি জানতে চাই।

৬| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৭:০৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ এটা লেখার জন্য| আরো বিস্তারিত জানতে চাইত চাই

৭| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৯:২৯

জাফরুল মবীন বলেছেন: আপনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই এ ধরনেরর বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞানকে সঠিক উপায়ে সমৃদ্ধ করে।

আরও লিখুন প্লিজ।

ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানবেন।

৮| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:১৭

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: ধন্যবাদ শেয়ার করবার জন্য। কিছু প্রশ্ন ছিলো, সেই সময়ের দৃস্টিকোন থেকে কিছু বললে খুশী হব। একটু পর ফিরে আসছি...

৯| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৫২

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন: একজন মুক্তিযোদ্ধার ব্লগে এসে তার বিরোচিত যুদ্ধের গল্প জেনে খুবই অভিভূত হলাম! বিনম্র শ্রদ্ধা!


নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা লিখার অনুরোধ রইল।

১০| ১৪ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:২৫

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: স্যার, এই পোস্টের সাথে হয়তো মেলেনা, কিন্তু তাও কিছু প্রশ্ন। যুদ্ধের সময়ের প্রেক্ষাপটে।

১। মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে তেমন কোন বিতর্ক নাই। যুদ্ধের সময় উনার ভুমিকা নিয়ে আপনার কিছু জানা আছে?

২। ভারত যদি সাহায্য না করতো একেবারেই, তাহলে স্বাধীনতা আসতে কতটা সময় লাগতো? অথবাআরো ৪-৫ বছরেও কি স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব ছিলো?

৩। মার্চে অন্য সব জায়গার মত ঢাকা ভার্সিটিতেও ম্যাসাকার হয়। কিন্তু তারপরেও বেশিরভাগ শিক্ষক কিন্তু ভারতে চলে যাননাই। তারা পুরটা সময়ই পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরী করে সেই সরকারের বেতন নিয়েছেন। এমনই করেছেন রেডিও, টিভি অথবা সিভিল সার্ভিসের বেশিরভাগ কর্মচারী। এইটাকে কেন ভিরুতা হিসেবে ধরা হবেনা? নাকি এটা ছিলো বিজয় কবে আসবে তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সময়ের সাথে চলার নীতি?

৪। রাজনৈতিক দৃস্টিকোন থেকে নয়, আপনি নিজে ঠিক কোন সময় উপলব্ধি করেছিলেন যে আর পাকিস্তান হিসেবে থাকা সম্ভব নয়? এবং কেন?

আরও কিছু প্রশ্ন আছে, এগুলার জবাব দিলে আরো বিরক্ত করবার ইচ্ছা আছে। ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.