নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখি না। তবে, মানুষ হয়ে মানুষকে ভুল বোঝা আমার স্বভাবে নেই, আপনার পেশা যাই হোক না কেন।

প্রসেনজিৎ হালদার

প্রসেনজিৎ হালদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

নীলের জন্য

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৫০

ছোট গল্প
লেখক : রিশান দিপু চৌধুরী

আমি দীপন মাহমুদ। একটি প্রাইভেট ফার্মে খুব ভালো একটা জব করি। বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য যা প্রয়োজন সবকিছুই আছে আমার জীবনে। তবে আমার জীবন একটা স্বাভাবিক রুটিনে বাঁধা। তবুও আমি ভীষণ খুশি। কী নেই আমার জীবনে, সবই রয়েছে। কিন্তু বেশি সুখ হয়তো বিধাতার কাছেও হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গত সাতদিনে আমার সাজানো গোছানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা কেউ যেন ছিড়ে-ফুড়ে খাচ্ছে। এই সময়টাতে আমি একবারের জন্যেও বাইরে যাইনি। হঠাৎ করে আমার পরিচিত কেউ দেখলে চিনতেই পারবে না আমিই তাদের গোছালো দীপন। হালকা দাড়িতে সারাটা মুখ ভরে আছে, মাথার চুল উশকোখুষকো। নাওয়া-খাওয়া প্রায় বাদ বললেই চলে। রাতে চোখজোড়া এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নিতে পারে না। চোখের পাতাগুলো যেন পণ করেছে আমরা কোনোমতেই ক্লান্ত হব না। কয়েকদিনের ব্যবধানে অফিস থেকে অসংখ্য বার ফোন এসেছিল। আমি ইচ্ছে করেই ধরিনি। সপ্তাহখানেক পর জব না করার ব্যাপারটি আমি মেইল করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সবাই খুব অবাক হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টা ঐ পর্যন্তই। কারণ চাকরি করা বা না করা একান্তই একজনের ব্যক্তিগত বিষয়। তবে একজন সেই ব্যাপারে নাক গলিয়েছিল। সাদিয়া, আমার অফিসেই কাজ করে। মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে, আমি প্রথমদিক থেকেই খেয়াল করতাম। কিন্তু প্রেম ভালোবাসার প্রতি আকর্ষণ কখনোই আমার ছিল না। তাই আমি ব্যাপারটা আমলেই নেইনি। মাঝে মাঝেই সাদিয়া কফি খাওয়া, ডিনার করার বাহানায় আমার সাথে বাইরে ঘুরতে যেতে চাইত। কিন্তু প্রতিবারই কাজের অজুহাতে আমি এড়িয়ে যেতাম। সাদিয়া একটা সময় আমার উপর বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। হাজার চেষ্টার পরেও যখন সে আমার মনে ভালোবাসার ফুল ফোটাতে ব্যর্থ হয় তখন লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন অফিসের সবার সামনেই একগুচ্ছ গাঁদা ফুল নিয়ে আমায় প্রপোজ করে বসে, "আই লাইক ইউ ইভেন লাভ ইউ। উইল ইউ ম্যারি মি?" আমি সবাইকে সকড করে দিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই সাদিয়াকে রিফিউজ করি। আমার এমন জবাবে মেয়েটা সেদিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। সে কল্পনাও করতে পারেনি তার মত সুন্দরী মেয়েকে কেউ হেলা করতে পারে। আমি জানিনা আমি কি করেছিলাম। তবে সাদিয়া সেদিন খুব অপমানিত হয়েছিল। কেন যেন আমারও খুব খারাপ লাগছিল। টানা তিনদিন অফিসে এসেছিল না মেয়েটা। হয়তো, জব ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কলিগরা বোঝানার পর আবার কাজে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু আগের মত আর হাসি-খুশি ছিলনা। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। আমাকেও আর ডিস্টার্ব করতনা। সেই থেকে সাদিয়া আমাকে দেখেও দেখত না। আমিও আমার মতই কাজ করে যেতাম। ব্যাপারটা এমন তার সাথে আমার কিছুই ঘটেনি। সেই সময় আমি অফিসের সিনিয়র জুনিয়ার সকল কলিগদের কাছ থেকে রোবটের উপাধি পেয়েছিলাম। লুকিয়ে তারা আমাকে রোবট বলত। আমার মাঝে নূন্যতম আবেগ বলতে নাকি কিছু ছিলনা। আমিও মেনে নিয়েছিলাম। কারো কথায় কান দিতাম না। মাস দুয়েক এভাবেই চলতে থাকে। সবাই প্রায় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঘটনাটি। সাদিয়াও কাজে ব্যস্ত থাকে। আমাকে নিয়ে যে উৎসাহ তার মধ্যে ছিল সেটা হারিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ, আমি প্রমোশন পেয়ে যাই। সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। তবে সাদিয়ার কাছ থেকে অভ্যর্থনা পাবার আশা আমি নেহায়েতই করছিলাম না। কিন্তু মেয়েটা অবাক করে আমায় বলেছিল, "গো এহেড দীপন। উইশ ইউ এ ভেরি ভেরি ব্রাইট ফিউচার।" কেন জানিনা, সেইদিন সাদিয়ার জন্য আমার মনের গভীরে এক ধরণের মায়া জন্ম নিয়েছিল। আমি তাকে অনেক অবহেলা করেছি, অনেক অপমান করেছি। যখন এসব ভাবতাম তখন নিজের কাছে নিজেকেই ছোট লাগত। পরেরদিন ধীরে ধীরে সাদিয়ার ডেস্কের দিকে এগিয়ে যাই। একটু সংকোচ হচ্ছিল। তাকে বাইরে লাঞ্চ করার জন্য অফার করি। সেদিন সে একটুও অবাক হয়েছিল না। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, কি উপলক্ষে ট্রিট? আমি বলেছিলাম ফর মাই প্রমোশন। ও...... সবাই যাচ্ছে তাহলে!!! কথাটি বলে নির্বাকভাবে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। সবাই না, শুধু তুমি। সাদিয়া হাসতে হাসতে জানতে চেয়েছিল, শুধু আমি!!! কিন্তু কেন??? তার মানে তুমি যাচ্ছ না, এই বলে আমি বেরিয়ে আসব তখন সাদিয়া একটু অভিমানী কিন্তু আদুরে গলায় বলেছিল আমি কী একবারও বলেছি আমি যাবনা। মনে মনে সেদিন যে কত্তটা খুশি হয়েছিলাম সেটা বোঝানো সম্ভব না।
এর পর থেকে আমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয় সাদিয়ার। কিন্তু সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্বের। আমি কেন জব ছেড়ে দিচ্ছি এটা জানতে সে অনেকবার ফোন করেছিল। মেয়েটি আমাকে ভালোবাসে। মিথ্যা বলব না, মেয়েটার জন্য আমার মনের ভেতরেও এক ধরণের সূক্ষ্ম অনুভূতির জন্ম নিয়েছে। হয়ত তার প্রতি আমার ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। আমি কেন চাকরি করব না সেটা জানতে বাসায় এসেছিল সাদিয়া। আমি তাকে ভেতরেই আসতে দেইনি। আমি চাইনি কেউ দেখুক আমার মত রোবট হৃদয়ের মানুষও ভেঙে পড়েছে। দরজার বাইরে ও দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলাম, "ডোন্ট ট্রাই টু ইরিটেইট মি অ্যান্ড স্টে মি অ্যালোন।" সাদিয়া একটুও রাগ করেনি সেদিন। সে বুঝতে পেরেছিল আমি কোনো সমস্যায় আছি। ঘণ্টাখানেক বাইরে অপেক্ষা করার পর যখন দেখল আমি দরজা খুলবনা, তখন চলে যাওয়ার আগে বলেছিল চাইলে তোমার প্রবলেম আমার সাথে শেয়ার করতে পারো; নিজেকে অনেকটাই হালকা মনে হবে। কিন্তু আমি পারিনি, কোনোভাবেই সাদিয়াকে বলতে পারিনি আমার অপরাধবোধের কথা।

দুই.
হয়ত আর কিছুক্ষণ পরেই মেঝেতে আমার দেহ নিথর হয়ে পড়ে থাকবে। আমার আপন বলতে কেউ নেই, হয়ত আমার কথা কেউ মনেই করবে না। সাদিয়া কয়েকদিন আপসেট থাকবে। পরে দেখতে দেখতে নিজেকে গুছিয়ে নেবে। অতীতের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে আজ। বাবা-মাকে খুব বেশি মনে পড়ছে। আমি যখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি তখন হঠাৎই এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা একসাথে মারা যান। সেদিন আমি নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রতিবেশী রহমান চাচা, সুমা আন্টি আরো অনেকেই বলেছিল একটু কাঁদ বাবা একটু কাঁদ। কিন্তু আমি কাঁদতে পারিনি। আমি শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। আজ খুব কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আমি তেমাদের অনেক ভালোবাসি। খুব মিস করি তোমাদের। আমি তোমাদের কাছে আসছি। খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের কাছে আসছি।

তিন.
এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারব না। সেদিন রাতে যদি আমি একটু সচেতন হতাম তাহলে আজ একটি নিরপরাধ নিষ্পাপ মেয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকত। আমি অপরাধী, বেঁচে থাকার যোগ্যতা আমি হারিয়ে ফেলেছি। দিন পনের আগের ঘটনা। অফিসের কাজ সেরে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। অফিস থেকে বের হব তখনই বস ফোন করেন। দীপন একটা জরুরী মিটিং হঠাৎ ফিক্সড হয়ে গিয়েছে। তোমাকে মিটিংটা অ্যাটেন্ড করতে হবে। এটা কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। নতুবা আমাদের প্রজেক্টটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। শরীরটা ক্লান্ত থাকা স্বত্বেও বসকে বলতে পারলাম না অন্য কাউকে দিয়ে কাজটা চালানো যায় কিনা। বস অনেক স্নেহ করেন আমায়। নিশ্চয়ই কোনো বড় প্রজেক্ট। তাইতো আমাকেই যেতে অনুরোধ করছেন। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সময়মত পৌঁছাতে হবে, গাড়ি বেশ জোড়েই ড্রাইভ করছি। ঠিকসময়ে পৌঁছাতে না পারলে নিজেকেই ছোট হতে হবে। আর নিজেকে ছোট হতে হয় এমন কাজ আমি কখনোই করব না। অ্যালান ওয়াকারের ডার্কসাইড গানটা শুনছি। বেশ ভালোই লাগছে। সত্যি বলতে গানটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি আমি। বারবার শুনি, তারপরেও শুনতে বেশ লাগে। গানের কথাগুলো জাস্ট অসাধারণ। হঠাৎ খেয়াল করি সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে ঈশারা করছে গাড়ি থামানোর জন্য। এত নির্জন জায়গায় একাএকা এই সময় কী করছে মেয়েটি। আমি গাড়ি থামাই। মেয়েটি যা বলে ব্যাপারটা সংক্ষেপে এমনঃ গ্রাম থেকে এসেছে মেয়েটি। একটা জব ইন্টারভিউ ছিল। সব কাজ শেষ করতে গিয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। এখন আমি যদি তাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেই তাহলে তার অনেক উপকার হয়। কিন্তু আমারতো খুব শ্রীঘ্র মিটিংটা অ্যাটেন্ড করতে হবে। এই সময় মেয়েটাকে সাহায্য করা উচিত। আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। আমি বললাম তোমার রাত হল কেন??? মেয়েটা অনেক খুশি হয়ে বলেছিল স্যার আমার চাকরীটা কনফার্ম হয়েছে।এটার জন্যই দেরী হয়ে গিয়েছে। আমি ফ্যামিলি বড় মেয়ে। আমার উপর অনেক দায়িত্ব। বাবা-মা যে কত্ত খুশি হবে!!! আমি মেয়েটাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এখান থেকে বাসস্ট্যান্ড যেতে প্রায় পঁচিশ মিনিট সময় লাগবে। আমি কি করব!!! আমি নিরুপায়। তাই মেয়েটাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। মেয়েটাকে হতাশ দেখালো। আমি বললাম দেখ বোন আমি অনেক দুঃখিত তোমাকে সাহায্য করতে পারছিনা। সে বলল আপনি সরি বলছেন কেন স্যার। আমি আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি। কিন্তু এই জায়গাটা বেশ নির্জন আর কোনো গাড়িও দেখছিনা। মেয়েটার গলার স্বর খুব অসহায় শোনায়। বুঝতেই পারছেন আমি শহরে নতুন, অচেনা জায়গা। মেয়েটার কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগছিল। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আচ্ছা বোন চল তোমাকে পৌঁছে দেই। কিন্তু আমিও আমার ক্যারিয়ারের কাছে বাঁধা। মিটিংটা মিস করলে প্রজেক্টটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এমনকি, আমার চাকরিও চলে যেতে পারে। মেয়েটার ডাকে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। আচ্ছা স্যার, আপনি যান। আপনাকে শুধু শুধু বিরক্ত করলাম। আমার সত্যি খুব খারাপ লাগছিল মেয়েটার জন্য। কেন জানি না মেয়েটাকে এই সময় একা ছাড়তে ইচ্ছা হচ্ছিলনা। আমি তোমাকে হেল্প করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু আমিও.......মেয়েটা আমার কথা শেষ হতে দেয়না। আমি আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি ভাইয়া। মেয়েটার মুখে হাসি দেখে অনেক ভালো লাগে। এই দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই বললেই চলে। মেয়েটা আমাকে ভাইয়া বলেছে। মনে মনে ভাবলাম মেয়েটাকে আগে ড্রপ করে আসি। চাকরির যা হবার হবে। কিন্তু আমি অনেক বাস্তববাদী। পারলাম না, গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পেছনের দিকে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা সামনে আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। কাজটা সম্পন্ন হয়েছে। বস আমার উপর অনেক খুশি। প্রজেক্টটা আমরা পাচ্ছি। আজ শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। বসকে বলে কাল ছুটি নিতে হবে। হঠাৎই মেয়েটার কথা মনে পড়ল। নামটাও জানা হয়নি মেয়েটার। একটু সামনে এগোতেই দেখি রাস্তার মধ্যে অনেক মানুষের ভিড়। ধূর!! কে জানে যেতে কতক্ষণ লাগবে। বিরক্ত লাগছে এখন। গাড়ি থেকে নেমে একজনকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে এখানে। লোকটা বলে একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে।মেয়েটার অবস্থা খুব খারাপ। অনেক ব্লেডিং হয়েছে। লোকটার কথায় মেজাজটা চরমে উঠে যায়। আমি প্রায় ধমকের স্বরে বলি, আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন। মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন??? কেউ একজন বলে শুধু শুধু ঝামেলায় জড়িয়ে কি লাভ। এগুলো পুলিশ কেস, পুুলিশ এসেই দেখবে। আমি কথা না বাড়িয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাই। দেখি রাস্তায় পড়ে আছে মেয়েটি। এখনও জীবিত, গোঙরানির আওয়াজ আসছে। মেয়েটা সম্পূর্ণ নগ্ন, একফোঁটা সুতোও নেই শরীরে। সারা শরীর রক্তাক্ত। দেখে মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র জানোয়ার মেয়েটাকে ছিড়ে-ফুড়ে খেয়েছে। আরেকটু এগিয়ে ভালোভাবে মেয়েটাকে দেখতেই আমার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। আরে...এতো সেই মেয়েটিই। আমার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসে। লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। কেউবা ছবি তুলছে আবার কেউ কেউ ভিডিও করছে।ফেসবুকে ঘটনাটি বর্ণনা দিয়ে আপলোড দিতে হবে। এতে মানুষের সস্তা সিমপ্যাথি পাওয়া যায়। আমি আর ঠিক থাকতে পারিনা, নিজের উপর কন্ট্রোল হারাই। কুত্তার বাচ্চারা মেয়েটা এখন জীবিত। কেউ ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলিনা। আমি যতটা সম্ভব মেয়েটার দেহ ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার কথায় কিছু লোক এগিয়ে আসলো। ধরাধরি করে মেয়েটাকে আমার গাড়িতে উঠালাম। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। আমি পাগলের মত চিৎকার করছি। আমি তোর কিছু হতে দেবনা বোন। মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ খুলে....."ভাইয়া" অস্ফুট স্বরে বলার পর জ্ঞান হারায়। আমি যত দ্রুত সম্ভব মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তার বলেন অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। কোইনসেডিন্সলি আমার সাথে মেয়েটির ব্লাডগ্রুপ ম্যাচ করে। আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও ওকে বাঁচাতে হবে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করে মেয়েটি আমার কি হয়??? আমার বোন, ও আমার বোন। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমার বোনকে বাঁচাতে হবে। ডাক্তার আমাকে শান্ত হতে বলেন। কিন্তু আমি কোনোভাবেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছিনা। তিনঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে মেয়েটির। তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। অবস্থা আশংকাজনক।আমি পাশে গিয়ে বসি। ভাইয়া আমার নাম নীল, মেয়েটি ঠিকমত কথা বলতে পারছি।
আমি যতটা সম্ভব নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করে বললাম আমি তোর কিছু হতে দেবনা বোন। তোর কিছু হলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবনা। ভাইয়া তুমি এমন করে বলোনা। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই আমি বুঝতে পারছি। তুমি নিজেকে দোষ দিওনা। আমার শুধু কষ্ট হচ্ছে মা-বাবার কথা ভেবে। তারা যখন জানবে তাদের মেয়ের সাথে কি ঘটেছে তখন তাদের কি অবস্থা হবে। তারা কেমন করে বাকি জীবনটা পার করবে। নীল কথাগুলো বলছে আর ওর চোখের কোনায় জল দেখতে পাচ্ছি আমি।আমি নীলের চোখে চোখ রাখতে পারছিনা।আমি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। তোর কিচ্ছু হবে না বোনটি। তোর ভাইয়া আছে না। বাবা-মায়ের চিন্তা এখন থেকে তোর ভাইয়ার। আমি তোকে কথা দিচ্ছি। কথা দিচ্ছি, তোর ভাইয়া এখন থেকে তোকে চোখে চোখে রাখবে। জীবনে একটা ভাইয়ার অনেক অভাব ছিল,সেই দুঃখটা আজ আর নেই। নীল হাসিমুখে কথাগুলো বলছে। তবে আফসোস ভাইয়ার ভালোবাসা আমার জন্য দীর্ঘস্থায়ী হলোনা। তোমার মত একটা ভাইয়ের ভালাবাসা পেতে হলে সত্যিই অনেক কপাল করে জন্ম নিতে হয়। তবে শেষবেলায় তোমার মত ভাইয়ার কোলে মাথা রেখে মরতে পারব এটাই অনেক বড় একটা পাওয়া। নীলের ঠোঁটের কোণায় একচিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। তারপর নীলের দেহটা নিথর হয়ে যায়। আমি সেদিন কান্না করেছিলাম, অনেক কান্না করেছিলাম। বোনটাকে গ্রামের বাড়িতে অন্ধকার ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসি আমি। নীলার বাবা-মা ক্ষণে ক্ষণে মূর্চ্ছা যাচ্ছে। আমার জীবনের সব সঞ্চয় তাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি শহরে ফিরে আসি।
সেদিনের ঘটনা আমাকে মুহূর্তে মুহূর্তে যন্ত্রনা দিচ্ছে। আমি এই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবনা। চাকু নিয়ে হাতের নার্ভগুলো কেটে ফেলি। দুই হাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। নীল, বোন আমার.... আমি আজ সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব। ধীরে ধীরে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। সাদিয়ার ছবিটাও এখন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মেয়েটাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। বলা হলোনা। আমাকে ক্ষমা করে দিও সাদিয়া। আমি বুঝতে পারছি আমার ফোনে রিং হচ্ছে। ফোনটা হাতে নিলাম, জীবনের শেষ ফোন। জানিনা কথা বলতে পারব কিনা!!! ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো শব্দ ভেসে আসছে। হ্যালো....গলার স্বর অস্পষ্ট, আমি আর বলতে পারছিনা। দীপন.... দীপন কি হয়েছে তোমার??? ওপাশ থেকে সাদিয়ার কণ্ঠ আসছে। দুইচোখে অন্ধকার দেখছি, হয়তোবা এটাই মৃত্যু।

# শেষকথা : যখন আমি চোখ খুলি, দেখি সাদিয়া আমার পাশে বসা। চোখদুটো কান্না করতে করতে ফুলে গিয়েছে। জানিনা কয়দিন অজ্ঞান ছিলাম। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে সাদিয়া হু হু করে কেঁদে উঠে। কিন্তু এটা কষ্টের কান্না না, আমি জানি এটা আনন্দের কান্না। সাদিয়া জানতে চায় কি হয়েছিল। আমি সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলি। আমি নীলকে বাঁচাতে পারনি সাদিয়া। আমি আমার বোনটাকে বাঁচাতে পারিনি। তুমিতো শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছো। সাদিয়া আমাকে শান্ত হতে বলে। তুমি না নীলকে কথা দিয়েছ তার বাবা-মাকে দেখবে। তোমাকে বাঁচতে হবে দীপন। তাদের জন্য বাঁচতে হবে। আমি সাদিয়ার কোলে মাথা গুঁজে কান্না করতে থাকি।
নীল নেই তাও প্রায় সাতবছর হয়ে গিয়েছে। আমার সাথে সাদিয়াও চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। আমরা গ্রামে চলে আসি। নীলের বাবা-মা আজ আমাদের বাবা-মা। খুব সুখে আছি। সাজানো গোছানো আমাদের সংসার। শুধু বোনটাই নেই। সাদিয়া আর আমার সংসারে ফুটফুটে একটা মেয়ে এসেছে। দেখতে অনেকটাই নীলের মত। সাদিয়া তার মেয়ের নাম রেখেছে নীল।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৭:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: নীল আর সাদিয়ার গল্প ভালো লাগলো। আসলে দুনিয়ার সমস্ত বাবা মায়ের উপর আমাদের সকলের দায়িত্ব আছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.