![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শ্রীরামসি গ্রাম । এর মধ্যস্থলে বাজার, উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাক ঘর, তহসিল অফিস, মাদ্রাসা প্রভৃতি বিদ্যমান থাকায় বহুসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী শিক্ষক ব্যবসায়ীর বসবাস এইগ্রামে । ভৌগোলিক দিক দিয়েও গ্রামটির গুরুত্ব অত্যধিক । পূর্বদিকে বিশ্বনাথ থেকে পশ্চিম দিকে জগ্ননাথপুর পর্যন্ত যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে শ্রীরামসি গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটি খাল । একাত্তরের ২৫ মার্চের পর জগন্নাথপুরের পূর্বাঞ্চল তথা শাহারপাড়া, মিরপুর, শ্রীরামসি গ্রাম অনেকদিন পর্যন্ত মুক্ত ছিল । এখানকার ব্রিটেন প্রবাসী বিপুল সংখ্যক বাঙালি হাজার হাজার পাউন্ড চাঁদা সংগ্রহ করে মুজিবনগরস্থ অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন সেই সময় ।
পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সামরিক অভিযানের সূচনা থেকেই নীল নকশা আঁকছিল জগ্ননাথপুরের পূর্বাঞ্চল আক্রমণের । সেই নকশা অনুযায়ী ২৯ আগস্ট শ্রীরামসি গ্রামে আসে দুজন রাজাকার । বাড়ি তাদের চিলাউরা গ্রামে ।তাদের একজনের নাম মগনাম উল্লা অন্যজনের নাম আব্দুল ওয়াতির । এসেই তারা গ্রামের যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানায় । গ্রামের মুক্তিপাগল বাঙালি সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এবং সেই দুই রাজাকারকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয় । বিতাড়িত হয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীকে এর পরিণাম ভাল হবে না বলে শাসিয়ে যায় । গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক । পাকসেনাদের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় অনেক মানুষ । কিন্তু এত অল্প সময়ে স্ত্রী , পুত্র , পরিজন নিয়ে সবাইকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না । অধিকাংশ লোকই রয়ে যায় গ্রামে।
৩১ আগস্ট সকালে গ্রামের ভেতর খাল দিয়ে পাকিসেনাদের বেশ কয়েকটি নৌকা এসে ভিড়ে শ্রীরামসি গ্রামে । সাথে বেশ কয়েকজন রাজাকার । সকাল দশটার দিকে তারা পুরো গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে ।
শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়
শান্তি কমিটি গঠনের নাম করে গ্রামবাসীকে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানায় । যারা তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি তাদেরও অস্ত্রের মুখে ধরে এনে জড়ো করা হয় হাইস্কুলে । দুইটি দলে ভাগ করা হয় তাদের । একটি দলে গ্রামের সব যুবক এবং অন্য দলে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও প্রবীণ । পিছন দিক থেকে হাত বেধে তাদের ঢুকানো হয় স্কুল ঘরের দুটি কক্ষে । প্রবীণদের কাছে জানতে চায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের নাম, তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হায়েনার দল আর হিংস্র রুপ ধারন করে । তারা গিয়ে ঢুকে দ্বিতীয় কক্ষে, পিছন দিকে হাত বাধা যুবকদের তারা আর দুইটি দলে ভাগ করে একটি দলকে নিয়ে যাওয়া হয় স্কুলের পাশে রসুলপুর পাড়ার মছরম উল্লার বাড়িতে । তাদের লাইন বেধে দাড় করানো হয় । কিছুক্ষনের মধ্যেই যে তারা স্বাধীনতার বলি হতে যাচ্ছেন তা বুঝতে বাকি রইল না এই নিরহ অসহায় লোকদের । জীবন বাচাতে শেষ চেষ্টা হিসাবে ছয়জন নিজেদের মুসলিম লীগের কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন । সৌভাগ্যক্রমে পাকবাহিনীর সাথে থাকা দালালদের একজন ছিল তাদের আত্মীয় । সেই দালালের সহযোগীতায় শেষ পর্যন্ত প্রাণ ভিক্ষা পান তারা, সমস্ত বাজার তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিবেন এই শর্তে । তবে মুক্তি পাওয়ার পর শর্ত পুরন না করেই সুযোগ বুঝে পালিয়ে যান তারা । অতি কষ্টে বন্ধনমুক্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচেন আর কয়েকজন তারা হলেন জওয়াহিদ চৌধুরী , হুসিয়ার আলী , ডা আবদুল লতিফ প্রমুখ । বাকিরা পাকসেনাদের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে ।
দ্বিতীয় দলটিকে নিয়ে যাওয়া হয় নজির মিয়ার পুকুর পাড়ে । সবাইকে লাইনে দাড় করিয়ে চালানো হয় গুলি । স্বাধীনতার জন্য শহীদের খাতায় নাম লেখালেন আর কয়েকজন, তাদের নিথর দেহ পড়ে রইল পুকুর পাড়ে । উভয় গ্রুপের গুলিবিদ্ধ অবস্তায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে যারা বেচে গিয়েছিলেন, তারা হলেন ছফিল উদ্দিন ( দীঘির পাড় ), আবদুল লতিফ ( ডাকঘরের নৈশ প্রহরী ), তপন চক্রবর্তী ( নিহত তহসিলদারের পুত্র ) প্রমুখ ।
গ্রামের দুটি স্থানে গণহত্যা চালানোর পর পাক হায়েনারা ঢুকে পড়ে গ্রাম ও বাজারে, ইচ্ছামত লুটপাটের পর গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি এবং পুরো বাজার তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় । সারাদিন নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ফিরতি পথে শ্রীরামসি গ্রামের পশ্চিমের হাওর থেকে একটি নৌকা থেকে একজন যুবতী মহিলাকে তুলে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী । এই হতভাগ্য মহিলার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা পরে আর জানা যায়নি ।
সেদিন গ্রামে আর কোন লোক থাকেনি । পরদিন ও ভঁয়ে গ্রামে ফিরেনি কেউ । শহীদদের লাশ গুলি পড়ে থাকে একই জায়গায় । দুদিন পর আশপাশের কিছু লোক সাহস সঞ্চয় করে আসে শ্রীরামসি গ্রামে । তারা শনাক্ত করে কিছু লাশ । ডেকে আনে তাদের আত্মীয় স্বজনদের । তাদের সহযোগীতায় লাশ গুলি দাফন করা হয় দীঘিরপাড় নামের গোরস্তানে ।
সেদিন কতজন গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই । যাদের লাশ শনাক্ত করা হয়েছিল তারা হলেন – ছাদ উদ্দিন আহমদ ( ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয় ), মাওলানা আবদুল হাই ( হেড মৌলবী , শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয় ), এহিয়া চৌধুরী ( তহসিলদার ), সত্যেন্দ্র নারায়ন চক্রবর্তী ( তহসিলদার ), সৈয়দ আশরাফ হোসেন ( পোষ্ট মাস্টার ), শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, আলা মিয়া, সমুজ মিয়া, নজীর মিয়া, আবদুল মান্নান ( হবিব পুর ), ওয়ারিছ মিয়া, মানিক মিয়া, আবদুল জলিল ( সাত হাল ), ছবির মিয়া, মরম উল্লা, মমতাজ উল্লা, ছওয়াব উল্লা, রইছ উল্লা, আবদুল মজিদ, আবদুল লতিফ ( সাত হাল ), এখলাছ মিয়া, মোক্তার মিয়া, আবদুল বারি ( ইউপি সদস্য ), উছমত উল্লা, তৈয়ব উল্লা, বাক্কু মিয়া, মছদ্দর আলী, তফাজ্জল আলী, আছাব মিয়া, ছমির আলী, রওয়াব আলী, জহুর আলী, আবদুল হান্নান প্রমুখ । বাকি নামগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি । তবে সেদিন মুসলমান নামধারী নরপশুদের হাতে ১০০ জনেরও উপর শহীদ হয়েছিলেন বলে গ্রামবাসীর ধারনা । স্বাধীনতার পর পাকবাহিনীর সাথে দালালির অভিযোগে আবদুল খালিক ও ময়না মিয়া নামে দুজন রাজাকার গ্রেফতার হলেও পরে তারা ছাড়া পায় ।
শহীদদের স্মৃতির উদ্দ্যেশে নির্মিত শ্রীরামসি গ্রামের ভিতর স্মৃতি সৌধ
তথ্য সুত্রঃ- সিলেটে গণহত্যা, তাজুল মোহাম্মদ ।
বধ্যভূমির গদ্য, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ।
©somewhere in net ltd.