![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদদের স্মৃতির উদ্দ্যেশে নির্মিত জগন্নাথপুর সদরে স্মৃতি সৌধ
জগন্নাথপুর সুনামগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। ভাটি অঞ্ছলের এই জনপদের জনগন বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত আন্দোলন-সংগ্রামে যেমন গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি একাত্তরে আমাদের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মহান মুক্তিযুদ্ধেও রেখেছে অবিস্মরণীয় অবদান। একাত্তরে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পাকবাহিনীর বর্বরতা যখন ছড়িয়ে পড়েছিল শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। বাঙালিরা যখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে লিপ্ত, তখনও এই একালার জনগন ঘরে বসে থাকতে পারেনি। উপজেলার মুক্তি পাগল বিপুল সংখ্যক ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, কৃষক, আইনজীবি হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেদিন ঝাপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে। কিন্তু তার জন্য তাদের দিতে হয়েছিল চরম মূল্য। একাত্তরের নয়টি মাস উপজেলার অনেক গ্রামগুলোতে চলে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের তান্ডবলিলা। হত্যা করা হয় অসংখ্য নিরহ ও নিরপরাধ লোককে। পাক হায়েনারা ৩১ আগষ্ট শ্রীরামসী ও ১ সেপ্টেম্বর রানীগঞ্জ বাজারে আমাদের দেশীয় কুলাঙ্গার রাজাকারদের সহযোগিতায় সংগঠিত করে ইতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংস দু’টি গণহত্যা। শত শত মানুষকে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে সেদিন হত্যা করেছিল তারা। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে দুঃস্বপ্নময় সে দিনগুলির কথা প্রায় অজানা। তাদের জন্যই এখানে অন-লাইনের বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ দুটি গনহত্যার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্ঠা করেছি।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে সিলেট থেকে বিশ্বনাথ হয়ে নৌকাযোগে ১০৮ জনের এক কোম্পানী পাক হানাদার বাহিনী জগন্নাথপুর আসে। জগন্নাথপুর এসেই কারফিউ জারী করে থানাসহ সরকারি সকল প্রশাসনের অফিস তাদের দখলে নিয়ে নেয়। পরে স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের তৎপরতা চালায়। এ সময় উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আরেকটি উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটির কার্যক্রম সচল রাখার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে ক্যাম্প করা হয়। জগন্নাথপুর থানায় করা হয় পাক বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প।
পাক বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জগন্নাথপুর উপজেলার মুক্তিকামী লোকজন ৩১ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন পৌর শহরের ইকড়ছই গ্রামের বাসিন্দা জগন্নাথপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ হিরন মিয়া। যার দুঃসাহসিকতা ও সুযোগ্য নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মুক্তিকামী সাহসি যুবকদের দেশ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার জন্য সংগঠিত করা হতো। এ সময় দফায়-দফায় মোট ৭১ জন ব্যক্তিকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বালাট সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে রেজিষ্ট্রেশন করিয়ে ভারতের বিএসএফ এর অধীনে ইকো-ওয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দীর্ঘ এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে জগন্নাথপুর পৌর শহরের ছিলিমপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ হোসাইনকে কোম্পানী কমান্ডার করে ১৩০ জনের এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা দেশে ফিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বর তারা জগন্নাথপুর আসেন। জগন্নাথপুর এসেই তারা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। প্রথমে পাটলি ইউনিয়নের রসুলগঞ্জ বাজার অভিমুখে স্থানীয় রাজাকারদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১১ নভেম্বর সকাল ৬ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ দিক থেকে জগন্নাথপুর থানায় অবস্থিত পাক বাহিনীর প্রধান ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এ সময় পাক বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। মুহুর্মুহ গুলিবর্ষণে সর্বত্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে যুদ্ধ ছেড়ে পাক বাহিনী পালিয়ে যায়। ওই দিন বিকেলে মোট ২৪৭ জন রাজাকার অর্ধশতাধিক পাক সেনা ও ১ জন দারোগা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। মুক্তহয় জগন্নাথপুর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১১ নভেম্বর জগন্নাথপুর মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু জগন্নাথপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল কাদির শিকদারের মতে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর মুক্ত হয় জগন্নাথপুর উপজেলা ।এবং গত বছর থেকে ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথপুর মুক্ত দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে ।
মুক্তিযুদ্ধে এ উপজেলার গৌরবোজ্জল ভূমিকা রেখেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, সাবেক এম.পি এডভোকেট রইছ উদ্দিন, ব্যারিষ্টার মির্জা আব্দুল মতিন, মির্জা আব্দুস ছাত্তার, আবদূর রউফ কামালী, সুবেদার আবুল বশর চৌধুরী, হারুনুর রশীদ হিরণ মিয়া, নুরুল ইসলাম, রসরাজ বৈদ্য, ইন্তাজ আলী, সৈয়দ আতাউর রহমান, আব্দুল কাদির শিকদার, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল কাইয়ুম, আব্দুল হক, রঞ্জিত কান্তি দাস, আশরাফ আলী, জয়নাল আবেদীন, ধীরেন্দ্র কুমার দাস, গৌছ আলী, সায়দুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার, চিত্তরঞ্জন দাস, সৈলেন্দ্র নম সূদ্র, ইলিয়াছ আলী, গোবিন্দ কুমার দাস, ক্বারী নাছির উদ্দিন, আব্দুল মতিন, আব্দুল্লাহ খান, ননী গোপাল, চেরাগ আলী, নিশিকান্ত গোপ, গৌরাঙ্গ গোপ, আব্দুল হাফিজ, মানিক পাল, আলমাছ উল্লাহ, রনিন্দ্র, গোলাম মোস্তফা, ধীরেন্দ্র কুমার দে, বকুল ভট্টাচার্য সহ আরও অনেকে ।
গণহত্যা শ্রীরামসি
সুনামগঞ্জ জেলার জগ্ননাথপুর উপজেলার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শ্রীরামসি গ্রাম। এর মধ্যস্থলে বাজার, উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাক ঘর, তহসিল অফিস, মাদ্রাসা প্রভৃতি বিদ্যমান থাকায় বহুসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী শিক্ষক ব্যবসায়ীর বসবাস এইগ্রামে । ভৌগোলিক দিক দিয়েও গ্রামটির গুরুত্ব অত্যধিক। পূর্বদিকে বিশ্বনাথ থেকে পশ্চিম দিকে জগ্ননাথপুর পর্যন্ত যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে শ্রীরামসি গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটি খাল। একাত্তরের ২৫ মার্চের পর জগন্নাথপুরের পূর্বাঞ্চল তথা শাহারপাড়া, মিরপুর শ্রীরামসি অনেকদিন পর্যন্ত মুক্ত ছিল। এখানকার ব্রিটেন প্রবাসী বিপুল সংখ্যক বাঙালি হাজার হাজার পাউন্ড চাঁদা সংগ্রহ করে মুজিবনগরস্থ অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন সেই সময়।
পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সামরিক অভিযানের সূচনা থেকেই নীল নকশা আঁকছিল জগ্ননাথপুরের পূর্বাঞ্চল আক্রমণের । সেই নকশা অনুযায়ী ২৯ আগস্ট শ্রীরামসি গ্রামে আসে দুজন রাজাকার। বাড়ি তাদের চিলাউরা গ্রামে। তাদের একজনের নাম মগনাম উল্লা অন্যজনের নাম আব্দুল ওয়াতির। এসেই তারা গ্রামের যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানায়। গ্রামের মুক্তিপাগল বাঙালি সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এবং সেই দুই রাজাকারকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। বিতাড়িত হয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীকে এর পরিণাম ভাল হবে না বলে শাসিয়ে যায় । গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক । পাকসেনাদের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় অনেক মানুষ । কিন্তু এত অল্প সময়ে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন নিয়ে সবাইকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ লোকই রয়ে যায় গ্রামে।
শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়
৩১ আগস্ট সকালে গ্রামের ভেতর খাল দিয়ে পাকিসেনাদের বেশ কয়েকটি নৌকা এসে ভিড়ে শ্রীরামসি গ্রামে। সাথে বেশ কয়েকজন রাজাকার। সকাল দশটার দিকে তারা পুরো গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে। শান্তি কমিটি গঠনের নাম করে গ্রামবাসীকে স্থানীয় হাইস্কুলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানায়। যারা তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি তাদেরও অস্ত্রের মুখে ধরে এনে জড়ো করা হয় হাইস্কুলে । দুইটি দলে ভাগ করা হয় তাদের। একটি দলে গ্রামের সব যুবক এবং অন্য দলে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও প্রবীণ। পিছন দিকে হাত বেধে তাদের ঢুকানো হয় স্কুল ঘরের দুটি কক্ষে । প্রবীণদের কাছে জানতে চায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের নাম, তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হায়েনার দল আর হিংস্র রুপ ধারন করে। তারা গিয়ে ঢুকে দ্বিতীয় কক্ষে, পিছন দিকে হাত বাধা যুবকদের তারা দুইটি দলে ভাগ করে একটি দলকে নিয়ে যাওয়া হয় স্কুলের পাশে রসুলপুর পাড়ার মছরম উল্লার বাড়িতে। তাদের লাইন বেধে দাড় করানো হয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই যে তারা স্বাধীনতার বলি হতে যাচ্ছেন তা বুঝতে বাকি রইল না এই নিরহ অসহায় লোকদের। জীবন বাচাতে শেষ চেষ্টা হিসাবে ছয়জন নিজেদের মুসলিম লীগের কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। সৌভাগ্যক্রমে পাকবাহিনীর সাথে থাকা দালালদের একজন ছিল তাদের আত্মীয়।
সেই দালালের সহযোগীতায় শেষ পর্যন্ত প্রাণ ভিক্ষা পান তারা, তবে সমস্ত বাজার তারা নিজ উদ্যোগে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিবেন এই শর্তে। তবে মুক্তি পাওয়ার পর শর্ত পুরন না করেই সুযোগ বুঝে পালিয়ে যান তারা। অতি কষ্টে বন্ধনমুক্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচেন আর কয়েকজন তারা হলেন জওয়াহিদ চৌধুরী , হুসিয়ার আলী , ডা আবদুল লতিফ প্রমুখ। বাকিরা পাকসেনাদের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
দ্বিতীয় দলটিকে নিয়ে যাওয়া হয় নজির মিয়ার পুকুর পাড়ে। সবাইকে লাইনে দাড় করিয়ে চালানো হয় গুলি। স্বাধীনতার জন্য শহীদের খাতায় নাম লেখালেন আর কয়েকজন, তাদের নিথর দেহ পড়ে রইল পুকুর পাড়ে। উভয় গ্রুপের গুলিবিদ্ধ অবস্তায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে যারা বেচে গিয়েছিলেন, তারা হলেন ছফিল উদ্দিন ( দীঘির পাড় ), আবদুল লতিফ ( ডাকঘরের নৈশ প্রহরী ), তপন চক্রবর্তী ( নিহত তহসিলদারের পুত্র ) প্রমুখ।
গ্রামের দুটি স্থানে গণহত্যা চালানোর পর পাক হায়েনারা ঢুকে পড়ে গ্রাম ও বাজারে, ইচ্ছামত লুটপাটের পর গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি এবং পুরো বাজার তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সারাদিন নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ফিরতি পথে শ্রীরামসি গ্রামের পশ্চিমের হাওর থেকে একটি নৌকা থেকে একজন যুবতী মহিলাকে তুলে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। এই হতভাগ্য মহিলার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা পরে আর জানা যায়নি ।
সেদিন গ্রামে আর কোন লোক থাকেনি। পরদিন ও ভঁয়ে গ্রামে ফিরেনি কেউ । শহীদদের লাশ গুলি পড়ে থাকে একই জায়গায় । দুদিন পর আশপাশের কিছু লোক সাহস সঞ্চয় করে আসে শ্রীরামসি গ্রামে । তারা শনাক্ত করে কিছু লাশ। ডেকে আনে তাদের আত্মীয় স্বজনদের । তাদের সহযোগীতায় লাশ গুলি দাফন করা হয় দীঘিরপাড় নামের গোরস্তানে।
সেদিন কতজন গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই । যাদের লাশ শনাক্ত করা হয়েছিল তারা হলেন- ছাদ উদ্দিন আহমদ ( ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয় ), মাওলানা আবদুল হাই (হেড মৌলবী , শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয় ), এহিয়া চৌধুরী ( তহসিলদার ), সত্যেন্দ্র নারায়ন চক্রবর্তী ( তহসিলদার ), সৈয়দ আশরাফ হোসেন ( পোষ্ট মাস্টার ), শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, আলা মিয়া, সমুজ মিয়া, নজীর মিয়া, আবদুল মান্নান ( হবিব পুর ), ওয়ারিছ মিয়া, মানিক মিয়া, আবদুল জলিল ( সাত হাল ), ছবির মিয়া, মরম উল্লা, মমতাজ উল্লা, ছওয়াব উল্লা, রইছ উল্লা, আবদুল মজিদ, আবদুল লতিফ ( সাত হাল ), এখলাছ মিয়া, মোক্তার মিয়া, আবদুল বারি ( ইউপি সদস্য ), উছমত উল্লা, তৈয়ব উল্লা, বাক্কু মিয়া, মছদ্দর আলী, তফাজ্জল আলী, আছাব মিয়া, ছমির আলী, রওয়াব আলী, জহুর আলী, আবদুল হান্নান প্রমুখ। বাকি নামগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে সেদিন মুসলমান নামধারী নরপশুদের হাতে ১০০ জনেরও উপর শহীদ হয়েছিলেন বলে গ্রামবাসীর ধারনা। স্বাধীনতার পর পাকবাহিনীর সাথে দালালির অভিযোগে আবদুল খালিক ও ময়না মিয়া নামে দুজন রাজাকার গ্রেফতার হলেও পরে তারা ছাড়া পায়।
শহীদদের স্মৃতির উদ্দ্যেশে নির্মিত শ্রীরামসি গ্রামের ভিতর স্মৃতি সৌধ
গণহত্যা রাণীগঞ্জ
রাণীগঞ্জ জগন্নাথপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্তিত এই বাজারটি অত্র একালার একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। শ্রীরামসির ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরদিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সকাল এগারোটায় সময় পাক হানাদার বাহিনীর আগমন ঘটে রানীগঞ্জ বাজারে। এদের এখানে নিয়ে আসতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে কয়েকজন দালাল । এরা হলো- আছাব আলী, হবিবপুরের আহমদ আলী, রানীগঞ্জের মনোহর আলী ও রাজাকার ইয়াহিয়া। পাক সৈন্যদের সাথে ছিল অসংখ্য রাজাকার ও আলবদর। রানীগঞ্জ বাজারে নেমেই তারা সমস্ত বাজারটি ঘেরাও করে ফেলে। বাজার থেকে দুইশ’র বেশি লোককে ধরে বাজারের একটি স্থানে এক লাইনে দাড় করায় তারা। সারিবদ্ধ লোকজনকে ইতিমধ্যে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে তারা।
রাণীগঞ্জ বাজার
বাজার থেকে ধরে নেয়ার আগে নিরীহ ব্যবসায়ীদের শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলা হলেও লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করার আগ পর্যন্ত তাঁদের সাথে একটি বাক্যও বিনিময় হয়নি। পাকসেনাদের হাতের রাইফেল গর্জে ওঠার সাথে সাথে আনন্দের আতিশয্যে আপ্লূত হয় তাদের দলপতি সুবেদার সরফরাজ খান। তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হয় পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসর আবদূর রাজ্জাক, ইয়াহিয়া, আহমদ আলী, আছাব আলী, আসাদ মিয়া, মকদ্দুস মিয়া, ছমির উদ্দিন প্রমুখ । এদের প্ররোচনাতেই বেপরোয়া হয়ে উঠে সরফরাজ। তারপর সমস্ত বাজারে লাগিয়ে দেয়া হয় আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১শ’ ২৮টি দোকান, ধান ভাঙার কল, করাত কল এবং পবিত্র মসজিদও। প্রান হারালেন প্রায় দেড়শ’ লোক। তাদের মধ্যে যাদের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তারা হলেন- আনোয়ার হোসেন ও আকিল হোসেন (এরা ছিলেন সহোদর, বাড়ি গন্ধর্ব পুর), আলী পুরের মন্তাজ আলি, আকল মিয়া, ধন মিয়া (১), ধন মিয়া (২), নুর মিয়া(১), নুর মিয়া(২), বাসখয়নার মজমিল আলী, তছই মিয়া, সোনাহর মিয়া, মদরিছ উল্লা, আলতা মিয়া, আলফু মিয়া, আঃ হেকিম, ফজিল মিয়া, মিছির আলি, ইছুব আলী, জফর আলী, হাজি মোঃ মমিন, বোরহান উদ্দিন, আঃ আজিজ, গৌছল মিয়া, সিরাজুল ইসলাম, মাসুক মিয়া, মছব্বির মিয়া, মজিদ মিয়া, আঃ আজিজ, ছয়েফ উল্লা, হোসিয়ার আলি, মকবুল হোসেন, জলিল মিয়া, আব্বাস উল্লা, তাজু মিয়া প্রমুখ। বাকি লাশগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি । পাক বর্বররা সেদিন নির্বিচারে নিরস্র নিরপরাধ যে সমস্ত লোককে সুস্ত মস্তিস্কে হত্যা করেছিল তাদের নামধাম পর্যন্ত আজ বিস্মৃত। আমরা ভুলে গেছি তাদের আত্মত্যাগের কথা ।
স্মৃতির ফলকে লিখা শহীদদের নাম
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, পাকবাহিনীর লাগিয়ে দেয়া আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, লাশগুলি আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছিল কুশিয়ারা নদীর অথৈ জলে। ঠিক তখন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর এবং দালালদের পাশাপাশি এলাকার বহু লোকজন অংশ নেয় লুটপাটে।
নৌকা বুঝাই করে বাজারের মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর সুযোগ বুঝে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের কিছু ব্যক্তি বাজারে আসেন। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার আবুল বাশার চৌধুরীও আসেন। বহু লাশ তুলে নিয়ে তাঁরা পৌঁছে দেন তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন তারা। তবে অধিকাংশ লাশই বেওয়ারিশ হিসাবে ভেসে যায় কুশিয়ারা নদীর স্রোতে ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথেই মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রান দিতে হয় স্থানীয় দালাল মনোহর আলিকে। পালিয়ে প্রানরক্ষা করে আবদূর রাজ্জাক ও ইয়াহিয়া। মামলা দায়ের করা হয় হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সাধারন ক্ষমার সুযোগে পরবর্তীকালে এরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
রাণীগঞ্জ স্মৃতি সৌধ
তথ্য সুত্রঃ- সিলেটে গণহত্যা, তাজুল মোহাম্মদ ।বধ্যভূমির গদ্য, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও অন-লাইনের বিভিন্ন সোর্স ।ছবিঃ গুগল
©somewhere in net ltd.