নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন ভালো মানুষ

রাহাদ আবির

www.rahadabir.com গল্পকার। প্রকাশিত বই তিনটিঃ আমার দুই প্রেমিকা এবং টিকটিকি (২০০৭, গল্প সংকলন, ঐতিহ্য), মির্জা সাহিবান (২০০৭, অনুবাদ, ঐতিহ্য), ভাল বউ (২০০৮, অনুবাদ গল্প সংকলন, কথাপ্রকাশ)। ইমেইলঃ [email protected]

রাহাদ আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

টিকটিকি

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০০৭ সকাল ৮:০৩

টিকটিকিটা আমার সঙ্গি, সারাটা দিন বাসায় একলা থাকি, ও ছাড়া আর কে আছে?

কী যে তুমি কওনা, টিকটিকি আবার কারো সঙ্গি হইতে পারে নাকি! শোনো, এইটারে মাইরা ফালাই, বাথরুমের সুইচ টিপতে গেলেই বিরক্ত লাগতাছে।

না না, প্লিজ মাইরো না, টিকটিকি মারা ভালো না। এমনেই দেখবা সইরা গেছে।

ঝাড়ু হাতে নিয়া মারতে উদ্যত হয়েও শেষপর্যন্ত লাজুর আর্জি রাখতে গিয়া টিকটিকিটা আর মারা হয় না, যদিও ছোটবেলায় অনেক টিকটিকি মারছিলাম, বহুগুলার খালি লেজও খসাইছি। মারমু না কেন, নবীজী একবার কাফেরদের আক্রমণ থেকা বাঁচার জন্য একটা গুহায় গিয়া লুকায়, একটা বড় মাকরসা তখন গুহামুখ আকঁড়ে নবীজীরে প্রটেকশন দ্যায়; সেইখানে শালার গুহার ভিতরের টিকটিকিটা কিনা টিকটিক শব্দ কইরা নবীজীরে ধরাইয়া দিলো! দাদির মুখে এ গল্প শোনার পর টিকটিকি দেখলেই মারতাম। আর একটা টিকটিকি মারলে নাকি সত্তর নেকি সওয়াব পাওয়া যায়। তবে বাথরুম বা ঘরের ভিতর বড় বড় মাকরসা দেইখা ভয় লাগলেও মারতাম না। বড় হয়ে অনেক কুসংস্কারমুক্ত হইতে পারলেও ফ্রয়েড সাহেবের মতানুসারে শৈশবের বিশ্বাসের বৃত্ত ভাঙতে এখনো সংকোচ লাগে।

সকালে অফিস যাওয়ার সময় খেয়াল করছিলাম বাথরুমের সুইচের পাশের ইন্ডিকেটরটার উপর একটা টিকটিকি। বাথরুমের সাথে বেসিন, সুইচ টিপলে ওটা প্রি গতিতে বেসিনের আয়নার ফাঁকে ঢুকে যায়। তখন আমল দেই নাই, কিন্তু রাতেও বাসায় ফিরে টিকটিকিটাকে একইভাবে ইন্ডিকেটরে বসে থাকতে দেখে খটকা লাগল, হইছেটা কী? আশেপাশে এটা কোথাও ডিম পাড়ছে নাকি?

আচ্ছা, একটা জিনিস খেয়াল করছ, লাজুকে বলি, একটা টিকটিকি সকাল থেকা ঠিক এই জায়গাটায় বইসা রইছে। একটুও নড়ন-চড়ন নাই, খালি সুইচ টিপতে গেলেই দৌড় দ্যায়।

সকাল না, কালকে রাত থেকাই এরকম। তোমার তো কিছুই চোখে পড়ে না, লাজু টিপ্পনি দ্যায়, যাক, তবুও ভালো যে একদিন পর চোখে পড়ছে। ঘরে আমি যে একটা প্রাণি সারাদিন একলা থাকি মাঝে মাঝে সেইটাও তো ভুইলা যাও।

কী কথার কী উত্তর! ওকে বলাটাই ভুল হইছে। আমি টিকটিকিটাকে খুটিয়ে দেখতে থাকি। লাজুর নকিয়া এগারশ সেটে টর্চ আছে, ইন্ডিকেটরের ডান পাশের সকেটে টর্চ মেরে দেখি : না, ডিম জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে না।

আচ্ছা, তোমার বিয়ে করার দরকারটা কী ছিল বলো তো? সকাল আটটায় যাও, রাত নয়টা-দশটায় আসো। বিয়ের আগের আর এখনকার জীবনে আমি তো কোনো চেঞ্জ দেখি না, পার্থক্য খালি রাতে একসাথে ঘুমাই, তারচে' বিয়ের আগেই অনেক সময় দিতা।

ওহ, এমন বোকার মতো কথা বলো ক্যান? তুমি যেমনে কইতাছ মনে হইতাছে আমি ইচ্ছা কইরা বাইরে থাকি, তাইলে ঠিকাছে, তোমারে সময় দেয়ার জন্য এখন চাকরি ছাইরা দিয়া না খাইয়া থাকি, নাকি?

তারপর আইসাই শুরু হয় তোমার এমবিএ! বাসায় আইসাও আমার সাথে কথা বলার সময় থাকে না। লাজুর কণ্ঠ আদ্র হয়।

এখন তো বিবিএ-এমবিএ-র যুগ। এমবিএ-টা শেষ করতে পারলে আরো ভালো চাকরি পামু, বেশি বেতন পামু। অ্যাতো টাকা দিয়া ভর্তি হইলাম, পড়াশুনা না করলে তো ফেল করমু_ খামাখা টাকা নষ্ট কইরা লাভ আছে?

লাজু এবার শুয়ে পড়ে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কম্বল টেনে নেয়। বিয়েতে পাওয়া কম্বল_ লালের ওপর ক্রিম কালারের ফুল, পাতা, আর চিতার গায়ের মতো অসংখ্য ফোটা। অ্যাতো সুন্দর মখমলের মতো জিনিস আসলে গায়ে দিতে ইচ্ছা করে না, দেয়ালে টাঙ্গানো গেলে বেশ হতো। কম্বলাবৃত লাজুকে চমৎকার লাগছে, মনে হচ্ছে ফারকোট পরা জড়সড় কেউ।

শুধু শুধু কে কষ্ট করতে চায়, অফিস থেকে এমবিএ-র কাস শেষে বাসায় এসে আমার কি ইচ্ছা করে না তোমারে নিয়া একটা মুভি দেখতে বসি? যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! কথাটা মনে মনে রেখে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলি। ওর কথা চিন্তা করেই এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছিলাম, সিঙ্গেল থাকলে কার এইসব ঠেকা পড়ছিল! সন্ধ্যাবেলা বগল বাজাইতে বাজাইতে বন্ধুগো লগে আড্ডা মারতে যাইতাম। দেড়মাস হলো লাজুর ছোটবোনটার বিয়ে হইছে, জামাই কোটিপতি; ঢাকা শহরে বাড়ি আর জায়গার অভাব নাই, গাড়ি তিনটা। হানিমুনে গেছিল মরিশাস। নাজুর কাছ থেকে মরিশাসের গল্প শুনে কয়েকদিন শুধু ওই প্যাচাল পারছে। শুনে হিংসা হতো, রাগ তো লাগতই। শালার বাপের এরকম সম্পত্তি পাইলে আমরাও বউ নিয়া বাইরে মউজ করতে যাইতাম। নাজুর জামাইর নিজের কৃতিত্বটা কোথায়? বাপের বিশাল সম্পত্তি লাইরা-চাইরা খাইতাছে, এই তো? শেষে বিরক্ত হইয়া লাজুরে কথা দিলাম, শোনো যদি বাইঁচা থাকি তাইলে নাজুগো মতো আমরাও একবার মরিচ দ্যাশে যামু।

শ্বশুরবাড়িতে গেলে এখন শ্বাশুড়ির মুখে সারাদিনই নাজুর জামাইর প্রশংসা। মরিশাস থেকা দুই-চাইরটা জিনিস পাইয়া শ্বাশুড়ি একেবারে খুশিতে গদগদ। আসলে টাকাই সব!

টিকটিকিটার লেজটা এমন ক্যান? মনে হয় কাটা পড়ছে, না? লাজু চায়ের কাপ টেবিলে রেখে আমার মতামত প্রত্যাশা করে।

টিকটিকিটাকে তখন খুটিয়ে দেখছিলাম, ঈগলচোখে লেজের খুতটাও খেয়াল করছি, তাই টেবিলে বইয়ের মাঝে চোখ রেখেই উত্তরটা দিলাম, প্রথম দৃষ্টিতে তাই মনে হয় কিন্তু ভালমত তাকিয়ে দ্যাখো, লেজের শেষটা দ-য়ের মতো_ কাটা না।

খাওয়ার পরপরই সিগারেটখোরদের যেমন সিগারেট, আমার এক কাপ চা। অনেকের রাতে চা খেলে ঘুম হয় না, আমার বরং উল্টাটা। আগে অবশ্য এতো চা খেতাম না; বিয়ের পর বন্ধু-বান্ধবের সাথে কালেভদ্রে মদ খাওয়া তো ছাড়তে হইলোই, এমনকি বহু কষ্টে সিগারেটও। পৃথিবীতে নাকি কোনো কিছুর ধ্বংস নাই, শুধু রূপান্তর ঘটে। আগে যে আসক্তি ছিল সিগারেটের প্রতি, এখন তা চায়ের প্রতি।

হু। লাজু চশমা চোখে পর্যবেণ করতে থাকে।

ধুর, চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, একটা ঝারু নিয়া দুইটা বাড়ি দেও তো, খামাখা এইটা বিরক্ত করতাছে।

দেখছো, এ সামান্য টিকটিকিটাও বুইঝা গ্যাছে তুমি কতটা পাষাণ, কথাটা বলার সাথে সাথেই আয়নার তলে চইলা গ্যাছে।

লাজু টেবিলমুখি হয়ে বিছানায় এসে বসে। নিঃশব্দে আমাকে কিছুণ দেখে, তারপর থেকে থেকে বলে : অ্যাই, শোনো না, পড়া শেষ হয় নাই? চলো ঐ নাটকটা দেখি। কী হবে পইড়া, অ্যাতো টাকা দিয়া? জীবনে যদি আনন্দই না থাকলো! আমার নিরুত্তর মূর্তি দেখে এবার ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, টিকটিকিটা যেমন আয়নার তলে যায়, একদিন আমিও কোথাও চলে যাবো যাতে তুমি আর খুঁইজা না পাও। ভালোই হবে, কেউ তোমারে বিরক্ত করবো না, কাছে আসতে বলবো না; সারাদিন তোমার কাজ আর পড়াশুনা নিয়া ব্যস্ত থাকতে পারবা।

কিশোরী মেয়ের মতো আভিমানী কণ্ঠ আমাকে স্পর্শ করে, খোলা বইয়ের উপর পেপার ওয়েট চেপে চেয়ার ছেড়ে উঠি। বিছনায় লাজুর পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরি। হালকা গোলাপি রঙের কামিজটাতে ওকে সুন্দর লাগছে, একটু আগে মুখে পানি দেয়ায় গালের ত্বকে উজ্জ্বলতা, দুপুরে শ্যাম্পু করা সিল্কি-চুলে টিউবলাইটের আলো গড়িয়ে পড়ছে।ং কোমল গালে গাল ঘষে ঠোঁটে চুমু দিতে গেলে ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়, যাও, পড়তে যাও, আহাদ দেখাইতে হবে না। আমার কাছে আসলে আজকের মতো কালকের পরীায়ও সি গ্রেড পাইবা_ যাও পড়গা।

পাইলে পামু, তুমিই যদি না থাকো তাইলে ওইসব দিয়া কী করমু?

বেশ কিছুণ এইভাবে জড়িয়ে থাকলে লাজু কাঁধে মাথা এলিয়ে দ্যায়। নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর মাথায় হাত বুলাই, কিন্তু ভিতরে তাড়া অনুভব করি : বারোটা বেজে যাচ্ছে, ঘুমাতে হবে, পড়া তেমন হলো না, ফ্রিজে নাকি কিছু নাই, ভোরে উঠেই যাইতে হবে বাজারে, কালকে অফিসেও দৌড়াতে হবে আগে আগে_ চীন থেকে ডেলিগেট আসতেছে..।

আচ্ছা, তুমি আমারে একটা চাকরি দিতে পারো না? সারাদিন বাসায় একলা থেকে একসময় তো মানসিক রোগি হইয়া যাবো। লাজু মাথা উঠিয়ে আমার চোখে চোখ রাখে।

অনার্স পাস না করে কী চাকরি করবা, টুকটাক কিছু করা যায় কিন্তু ওইসব সামান্য বেতনের চাকরি করার চেয়ে না করাই ভালো। একটু থেমে নরম সুরে বলি, অনেক দিন তো ইউনিভার্সিটি যাওনা, ইয়ার ফাইনাল কবে? খোঁজ-খবর রাখতাছো?

কত দূর ইউনিভার্সিটি, যাইতে ভাল লাগে না; আগে তো যাহোক তুমি ছিলা, একলা লাগতো না।

ক্যান, তোমার বান্ধবিরা আছে না?

ওরা নিজেদের প্রেম নিয়া ব্যস্ত, লাজুর কথার তলে দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ ওঠে, আমার সাথে কথা বলার সময় পায় না।

আমার চোখে মৃতব্যাক্তির খোলা চোখের মতো শূন্যতা, ভাবতে থাকি কী করা যায় : লাজুর একাকীত্বের যন্ত্রণা লাঘবে কয়েকবার এর সমাধানকল্পে দুজনে মিলে কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হইছিল, যেমন_ প্রতি শুক্রবারে আমরা কোথাও ঘুরতে যাবো, অফিস শেষে যেদিন এমবিএ-র কাস থাকবো না বাসায় এসে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ওর সাথে সময় কাটাবো ইত্যাদি। দুই-তিন সপ্তা এইরকম চলার পর উৎসাহে ভাটা পড়ে। বাংলাদেশে প্রণীত অসংখ্য আইনের মতো আমাদের প্রকল্পও অকার্যকর হয়ে পড়ে।

লাজু হতাশাবাদী একজন মানুষ, জীবনের কোনো মানে ও খুঁজে পায় না, এ পৃথিবী, মানবজন্ম, বেঁচে থাকা সবকিছুই ওর কাছে বিষাদময়। বহুবার তর্কে জীবন সম্পর্কে আমি ওকে একটা পজিটিভ ধারণায় না আনতে পেরে শেষমেষ ফ্রয়েডের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ওর কৈশোর যে অবরুদ্ধতার ভেতর কেটেছে, ধর্মের যাতাকলে ওর সমস্ত ভালো লাগা, শখ যেভাবে পিষ্ট হয়েছে; মানুষের নিষ্ঠুরতা, কঠোর শাসন আর না-পাওয়ার বেদনাগুলো ক্রমে তাই ওকে জীবনবিমুখ করে দিয়েছে।

আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পৃথিবীটা কত সুন্দর, কত কিছু দেখার আছে এখানে, জীবনটাকে উপভোগ না করে, কিছুই না দেখে না করে তুমি চলে যেতে চাও?

এসব মিথ্যা স্বপ্ন দেইখা কী লাভ? লাজু বিষণ্ন গলায় তেতে ওঠে, ছোটবেলা থেকে কোনো স্বপ্নই আমার কখনো পূরণ হয় নাই, আমার সব স্মৃতিই খালি দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। ছোটবেলায় শিশু একাডেমিতে গানে ভর্তি করাইলো কিন্তু আমার নাচ ভালো লাগতো, গান বাদ দিয়া আমি নাচের কাস করতাম। আব্বা জানতে পাইরা একাডেমি যাওয়াই বন্ধ কইরা দিলো, কয়, মাইয়া মানুষ নাচ শিখখা কী করবি, নটী হইতে চাস, নটী? গানের জন্য বাসায় একটা হারমোনিয়াম ছিল, মাঝে-সাঝে বাজাইতাম, আব্বা তাবলিগ শুরুর পর ভাইঙ্গা ফালায়; খুব কষ্ট পাইছিলাম তখন। তারপর সময় কাটানোর জন্য ছবি আঁকতাম, একদিন আব্বা অনেকগুলা ছবি ছিঁড়া কয়, ছবি আঁকাআঁকি এসব অনৈসলামিক কাজ যেন না করি। এরপর আমার সময়ই কাটতো না, নিচের মাঠে অন্য মেয়েরা খেলতো আমি তাকাইয়া দেখতাম, আমার যাওয়া নিষেধ কারণ ততদিনে আমি সিয়ানা হইয়া গেছি, আর সিয়ানা মাইয়ার দৌড়-ঝাপ করা নিষেধ। আমি খুব চুপচাপ হইয়া গেলাম, নিজেরে শামুকের মতো গুটায়া নিলাম, বাস্তবতা থেকে দূরে সরে ধীরে ধীরে কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠলাম; সময় কাটাইতাম গল্পের বই পড়ে, আকাশ দেখে, জানালার পাশের গাছের সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলে। ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের জন্য স্কুল-কলেজে আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। এতটুকু বলে লাজু থামে, একটু হাসার চেষ্টা করে দীর্ঘ করে শ্বাস টেনে বলে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়া পর্যন্ত বই-ই ছিল একমাত্র সঙ্গি, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জাহাঙ্গীর নগরে ভর্তি হইতে গিয়াও অনেক কাঠ-খড় পোড়াইতে হইছে, ঢাবিতে চান্স পাই নাই, আব্বা কিছুতেই এতা দূরে ভর্তি করাইবো না। শেষে মা বড় চাচারে ধরে। আব্বা আবার বড় চাচার কাছে বিলাই, বড় চাচা অইসা আব্বারে ধমক দিলো, মানুষ ইউনিভার্সিটি চান্স পায় না, আর মেয়েটা চান্স পাইয়াও ভর্তি হইবো না ক্যা? কী এমন দূর সাভার? নবীজী বলে নাই, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও? আচ্ছা_, লাজুর কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করি, আমি তো ছোটবেলায় ছোট ভাই-বোনদের সাথে খেলতাম, তুমি নাজুর সাথে খেলো নাই?

লাজু ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসির রেখা তৈরি করে, নাহ, ও ছোটবেলা থেকাই মায়ের ফটোকপি_ সাজগোজ, পরচর্চা আর স্বার্থপর সব চিন্তা-ভাবনা নিয়া ব্যস্ত, ওর সাথে আমার কখনোই মিলতো না।



আচ্ছা, চুলে বিলি কাটা আমার আঙ্গুল থামিয়ে দিয়ে লাজু মাথা সোজা করে। দেশের থেকে আব্বা-আম্মাকে ঢাকায় এনে রাখলে কেমন হয়?

সেটা তো আমিও চাই। তাইলে তোমারও আর একা লাগতো না, কিন্তু যে ইনকাম তাতে দেড়রুমের এই ফাটের ভাড়া দিয়া, খাওয়া খরচ আর বিয়ার ধার শোধেই তো টাকা শেষ। তোমার ইচ্ছা হইলে তোমার বাড়িতে গিয়া তুমি থাকতে পারো, আমার আপত্তি নাই, কিন্তু প্লিজ, আমারে রাত্রে যাইতে বলবা না; তখন কয়দিন পর মানুষ ঘরজামাই ডাকতে শুরু করবো। গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে খানিক বিরতি দিয়ে বলি, তুমি যদি আর দেড়-দুই বছর বিয়েটা ঠেকাইয়া রাখতে পারতা.. তাইলে মাস্টার্সটা শেষ কইরা চাকরি করে টাকা-পয়সা জমাইয়া তারপর..,

এখন আমারে দোষ দাও ক্যান? তুমি বিয়া না করলেই পারতা। লাজু উত্তেজিত হয়।

থাক, এখন আর এইসব আলোচনায় লাভ কী।

অনেকণ কথা এগোয় না। দুজনেই নিশ্চুপ। রাস্তা থেকে কেবল থেকে থেকে ভেসে আসছে গাড়ি চলাচলের শব্দ।

আসো শুইয়া পড়ি, লাজুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসে।

অ্যাতো তাড়াতাড়ি? মাত্র 12টা বাজলো। বলেই মাথা উঠিয়ে লাজু আমাকে দেখে। ইস, তোমার দেখি ঘুমে অবস্থা খারাপ। ঠিকাছে, তুমি দাঁত ব্রাশ করো।

ঝপাঝপ দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, ঠোঁটে ভেজলিন মেখে, লাইট নিভিয়ে যখন কম্বলের তলায় গেলাম ততণে ঘুম কেটে গেছে। লাজু আমার সাথে লেপ্টে বুকের ওপর মাথা রাখে, আমারে একটু ঘুম পাড়াইয়া দেও না, তুমি তো একা একাই ঘুমাইয়া যাও। গলায় অসন্তুষ্ঠি মিশিয়ে বলে, কালকে শোয়ার এক-দেড় ঘন্টা পর ঘুম আসছে। বিয়ার আগে তো বলতা, তোমারে রাত্রে ঘুম পাড়াইয়া দিমু।

ঠিকাছে, চুলে হাত বুলাই, ঘুমাইতে চেষ্টা করো। চোখ বন্ধ কইরা চুপ কইরা থাকো, দেখবা এমনেই ঘুম আসবো।

লাজু চোখ বুজে ওর আজকে দেখা 'লাইফ ইজ বিউটিফুল' ছবির কাহিনী বলা শুরু করে। সেসব আমার কানে কিছুই ঢোকে না, আমি চুলে হাত বুলিয়ে চলি আর মাথায় কালকের চিন্তা-স্রোত ঘূর্ণি খায় : পড়া হইলো না, কালকের পরীায়ও সি পামু, ফ্রিজে কিছু নাই, ভোরে উঠেই যাইতে হবে বাজারে, অফিসে দৌড়াতে হবে আগে আগে_ চীন থেকে ডেলিগেট আসতেছে, মিজান ফোন করছে, ওর টাকাটা দিতে হবে..।





পৌষ 1412

(প্রকাশ : জনকণ্ঠ, 6 জানুয়ারি '06)





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.