![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাহাদত হোসেন খান
তারিখ: ১২ জানুয়ারি, ২০১৩
১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি পদদলিত করে মাত্র পাঁচ দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদ গ্রাস করে। হায়দরাবাদ দখলের সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন পলো। সর্বাত্মক সামরিক অপারেশন হলেও ভারতের কাছে এ অভিযান ‘পুলিশি অভিযান’ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় সৈন্যদের স্বাগত জানাতে ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর থেকে ভয়ার্ত জনতা রাজধানী সিকান্দারাবাদ মাঠে সমবেত হয়। বুটের তলায় পিষ্ট হওয়ার ভয়ে জনতা ভারতীয় সাঁজোয়া যানে ফুল ছিটিয়ে দেয়। জনতা স্লোগান দেয়, জয় হিন্দ, মহাত্মা গান্ধী কি জয়, পণ্ডিত নেহরু জিন্দাবাদ, সরদার প্যাটেল জিন্দাবাদ, জেনারেল চৌধুরী জিন্দাবাদ, হিন্দুস্তানি ফৌজ জিন্দাবাদ, ভারত মাতা কি জয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা নাগাদ কারফিউ জারি করা হয়। জনতা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়িঘরে ছুটে যায়। চার দিকে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। শুরু হয় একটি জাতির পরাধীনতার ইতিহাস। শক্তি প্রয়োগ করা না হলে হায়দরাবাদ আজো স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকত। ভারত এ দেশীয় রাজ্যে শুধু অন্যায় আগ্রাসন চালিয়েছে তাই নয়, ভারতীয় সৈন্যরা সেখানে নির্মম গণহত্যা চালায় এবং ধর্ষণে লিপ্ত হয়। প্রচারণার জোরে একটি কালো দিনকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার একটি উপাখ্যান। বিশ্ববাসী কথায় কথায় বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোস্লাভিয়া, সিয়েরালিয়ন ও রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যা এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি হলোকাস্টের ট্রাজেডি স্মরণ করে, স্মরণ করে না কেবল হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের গণহত্যা। আজ পর্যন্ত কোথাও কেউ হায়দরাবাদে গণহত্যার জন্য ভারতের বিচার দাবি করেনি। কাউকে ভারতের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতেও দেখা যায় না। কী বিচিত্র পৃথিবী!
হায়দরাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় এজেন্ট জেনারেল কে এম মুন্সী ছিলেন সব ঘটনার সাী। কিন্তু ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দ্য এন্ড অব অ্যান অ্যারাতে সব সত্য চাপা দিয়েছেন। ভারতীয়রা নিজেদের কৃত অপরাধ চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সত্য তার নিজের শক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পল হায়দরাবাদ সফরে গিয়ে সেখানে বিজয়ী ভারতীয় সৈন্য ও তাদের স্থানীয় হিন্দু দোসরদের গণহত্যার সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পান। তিনি তার দ্য এজ অব কলি শিরোনামে গ্রন্থের ২০৯-১০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘পুলিশি অভিযানে নিহতদের আনুমানিক একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে আমি উপলব্ধি করি। দিল্লিতে গণহত্যার রিপোর্ট এসে পৌঁছতে শুরু করলে নেহরু ‘তার ব্যক্তিগত মতাবলে’ নিজামের শাসনের কট্টর বিরোধিতাকারী ও কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য হায়দরাবাদের দু’জন মুসলমান এবং হিন্দু পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এ টিম হায়দরাবাদে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে নেহরু ও সরদার প্যাটেলের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা থাকায় এ তদন্ত রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্টের একটি অংশ ভারতের বাইরে পাচার হওয়া নাগাদ তা ছিল অপ্রকাশিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘হায়দ্রাবাদ : আফটার দ্য ফল’ শিরোনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থে এ উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থে ‘অপারেশন পলো-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং হায়দরাবাদ রাজ্যে সম্পত্তি দখল’ শিরোনামে একটি রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ রিপোর্টে হায়দরাবাদ রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা, গণধর্ষণ এবং নিরস্ত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধনে স্থানীয় হিন্দু গুণ্ডাদের পরিকল্পিত অপরাধের নির্মোহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা থেকে গোটা পরিস্থিতি আঁচ করা সম্ভব:
গাঞ্জোটি পায়গাঁও, ওসমানাবাদ জেলা : এখানে মুসলমানদের ৫০০ বাড়ি ছিল। গুণ্ডারা ২০০ মুসলমানকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী মুসলমানদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। মুসলমানেরা অরতি হয়ে গেলে গুণ্ডারা হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। সৈন্যরা মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করে। গাঞ্জোটির পাশা বাঈ বলেছেন, সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর পর গাঞ্জোটিতে গোলযোগ শুরু হয়। এখানকার সব যুবতী মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। ওসমান সাহেবের পাঁচ কন্যা এবং কাজী সাহেবের ছয় কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়। সাইবা চামারের বাড়িতে ইসমাইল সাহেব সওদাগরের কন্যাকে এক সপ্তাহ ধর্ষণ করা হয়। ওমরগাঁও থেকে সৈন্যরা প্রতি সপ্তাহে আসত এবং সারা রাত ধর্ষণের পর যুবতী মুসলিম মহিলাদের সকালে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হতো। মাহতাব তাম্বুলির কন্যাদের হিন্দুদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয়। বুর্গা জুলাহার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল একজনকে।
রিপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠার বর্ণনা অভিন্ন। তাতে বলা হয়, ‘পুলিশি অভিযানে’ হায়দরাবাদে মোট দুই লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নিহতদের এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য। রিপোর্টের বর্ণনা সত্যি হয়ে থাকলে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পাঞ্জাবে সংঘটিত গণহত্যার সাথে হায়দরাবাদে ‘পুলিশি অভিযানের’ রক্তগঙ্গাকে তুলনা করা যায়। কেউ হয়তো দুই লাখকে অতিরঞ্জিত মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এ হত্যাকাণ্ড ছিল ভয়াবহ। জাতিসঙ্ঘে ভারতীয় প্রতিনিধি দাবি করেছিলেন, নিজামের সৈন্যরা তাদের চৌকি পরিত্যাগ করার পর কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এ বিশৃঙ্খলাকালে হিন্দুরা নিজামের স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে কথিত তাদের দুর্ভোগের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নেহরু প্রকাশ্যে হায়দরাবাদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করলেও একান্তভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সরদার প্যাটেলের মন্ত্রণালয়ে নেহরুর পাঠানো একটি চিঠিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। চিঠিতে নেহরু উল্লেখ করেছিলেন, ‘তিনি শিউরে ওঠার মতো বিপুল মুসলিম হত্যাকাণ্ড এবং অবিশ্বাস্য মাত্রায় মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের রিপোর্ট পেয়েছেন। এসব ঘটনা পণ্ডিত সুন্দরলালের রিপোর্টের সার্বিক ধারণাকে সত্যি বলে প্রমাণ করছে।’
ইসলামি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক উইলফ্রেড কার্টওয়েল স্মিথও হায়দরাবাদে মুসলিম গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকান পর্যটক উইলিয়াম ডালরিম্পলের অনুরূপ মতামত দিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে হায়দরাবাদ সফর শেষে তিনি লিখেছেন, ‘রণাঙ্গনের বাইরে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপক ও নৃশংস দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। হাজার হাজার লোককে হত্যা এবং লাখ লাখ লোককে গৃহহীন করা হয়। অবশ্যই প্রতিহিংসা তাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে এ রাজ্যের মারাঠারা এবং অন্যান্য এলাকায় এখনো প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর স্বার বিদ্যমান। ‘পুলিশি অভিযানের’ পরবর্তী দিনগুলোর উপাখ্যান খুবই করুণ।’
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার রিপোর্ট প্রণয়নে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এ তদন্ত কমিটি নেহরুর কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ফাঁক ফোকর দিয়ে এ রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায়। মুসলিম দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসতার বিবরণ সংবলিত অতি গোপনীয় এ রিপোর্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
প্রতি,
০১. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি।
০২. মাননীয় রাজ্যমন্ত্রী, ভারত সরকার, নয়াদিল্লি।
মহোদয়,
ভারত সরকার আমাদেরকে হায়দরাবাদ রাজ্যে একটি শুভেচ্ছা সফরে যাবার জন্য অনুরোধ করে। আমাদের কাজ শেষ করে এখন আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করছি।
০১. পণ্ডিত সুন্দরলাল, কাজী আবদুল গফুর ও মাওলানা আবদুল্লাহ মিসরির সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদল ২৯ নভেম্বর হায়দরাবাদে গিয়ে পৌঁছে এবং ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নয়া দিল্লিতে ফিরে আসে। এ সময় আমরা রাজ্যের ১৬টির মধ্যে ৯টি জেলা, সাতটি জেলা সদর, ২১টি শহর ও ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম সফর করেছি। এ ছাড়া আমরা এ ধরনের ১০৯টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোকের সাাৎকার গ্রহণ করেছি।
প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ৩১টি জনসমাবেশ এবং হিন্দু, মুসলিম, কংগ্রেস সদস্য, জমিয়ত উলেমা ও ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের কর্মকর্তা, কয়েকটি শিাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ছাত্র, প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং হিন্দুস্তানি প্রচার সভার ২৭টি ঘরোয়া সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন।
আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তার সাাৎকার গ্রহণ করেছি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হায়দরাবাদের মহামান্য নিজাম, বেরারের মহামান্য প্রিন্স, মেজর জেনারেল চৌধুরী, মি. বাখলু, মুখ্য বেসামরিক প্রশাসক, স্বামী রমানন্দ তীর্থ, ড. মালকোত, রামচন্দ্র রাও, রামাচার্য, কে. বৈদ্য, ভেঙ্কট রাও, আবুল হাসান সৈয়দ আলী, নওয়াব আলী ইয়ার জং, নবাব জৈন ইয়ার জং, রাজা ধোন্দি রাজ, মাওলানা আবু ইউসূফ, মৌলভী আবদুল খায়ের ও মৌলভী হামিদউদ্দিন কামার ফারুকী।
এসব সমাবেশ ও সাাৎকারে আমরা দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বজায় রাখার মূল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। নিজেদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করার এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের কাছে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছি এবং হায়দরাবাদের জনগণের জন্য একটি ধর্মনিরপে সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। আমরা তাদের সামনে ব্যাখ্যা করেছি যে, ধর্মনিরপে সরকারে ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে তাদের সবাই সমান অধিকার ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সবার সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ নীতি বাস্তবায়ন করা হলো সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছি যে, পুলিশি অভিযানের আগে বা পরের ঘটনাবলি তদন্ত বা অনুসন্ধান করার জন্য কোনো কমিশন হিসেবে আমরা কাজ করছি না। আমরা এসেছি একটি শুভেচ্ছা মিশনে এবং আমাদের দায়িত্ব হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা। একই সঙ্গে আমরা যা প্রত্য করেছি এবং আমাদের সফরকালে যেসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি সেসব তথ্য আপনার নজরে আনা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের মতে, এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।
০২. ১৬টি জেলা এবং আনুমানিক ২২ হাজার গ্রাম নিয়ে হায়দরাবাদ রাজ্য গঠিত। এসব জেলার মধ্যে মাত্র তিনটি পুরোপুরি না হলেও বাস্তবে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ থেকে মুক্ত ছিল। রাজাকারদের তৎপরতাকালে এবং এ মিলিশিয়া সংগঠনের পতন ঘটার পর প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাজ্যটি আক্রান্ত হয়। অন্য চারটি জেলায় সাম্প্রদায়িক গোলাযোগ ছিল আরো মারাত্মক। তবে এ চারটি জেলার গোলযোগ অবশিষ্ট আটটি জেলার মতো এত শোচনীয় ছিল না। এই আটটি জেলার মধ্যে আবার সবচেয়ে তিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন। এ চারটি জেলায় পুলিশি অভিযানকালে এবং পরে ১৮ হাজারের কম লোক নিহত হয়নি। অন্য চারটি জেলা আওরঙ্গাবাদ, বীর, নলগুন্দা ও মিদাকে কমপে পাঁচ হাজার লোক জীবন হারিয়েছে। আমরা অত্যন্ত রণশীল হিসেবে বলতে পারি যে, পুলিশি অভিযানকালে এবং পরে গোটা রাজ্যে কমপে ২৭ থেকে ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। কর্তৃপ আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ওই আটটি জেলা সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমাদের প্রতিনিধিদলের সেখানে সফর খুবই জরুরি। অতএব আমরা ওই সব জেলায় আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি এবং আমরা বলতে পারি যে, পারস্পরিক শত্র“তা ও অবিশ্বাস প্রশমনে আমরা সফল হয়েছি। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সত্য যে, এই আটটি জেলার সবচেয়ে তিগ্রস্ত চারটি জেলা ছিল (ওসমানাবাদ, গুলবার্গ, বিদার ও নান্দেন) নেজামের স্বেচ্ছাসেবকদের মূল ঘাঁটি লাতুর হচ্ছে কাসিম রিজভির নিজ শহর। এখানে ধনাঢ্য কুচ্চি মুসলিম বণিকেরা বসবাস করত। এই বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ২০ দিনের বেশি হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল। ১০ হাজার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে আমরা সেখানে বড়জোড় তিন হাজার লোককে এখনো শহরে অবস্থান করতে দেখেছি। এক হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং বাদবাকিরা কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
০৩. প্রায় প্রতিটি তিগ্রস্ত এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা কেবলমাত্র হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, কোনো কোনো জায়গায় মহিলা ও শিশুরাও রা পায়নি। হত্যাকাণ্ডের পরে মহিলাদের ধর্ষণ ও অপহরণ (কখনো কখনো শোলাপুর ও নাগপুরের মতো রাজ্যের বাইরে ভারতীয় শহরে), লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মসজিদের প্রতি অসম্মান, বলপূর্বক ধর্মান্তর, বাড়িঘর ও জমিজমা দখল করা হয়। শত শত কোটি রুপি মূল্যের সম্পদ লুট ও ধ্বংস করা হয়েছে। তিগ্রস্তরা ছিল মুসলমান। এসব অসহায় মুসলমান ছিল গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু। নৃশংসতার জন্য দায়ী অপরাধীরা শুধু স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে নিগৃহীত ব্যক্তিরা ছিল তা নয়, হায়দরবাদের অমুসলিমরাও নয়। সীমান্তের বাইরের নিরস্ত্র ও অস্ত্রধারী ব্যক্তি ও দুর্বৃত্তরা হায়দরাবাদের অমুসলিমদের এ দুষ্কর্মে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের পর এসব দুর্বৃত্ত অনুপ্রবেশ করেছিল। আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, শোলাপুর ও ভারতের অন্য শহরের একটি সুপরিচিত হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বেশ কিছু সশস্ত্র ও প্রশিণপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কতিপয় স্থানীয় লোক এবং বাইরের কমিউনিস্টরা এসব দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছে এবং কোনো কোনো েেত্র তারা দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্ব দিয়েছে।
০৪. কর্তব্য আমাদেরকে এ কথাও বলতে বাধ্য করছে যে, আমাদের কাছে এ মর্মে নিঃসন্দেহে অকাট্য প্রমাণ আছে, বহু ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় পুলিশ লুটতরাজ এবং অন্যান্য অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের সফরকালে আমরা এমন তথ্য সংগ্রহ করেছি যে, সৈন্যরা মুসলমানদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালাতে হিন্দু জনতাকে উৎসাহিত এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় বাধ্য করেছে। একটি জেলা শহরে বর্তমান প্রশাসনের হিন্দু প্রধান আমাদের জানিয়েছেন, সশস্ত্রবাহিনী মুসলমানদের দোকানপাটে নির্বিচারে লুণ্ঠন চালিয়েছে। আরেকটি জেলায় সৈন্যরা একজন মুন্সেফসহ অন্যদের বাড়িঘর লুট করেছে এবং একজন তহসিলদারের স্ত্রীর সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে শিখ সৈন্যদের বিরুদ্ধে মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটানোর এবং অপহরণ করার অভিযোগ কোনোক্রমেই নগণ্য ছিল না। আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে যে, বহু জায়গায় সশস্ত্রবাহিনী লুণ্ঠিত সম্পদ, নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রৌপ্য নিয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট লুণ্ঠিত মালামাল জনতার হাতে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু সদস্য ছিল যারা সাম্প্রদায়িক আবেগ মুক্ত ছিল না। কেননা তাদের কেউ কেউ অন্যত্র তাদের আত্মীয়স্বজনদের ওপর নৃশংসতার কথা ভুলতে পারেনি।
পাছে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর কলঙ্ক আরোপ করার জন্য যাতে অভিযুক্ত করা না হয় সে জন্য আমরা আমাদের সুচিন্তিত মতামত রেকর্ড করেছি যে, হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও এ বাহিনীর অফিসাররা উঁচু মানের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য জ্ঞান বজায় রেখেছেন। আমরা জেনারেল চৌধুরীকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক পপাতিত্ব ছিল না। তিনি হলেন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ ও আগাগোড়া একজন ভদ্রলোক।
মুসলমানদের রায় এমন উদাহরণ আমাদের কাছে দেয়া হয়েছে যেখানে হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশী মুসলিম নর-নারীকে তাদের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে রা করেছে। কোনো কোনো পেশাজীবীদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত লণীয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু তাঁতীরা হিন্দুদের আক্রমণ থেকে মুসলিম তাঁতিদের রা করেছে এবং কখনো কখনো নিজেরা অনেক চড়া মূল্য দিয়ে (প্রাণহানিসহ) তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বহু হিন্দু অপহৃত মুসলিম মহিলাদের উদ্ধারে সহায়তা করেছে।
০৫. পুলিশি অভিযানের পরে এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের পতনের পরিণামে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ বেধে যায়। নেজামের স্বেচ্ছাসেবকেরা ছিল সরকার প্রতিষ্ঠার পথে কার্যকর অন্তরায়। হায়দরাবাদের মুসলমানদের কাছে একটি দায়িত্বশীল সরকার ছিল হিন্দু রাজের সমার্থক। কেননা এ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। এ সত্য অনুধাবনে মুসলমানদের বিলম্ব হয় যে, তাদের দুর্ভোগ হচ্ছে মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। স্বেচ্ছাসেবকদের আন্দোলনের প্রতি হায়দরাবাদের বিপুলসংখ্যক মুসলমানের সহানুভূতি ছিল। কেউ কেউ উন্মত্ততার প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে গিয়ে তাদের গোঁয়ার্তুমির জন্য চরম মূল্য দিয়েছে। তাদের গোঁয়ার্তুমি এমন ছিল যে, তাদের একজন আততায়ীর বুলেটে প্রাণ দেয়। তাদের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিরা এমন একটি বিশ্বাসে উৎসাহ বোধ করেছিল যে, তাদের পেছনে কর্তৃপরে সমর্থন আছে।
শেষ করার আগে আমাদেরকে মূল্যবান সহায়তা এবং স্বপ্রণোদিত সহযোগিতা করার জন্য হায়দরাবাদের সামরিক প্রশাসন, আমরা যেসব জেলা সফর করেছি সেসব জেলার সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, বিশিষ্ট নাগরিক এবং সবশেষে আমাদের দু’জন সচিব মি. ফারুক সায়ার ও পিপি আম্বুলকারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
লেখক : সাংবাদিক
©somewhere in net ltd.