নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গত ১৯শে এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘এক মুঠো অন্যের জন্য আদালতের দ্বারপ্রান্তে’ শিরোনামে চোখ আটকেনি এমন পত্রিকা পাঠক হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না । তবুও যারা খবরটি মিস করেছেন তাদের জ্ঞাতার্থে প্রতিবেদনটির সারাংশটি উল্লেখ করছি । চাদপূরের মিন্নত আলী ও শামছুন্নাহার দম্পতি চাঁদপুর আদালতে তার ছেলে মোঃ নুরুল আমীন ও পুত্রবধু জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে পিতামাতার ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তার জন্য মামলা করেছেন । মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, মিন্নত আলী এবং শামছুন্নাহার তাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বৈবাহিক জীবনে ১ ছেলে এবং ৪ কন্যার জনক-জননী । তারা ভিক্ষা করে চার মেয়ের বিবাহ দিয়েছন এবং নুরল আমীনকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন । লেখাপড়া শিখে নুরুল আমীন সেনাবাহিনীতে যোগদান করায় ভিক্ষুক মিন্নত আলী এবং শামছুন্নাহার একজন সৈন্যের গর্বিত পিতামাতা হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন । মোঃ নুরুল আমীন দুই বার জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদান করায় বেশ কিছু টাকা পয়সার মালিক হন । দ্বিতীয়বার মিশনের কাজ শেষে দেশে ফিরে নুরুল আমীন সেনাবাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফিরে আসেন । তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ীতে সার্বক্ষনিক অবস্থান করে স্ত্রী জেসমনি আক্তারের সাথে পরামর্শ করে কিংবা স্ত্রীর নির্দেশে ২০১৩ সালের ২১ শে জুন থেকে তার বৃদ্ধ পিতামাতাকে রান্না ঘরে থাকতে বাধ্য করেন । রান্না ঘরে থাকা অবস্থায় মিন্নত আলী ও শাসমছুন্নাহার দম্পতির ভরণ পোষণ দিত তার মেয়েরা। এখানেই থেমে থাকেনি নুরুল আমীন এবং জেসমিন দম্পতি । পিতামাতাকে চাপ দিতে থাকেন তাদের ভিটে-মাটিটুকু নুরুল আমীনের নামে করে দিয়ে মিন্নত আলীর চার কন্যাকে বঞ্চিত করতে । এ অন্যায় প্রস্তাবে মিন্নত আলী রাজি না হওয়ায় গত ১৪ই এপ্রিল মিন্নত আলী এবং শামছুন্নাহারকে পাকের ঘর থেকেও বের করে দেয় । বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আশ্রয় হয় রাস্তায় । এর দ্বারে ও দ্বোরে । এতদিন যে পিতামাতা পরম মমতায় লালন করে নুরুল আমীনকে প্রতিষ্ঠা পাইয়েছেন সেই পিতামাতাই ছেলে এবং ছেলেবউ এর বিরুদ্ধে গ্রামের সকলের কাছে বিচার চেয়ে ব্যর্থ হয়ে আদালতের শ্বরণাপন্ন হন । মিন্নত আলী এবং শামছুন্নাহার এর মত এরকম ঘটনা বাংলাদেশে হাতে গোন দু’একটি নয় বরং শতাধিক । এর থেকে কিছু কিছু আমরা জানতে পারলেও প্রায় সবগুলোই রয়ে যায় অগোচরে । জীবনের বিনিময়ে হলেও পিতামাতা তার সন্তানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখতে যেন বদ্ধপরিকর । চরম অত্যাচার সহ্য করার পরেও বৃদ্ধ পিতামাতা তাদের সন্তানের বিরুদ্ধে অন্যের কাছে নালিশ করতে চান না । তবুও যখন জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে তখন দু’একজন পিতামাতা তাদের চরম ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় গ্রাম্য শালিশ কিংবা আদালতের দ্বারস্থ হন । তবে গ্রাম্য শালিশ কিংবা আদালতে নালিশকারীর সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা ।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে পিতামাতা অকর্মণ্য কিংবা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদের কাছে এটা সামাজিক প্রথা হয়ে গেলেও ব্যক্তিগতভাবে আমি এ প্রথাকে শুধু অপছন্দই করি না বরং এর বিরুদ্ধে ঘৃণার সবটুকু শক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করি । কেউ কেউ বলেন, উন্নত দেশ যদি বৃদ্ধাশ্রম চালু না করত তাহলে তারা বিশ্বে শোর্য-বীর্যে বলীয়াণ হয়ে বিশ্বের বুকে পরিচিত পেত না । কোন কিছু পেতে হলে কিছু একটা ত্যাগ করতে হবে এটাই তাদের দর্শন । তারা এ দর্শনের পথেই জীবন পরিচালিত করছে । তবে যাদের প্রকৃত মন আছে তারা হয়ত অর্থের বিনিময়ে ভালবাসা বিক্রি করবে না । বিশ্বের ঐ সকল কথিত উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে বাংলাদেশেও বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । অবসর প্রাপ্ত সরকারি আমলা থেকে শুরু করে গ্রামের সবচেয়ে নগন্য ব্যক্তিটিরও বৃদ্ধ বয়সে ঠিকানা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম । বৃদ্ধাশ্রমকে ঢালাওভাবে খারাপ বলার উপায় নেই কেননা সমাজে যে সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অপাঙক্তেয় কিংবা যাদের দেখার কেউ নাই তাদের জীবনের শেষদিন গুলি বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে পারলে তাদের অতীত জীবনের চেয়ে ঢের বেশি শান্তিতে কাটাতে পারবে- সেটা নিশ্চিত কিন্তু যারা লক্ষ কোটি টাকা আয় করে তাদের সন্তানদের ভরণ-পোষন করল, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করল সেই তাদের জীবনের যে স্তরটি নাতী-নাতনীদের সাথে হেসে খেলে পরম প্রশান্তিতে কাটানোর কথা ছিল সেই তারা আপনজনের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রায় নিঃসঙ্গভাবে কাটাবে সেটা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে । বৃদ্ধাশ্রমের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় সমাজ সংস্কারক শিল্পী নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের কয়েক কলি, ‘একশ বছর বাঁচতে চাই এখন আমার স্বাদ/পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট/আশ্রমের এই ঘরটা ছোট যায়গা অনেক বেশি/খোকা আমি দু’জনেতে থাকব পাশাপাশি’ ।
যারা ইচ্ছা না করলে আমরা পৃথিবীর আলোর দেখতে পেতাম না, যে মা সময় মত এক ফোঁদ দুধ মূখে না দিলে জীবনের অস্তিত্ব বীলিন হয়ে যেত, যেই বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অন্ন জোগাড় করে আমাদের মূখে তুলে দিয়েছেন সেই পিতামাতার ঋণের কিছু অংশ পরিশোধ করতে যখন ব্যস্ত থাকার কথা সেই সময়টাতে পিতামাতার ঠিকানা হয় খোলা আকাশের নিচে । জীবনের সব স্বাদ আহ্লাদ ত্যাগ করে, চাওয়া পাওয়া জলাঞ্জলি দিয়ে যে সন্তানকে বেড়ে ওঠানোর এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দেয়ার শুধু স্বপ্নে বিভোর থাকেন নাই বরং সহস্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সমাজে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিয়েছেন সেই সন্তানের কাছ থেকে অনাদর অবহেলা পাওয়ার সময় প্রত্যেক পিতামাতাই নিজেদের মৃত্যু কামনা করেন কিন্তু কলিজার টুকারার পানে চেয়ে চোখ রাঙান না । নুরুল আমীনের বধু জেসমিনের মত প্রায় মেয়েরাই পিতামাতার ঘর ছেড়ে স্বামীর ঘরে আশার পর বদলে যায় । পিতামাতাকে যে চোখে দেখে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে ঠিক তার উল্টো চোখে দেখে । স্বামীর কাছে কেবল বায়না ধরে আলাদা হওয়ার । স্বামীও এক সময় স্ত্রীর পরামর্শ এবং সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আলাদা পরিবার প্রতিষ্ঠা করে । সেখানে তার পিতামাতার স্থান হয় না আর যদি দৈবক্রমে স্থান হয়েও যায় তবে তাদের অবস্থা বাসার কাজের ছেলে বা মেয়ের চেয়ে খুব উপরের হয় না । অথচ যে সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে পেরেশানীর কারনে পিতামাতাকে ত্যাগ করলে সেই পিতামাতাও ঠিক তোমার মত তোমাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিল । আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যখন তোমাদের সন্তান তাদের সন্তানের ভবিষ্যত বিবেচনায় এখনকার অবিবেচকদের ত্যাগ করে বৃদ্ধাশ্রম, পাকের ঘর কিংবা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করবে তখন নিশ্চয়ই তোমাদের পিতামাতাদের মত তোমাদেরও মন খারাপ হবে । ¯্রষ্টার কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করবে তবুও মৃত্যু হবে না। আগামী ৩০ বছর পরের বাস্তব ঘটনা আগে ভেবে সে মতে সিদ্ধান্ত নিলে আজকের বৃদ্ধ পিতামাতার মত আগামীর ব্দ্ধৃ পিতামাতাদের লাঞ্ছনা, অপমানে পতিত হতে হবে না । যারা বৃদ্ধ পিতামাতাকে বোঝা মনে করে তাদের সন্তানরাও অদূর ভবিষ্যতে তাদের পিতামাতাকে বোঝা মনে করবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই ।
অসহায় মিন্নত আলী চাঁদপুরের যে আদালতের শ্বরণাপন্ন হয়েছে যে বিচারালয়ের বিচারকের কাছে করজোর অনুরোধ, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এমন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করুন যা দেখে গোটা দেশবাসী শিক্ষা নিতে পারে । অভিজ্ঞ বিচারক সাহেবও কারও সন্তান আবার কারো পিতা । আইনের খাতিরে হোক আর নিজের প্রয়োজনেই হোক এমন সিদ্ধান্ত দিন যা ইতিহাসে সিদ্ধান্তের সাথে আপনাকেও স্মরণ করে রাখে । যারা পিতামাতা হয়েছেন তারা অবশ্যই সন্তানের প্রতি গভীর টান উপলব্ধি করেন । আপনারা যে টান আপনাদের সন্তানের প্রতি অনুভব করছেন সেই টান বা তার থেকে বেশি টান আপনার পিতামাও আপনাদের প্রতি উপলব্ধি করতেন, এখনো করেন । কাজেই পিতামাতার প্রতি সদয় হোন । তাদের অসাহায়ত্বের সময়ে তাদেরকে সর্বোচ্চ সংঘ দিন । এদেশের কোন সন্তান যেন নুরুল আমীন এবং তার স্ত্রী জেসমিন আক্তারের মত নিষ্ঠুর না হয় । নুরুল আমীন এবং জেসমিনর আক্তার যদি তাদের পিতা এবং শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীরর সাথে পত্রিকায় উল্লেখিত আচরণ করে থাকে তাহলে নিকট ভবিষ্যতে তারাও তাদের সন্তান থেকে অনূরুপ কিংবা এর চেয়েও জঘন্য পরিস্থিতির সম্মূখীন হবে তা সুর্যালোকের মতই স্পষ্ট । নুরুল আমীন এবং তার স্ত্রীর পরিনতি দেখার জন্য কেবল সময়ের অপেক্ষা ।
কলাম লেখক । রাজু আহমেদ ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.