নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গত ৭ই মে বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত পিরোজপুর জেলার সদর আসনের সাংসদ একেএম আউয়ালের অপেক্ষায় থেকে প্রচন্ড রোদে অসুস্থ হয়ে পড়েছে অর্ধ শতাধিক স্কুল শিক্ষার্থী ।
খবরে প্রকাশ পেয়েছে, বুধবার বেলা ১১টার দিকে সদর উপজেলার করিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে । পুরস্কার বিতরণী ও এমপি একেএম আওয়ালের আগমন উপলক্ষে স্কুলের সকল ছাত্রীদেরকে সকাল ৮.৩০টার মধ্যেই স্কুলে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় ।
শিক্ষার্থীরাও তাদের গুরুজনদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে । কিন্তু গুরুজনরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে নি । সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১.৩০টা পর্যান্ত শিক্ষার্থীদেরকে বৈশাখের এ কাঠ-ফাটা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখে । যা একেবারেই অমানবিক ।যে শ্রমিকরা তাদের অভ্যাসমত প্রতিদিন রোদের মধ্যে মাঠে কাজ করে সে শ্রমিকরাই চলতি বছরের সূর্য তাপে সৃষ্ট তীব্র দাবদাহের কারনে সকাল ১০টার বেশি মাঠে কাজ করতে পারে না অথচ সেই রোদ্রে ১০-১২ বছরের কোমলমতি শিশুদেরকে কোন আক্কেলে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল হালিম হাওলাদার রোদ্রে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন তার প্রকৃত কারন অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে ।
স্থানীয় এমপি জনাব একেএম আউয়াল অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন । তিনি আসতে আসতে বেলা ১১.৩০টা বেজে গিয়েছিল । রাজনৈতিক কর্তা ব্যক্তিদের সময় জ্ঞান কিংবা ব্যস্ততার কারনে প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাদেরকে দেরী করে অংশগ্রহন করতে দেখা যায় । যেমনটি হয়েছিল পিরোজপুরের করিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ে । এমপি মহোদয়ের উপস্থিতির পর যখন শিক্ষর্থীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করতে শুরু করে এবং দু’তিন লাইন গাওয়ার পরেই ৫০-৬০ জন ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । এদের মধ্যে কয়েকজন ঘন্টা ব্যাপী অজ্ঞান ছিল । অসুস্থদের মধ্যে মাহফুজা, নুরজাহান, জান্নাতুল, জেরিন ও আখির অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর হওয়ায় তাদেরকেসহ প্রায় বিশ জনকে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ।
জ্ঞান ফিরে আসার পর অসুস্থরা জানায়, তাদের বুক জ্বলছে এবং শ্বাস নিতে পারছে না । অসুস্থ নুরজাহান জানায়, তীব্র রোদের মধ্যে যখন তাদের পানির পিপাসা লেগেছিল তখন তারা একটু পানির জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে জোর অনুরোধ জানিয়েছিল । স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সে অনুরোধে সাড়া দেয়নি । পিরোজপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শংকর কুমার ঘোষ বলেন, গুরুতর অসুস্থ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কৃত্রিম অক্সিজেন দেয়া হয়েছে ।একজন রোগী কত মারাত্মক অসুস্থ হলে তাকে কৃত্রিম অক্সিজেন দেয়া প্রয়োজন তা অবশ্যই সবাই বুঝেন ।
এ ঘটনার পর অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে । অভিভাবকদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এরা মানুষ না কসাই ? শিক্ষার্থীদের জীবনের চাইতে কি এমপির সংবর্ধনা বড় ? অভিভাববদের এ প্রশ্নের উত্তরের সঠিক জবাব আপাতত দেশের পরিচালকদের মাথায় আছে কিনা তাতে অনেকেরই সন্দেহ ? যদি এ পশ্নের সঠিক উত্তর দেশের অভিভাবকদের থেকেই থাকে তবে কেন পিরোজপুরের করিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের মত অমানবিক ঘটনা প্রত্যহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে ? কিছু দিন পর পর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে এরকম অমানবিক ঘটনা । কোথাও দীর্ঘ ২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে এমপি-মন্ত্রীদের সংবর্ধনা দেয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে । এ সকল ঘটনায় শিক্ষার্থীরা কখনও প্রচন্ড রোদে পুড়ছে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজছে । স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যরা এমপি-মন্ত্রীর নেক নজর লাভের জন্য এমন সব অমানবিক কাজ করছে যা সভ্য দেশের কোন মানুষের কাজ নয় । মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি মানুষের মাঝে বাস করছি নাকি কসাইদের সাথে ? মানুষের তো মনুষ্যত্ব থাকার কথা । আমাদের আচরনে যেহেতু সেটা প্রকাশ পাচ্ছে না সুতরাং কসাইদের মত নির্মম হয়ে যাচ্ছে আমাদের আচরন । দেশের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় সংবর্ধনার কাজে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধ করলেও দেশের অন্যান্য এমপি-মন্ত্রী মহোদয়গণ অঘোষিতভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংবর্ধনা পেতে মরিয়া । এমপি-মন্ত্রীদের যে সকল চামচারা স্কুল পরিচালনার সাথে জড়িত তারা শিক্ষকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় কিংবা মাঠে তীব্র রোদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে । কোন শিক্ষার্থী যদি তাদের আদেশ অমান্য করে তবে তাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় । এমনকি স্কুলও ছাড়তে হতে পারে । তাইতো শিক্ষার্থীরা অনেকটা দায় ঠেকে হলেও শিক্ষকদের আদেশ পালন করতে বাধ্য হয় । যার প্রমাণ মেলে করিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাসির শেখের কথায় । তিনি জানান, তার মেয়ে কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল । সেই মেয়েটিকেও আড়াই ঘন্টা রোদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল । অবশ্যই নাসির শেখ তার স্ব-মতে তার মেয়েকে রোদ্রে দাঁড় করাতে রাজি হয় নি বরং এর পিছনে যে অন্য কোন চাপ ছিল তা স্পষ্ট ।
এভাবে আর কতদিন চলবে ? শিক্ষার্থীদেরকে আর কতদিন রাস্তায় দাঁড় করানো হবে ? এদেশে কি একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তিও নেই যিনি এ অমানবিক প্রথাকে বন্ধ করবেন । দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর পানে চেয়ে আছে হয়ত তিনি কিছু একটা করবেন । কিন্তু তিনিও নিশ্চুপ । দেশের মানুষ কার কাছে যাবে ? কে এর সমাধান করতে পারে ? দলকানা শিক্ষক কিংবা চাটুকার স্থানীয় রাজনীতিকদের কারনে এমপি-মন্ত্রীদের সংবর্ধনার নামে শিক্ষার্থীদেরকে যে কষ্টের সামানে দাঁড় করানো হয় সে কষ্ট কি বর্তমান সময়ের এমপি-মন্ত্রী কিংবা শিক্ষকরা তাদের ছাত্রজীবনে পায় নি ? যদি এ কষ্ট পেয়েই থাকেন তবে ছাত্রদের কেন সে কষ্টের মূখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে ? এমপি-মন্ত্রী এবং শিক্ষকদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের প্রতি কেন একটুও মায়া জন্মাচ্ছে না । নাকি এমপি-মন্ত্রী এবং শিক্ষকরা তাদের বাল্যকালে যে কষ্টের সম্মূখীন হয়েছিলেন তার প্রতিশোধ নিচ্ছেন ? শুধু বাংলাদেশ ব্যতীত বিশ্বের অন্যকোন দেশে বাংলাদেশের মত কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সংবর্ধনা দেয়া কিংবা গ্রহন করা হয় না । বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদেরকে এমন অমানবিক ভাবে রাস্তায় দাঁড় করাতে দেখে তারা আশ্চার্য্ হন । এমনকি দেশের মানবাধিকার সংঘঠনগুলোও এ প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেও দেশের পরিচালকদের কর্ণ-কুহরে শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং মানবাধিকার কর্মীদের কথা পৌঁছাতে পারেন নি ।
দেশের মানুষের কাছে দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখা হাসিনা অনেক শ্রদ্ধার পাত্র । সবাই এক বাক্যে বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী দেশ ও দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেন । তিনি দেশের মানুষের আকুতি বুঝবেন । দেশের সকল সমস্যা সমাধানের সাথে প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে সংবর্ধনার নামে রাস্তায় দাঁড় করানোর প্রথাকে বন্ধ করতে হবে । যদি প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী এ অমানাবিক প্রথা অবিলম্বে বন্ধ না করেন তবে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের দুরত্ব সৃষ্টি হবে । যা এক পর্যারয়ে এমপি-মন্ত্রীদের উপরও ক্ষোভের সৃষ্টি করবে । যা ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যও সুখকর হবে না । সুতরাং অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়াই বুদ্ধিমানদের কাজ ।
প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী তাদের প্রজ্ঞানুযায়ী যদি সংবর্ধনার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে রাস্তায় দাঁড় করানোর প্রথা আইনের মাধ্যমে বন্ধ না করেন তবে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করবে । এটা অবশ্যই শিক্ষার জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.