নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বরিশাল সদরের অটো চালক রাসেল শিকদার গত ২২শে জুলাই গুম হওয়ার পরে ২রা আগষ্ট তার গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে । একজন সামান্য অটো চালকের সমাজে কতটুকু মূল্য আছে ? সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাকে মূল্যায়িত করুক কিংবা না করুক তাতে কিছু যায়-আসে না । কেননা সমাজকে ঘুনে ধরেছে কিংবা সমাজে এমন কিছু কুপ্রথার প্রচলন করেছি যার কারনে সমাজের নিম্ন পেশাবৃত্তির মানুষকে মানুষ হিসেবে মুল্যায়ণ করতেই যেন ভূলে গেছি । বরিশাল সদরের ২৩নং ওয়ার্ডের সাগরদী ফকিরবাড়ী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আব্দুল মাজেদ শিকাদারের ছেলে রাসেল শিকদার সমাজের কাছে মূল্যহীন হলেও তার পরিবারের কাছে তিনি অমূল্য ছিলেন। কেননা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে রাসেলের পরিবার এখন দিশেহারা । সর্বোপরি রাসেলের স্ত্রী ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা । কয়েকদিন পরেই তার সন্তান ভূমিষ্ট হয়ে যখন জানতে চাইবে তারা বাবা কোথায় ? তার বাবা সম্মন্ধে তার কাছে কি কৈফিয়ত দেয়ার থাকবে ? রাসেলের এমন মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পরেও তার হত্যাকারীরা গ্রেফতার হয়নি । রাসেল হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে বরিশালের সুধীসমাজকে আন্দোলনের পর আন্দোলন করতে হচ্ছে ।
বাংলাদেশে একটি কুপ্রথা বেশ শক্তভাবেই শিকড় প্রোথিত করেছে । মানুষের জীবনকে টাকার মানদন্ডে মুল্যায়িত করা হচ্ছে । সর্বনিম্ন ৫হাজার থেকে শুরু করে কারো জীবনের মূল্য লাখ টাকাও নির্ধারণ করা হয় । কেউ অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেই বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঘোষণা করা হয় । এ ক্ষতিপূরণের টাকা কখনো ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে প্রদান করা হয় আবার কখনো কেবল ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকে । হত্যাকান্ডের বিচার কাজকে সামনে অগ্রসর করার জন্য অনেকগুলো দিককে বিবেচনা করা হয় । রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচারের সাথে অন্যান্য সাধারণ হত্যাকান্ডের বিচারের থাকে যোজন যোজন তফাৎ । আবার সরকারীদল কিংবা বিরোধীদল বলেও অনেক বলয়ের মধ্যে বিচারকাজকে শেষকরা কিংবা ঝুলিয়ে রাখা হয় । অটোচালক রাসেলের হত্যাকান্ড রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বিবেচিত না হওয়ার কারনে এ অপরাধের সাথে জড়িত আসামীরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে । এমনকি সহায় সম্বলহীন রাসেলের পরিবারকে রাসেল গুম থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন মহলের পিছনে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে শুধু রাসেলকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশায় । অথচ রাসেলকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি । রাসেলকে হারিয়ে রাসেল অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নির্বাক । এ পরিবারটির ভবিষ্যতে যে কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে তা সহজেই অনুমেয় ।
গত ৬ই আগষ্ট বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সামনে রাসেল শিকদারের হত্যার প্রতিবাদে ব্যাটারী চালিত হলুদ অটোরিক্সা গাড়ী মালিক ও সমন্বয় সংগঠনের উদ্দ্যেগে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে । এ শোক সভায় রাসেলের হত্যাকারীদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী উত্থাপিত হয়েছে । শোক সভায় উপস্থিত বক্তারা সরকারের কাছে যে ক্ষতিপূরণ দাবী করেছে সরকারের পক্ষ থেকে তা আদৌ পূরন করা হবে কিনা তা নিয়ে খোদ বক্তারাই সন্দিহান । কেননা সামান্য অটোচালক রাসেল কিংবা রাসেলের পরিবারকে নিয়ে ভাবার মত কতটুকু সময় রাষ্ট্রের আছে ? মানবিক বিবেচনায় রাসেলের জন্য অনেক কিছু করা দরকার থাকলেও অতীতে ঘটে যাওয়া গুমের শিক্ষা থেকে রাসেলের পরিবারের জন্য উত্তম কিছু আশা করা অর্থহীন ।
গুম হওয়া রাসেলের লাশটা শেষ পর্যন্ত তার পরিবার পেয়েছে । এক্ষেত্রে রাসেলের পরিবারকে ভাগ্যবান বলতেই হবে । দেশে রাজনৈতিক কিংবা অন্যকোন কারনে শতাধিক মানুষ গুম হয়ে আছে অথচ তারা বেঁচে আছে নাকি তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তার কোন সংবাদ পরিবারের কাছে নাই । রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ছাত্রসহ নানা পেশার মানুষ অহরহ গুম হচ্ছে এবং তাদের সংবাদ লোকালয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে । কিছুদিন এ নিয়ে নানা আলোচনা কিংবা উদ্ধার তৎপরতা চালানো হলেও এক সময় এদের ব্যাপারে সবকিছু জিমিয়ে আসে । তখন তাদের ব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনা করা হয়না কিংবা তাদের পরিবারের খোঁজও রাখা হয় না । এ গুমের কাজে কখনো অবৈধ সন্ত্রাসী আবার কখনো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত হচ্ছে । যারা গুম হচ্ছে তাদের মধ্য থেকে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক জীবিত উদ্ধার হলেও অধিকাংশের গলিত লাশ পাওয়া যাচ্ছে কিংবা কাউকে পাওয়াই যাচ্ছে না । এভাবে আর কতদিন চলবে ? যারা গুম হচ্ছে কিংবা গুম হয়ে নিহত হচ্ছে তাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদের পরিবারকে ততোটা ধ্বংসের মূখে পড়তে না হলেও রাসেলদের মত সহায় সম্বলহীন যারা গুম হচ্ছে কিংবা গুম হয়ে হত্যার শিকার হচ্ছে তাদের পরিবারকে ধ্বংসের দাবানলে পড়তে হচ্ছে । যারা গুম করছে তারা যদি মুক্তিপণ দাবী করে তাবে প্রতিটি পরিবার সর্বশান্ত হয়ে যায় । মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করেও অনেক সময় গুম হওয়া ব্যাক্তিটিকে জীবিত ফেরত পাওয়া যায় না । গুমের ব্যাপারে সরকারকে এবং প্রশাসনকে যথেষ্ট সোচ্চার এবং নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে হবে । দল মত কিংবা ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে মূল্যায়িত করে সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি দিতে হবে । মনে রাখতে হবে, একটি খুন একটি পরিবারের চিরদিনের কান্না । অধিকন্তু যিনি খুন হচ্ছেন তিনি যদি ঐ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হন তবে ঐ পরিবারের দূর্ভোগের কোন সীমা পরীসিমা থাকে না । এটা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে । রাসেলের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য আমাদেরকে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যাতে সে সন্তান দেশবাসীকে তার পিতা হত্যার জন্য ঢালাওভাবে দোষারোপ করতে না পারে । সারা দেশবাসী না হোক অন্তত বরিশালের সকল বিত্তশালীকে রাসেলের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান এবং রাসেলের অনাগত সন্তানের নির্ভার ভবিষ্যত নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক । বিবেকের মূখোশ উম্মোচিত করার মাধ্যমে আমরা যেন রাসেলের পরিবারের জন্য এ কর্মটুকু করে আমাদের দায়ভার থেকে মুক্ত হতে পারি । বরিশালের সকল স্তরের প্রশাসনের কাছে বিনীত আরজ, অবিলম্বে রাসেলের প্রকৃত হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তির মূখোমূখি করুন । অটো চালক রাসেলের খুনীরা যাতে কোনভাবেই পার পেয়ে যেতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করুন। রাসেলের পরিবারের অন্যকোন সদস্যের জন্য না হোক অন্তত রাসেলের অনাগত সন্তানের জন্য এ কাজটুকু করুন ।
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক ।
©somewhere in net ltd.