![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুনি-ঋষিরা নাকি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন শব্দ- অপার্থিব অমূল্য জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মত সব শব্দ। তারা শব্দের ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। লালন কিন্তু বলেছেন বিপরীত কথা, ‘যেদিন নিঃশব্দ শব্দকে খাবে’ এই নিঃশব্দের ওপর লালন যে আধ্যাত্মিক অর্থই আরোপ করতে চান না কেন শব্দের মূল্য কিন্তু তাতে কমেনি।
শব্দের সবচেয়ে বড় গুনগ্রাহী হলেন লেখক-কবি সম্প্রদায়। নজরুলের দ্রোহীভাবের কবিতাগুলোর মধ্যে রক্তগরম করা ভাব, রবীন্দ্রনাথের ভাষার যে ঋষিসুলভ মায়া ও আচ্ছনতা, জীবনানন্দের কাব্যভাষার যে কোমল আর সাংগীতিক বিহ্বলতা , তা তাদের জীবন ও চেতনাবোধ দ্বারা প্রভাবিত হলেও পাঠকের কাছে সেই পৌছানোর মাধ্যম ভাষা তথা শব্দের ব্যবহার। ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী’ রবীন্দ্রনাথের এই লাইনের মাত্রা ঠিক রেখে অন্যশব্দ বসিয়ে দিন দেখবেন কি আকাশ পাতাল ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায়। ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ এর যেকোন শব্দকে অন্য শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে দেখুন তো কথা কত দূরে চলে যায়!
শব্দের আছে জাদু। কেমন জাদু? পাঠকের চেতনা স্পর্শ করার ক্ষমতা অর্জনের মত জাদু। ছুয়ে যাওয়া, দোলা দেয়া, কল্পনাকে উসকে দেয়া, নিজের ভেতরের বোধকে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করার আনন্দের জাদু।
প্রকৃত ভাষাশিল্পী জানেন কখন ‘বোকা’ আর কখন ‘বেকুব’ বলতে হয়। কখন ‘হতবাক’, কখন ‘নির্বাক’ কিংবা কখন ‘বাকরুদ্ধ’ হয়ে যেতে হয়। কখন ‘আকাশে’ ডানা মেলে পাখি আর কখন ‘নীলিমায়’। ‘বোবা’ও কখন ‘মূক’ হয়ে থাকে! জানেন ‘ঘরে ঘরে’ আর ‘নীড়’ নেই কেন? বনলতার চোখ ‘পাখির বাসা’র মত না হয়ে কেন ‘পাখির নীড়’ এর মত? শুধুই কি ধ্বনিব্যাঞ্জনা নাকি অন্য কিছু? ‘ভাল-বাসাতে’ই যে ‘ভালবাসা’ থাকবে তারও কোন নিশ্চয়তা কি আছে?
শব্দ কতভাবেই না অনুভুতিতে দাগ কেটে যায়। মুড়ি মুড়কির মত যে শব্দগুলো ব্যবহার করি তা কখনো কি ভাল করে ভেবে দেখি? ‘ভালবাসা’ এক হুলস্থূল শব্দ! কখন কোন দিকে তার অর্থানুগমন বোঝা মুশকিল। এখন যেমন ‘মানুষ’ শব্দটি নাকি খুবই ভঙ্গুর! ‘বিবেক’ শব্দটি শুনলেই কেন যেন মনে হয় মাঢ়িচাপা পরিহাসের হাসি। ‘মা’ শব্দটি কি মায়ার! অর্থের উর্ধ্বে উঠে ভালবাসার, স্নেহের এক অমৃত সমুদ্রের কথাই কি মনে হয় না? ‘বাবা’ যেন একটু ভারী শব্দ, কিন্তু ভরসার ইমারতের মত, বটের ছায়ার উপমাও মনে পড়ে ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণে।
‘বিশ্বাস’ শব্দটিকে মনে হয় কখনো খানাখন্দ ভরা পথ। এই ‘পথ’ আর ‘রাস্তা’র ‘ব্যবধান’ ( ‘পার্থক্য’ আরেকটু হালকা শব্দ) কি ভেবে দেখেছি কখনো? ‘কখনো’ শব্দটি যে ‘কভু’ শব্দটিকে প্রায় হটিয়ে দিল তাও তো খেয়াল করিনি। ‘গ্রাম’ শব্দটি শহুরে লোকের যে মনে আদুরে ব্যঞ্জনা আনে, ‘গ্রাম্য’ বা ‘গেয়ো’ লোকটির (মানুষ বা ব্যক্তিটির নয় কিন্তু, তুচ্ছার্থ লক্ষনীয়) মনেও কি একই ব্যঞ্জনা আনে? আবার ‘প্রশ্ন’ শুনলেই আমাদের মত ছাত্রের পরীক্ষার ভয়ে মুখ ভার হতে পারে, কিন্তু বেয়ারা সাংবাদিকের ‘প্রশ্ন’ শুনলে মন্ত্রী কি আতংকিত হন না? তখন মন্ত্রী তাকে ‘বেয়াক্কেল’ বলে বসলে আকল শব্দের মানে না জানলেও বেয়াক্কেলের মানে ঠিকই বুঝি। এই বোঝাবুঝির ভেতরেও কিন্তু হতে পারে ভূল বোঝাবুঝি। আবার বু-জী’র মন খারাপ হলেও বুঝতে বাকি থাকে না। ঘুম পেলে আমরা চোখ বুজি।
‘প্রেম’ বলতে একশ্রেণির মনে যদি কেজি কেজি চীনাবাদামের খোসা আর ফুচকা চটপটির ছবি ভেসে ওঠে, তো আরেক শ্রেণির মনে দামি রেস্তোরা। তার মানে ‘প্রেম’ শব্দটার গায়ে লেগেছে কর্পোরেট হাওয়া। তার মানে বোঝা যাচ্ছে ‘প্রেম’ শব্দের প্রতি প্রেম কমে গেছে মানুষের। ‘প্রেম’ যে ‘প্রীতি’ থেকে আলাদা তা বুঝি ‘মানবপ্রেম’ আর ‘স্বজনপ্রীতি’ শব্দ দুই্টির দিকে তাকালে। আরো মজার এই ‘প্রীতি’ থেকেই আদি স্বরাগমে সৃষ্ট শব্দ ‘পিরিতি’ কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে চলে গেছে বহু দূরে। তাই কোন প্রেমের কথা শুনলে অনেকে প্রীত হয় আবার কখনো পিরিতির কথা শুনে পীড়িত হয়ে পড়ে। এভাবেই কত শব্দ নিঃশব্দে জাত খোয়ায়! ‘মাগী’ কেউ বললে আপনি ভ্রু কোচকাতে পারেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি বাংলা ভাষার চলার পথে ছিলেন বড় অগ্রদূত, কিন্তু মেয়েকে এই সম্বোধনই করতেন!
‘আস্থা’ শব্দটিকেও কেমন অনাথ মনে হয়। নাকি প্রকান্ড অনাস্থা বদ্ধমূল হয়েছে আমাদের ভেতরে? ভদ্রলোকেরা ‘দুস্থ’ শব্দটি ব্যবহার করি যেন করুণা প্রকাশ আর নিজেদের মহানুভবতার প্রচ্ছন্ন দাবিতে। এটা কি সুস্থ? সুস্থ কিভাবে হবে যেখানে পুরো সমাজ, দেশই অসুস্থ! ‘দেশ’ শব্দটিকে মনে হয় ফাঁপা, ফোপড়ার মত। অথচ এটাও জানি এই দেশের জন্যই অনুরাগে ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ড হয়ে যায় টানটান। শোণিত তপ্ত হয়ে ওঠে।
আশা যদি হত হয়ে যায় তার নাম হতাশা। যদি হতাশার মধ্যেও দেশ নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলি বন্ধুরা বলে, দুরাশা! এই জাতির নাকি তিনটি মাত্র আশাঃ হতাশা, দুরাশা আর আমাশা। এটা অবশ্য তাদের তামাশা। তখন কিন্তু মার্ক টোয়াইনকে মনে পড়েঃ ‘দুঃখই হাস্যরসের গোপন উৎস, আনন্দ নয়। স্বর্গে কোন হাস্যরস নেই’( The secret source of humor is not joy but sorrow. There is no humor in heaven)
বিচিত্র শব্দের সাক্ষাৎ এমনি করে পাই। চারপাশে শব্দ আর শব্দ। আমার প্রিয় মাতৃভাষার মনিমুক্তার মত একেকটা শব্দ। কখনো মনে হয় হয়ত শব্দ নিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায় একটি জীবন! কোন কোন ভাষাশিল্পী কাটিয়ে দেনও।তারা অধরা শব্দের পেছনে যেন ছুটতে থাকেন জীবনভর, নবনীতা দেবসেনের ভাষায়, ‘প্রানভোমরার কৌটোর মত নিবিড় নিটোল কোন শব্দ’ তারা খোঁজেন। ‘The seal’s wide __ gaze toward paradise’ কবি হার্ট ক্রেনের একবার দরকার পড়েছিল একটি দুই সিলেবলের শব্দ। তিনি ঘর ফাঁকা রেখে বিশদ অভিধানের শুরু থেকে পৃষ্ঠা ওলটানো শুরু করেন। অবশেষে ‘s’ বর্ণে গিয়ে পান ইপ্সিত শব্দের সন্ধান: ‘spindrift’। বোঝা যায় শিল্পের প্রতি কবিতার প্রতি কতটা নিবেদন ছিল তার। এটা ঠিক যেকোন শব্দই হতে পারে যথাশব্দ যদি ঠিকমত ব্যবহার করা হয় এবং হার্ট ক্রেনের মত পরিশ্রমও সবাই করবেন না। তবে যারা লেখালেখি করেন এইদেশে তাদের ভাষার দিকে শব্দ চয়নের দিকে আরো মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে মনেকরি। কারন কবি সাহিত্যিকেরা তো প্রধানত ভাষা শিল্পী।
আমাদের ভাবনাচিন্তা করতেও উপলক্ষ লাগে( we take occasion to think ... রবার্ট ফ্রস্ট) উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের অনেকের ভাষাপ্রেম জেগে ওঠে, ভাষা নিয়ে মাসব্যাপী ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। এবারো ফেব্রুয়ারি চলে এলো । আমরা যেন পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই ভাষা ও ভাষা ব্যবহারের দিকে খেয়াল রাখি- সংগীতের ‘খেয়াল’ নয়, বেখেয়ালের যে বিপরীত শব্দ ‘খেয়াল’ সেই খেয়াল যেন রাখি! ভাবনার ‘কাল’ যেন শুধু একমাসের পরিসরে না হয়, তাহলে সেই ভাবনাই হয়ত 'কাল' হয়ে দেখা দেবে।
০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩২
কে এম এ রাকিব বলেছেন: ধন্যবাদ মিশু মিলন।
'আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ উপকৃত এবং আরো সচেতন হলাম প্রবন্ধ পড়ে।'
কৃতজ্ঞতা জানবেন। উপকারে এসেছে জেনে ভালো লাগছে। শুভকামনা।
২| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৫৫
পুলহ বলেছেন: আপনার নিবন্ধের প্রতিটা প্যারা সম্পর্কেই অনেক কিছু বলা যায়, আমি শুধু এটুকু বলি- আপনি নিজেও এই পোস্টের মাধ্যমে শব্দ নিয়ে, কথা নিয়ে মোহনীয় এক ম্যাজিক দেখালেন।
ব্লগে নিবন্ধিত হবার পর এখন পর্যন্ত, এটা আমার পড়া শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ।
অনেক অনেক শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।
লেখাটা দুইবার পোস্ট হয়েছে, ঠিক করে নিয়েন সুযোগমত
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:২৩
কে এম এ রাকিব বলেছেন: ধন্যবাদ পুলহ।
পাঠকের ভালোলাগা লেখকের জন্য তৃপ্তিকর।
লেখাটা দুইবার পোস্ট হয়েছে?
আচ্ছা ঠিক করার চেষ্টা করছি। সামুতে নতুন। কায়দা-কানুন এখনও রপ্ত করে উঠতে পারিনি।
শুভকামনা রইল আপনার জন্য।
৩| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:১৬
আজমান আন্দালিব বলেছেন: শব্দ শিল্প হলে আপনিও সুনিপুণ শিল্পী। প্রবন্ধ ভালো লেগেছে।
০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৯
কে এম এ রাকিব বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকা হোক নিরন্তর।
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১১
মিশু মিলন বলেছেন: অসাধারণ এক নিবন্ধ!
নিবন্ধ যে কেবলমাত্র মননশীল নয় সৃজনশীলতারও ফসল এই লেখাটি পড়লে তা বোঝা যায়, একই সাথে কাজটি দারুণ পরিশ্রমলব্ধ। নতুনেরা ভীষণ উপকৃত হবে, পুরনোরাও নিজেকে ঝালাই করে নিতে পারবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ উপকৃত এবং আরো সচেতন হলাম প্রবন্ধ পড়ে।
এ ধরণের পোস্ট তোমার কাছ থেক আরো চাই।
ভাল থেকো। শুভকামনা রইলো................