নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।

রমিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস - ১

৩০ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:১৯





বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস - ১

--------------------------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ





খুব ছোটবেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম তখন সেটিকে আমার অত্যন্ত দামী জায়গা বলে মনে হতো। সবুজ শান্তির সমারোহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তারুণ্যের উচ্ছলতায় মুখরিত থাকতো। বিশাল চত্বরে ঢুকে খুশীতে ছেয়ে যেত মনটা। আমার বড় বোন তখন সেখানে পড়তেন, গাড়ীতে করে তাঁকে পৌঁছে দিতে অথবা আনতে যেতাম। যে সময়টুকু সেখানে অপেক্ষমান থাকতাম, আমার খুব ভালো লাগতো, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় অবস্থান করছি বলে। অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হতো এখানে পড়াটাই একটি বিশাল গর্বের ব্যাপার। কেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি মুর্তি! বিশ্ববিদ্যালয়ে মানেই তো, মাথা নত না করা। মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, একদিন আমিও এখানে পড়বো!



পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরেছিলাম তবে বেশিদিন ক্লাস করা সম্ভব হয়নি, কারণ স্কলারশীপ নিয়ে ইউরোপে চলে গিয়েছিলাম উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। উন্নত দেশে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়েছি সেই আনন্দে যখন বিভোর তখন একদিন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। ট্যাক্সিতে চড়ে যাচ্ছিলাম কোথাও, হঠাৎ ট্যাক্সিচালক একটা প্রশ্ন করে বসলো, "আপনারা যারা আমাদের দেশে পড়ালেখা করেন তাদের একটা বিষয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে, আপনার দেশে কি বিশ্ববিদ্যালয় নেই?" উত্তরে আমি বললাম, "কেন থাকবে না? অবশ্যই আছে।" "যদি থেকে থাকে, তাহলে আপনারা আমাদের দেশে পড়তে আসেন কেন?" ট্যাক্সিচালক পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো। এবার একটু ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। কি জবাব দেব? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুন্নত (যেটা আসল সত্য কথা), তাহলে তো দেশের সম্মান যায়। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে সারাক্ষণই দেশের সম্মান নিয়ে ভাবি। সর্বক্ষণই চিন্তা করি কিভাবে দেশের মর্যাদা বাড়ানো যায়। তাই একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ভিন্ন উত্তর দিলাম। কিন্তু নিজের মনে প্রশ্ন রয়েই গেলো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুন্নত কেন? বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়', এটাই কি একেবারে প্রথম? এর আগে কোন কালেই কি আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিলনা? থাকলে তার নাম কি? উপমহাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি? পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি? কবে কোথায় প্রতিস্ঠিত হয়েছিলো? মানবজাতির ইতিহাসের ধারায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় কারা এগিয়ে ইউরোপীয়ানরা না এশিয়ানরা?



এই সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ালেখা করতে শুরু করলাম। এ পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি তার কিছু প্রতিফলন করার চেষ্টা করছি এই লেখায়।



"বিশ্ববিদ্যালয়" শব্দটির উদ্ভব হয়েছে ল্যাটিন universitas magistrorum et scholarium থেকে যার অর্থ 'শিক্ষক এবং পণ্ডিতদের সম্প্রদায়'। বিদ্যালয় শব্দটির সাথে বিশ্ব শব্দটি যোগ করার অর্থ হলো এই বিদ্যাপিঠটি কোন একটি নির্দিস্ট দেশ বা জাতির জন্য নয়, এটি সারা বিশ্বের জন্য। অনুরূপভাবে এখানে সারা বিশ্বের যেকোন দেশের মানুষ পড়তে ও পড়াতে পারবে।



যতদূর জানা যায় এই পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো চীনের সাংহাই হায়ার স্কুল (Shangyang, "higher school)। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো খ্রীষ্টপূর্ব ২২৫৭ সালে, এবং তা টিকে ছিলো ২২০৮ সাল পর্যন্ত। পরবর্তীতে আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয় চীনের ঝু ডায়নাস্টির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তার নাম ইম্পেরিয়াল কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় (Imperial Central School)। প্রতিস্ঠাকাল খ্রীষ্টপূর্ব ১০৪৬। টিকে ছিলো খ্রীষ্টপূর্ব ২৪৯ সাল পর্যন্ত। প্রাচীন চীনা রাষ্ট্র সাম্রাজ্যের পরিচালনার জন্য বিদ্বান্, শিক্ষিত কর্মকর্তাদের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলো। একটি রাষ্ট্রীয় পরীক্ষার দ্বারা সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকে কর্মকর্তা নির্বাচন ও নিয়োগ দেয়া হতো। এই পদ্ধতি প্রচলিত হয় সুই ডায়নাস্টির ( Sui Dynasty) (৫৮১ - ৬১৮) দ্বারা।



তৃতীয় প্রাচীন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান পাওয়া যায় তা ছিলো আমাদের উপমহাদেশেই। আজ থেকে ২৭০০ বছর পূর্বে এর প্রতিষ্ঠা হয়। বেবিলন, গ্রীস, সিরিয়া, পারস্য, আরব, চীন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্যা লোভী ছাত্ররা এখানে এসে ভীড় করত । প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবড়ো থেবড়ো অমসৃন পথের দুঃসহ যন্ত্রনা ও যাত্রা পথে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে উচ্চ শিক্ষার হিরন্ময় সাফল্য লাভের আশায়। সারা বিশ্ব থেকে ১০৫০০ জন ছা্ত্র উচ্চতর গবেষনার জন্য আসতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশাল সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষকের দ্বারা মুখরিত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদের কাছ থেকে শিক্ষা বাবদ এবং থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থ গ্রহণ করতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষক ও বিশ্বদ্যালয়ের অন্যান্য খরচ আসতো রাজকোষ ও ছাত্রদের কাছ থেকে। দরিদ্র ছাত্ররা এখানে নানা রকম কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাতো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। এই বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় ছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান, পাকিস্তানের বর্তমান রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে।। তার ধ্বংসাবশেষ এখনো সেখানে রক্ষিত আছে।

সেখানে ৬৪টি বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রদের জ্ঞানদান করা হতো। যেমন, বেদ, ব্যাকরণ, দর্শন, আয়ুর্বেদ, কৃষি, সার্জারি, রাজনীতি, ধনুর্বিদ্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, জ্যোতির্বিদ্যা, বাণিজ্য,

ভবিষ্যচর্চা, সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি। এমনকি গুপ্তধন আবিষ্কার শিল্প, তথ্যগুপ্তিবিদ্যা জাতীয় অদ্ভুত বিষয়েও সেখানে জ্ঞানদান করা হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ভর্তি হতো ১৬ বছর বয়সে। এই ছাত্ররা তার পূর্বে স্থানীয় স্কুল থেকে মৌলিক শিক্ষা সমাপ্ত করতো। বিশ্ববিদ্যালয় সমাপান্তে তারা এক একজন ভালো স্নাতক হয়ে বেরুতো এবং তাদের পান্ডিত্যের জন্যে তারা উপমহাদেশ তথা পৃথিবীতেই যথেস্ট মর্যাদা পেতো।



বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ছিলো পুরোপুরি মেধাভিত্তিক। ভর্তির পর তারা তাদের পছন্দমতো বিষয় বেছে নিতে পারতো। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের অনেকেই পরবর্তীতের বিখ্যাত চাণক্যের (ইতিহাসখ্যাত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রের লেখক) সাথে কাজ করেছেন।



রাজা তক্ষের নামানুসারে তক্ষশীলা নামকরন হয়েছিলো। বর্তমান উজবেকিস্তান একসময় রাজা তক্ষের অধীনে ছিলো। ধারনা করা হয় যে তাসখন্দের বর্তমান রাজধানী তাসখন্দ-এর নামকরণও তক্ষ থেকে হয়েছে।



চাণক্য: তক্ষশীলা ও চাণক্য যেন ছাপানো মুদ্রার এপিট ওপিট। তক্ষশীলা নিয়ে কোন কথা উঠলেই যেমন চাণক্যর নাম আসে অবধারিত ভাবে তেমনি চাণক্যর জীবনী তক্ষশীলাকে বাদ দিয়ে আলোচনা করলে তা হবে অসম্পূর্ন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রখর মেধা, বাস্তববাদী ও অসাধারন পান্ডিত্যের অধিকারী এই মহা পুরুষ টির শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্ম জীবনের প্রথম অধ্যায়টি কাটে তক্ষশীলায়।তিনি তক্ষশীলার রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে আচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন।

ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম নেয়া মহাপুরুষটির পিতা মাতার দেয়া নাম ছিল “বিষ্ণুপদ”। “কূটিলা গোত্র” থেকে এসেছেন বলে গোত্র নামকে অক্ষয় করতে “কৌটিল্য” ছদ্ম নামে লেখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “অর্থশাস্ত্র”। নামে “অর্থশাস্ত্র” হলেও মূলত তা ছিল রাজ্য শাসন ও কূটনৈতিক কলা কৌশল বিষয়ক সুপরামর্শ।“অর্থশাস্ত্র”র মোট ভাগ ১৫ টি। গ্রন্থে মোট শ্লোক সংখ্যা ৬০০০ রাষ্ট্র বিজ্ঞান, শত্রু দমন, রাজস্ব, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, প্রভৃতি রাষ্ট্র ও জন কল্যান মূলক বিষয় নিয়ে এই ১৫টি ভাগ গঠিত। খ্রীষ্ট পূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে “চানকা” গ্রামে জন্ম নেওয়ায় বিষ্ণুপদ “চানক্য” নামে ব্যাপক পরিচিতি পান। আবার কোন কোন ইতিহাসবিদদের ধারনা পিতার নাম “চানক” অনুসারে তাঁর নাম হয় “চাণক্য”।

মগধ রাজা “ধনানন্দ”র রাজসভা থেকে বিতাড়িত হয়ে “চাণক্য” ও দাসী “মুরা”র গর্ভে জন্ম নেওয়া “ধনানন্দ”র সৎভাই রাজ্য থেকে বিতারিত “চন্দ্রগুপ্ত” দুজনে মিলে অপমানের প্রতিষোধ নিতে গড়ে তোলেন এক বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী। যা নন্দ বংশের রাজা “ধনানন্দ”কে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করে গোড়াপত্তন করেন ইতিহাসখ্যাত “মৌর্যবংশ”।



চাণক্যের অর্থশাস্ত্রঃ

চাণক্যের বিরাট সাহিত্য কর্ম 'অর্থশাস্ত্র', যার শব্দগত অর্থ 'পৃথিবীতে সাধারণ কল্যাণ বিষয়ক বিবরণী।' এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে কিভাবে একজন শাসককে তার প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবন মান উন্নত করার জন্যে কাজ করবেন এবং কিভাবে আরও ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে হবে। চাণক্য উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা এবং তার কিছু নীতি বিশ্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।হাজার বছরের অধিক সময়ের ব্যবধানেও সেগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেনি।



অর্থনৈতিক দুর্নীতি সর্বকালেই ছিল এবং চাণক্যের যুগেও তা নতুন কোন বিষয় ছিল না। সে কারণে তিনি লিখেছেন, "সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরুপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে।



চাণক্য তার নীতিকথায় বলেছেন, "বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী - এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।"

"মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।"

"যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্যে কোনকিছু হাসিল করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোন ব্যক্তির জন্যে কোন দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।"

"মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।"



গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতোই চাণক্যের চেহারাও সুন্দর বা আকর্ষণীয় ছিলনা এবং দৈহিক গড়নও ছিল আকর্ষণহীন। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি, যদিও সক্রেটিসের মতোই পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, "দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।" অন্যদিকে চাণক্য ছিলেন দক্ষ পরিকল্পনাবিদ। সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল এবং অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিল না তার কাছে। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।





এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মহান প্রোডাক্ট ছিলেন পাণিণী। ভাষা ও ব্যাকরণে তাঁর অঢেল পান্ডিত্য ছিলো। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর তিনি কালজয়ী গ্রন্থ অস্টোঅধ্যয় রচনা করেছিলেন। যেখানে ব্যাকরণের নিয়মাবলী তিনি এত চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছিলেন যে তার তুলনা করা চলে বর্তমান যুগের প্রোগ্রামিং ল্যংগুয়েজ C/C++-এর সাথে।



তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মহান ছাত্র ছিলেন বিষ্ণু শর্মা, তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ পঞ্চতন্ত্র-এর লেখক। পঞ্চতন্ত্র অর্থ পাঁচটি কৌশল। এই গ্রন্থটি রাষ্ট্রবিদ্যা-কে সাবলীল গল্পচ্ছলে বর্ণনা করার শিল্প শেখায়। কথিত আছে যে, তিনি এই গ্রন্থ লিখেছিলেন তিনজন গর্দভ রাজপুত্রকে রাজনীতি শিখিয়ে দক্ষ শাসকে পরিণত করার জন্য।



বিখ্যাত প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসক চরকা ছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন প্রোডাক্ট। তিনি চরকা সংহিতা (Charaka Samhita) গ্রন্থের লেখক। তার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন শুশ্রুশা সংহিতা (Sushrutha Samhita), অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ (Ashtanga Sangraha) এবং অষ্টাঙ্গ হৃদয়ম (Ashtanga Hrudayam) গ্রন্থগুলি। এই সবগুলি গ্রন্থই আধুনিক আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তিস্বরূপ। চরকা বলেছেন, "যে ডাক্তার বোধ ও জ্ঞানের প্রদীপ নিয়ে রুগীর শরীরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়, সে কখনোই রোগের চিকিৎসা করতে পারবে না।"



জীবক (Jivak ) তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন প্রতিভা। তিনি ছিলেন একজন জগৎবিখ্যাত ডাক্তার ও নাড়ি পড়া বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ (শুধুমাত্র পালস শুনেই একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থা বুঝতে বুঝতে পারতেন)। তিনি সাত বছর তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি Panchakarma, Marma and Surgery-তে পন্ডিত ছিলেন।



জীবক গৌতম বুদ্ধের ব্যক্তিগত চিকিত্সক ছিলেন এবং এছাড়াও বুদ্ধের Nadi Vran তিনি নিরাময় করেন! তিনি মহান ক্লাসিক সৌন্দর্য আম্রপলি (Amrapali)-র সঙ্গে কাজ এবং সে তার তেজকে অপরিবর্তিত রাখেন। Marma ও অস্ত্রোপচার (surgical) পদ্ধতি ব্যাবহার করে তিনি অনেক বিস্ময়কর শল্যচিকিৎসা করেছিলেন। তিনি ফিলারিয়াসিস-এর জন্য একটি প্রতিকারও উদ্ভাবিত করেন। জীবকের রচিত ১৫০০০-এরও বেশী পাণ্ডুলিপি রয়েছে, যেগুলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত সঞ্চালিত হচ্ছে । এই সবগুলো অদ্যাবধি ভারতে সংরক্ষিত রয়েছে।



কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে চন্দ্র গুপ্ত তক্ষশীলায় লেখাপড়া করেন এই তথ্য সঠিক হলে তক্ষশীলাকে মৌর্য বংশের ভিত্তিভূমি বলা হলেও মিথ্যা বলা হয় না কেননা প্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের জনক কৌটিল্যের (চানাক্য) সাথে লেখাপড়ার সূত্র ধরে সম্পর্ক জোরদার হয় প্রখর বুদ্ধি দীপ্ত দূরন্ত উচ্চবিলাসি বালক চন্দ্রগুপ্তের। যা মৌর্য বংশের রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বিশাল ভূমিকা রাখে পরবর্তিতে কিংবা বলা চলে ঐতিহাসিক মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠার যোগাযোগ লগ্ন। মৌর্য বংশের ধারাবাহিকতায় আনুমানিক ৩০৪ খ্রীষ্টপূর্বে জন্ম হয় ভারত উপ মহাদেশের অনন্য বিচক্ষন জনদরদি, প্রজাসেবি ও বিদ্যানুরাগী পরাক্রমশালী সম্রাট অশোকের।



তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বেশী সংখ্যক প্রতিভাবানদের প্রসব করেছে যে তাকে অনায়াসেই রত্নগর্ভা বলা যায়।



একটি প্রাচীন সংস্কৃত বাণীতে বলা হয়েছে

বোকা তার বাড়িতে পূজিত হয়.

একজন নগরপ্রধান তার শহরে পূজিত হয়.

রাজা তার রাজত্বে পূজিত হয়.

একটি বুদ্ধিমান ব্যক্তি সমগ্র পৃথিবীতেই পূজিত হয়।



(A fool is worshiped at his home.

A chief is worshiped in his town.

A king is worshiped in his kingdom.

A knowledgeable person is worshipped everywhere)



খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৫ অব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করেন এবং এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন।



চাণক্য, আত্রেয়, বিষ্ণু শর্মা, নাগার্জুনের মত ইতিহাস খ্যাত প্রথিযশা জ্ঞান তাপস পন্ডিত ব্যক্তিদের শিক্ষক রূপে পেয়ে তক্ষশীলার সুখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল অনতিক্রম্য উচ্চতায়, দ্রুত নজর কেড়েছিল বিশ্ব দরবারে। তক্ষশীলার খ্যাতির পরশ গ্রিক সেনাপতি আলেকজেন্ডারকে এতটাই তন্ময় করেছিল তিনি তক্ষশীলা দখল করার পর সাথে করে কিছু শিক্ষক বগল দাবা করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রাচীন শিল্প সভ্যতায় উন্নত গ্রীক সভ্যতাকে আরো গতিশীল করার মানসে।



আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের আগে ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন। এরপর চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের (চাণক্য) পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। কালক্রমে চন্দ্রগুপ্ত বিশাল রাজত্বের অধিকারী হন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর, তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিন্দুসার তক্ষশীলার বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে বিন্দুসারের পুত্র অশোক রাজত্ব লাভ করেন। মৌর্য রাজাদের রাজধানী ছিল পাটালীপুত্র। কিন্তু তক্ষশিলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। অশোক পাটালিপুত্র থেকে তক্ষশিলার ভিতরে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেন।



হাজার বছর ধরে উপমহাদেশের শিক্ষাদীক্ষাকে প্রগতির পথে পরিচালিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণে। এই সব আক্রমনে সৃষ্ট অস্থির রাজনৈতিক আগ্রাসনে ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দে সর্ব শেষ আক্রমণটি আসে হুন দের পক্ষ থেকে।স্তব্দ হয় মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টির পথ চলা।





নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

মানবজাতির ইতিহাসে আরও একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হলো 'নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়'। প্রাচীন নালন্দা মহাবিহার বিহারের রাজধানী পাটনা শহর থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ছিল। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দ থেকে ১১৯৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নালন্দা ছিল একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র।[১][২] এই মহাবিহারকে "ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম" বলে মনে করা হয়।[২] এখানকার কয়েকটি সৌধ মৌর্য সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন। গুপ্ত সম্রাটরাও এখানকার কয়েকটি মঠের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, গুপ্ত সম্রাট শক্রাদিত্যের (অপর নাম কুমারগুপ্ত, রাজত্বকাল ৪১৫-৫৫) রাজত্বকালে নালন্দা মহাবিহারের বিকাশলাভ ঘটে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও পাল সম্রাটগণও এই মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন।[৩] ১৪ হেক্টর আয়তনের মহাবিহার চত্বরটি ছিল লাল ইঁটে নির্মিত। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন অবস্থায় চীন, গ্রিস ও পারস্য থেকেও শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসতেন বলে জানা যায়।[



চীনা তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী হিউয়েন সাঙ (জুয়ানঝাং) লন্দা নামের বিবিধ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাঁর একটি মত হল, এই নামটি স্থানীয় আম্রকুঞ্জের মধ্যবর্তী পুষ্করিণীতে বসবাসকারী একটি নাগের নাম থেকে উদ্ভুত। কিন্তু যে মতটি তিনি গ্রহণ করেছেন, সেটি হল, শাক্যমুনি বুদ্ধ একদা এখানে অবস্থান করে "অবিরত ভিক্ষাপ্রদান" করতেন; সেই থেকেই এই নামের উদ্ভব।



কথিত আছে, বুদ্ধ একাধিকবার নালন্দায় অবস্থান করেছিলেন। নালন্দায় এলে তিনি সাধারণত পাবারিকের আম্রকাননে অবস্থান করতেন এবং সেখানে উপালি-গৃহপতি, দীগতপস্সী, কেবত্ত ও অসিবন্ধকপুত্তের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতেন।

মগধের মধ্য দিয়ে নিজের শেষ যাত্রার সময় বুদ্ধ নালন্দায় উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানেই বুদ্ধের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সারিপুত্ত "সিংহগর্জনে" তাঁর বুদ্ধভক্তি প্রকাশ করেছিলেন। রাজগৃহ থেকে নালন্দার পথটি অম্বলত্থিকা হয়ে গিয়েছিল। নালন্দা থেকে এই পথটি পাটলিগাম পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। বহুপুত্ত চৈত্য অবস্থিত ছিল রাজগৃহ ও নালন্দার মধ্যবর্তী পথের পাশে।[১২]

কেবত্ত সূত্ত অনুযায়ী, বুদ্ধের সমসাময়িক কালেই নালন্দা ছিল এক সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী নগরী। সেই যুগে এই শহর ছিল ঘন জনাকীর্ণ। তবে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে এর খ্যাতি অনেক পরবর্তীকালে অর্জিত হয়। সময়ুত্তা নিকায় থেকে জানা যায়, বুদ্ধের সমসাময়িক এই শহর একবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। বুদ্ধের প্রধান শিষ্য সারিপুত্তের জন্ম ও মৃত্যু এই শহরেই।

কথিত আছে, ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক সারিপুত্তের স্মৃতিতে এখানে একটি স্তুপ নির্মাণ করেন। তিব্বতীয় সূত্র থেকে জানা যায়, নাগার্জুন এখানে শিক্ষাদান করতেন।



ঐতিহাসিকদের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে। হিউয়েন সাঙ ও প্রজ্ঞাবর্মণ তাঁকে এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেছেন। মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত একটি সিলমোহর থেকেও একথা জানা যায়।

ঐতিহাসিক সুকুমার দত্তের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে "মূলত দুটি পর্ব বিদ্যমান ছিল। প্রথমত এই বিশ্ববিদ্যালের প্রতিষ্ঠা, বিকাশলাভ ও খ্যাতি অর্জনের পর্ব। এই পর্বের সময়কাল খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে নবম শতাব্দী। এই সময়টি ছিল গুপ্ত যুগের ঐতিহ্য অনুসারে প্রাপ্ত মুক্ত সাংস্কৃতিক চিন্তা ও ঐতিহ্যের পর্ব। এর পর নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পূর্বভারতের বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিক রীতিনীতির আবির্ভাব ঘটলে এই মহাবিহারও ধীরে ধীরে পতনের পথে ধাবিত হয়



নালন্দাকে নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই ছিল। সেই সময়ে ওখানে ছিল ছাত্রদের থাকার বন্দোবস্ত, শ্রেণীকক্ষ, নয়নাভিরাম খাল ও আরো অনেক সুবিধাদী। ২০০০ শিক্ষক ও ১০,০০০ এর মত ছাত্র ছিল। তবে এ সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ আছে। সারাবিশ্ব থেকেই ছাত্ররা এখানে পড়তে আসত, তার মধ্যে ছিল কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পার্শিয়া এবং তুরস্ক। নালন্দা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের গবেষণা ও ধর্মচর্চার জন্য নির্মিত হলেও ওখানে পড়ানো হতো হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ব্যকরণ, ভাষাতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের আরো অনেক বিষয়।



মনে মনে কল্পনা করুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ১০০০০ হাজার শিক্ষার্থী মুখরিত ক্যাম্পাস,আর ২০০০ শিক্ষক শেখানে শ্রেষ্ঠ পাঠ দান করছেন। যেখানে অম্রকানন ছায়া শোভিত প্রকাণ্ড সব অট্রালিকা।তার ভেতর লেক আর নীল পদ্ম সরবোর বেষ্টিত। এই বিশ্ববিদ্যালয় টির নাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।এটাকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়।



লাইব্রেরীঃ

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে বলা হত ধর্ম গঞ্জ । এটা সে সময় তিনটি আলাদা আলাদা বিল্ডিং নিয়ে বিভক্ত ছিল । সেগুলোর নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যথাক্রমে রত্ন সাগর, রত্ন দধি, রত্ন রঞ্জক । নয়তলা ভবনটিতে আলোর প্রতিসরনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল ।



লাইবেরিতে কয়েকটি শ্রেনি বিন্যাস ছিল যেখানে মহা পণ্ডিত পানিনি রচিত ব্যকরন পড়তে হত।এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ত্রিপিটক কে তিনভাগে ভাগ করা হত , যা বিনয়, সুত্র, এবং আভিধম্মা নামে পরিচিত। এছাড়াও মনিষী জীবনী ও প্রচুর লেখকের রেফারেন্স নিয়ে ছিল পড়ার সুবিধা। এসব যত্ন করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা হত। ছিল কাপড় দিয়ে ঢেকে বেঁধে রাখার ব্যাবস্থা ।



বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথেধর্মের পাশাপাশি বেদ উপনিশদ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষবিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষা ব্যাবস্থার উপযোগী পুস্তক ছিল ।



নালন্দার পণ্ডিতগণ:

নালন্দায় অনেক বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপনা করছেন । এদের মাঝে নাগারজুন, ধর্মপাল , শীলভদ্র (বাংলাদেশ) , বিরাজবধি, ধরমকিরতি,আরয দেব, সন্ত্র রক্ষিত, কমল শিলা’র নাম উল্লেখ যোগ্য ।



নাগার্জুনঃ

নাগার্জুন (আনুমানিক ১৫০-২৫০ খ্রি:) গৌতম বু্দ্ধের পরবর্তী সর্বাধিক প্রভাবশালী বৌদ্ধ দার্শনিকদের অন্যতম। তাঁর শিষ্য আর্যদেবের সাথে তাঁকে 'মহাযান' বৌদ্ধধর্মের 'মাধ্যমিক' শাখার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কৃতিত্ব দেয়া হয়। তাঁকে 'প্রজ্ঞা পারমিতা সুত্র' সম্পর্কিত দর্শনের উন্নয়নের কৃতিত্ব দেয়া হয় এবং কোন কোন মতানুসারে এই সম্পর্কিত পুঁথিগুলো নাগ (সাপ/ড্রাগন)দের থেকে উদ্ধার করে, বিশ্বে প্রকাশ করেছেন। ধারনা করা হয় তিনি চিকিৎসা রসায়ন শাস্ত্রের উপর কয়েকটি রচনা করেছেন এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইতিহাস



শীলভদ্রঃ

এক সময় এত সুবিশাল একটি বিশ্ব বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান শীল ভদ্র।শীলভদ্র ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহন করেন। ধর্মপালের শিস্য ছিলেন ।যিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙ এর গুরু। প্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন।

তিনি একশ ষোল বছর বেঁচেছিলেন । শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের চার শত বৎসর পূর্বে পৃথিবীর আদিতম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দার সর্বাধ্যক্ষ বা আজকের দিনের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন মহাস্থবীর শীল ভদ্র। যিনি কুমিল্লার চান্দিনা থানার কৈলান গ্রামের ব্রাহ্মণ রাজ পরিবারের সন্তান ছিলেন। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সভ্যতা। কোটবাড়ীর শালবন বিহার অন্যতম সাক্ষী।



নালন্দার অবদানঃ

পাল যুগে বাংলা ও মগধে একাধিক মঠ স্থাপিত হয়। তিব্বতীয় সূত্র অনুযায়ী এই সময়ের পাঁচটি প্রধান মহাবিহার হল: বিক্রমশীলা (সেযুগের প্রধান মহাবিহার), নালন্দা (সেযুগে বিগতগরিমা হলেও উজ্জ্বল), সোমপুর,ওদন্তপুরা ও জগদ্দল। যেগুল নালন্দার সহযোগিতায় পরবর্তীতে এসোসিয়েট কলেজ বা পুরনাংগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়। যেমন বিক্রমশিলা । আমাদের সুপরিচিত পণ্ডিত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অতিশ দিপঙ্কর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন । আজকের অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটিও গ্রুপ অফ কলেজ, যারা অক্সফোর্ড নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতেই শিক্ষা দান করে। এই পাঁচটি মহাবিহার পরস্পর সংযুক্ত ছিল, "প্রতিটিই রাষ্ট্রীয় তদারকিতে পরিচালিত হত", এবং তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল "এক প্রকার সহযোগিতার ব্যবস্থা... মনে করা হয়, পাল যুগে পূর্বভারতে একাধিক বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র একটি পরস্পর-সংযুক্ত গোষ্ঠীব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হত।" এই কারণেই বিশিষ্ট পণ্ডিতেরা সহজেই একটি থেকে অপরটিতে গিয়ে শিক্ষাদান করতে পারতেন।

পাল যুগে নালন্দাই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। মনে করা হয়, অন্যান্য পাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সাথে নালন্দা থেকে পণ্ডিতদের নিজেদের মধ্য শিক্ষা বিনিময় ও সমন্বয় করতে হত। এর কারণ, তারা সকলে একই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করতেন।



তিব্বতীয় বৌদ্ধ দর্শন বলে আজ যা পরিচিত তার বড় অংশ এসেছে নালন্দা থেকে। বৌদ্ধ দর্শনের অন্যান্য রূপ যেমন, মহাযান যা ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া এবং জাপানে অনুসরণ করা হয়, নালন্দাতেই শুরু হয়েছিল। এখান থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান ভিয়েতনাম , চীন , কোরিয়া , জাপান সহ পুরব এশিয়ার দেশ গুলোতে ছডিয়ে পরে।





নালন্দায় বহিঃশত্রুর আক্রমণঃ

নালন্দা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। যতদূর জানা যায় সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খৃষ্টাব্দে) মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। উল্লেখ্য মিহিরকুলার নেতৃত্ব হানরা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পূণর্গঠন করেন। প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়'র রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে তার বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, তিনি সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ও এর একান্ত অনুরাগী। উল্লেখ্য রাজা শশাঙ্কের সাথে বুদ্ধের অনুরুক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড় একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মাগ্ধায় প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড-বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’কে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও, বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে । হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন (চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৩ সালে গুপ্ত রাজাদের শাসনামলয়ে নালন্দা ভ্রমণ করেন):



Sasanka-raja,being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet be did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka's hatred towards Buddhism.





হর্ষবর্ধন পরে রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন ও শেষপর্যন্ত বাংলার কিয়দংশ করায়ত্ত করেন। তিনি নালন্দাকে পূনর্গঠনে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখেন।



তৃ্তীয়বার নালন্দা ধ্বংস হয় তূর্কী যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজী দ্বারা ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে। বখতিয়ার খিলজীর সময়ে নালন্দার অনেক ক্ষতিসাধন হয়। অনেক ভিক্ষু নিহত হন, আর যারা বেঁচে থাকেন তাদের অধিকাংশই পালিয়ে যান। ক্ষয়ীষ্ণু বৌদ্ধধর্ম খিলজীদের কাছে কোন চ্যালেঞ্জ হিসাবে আসেনি, তারপরও খিলজী নির্মমভাবে অনেক ভিক্ষুকে হত্যা ও নালন্দাকে ধ্বংস করেন!



বখতিয়ার খিলজির বিহার অভিযানের কাহিনী পাওয়ার একমাত্র উৎস হল ঐতিহাসিক মিনহাজ এর ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’ বই। তৎকালীন আর কোন ঐতিহাসিকের লেখায় খিলজী দ্বারা নালন্দার ধ্বংসের কাহিনী স্থান পায়নি! খুব অবাক ব্যাপার বৈ কি! নালন্দার ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি তৎকালীন ঐতিহাসিকদের এ অবহেলা ঘটনাটিকে গুরুত্বহীন বলেই প্রতীয়মান করে। অবশ্য এর কারণও ছিল। রাজাদের মধ্যে অন্তর্কলহ, শত্রুতা, হত্যা ও উপসনালয় ধ্বংস সেসময় খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল না। মিনহাজের ‘তাব্বাকাত-ই-নাসিরি’ মতে নালন্দাতে কোন কার্যকর সামরিক শক্তির উপস্থিতি ছিল না। চারপাশ ঘেরা প্রাচীরের অভ্যন্তরেই বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল, আর এর প্রতিরক্ষায় যেসব অস্ত্রধারী ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল “মুন্ডিত-মস্তক” শ্রমন (বৌদ্ধ সন্ন্যাসী), কিন্তু খিলজীর সৈন্যরা তাদের হত্যা করেছিল ভুলবশতঃ, ব্রাহ্মণ রাজপূত মনে করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ৭০০ খৃষ্টাব্দের পরপরই ভারত ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়, আর এগুলোর নেতৃত্ব ধীরে চলে যায় ব্রাহ্মণ রাজপূতদের কাছে। রাজপূতদের এই শাসনকালকে অনেক ঐতিহাসিকই ভারতবর্ষের অন্ধকার যুগ বলেই অভিহিত করেন- সতীদাহ, বর্ণপ্রথা, অন্যান্য ধর্ম বিশেষ করে বৌদ্ধদের প্রতি নির্মম অত্যাচার ইত্যাদির যথেচ্ছাচার প্রয়োগের কারণে। খিলজীদের ভারত আক্রমণে এই রাজপূতরাই প্রতিরোধের ভূমিকা নেয়। আর ভারতবর্ষের সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে তূর্কী খিলজীদের অজ্ঞতা নিরপরাধ ভিক্ষু হত্যার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। খিলজীরা আরেকটা ভুল করেছিল, তা হল, তারা ভেবেছিল চারপাশ দিয়ে ঘেরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি দূর্গ।



তবে নালন্দা পুরোপুরি ধ্বংস করা হয় বলে যে দাবী করা হয় তা সঠিক নয়, নালন্দার একটি বড় অংশকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কারণ ১২৩৪ সালে তিব্বতীয় ভিক্ষু ধর্মাসভামিন নালন্দাতে যখন ভ্রমণ করেন তখন সেখানে কিছু পণ্ডিত ও ভিক্ষু মহাপাণ্ডিত রাহুলাস্রিভাদ্রার তত্ত্বাবধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। পনেরশ শতকের দিকে এটি প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম দুইবার নালন্দাকে পুনরুদ্ধার করলেও তৃতীয়বার আর তাকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কারণ গুপ্ত বা পাল রাজাদের মতো সেইরকম আর কোন শাসক অবশিষ্ট ছিল না যারা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আবার পুনর্গঠন করবেন। তাছাড়া ছিল বর্ণহিন্দু (ব্রাহ্মণ) ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজাদের বৌদ্ধদের প্রতি নির্মম অত্যাচার ও এর ফলে ভারতবর্ষ থেকে তাদের ব্যাপক হারে দেশত্যাগ।



নালন্দার অধঃপতনে আরেকটি কারণ হল এর আমলাতান্ত্রিকতা, দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। ভারতীয় পার্লামেন্টের সংসদ শশী থারুর হিন্দু অনলাইনে লেখা তার আর্টিকলে সে সময়ের বাস্তব চিত্রই এঁকেছেন:



This time there was to be no reconstruction: not only were there no equivalent of the Gupta kings or Harsha to rebuild it, but the university had already been decayed from within by the cancer of corruption on the part of its administrators and by declining enthusiasm for Buddhist-led learning. If we are to rebuild it 800 years later, we will need not just money but the will to excellence, not just a physical plant but a determined spirit.





রাজাদের আনুকূল্যের অভাব, ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, দূর্নীতি, আমলাতান্ত্রিকতা ও অব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে মোটামুটি একটা খুব প্রতিকূল পরিবেশে ছিল বৌদ্ধরা। তাছাড়া বৌদ্ধরা জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে ধীরে ধীরে তান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকায়, তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল খুব কম। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতীতে নিজেদের রক্ষা করতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। হিন্দুদের মতো তাদের কোন যোদ্ধাদল ছিল না, ফলে শাসকশ্রেণীর কাছে তারা তাদের গুরুত্ব ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, নালন্দার আশেপাশের বাসিন্দারাও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল না। কিন্তু এর খরচ বহন করা হত আশেপাশের জনগণের খাজনা দ্বারা। যেমন, রাজা হর্ষবর্ধন সে সময়ে ১০০ গ্রাম থেকে যে খাজনা পেতেন তা নালন্দাতে দান করতেন। ফলে সাধারণ অধিবাসীদের এই নালন্দা থেকে উপকৃত হবারও কোন উপায় ছিল না।



মিনহাজ-উদ-দীন-এর তবক্বাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে ইখতিয়ার-উদ-দীন মুহম্মদ খিলজীকর্তৃক দুর্গশহর বিহার অভিযানের উল্লেখ রয়েছে। বিহার অভিযানের প্রায় ৫০ বছর পর মিনহাজ-উদ-দীন ইখতিয়ারের সৈন্যবাহিনীর শামশাম-উদ-দীন নামে এক সৈনিকের সাক্ষাত লাভ করেন, যার কাছ থেকে শুনে তিনি ঘটনা বর্ণনা করেন। গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বখতিয়ার দুর্গের ভেতরকার ব্রাহ্মণদের হত্যা করেন, তবে লাইব্রেরী বা বই পোড়ানোর কোনো উল্লেখ তাতে নেই।







বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়

বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পালযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কেন্দ্রের একটি; এর অপরটি ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দাতে শিক্ষার মান কমে গেছে এমন ধারণার থেকে রাজা ধর্মপাল (৭৮৩ থেকে ৮২০) বিক্রমশীলার প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঠাধ্যক্ষদের মধ্যে প্রখ্যাত বৌদ্ধ ভীক্ষু শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর উল্ল্যখযোগ্য।



বিক্রমশীলার (গ্রাম: আন্তিচক, জেলা ভাগলপুর, বিহার) ভাগলপুর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এবং পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের ভাগলপুর-সাহেবগঞ্জ সেকশনের কাহলগাও স্টেশন থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। কাহলগাও থেকে ২ কিলোমিটার দূরবর্তী অনাদিপুর নামক স্থানে জাতীয় মহাসড়ক ৮০-র সাথে সংযুক্ত ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক দিয়ে বিক্রমশীলায় যাওয়া যায়।



শালবন বৌদ্ধবিহার



শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রত্নস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি এই বৌদ্ধ বিহার । এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম।



ধারণা করা হয় যে খৃষ্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। খৃষ্টিয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ও বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে।



আকারে এটি চৌকো। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্খানে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল রয়েছে। বিহার অঙ্গনের ঠিক মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির। বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে অনুচ্চ দেয়াল। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গিতে দেবদেবী, তেলের প্রদীপ ইত্যাদি রাখা হতো। এই কক্ষগুলো ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। সেখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চ্চা করতেন। বিহারের বাইরে প্রবেশ দ্বারের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি হলঘর রয়েছে। চার দিকের দেয়াল ও সামনে চারটি বিশাল গোলাকার স্তম্ভের ওপর নির্মিত সে হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবার ঘর ছিল বলে ধারণা করা হয়। হলঘরের মাপ ১০ মিটার গুণন ২০ মিটার। হলঘরের চার দিকে ইটের চওড়া রাস্তা রয়েছে।



উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা এখানে আসতো। ছাত্র-শিক্ষকরা এখানেই বসবাস করতো ও অধ্যায়ন করতো। তারা মূলত বৌদ্ধ দর্শন চর্চা করতো।



আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ ধর্মীয় দর্শন ছাড়াও সেখানে গণিত, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি , ইত্যাদি অর্থাৎ প্রকৃতিবিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয় যেখানে পড়ানো হয়, এমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলিম মণিষীরা ইসলামের স্বর্ণযুগে (Islamic Golden Age)।





ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের আলো পৌছায় অনেক পরে। ইউরোপে দশম শতাব্দীর পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ গড়ে উঠতে থাকে। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজার নিকট থেকে বৈধতার সনদলাভ করে।



পরবর্তি পর্বে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।

(চলবে)



তথ্যসুত্রঃ ১। বিভিন্ন ইতিহাসের বই, ২। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল, ৩। সামহোয়ারইনব্লগ-এর কয়েকজন ব্লগারের (দীপ জ্বেলে যাই, সাজিদ এহসান, প্রমুখ) আর্টিকেল।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:৪২

মুহাম্মদ তৌহিদ বলেছেন: তথ্যবহুল পোষ্ট। + না দিয়ে উপায় নাই। তবে আপনাদের পরিবারের দুই জন সদস্য (কমপক্ষে) যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন সেটি সুকৌশলে জানিয়ে দিলেন।

৩০ শে জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:০৭

রমিত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।আমার পরিবারের সবাইই কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। আমি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এইজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি পৃথক দুর্বলতা রয়েছে।

২| ৩০ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:২৮

আপেল বেচুম বলেছেন: অসাধারণ !!!

হায়, যেই আমরা পৃথিবীতে উচ্চশিক্ষার গাঠনিক রূপ প্রতিষ্ঠা করলাম, সেই আমরা আজ মূর্খতম জাতির একটি ।

৩০ শে জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:০৯

রমিত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, বিষয়টা এরকমই দাঁড়িয়েছে।

৩| ৩১ শে জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯

বোকামন বলেছেন:
তথ্যবহুল পোস্টে প্লাস !
ভালো থাকবেন।।

৩১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:৫৩

রমিত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.