নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।

রমিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

দ্বিপ্রহরের প্রহরী - ১

২৭ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ৩:৫৫

দ্বিপ্রহরের প্রহরী - ১

------------------ ডঃ রমিত আজাদ





(আমি মাদ্রাসা বা মক্তবে কোনদিনও পড়িনাই, বরং পড়েছি নামি-দামী সব স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারপরেও কোন ধর্মীয় পুস্তক হাতে নিলে আবেগ আপ্লুত হয়ে যাই।)







আমি এখন চলছি খোয়ারী নদীর একপাশ দিয়ে। খরস্রোতা এই পাহাড়ী নদীটি নগরীর ভিতরে ভারী পাথর দিয়ে চমৎকার করে বাঁধানো। যার দুই তীরে সাজানো রয়েছে বার্চ, ম্যাপেল আর পপ্‌লার গাছের সারি। এছাড়াও রয়েছে চোখ জুড়ানো কিছু ফুলের গাছ। ওগুলোর নাম জানিনা। জানার কথাও না। মাত্র একমাস হলো পা রেখেছি, ককেশাস পাহাড়ের উপর বিছিয়ে থাকা সাজানো-গোছানো এই সুন্দর দেশটিতে। তার নামটিও খুব ছিমছাম, 'জর্জিয়া'। সারা পৃথিবীতে সে এই নামে পরিচিত হলেও রুশরা একে বলে 'গ্রুজিয়া', আর জর্জিয়ানরা নিজেরা নিজেদের দেশকে বলে 'সাকার্তভেলো'। এই জর্জিয়ার রাজধানী শহরটির নাম 'তিবিলিসি'। তার বুক চিরেই চলে গিয়েছে চঞ্চল খোয়ারী নদী। শরতের হরেক রঙের পাতাঝড়া আমার চলার পাহাড়ী পথটি নদীর তীর ঘেষে চলতে চলতে ধীরে ধীরে ডান দিকে বেঁকে আরো উপরে উঠে গেছে। সমতলের মানুষ আমি, উপরে উঠতে কিছুটা কষ্ট হলেও বেশ উপভোগ করছিলাম, পথের দুই ধারে মধ্যযূগীয় ধাঁচের বিভিন্ন স্থাপনায় সজ্জিত আবাসিক এলাকা। ঠিক যেন পুরণো আমলের কোন ইউরোপীয় নির্বাক চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ। "আর কতদূর?" আমার সঙ্গীদের একজন জর্ডানের আবদুল্লাহ্‌ ভাইকে প্রশ্ন করলাম। "এই তো, সামনেই, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব" ছিমছাম উত্তর দিলেন শান্ত স্বভাবের আবদুল্লাহ্‌ ভাই। প্রতিটি পথ চলারই একটা উদ্দেশ্য থাকে। পথের যেমন একটি প্রারম্ভ থাকে তেমনি একটি গন্তব্যও থাকে। আমাদের গন্তব্য ছিলো 'তিবিলিসি মসজিদ'। আমি, প্যালেস্টাইনের ইয়াছিন ও রিয়াদ, আলজেরিয়ার খালেদ আর জর্ডানের আবদুল্লাহ্‌ ভাই ককেশাস পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই ভেঙে চলছি ঐ 'তিবিলিসি মসজিদ'-এর, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক পবিত্র দিন শুক্রবরে জুম্মার নামাজ আদায় করবো। এই বিদেশ-বিভূঁয়ে ঐদিকে চলছি কোন বিত্ত-বিভবের আশায় নয়, কোন চমকপ্রদ সনদপত্রের টানে নয়, স্রেফ আত্মার টানে, আধ্যাত্মিকতার প্রবল আকর্ষণে। মসজিদে দু'রাকাত নামাজ পড়ে একটু মনটা জুড়াবো!



কিছুদিন আগের একটি ভয়াবহ রাত্রীর পর, একটি মন খারাপ করা বিষন্ন সকালে, পুরোনো দিনের ডায়েরী ঘেটে, ১৯৮৯ সালের এই লেখাগুলো পেয়েছি।



আমার দাদা ছিলেন বৃটিশ শাসনামলের এ্যাডভোকেট। তাই আমাদের বংশে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিলো অনেক আগেই। আমি যতদূর জানি আমাদের বংশের কেউই মাদ্রাসা বা এই জাতীয় ধর্মীয় লাইনে পড়ালেখা করেননি। সকলেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী। জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছি, আর দশটা আধুনিক পরিবারের মত আমাদের পরিবারেও পড়ালেখার গুরুত্ব সর্বাধিক। মুরুব্বীরা সবসময়ই কথায় কথায় বলতেন, 'লেখাপড়া করে যে, গাড়ী-ঘোড়া চড়ে সে।' খুব ছোটবেলা থেকেই আমার অক্ষর জ্ঞান হয়। এটা এতই ছোটবেলায় হয় যে আমার এখন আর মনেই নেই যে আমি কবে থেকে পড়তে জানি। আবছা মনে পড়ে যে আমাকে হাতে খড়ি দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো একজন সম্মানী হেডমাস্টারের কাছে। তিনি ক খ ইত্যাদি লিখে আমার ডান হাতটি তার ডান হাতে ধরে অক্ষরগুলোর উপর আমার হাত ঘোরাচ্ছিলেন, আর আমি মনে মনে খুব অবাক হচ্ছিলাম, 'কেন আমাকে এভাবে লেখানো হচ্ছে? আমি তো ভালোভাবেই লিখতে জানি।' এত কিছুর পরেও আমি আরবী লিখতে বা পড়তে কোনটাই জানিনা। এর মূল কারণ আমকে মাদ্রাসা তো দূরের কথা, কোন মক্তবেও পাঠানো হয়নি। একবার আমার চাচা (তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ও ভাষাণীর একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন) ক্ষীণ স্বরে মুরুব্বীদের বলছিলেন, "ওকে একটু আরবী পড়া শেখানো দরকার, সকালের দিকে এলাকার মসজিদে হুজুররা বাচ্চাদের আরবী শেখান।" কিন্তু চাচার কথায় মুরুব্বীরা কেউ আমল দেননি। হয়তো তারা ভেবেছিলেন, এখন স্কুলের পড়ালেখার ভীত মজবুত হোক, পরে কোন এক সময় আরবী শেখানো যাবে।



তবে আমাদের বংশে ধর্মবিরোধী কেউই ছিলেন না। বরং মুরুব্বীদের প্রায় সবাইই নিয়মিত নামাজ-রোযা করতেন। অন্যান্যদের মধ্যেও ধর্মভীরুতা রয়েছে। ধর্মের অবমাননা কাউকেই কখনো করতে দেখিনি বা শুনিনি।



আমাদের মসজিদে বয়স্ক একজন হুজুর ছিলেন সবাই উনাকে বলতো ছোট হুজুর। এত বয়স্ক ব্যাক্তিকে কেন সবাই ছোট হুজুর বলতো বুঝতাম না। পরে বুঝেছিলাম, মসজিদে আরো বয়স্ক সম্মানী একজন হুজুর আছেন, তিনিই ঐ মসজিদের প্রধান, তাই উনাকে সবাই বলে বড় হুজুর। ছোট হুজুর আবার আমাদের স্কুলেও পড়াতেন। খুব হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন। আমাদের শিশুদের তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। স্কুলের শিক্ষকদের সাথে তখন বেতের একটা সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু ছোট হুজুরের হাতে কোনদিন বেত দেখিনি। বরং উনি পড়াতেন খুব মজা করে, উনার ক্লাসে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যেতাম। 'বাঙলাদেশ সমতল ভূমি', এই বিষয়টি উনি এত মজা করে পড়িয়েছিলেন যে, আজ সাঁইত্রিশ বছর পড়েও আমার প্রতিটি কথা মনে আছে। আমাদের ক্লাসে একটি মেয়ে ছিলো, ওর নাম ছিলো মালা। হুজুর একদিন ক্লাসের শেষে পান্জাবীর পকেট থেকে একটি বেলী ফুলের মালা বের করলেন, তারপর হাতে নিয়ে কৌতুক করে বলতে শুরু করলেন, "এই যে মালা, এই যে মালা, এই যে মালা রে"। তাই দেখে ছোট্ট মালা হেসে লুটোপুটি। আর আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে কাড়াকাড়ি করে মালার ফুল ছিড়ে নিলাম। পুরো এলাকার সকলেই হুজুরকে চিনতো আর ভালোবাসতো।



আমার ছোটবেলায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিলো রবিবার। শুক্রবার ছিলো হাফ ডে। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে যেত। অফিসও আগে আগে বন্ধ হয়ে যেত। সবাই পাক-পবিত্র হয়ে জুম্মার নামাজ পড়তে যেত। এলাকার মসজিদটি তখন ছোট ও একতলা ছিলো। অন্যান্য নামাজের সময় যা হোক, শুক্রবারে জায়গা হতো না। রাস্তায় চাটাই বিছিয়ে নামাজ পড়তেন মুসল্লীরা। নয়-দশ বছর বয়স হলে আমিও ঐ দলে শরীক হলাম। মসজিদের ছাদটি ছিলো আমাদের প্রিয় জায়গা। ওখানে সবাই দল বেধে বসতাম। নামাজের গুরুত্ব-টুরুত্ব কিছু বুঝতাম না। বন্ধুরা সবাই মিলে উৎসবের মত যেতাম। আবার দল বেধে ফিরে আসতাম। যেমনটি যেতাম খেলার মাঠে বা স্কুলে।



আমাদের বাড়ি থেকে কিছুদূরে একটি মাদ্রাসা ছিলো। তার সামনে একটি বড় মাঠ ছিলো। সেই মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম। সেখান থেকে দেখতাম পায়জামা-পান্জাবী টুপি পরিহিত মাদ্রাসার ছাত্রদের। বুঝতাম এটা ভিন্ন ধরনের স্কুল, আমি যেটায় পড়ি সেটার মতো না। পবিত্র রমজান মাসে সেহরীর সময় এই মাদ্রাসার ছেলেরা গান গেয়ে আমাদের ঘুম থেকে জাগাতো। খুব সুন্দর সুর করে তারা গাইতো, "উঠমে রোজামে রাখো, একথা ভেলে যেওনা, রোযা করো, নামাজ পড়ো, একথা ভুলে যেওনা"। আজকাল যেমন পাড়ার বখাটে ছেলেরা চিৎকার দিয়ে ডাকে বা অনেক সময় ঢোল ঘন্টাও বাজায়, তেমনটি মোটেও ছিলো না"। রমজানের শেষে তারা প্রতি বাড়ী থেকে কিছু টাকা পেত। সেখানেও জোর-জবরদস্তি কিছু ছিলোনা। যা দিতো তাই তারা নিত।



ঈদের দিনটি ছিলো সবচাইতে মজার নামাজের দিন। এই নামাজ মিস হবে এমন ভাবতেই পারতাম না। নামাজ ছাড়া ঈদ হয় নাকি? খুব ভোরে উঠে গোসল-টোসল করে নতুন জামা কাপড় টুপি আতর দিয়ে রেডি হয়ে পাড়ার বন্ধু-বান্ধব, বড় ছোট ভাই-ব্রাদার সবাই মিলে দল বেধে মসজিদে যেতাম। অনেক সময় গিয়ে মসজিদের ভিতর তো দূরের কথা কাছাকাছিও জায়গা পেতাম না। যাহোক যেখানেই জায়গা পেতাম বসে যেতাম। বড় হুজুর খুব গুরুত্বের সাথে ঈদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতেন। তারপর খুব দরদ দিয়ে ঈদের নামাজ পড়াতেন। উনার মোহনীয় সুরের কিরাতের সাথে সাথে আমরা খুশী-খুশী মনে নামাজ পড়তাম। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে সে কি উল্লাস!



বছরে অন্ততপক্ষে একবার বাড়িতে মিলাদ হতো। আমার চাচা গিয়ে আগে থেকেই ছোট হুজুরকে বলে আসতেন। ঐদিন দল বেধে হাফেজরা আসতেন সারাদিন সুর করে কোরান খতম দিতেন। উনাদের মধুর কন্ঠস্বরে আর তিলওয়াতের মোহনীয় সুরে সারা বাড়িতো বটেই যতদূর এই শব্দ শোনা যেত ততদূর পর্যন্ত এক পবিত্র আবহ সৃষ্টি হতো। বিকালে বাদ আছর হতো মিলাদ। আমরা ছেলেবুড়ো সবাই উচ্চস্বরে মিলাদ পড়তাম। আমাদের ছোটদের আকর্ষণ ছিলো মিলাদের পরের মিস্টান্নের দিকে। একটু বয়সে মনযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম হুজুর মিলাদে কি পড়েন। যা পড়েন তা শুনে ভীষণ আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলাম, "হাজারো শোকরও খোদার, না হয়ে ফিরিশতা পয়গম্বর, হয়েছি উম্মতো তোমার, ইয়া নবী সালামালাইকা, ....."। আমার ছোট ফুপার ছোট ভাই একজন শহীদ বুদ্ধিজীবি। প্রতি পচিশে মার্চে উনাদের বাড়ীতে মিলাদের আয়োজন হতো। আমরা সবাই সেখানে যেতাম। একবার মিলাদ পড়ালেন বয়স্ক এক হুজুর। মিলাদের শেষে দোয়া করার আগে জানতে চাইলেন, কি উদ্দেশ্যে মিলাদ? একজন বললেন, আমাদের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, এই দিনে তিনি......।" শেষ করার আগেই হুজুর বললেন, "বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি, এই দিনে তিনি শহীদ হয়েছিলেন।" তারপর তিনি প্রাণ ভরে শহীদের জন্য দোয়া করলেন। মিলাদ শেষে তার হাতে টাকা দিলে তিনি নিতে চাইছিলেন না, বললেন, "না না থাক টাকা লাগবে না, আমি তো মিষ্টি পেয়েছি।"



সেই সময়ে এক ঈদের দিনে একবার ধাক্কা খেয়েছিলাম। তখন দুপুর বারোটা হবে। আমাদের পারিবারিকভাবে পরিচিত এক বড় ভাই এলেন আমাদের বাড়িতে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামজাদা ছাত্রনেতা, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শুনাম করেছিলেন, পড়ালেখায় ভালো ছিলেন, কথাবার্তা শুনলে বোঝা যেত জ্ঞান অনেক আছে। তাই তার প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। আমি সালাম করে উনাকে প্রশ্ন করলাম, "ঈদের নামাজ পড়েছেন কোন মসজিদে?" তিনি উত্তর দিলেন, "আমি নামাজ পড়িনা"। আমি বেশ অবাক হলাম। নামাজ পড়েনা, এরকম লোকতো জীবনে দেখিনাই। পাঁচ ওয়াক্ত না হোক, এক-দুই ওয়াক্ত, অথবা জুম্মার নামাজ, অন্ততপক্ষে ঈদের নামাজ তো সবাই পড়ে। একেবারেই নামাজ পড়েনা, এ আবার কেমন মানুষ? পরে জেনেছিলাম তিনি কম্যুনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কম্যুনিস্টরা ধর্ম মানেনা।





কিছুদিন পর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করলাম। বাড়ীর সবাই ভীষণ খুশী। জুন মাসে ক্যাডেট কলেজে চলে যাবো। আমার বড় ভাই এক শুক্রবারে বললেন, "আজ তোকে মসজিদের বড় হুজুরের কাছে নিয়ে যাব। ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে হুজুরকে সালাম করে যাবি। দেখবি হুজুর দোয়া করলে তোর অনেক ভালো হবে"। আমি সুবোধ বালকের মত উনার কথা মেনে নিলাম। জুম্মার নামাজের পর, ভাইয়া আর উনার দুই বন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন বড় হুজুরের কাছে। আমি গিয়ে উনাকে সালাম করলাম। একটি বালকের এমন হঠাৎ সালাম করা দেখে হুজুর অবাক হয়ে তাকালেন। আমার বড় ভাই বললেন, "হুজুর আমার ছোট ভাই, ক্যাডেট কলেজে পড়তে যাচ্ছে, ওকে একটু দোয়া করে দেন।" হুজুর আমার মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন।



হজরত শাহজালাল (রঃ)-এর পূণ্যভুমি সিলেট। মনে মনে অনেক কামনা করেছিলাম ঐ পূণ্যভুমির ক্যাডেট কলেজে পড়ার তৌফিক যেন পরম করুণাময় আমাকে দেন। তিনি আমার আর্জি শুনেছিলেন। ওখানেই আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সিলেটে বানিয়ে দিলেন আমার দ্বিতীয় ঠিকানা। হজরত শাহজালাল (রঃ)-এর মাযার জিয়ারতের মধ্যে দিয়ে শুরু হলো আমার সিলেট জীবন। এখানে এসে সংস্পর্শ পেলাম একজন ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন ব্যাক্তির। উনার নাম আবদুর রব। টাইটেল পাশ রব স্যার ছিলেন আমাদের ইসলামিয়াতের শিক্ষক। অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন এই গুনী শিক্ষক অত্যন্ত দরদ দিয়ে আমাদের পড়াতেন। তার কাছ থেকেই আমরা প্রথম জানলাম, ইসলামী ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ। জানলাম আমাদের প্রিয় নবীর মহান জীবন কাহিনী - তাঁর দুঃখময় ছেলেবেলা, বছরের পর বছর হেরার গুহায় ধ্যান, নবুওত প্রাপ্তি, ইসলাম ধর্মের প্রচার করতে গিয়ে কাফেরদের জুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হওয়া, মদীনায় হিজরত, ইত্যাদি। জানলাম বদর থেকে শুরু করে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। জানলাম বিশ্বনবীর মহানুভবতার কথা। সাহাবাদের বীরত্ব ও মহত্বের কথা। এই সবকিছু স্যার আমাদের পড়াতেন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। আরো দিতেন ইসলামী আলোকে নৈতিক শিক্ষা। ভালো ও মন্দের বিচার। আমাদের নিজেদের জীবনের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজ-দেশের প্রতি ও সর্বোপরি মানবজাতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি আমাদের সচেতন করতেন। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম, লেখাপড়া ও জ্ঞান বেশী থাকার কারণে স্যার আমাদের যেকোন প্রশ্নের জবাবই খুব সুন্দর করে দিতে পারতেন। আমাদের দু'একজন শিক্ষক ছিলেন নাস্তিক টাইপের। তারা যা বলতেন আমরা সেই সম্পর্কে স্যারের মতামত জানতে চাইলে স্যার খুব যৌক্তিকভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দিতেন। আমাদের স্যারের কথাটাই সঠিক মনে হতো। তাছাড়া সমাজে প্রচলিত অনেক ধর্মীয় কুসংস্কারেরও স্যার বিরোধিতা করতেন। স্যারকে আমরা মন থেকে শ্রদ্ধা করতাম।



আমাদের কলেজের ইমাম সাহেবের পড়ালেখা রব স্যারের চাইতে কম ছিলো। সেই পার্থক্য আমরা যেমন বুঝতাম, তিনি নিজেও তার সীমাবদ্ধতা বুঝতেন। তাই কোথাও ঠেকে গেলে তিনি রব স্যারের সাথে কনসাল্ট করতে বলতেন। উনার যে দায়িত্ব ছিলো - ইমামতি করা, মিলাদ পড়ানো, তিলওয়াৎ শেখানো, নামাজ শেখানো ইত্যাদি তিনি দরদ দিয়েই করতেন।





ক্যাডেট কলেজের পাঠ চুকানোর পর আর দেশে থাকা হলোনা। স্কলারশীপ নিয়ে চলে গেলাম সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ ছিলো। তাই কেউ সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে গেলে অনেকে তাকে কম্যুনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী বলে ভাবতো। কিন্তু মূল ব্যাপারটি তা ছিলো না। দরিদ্র পশ্চাদপদ বাংলাদেশের মানুষ আমরা, কয়জনার ভাগ্য হয় ইউরোপে লেখাপড়া করার? তাই নিখাদ উন্নত লেখাপড়া করার উদ্দেশ্যেই অনেকে যেত। আমিও সেই দলেই ছিলাম। ওখানে গিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিলো। এই প্রথম বুঝতে পারলাম পৃথিবী কত বিশাল! এই প্রথম সুযোগ হলো নানা দেশের নানা বর্ণের, নানা ধর্মের মানুষদের সংস্পর্শে আসার। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের ডিগ্রী নিয়েছি। এদের মধ্যে দুইটি জগৎবিখ্যাত 'খারকোভ স্টেট ইউনিভার্সিটি' ইউক্রেন এবং 'পিপলস ফ্রেন্ডশীপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়া'। সৌভাগ্য হয়েছে তুখোড় জ্ঞানসম্পন্ন প্রফেসার-বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে আসার। তাদের জ্ঞানের ছিটেফোটা পাওয়ার। সৌভাগ্য হয়েছে নোবেল বিজয়ী লেভ লান্ডাউ ও ইভগেনি লিফশিৎস-এর প্রতিস্ঠিত ডিপার্টমেন্টে পড়ার। খ্যাতিমান পদার্থবিদ আলেকজান্ডার আখিয়েজার ও ইয়ানসানকে নিজের চোখে দেখার। ইয়ানসানের ছেলেকে পেয়েছিলাম আমার সহপাঠি হিসাবে। সুযোগ হয়েছে তেরেলেৎস্কির ডিপার্টমেন্টে গবেষণা করার। রিবাকোভের মত বিজ্ঞানীর সরাসরি ছাত্র হওয়ার।



আমি মাদ্রাসা বা মক্তবে কোনদিনও পড়িনাই, বরং পড়েছি নামি-দামী সব স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারপরেও কোন ধর্মীয় পুস্তক হাতে নিলে আবেগ আপ্লুত হয়ে যাই। ঘটনার সূত্রপাত অনেক আগেই। আমাদের বাড়ীতে একটি পারিবারিক লাইব্রেরী ছিলো। সেখানে বিশাল বিশাল আলমারী বোঝাই করা ছিলো নানা রকম বই। সময় কাটানো আমার জন্য কোন সমস্যাই হতোনা। অলস সময়ে যেকোন একটি ব্য নিয়ে পড়তে শুরু করতাম। এভাবে ছোট থাকতেই বিশ্ব সাহিত্যের অনেক নামী-দামী বই-পত্র পড়ে ফেলেছিলাম। একটি জায়গায় দেখতাম দাঁতভাঙা ইংরেজীতে লেখা অনেকগুলো বই। কিসের বই এগুলো? কে পড়ে? পরে জানতে পেরেছিলাম এগুলো সব আমার মরহুম মেজো ফুপার বই। তিনি বামপন্থী ছিলেন। বইগুলো সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ইত্যাদির উপর লেখা। আগ্রহ থাকলেও ঐ বয়সে ইংরেজী ভাষায় দখল না থাকার কারণে ওগুলো আর পড়া হয়নি। আলমারীর সব চাইতে উপরে দেখতাম পরম যত্নে রাখা কিছু বই। পবিত্র কোরান শরীফ, তার তফসির, মকসুদুল মোমেনিন, নেয়ামুল কোরান, তাজকেরাতুল আউলিয়া, চাহার দরবেশ, বাইবেল-বিজ্ঞান ও কোরান, আত্যদর্শনে সত্যদর্শন, ইত্যাদি। ওখান থেকে নিয়ে নিয়ে একটা দুটা করে বই পড়তে শুরু করলাম। এক একটা বই পড়ি আর বিস্মিত হই জ্ঞানের এই বিশেষ জগৎটিতে প্রবেশ করে। সৃষ্টিকর্তার কথা, ধর্মের কথা এ যেন ভিন্ন এক জগৎ। এক একটা বই পড়ি আর গভীর আবেগে মন ভরে ওঠে।



(চলবে)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৯:৫০

একিউমেন০৮ বলেছেন: পুরাটা পড়া সম্ভব হয়নি।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৬

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ

২| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১০:২১

মোমেরমানুষ৭১ বলেছেন: চলুক....। অপেক্ষায় আছি.......

২৭ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৭

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ

৩| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৯

বাঙাল শিক্ষক বলেছেন: চলতে থাকুন। থামবেন না। আছি আপনার সংগে।

৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ ভোর ৪:১৩

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.